রহস্যময় সারপ্রাইজ পর্ব ১০

0
355

#রহস্যময়_সারপ্রাইজ
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
#পর্ব-১০ (ধামাকা পর্ব)

“এক সেকেন্ড, ফরেনসিক ল্যাবে কর্মরত ডাক্তার সাজিদ কি সেই, যে কি না প্রতিভাকে বিয়ের আগে বিরক্ত করতো?”
ভাবুক কন্ঠে বলল অধরা। নিতিন মুচকি হেসে বলল,
“ডাঃসাজিদের নাম শুনে আমারও প্রথমে তাই মনে হয়েছিলো, কিন্তু পরে খবর নিয়ে জানতে পারি দুজনে ভিন্নজন। ডাঃ সাজিদের পুরো নাম সাজিদ শেহজাদ। যার গ্রামের বাড়ি যশোর আর ঢাকার স্থানীয় বাড়ি হচ্ছে গুলশানে। আর যে প্রতিভাকে বিরক্ত করতো তার নাম হচ্ছে সাজিদ হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সিলেট, ঢাকার বাসা ধানমণ্ডি। বর্তমানে সে কাপড় ব্যবসায়ী। গাউছিয়ায় দোকান নিয়ে বসেছে। দুজনের সব কিছু আকাশ পাতাল তফাৎ। সুতরাং দুজনকে গুলিয়ে ফেলার কোন সুযোগ নেই। ”

“ওহ আচ্ছা। তবে, ওই লোভী ডাক্তারগুলোর কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার।”
রেগে কটমট করে বলল অধরা। নিতিন শান্ত কন্ঠে বললো,
“তারা এখন আইনের আওতায় আছে। আশাকরি, বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি পাবে তারা। ”

“বাই দ্যা ওয়ে, অভিলাষের কাহিনীটা মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে আমার। ”
“সিম্পল বিষয়, অভিলাষের মৃত্যুতে ও অভিলাষের হাত আছে। আমি যদি ভুল না হই, প্রতিটা খুনেই অভিলাষের সম্পৃক্ততা ছিলো। তবে এখানে সে একা নয় তার সাথে আরো কয়েকজনের একটা দল শামিল আছে। আর এই খুনগুলো অনেক আগ থেকেই পরিকল্পনা করা। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলো সবাই। সঠিক সময়ে পরিকল্পনা অনুয়ায়ী এগিয়েছে। তাই তারা প্রথমে অভিলাষকে ফাঁসিয়েছে তারপর তাকে নির্দোষ প্রমাণ করিয়েছে। তারপর তাকে কিডন্যাপ করেছে। কিডন্যাপের পর অভিলাষ নিজেই মর্গে থেকে একটা লাশ বেছে নিয়ে পুড়িয়ে ভুঁইয়া ভিলার অদূরে থাকা সেই ঝোপের কাছে রেখে গেছে। যখন তার লাশ সবাই দেখল, ডিএনএ তার সাথে মিলিয়ে সে প্রমাণ করাল যে এটা তারই লাশ। সবাই বিশ্বাস করল। এবার সে স্বাধীন, যেহেতু সে মৃত তাই কেউ তাকে খুঁজবে না,তাকে সন্দেহ করবে না। সুতারাং, সে নিশ্চিন্তমনে আড়ালে থেকে তাদের পরিকল্পনায় শামিল হতে পারবে। জীবিত থাকা অবস্থায় খুনের মতো কোন কাজ করতে সুবিধা পাচ্ছিলনা, যা মরার পর নির্দ্বিধায় করতে পেরেছে। সন্দেহের আওতাহীন হতে সবার কাছে নিজেকে মৃত বলে প্রমাণ করাটা জুরুরি ভেবেছে। তারা কখনো ভাবেনি আসল রিপোর্ট আমরা হাতে পাব। তারা ভেবেছে এভাবে মামলা সন্দেহের কৌটায় গিয়ে কোন সমাধান না পেয়ে একসময় বন্ধ হয়ে যাবে।”

“অভিলাষ যদি প্রতিভা খুনের সাথে জড়িত থাকে তবে আমি নিশ্চিত বলতে পারি অভিলাষ যেই দলের সাথে জড়িত সেই দলে মেয়েও আছে। কোন মর্ডান মেয়ে। যে কিনা ভালো মেকাপ জানে। কারণ প্রতিভাকে খুনের আগে বা পরে সাজানো হয়েছিলো। আর সাজটা একদম কোন বিউটিশিয়ানের সাজানোর মতো পারফেক্ট ছিলো। প্রতিভার নিখোঁজ এবং খুন হওয়া সবটাই ছিলো গভীর রাতে। যখন কিনা কোন পার্লার সাধারণত খোলা থাকেনা, আর খুন করার প্ল্যান মাথায় রেখে পার্লারে ও নিয়ে যাবে না প্রতিভাকে। তাই আমার মনে হয় কোন মেয়েই সাজিয়েছে প্রতিভাকে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে মেয়েটা কে?”

“তুরাগের ফ্ল্যাটে একটা কাজের মেয়ে থাকতো যে কি নাম জানি মেয়েটার?” মাথা চুলকিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বলল নিতিন। নিতিনের কথায় অধরা ভ্রু কুঁচকে বললো,
“শিলা। শিলা ও কি প্রতিভা খুনের সাথে জড়িত আছে বলে আপনার মনে হয়?”

নিতিন দৃঢ়তার সাথে বলল,
“মনে হওয়ার সুযোগ নেই, আমি নিশ্চিত শিলা খুনের সাথে জড়িত আছেই। তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার কী জানেন? শিলাই প্রতিভাকে সাজিয়েছে। প্রতিভার চোখ মুখের মেকাপের উপর শিলার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। ”

“শিলা? ওই গ্রাম্য কিশোরী মেয়েটা প্রতিভাকে সাজিয়েছে? ” অবিশ্বাস্য সুরে বলল অধরা। নিতিন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আপনি যাকে গ্রাম্য কিশোরী বলছেন সে আসলে গ্রাম্য কিশোরী নয়। একটা গ্রাম্য মেয়ে যে কি না ঠিক করে শুদ্ধ ভাষায় কথাই বলতে পারে না সে কিভাবে এতটা স্মার্টলি একটা মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে দিবে আর খুন করবে? এটা হাস্যকর আর অবিশ্বাস্য তাই না? আমার মনে হয় সে শহুরের মেয়ে, প্রতিভা খুনের উদ্দেশ্যেই তুরাগের ফ্ল্যাটে কাজ নিয়ে ছদ্মবেশে ছিল।”

অধরা চোখ বড় বড় করে নিতিনের দিকে তাকিয়ে রইল। অবাক হয়ে বলল,
“এরা একেকটা কী চমৎকার অভিনেত্রী! এদের চল-চাতুরী দেখে আমার মাথা ঘুরাচ্ছে! মেয়েটা কী নিষ্পাপ চাহনি দিয়ে থাকতো! দেখে মনে হতো যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে পারে না। আমার ওকে কোন প্রকার সন্দেহই হয় নি। অথচ এই মেয়ে থলের বিড়াল বেরুলো!”

অধরার বিস্ময়ী ভাব দেখে নিতিন হাসল। হেসে বলল,
“আপনি এই সামান্য খবর শুনেই কাত! আমার কাছে বাকি যেই শকিং নিউজ আছে তা শুনলে তো আপনি হার্ট অ্যাটাক করবেন তবে। ”

“আরো শকিং নিউজ! “অবাক হয়ে বলল অধরা। নিতিন মাথা নাড়িয়ে বলল,
” হ্যাঁ, পুরো কেসের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি বলতে পারেন। খুনী দলের প্রায় সবার নাম আমার সামনে এসে গেছে। ”

“কারা কারা?”
কৌতুহলী হয়ে দ্রুততার সাথে বলল অধরা। নিতিন উঠে দাঁড়িয়ে অধরার সামনে থেকে ফাইলটা তুলে নিয়ে হেসে বলল,
“এত শকিং নিউজ একসাথে বলবো না আপনাকে। শেষে দেখা যাবে এত শক সইতে না পেরে আপনি ছক্কার ঘরে গিয়ে অক্কা পেলেন। তখন সবাই আমাকেই মার্ডার কেসের আসামী বানাবে। তার চেয়ে বরং এখন থাক, আপনি থানায় বসে চিন্তা করুন। আমি ওদের বাকি খেলা জেনে আসি। ততক্ষণ আপনি মাইন্ড সেট করুন। আমি এসে সবার সামনে সব রহস্য উন্মোচন করব। ”
বলে ফাইল হাতে নিয়ে নিতিন হাটা ধরল।

অধরা একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“সমস্যা নেই, বলুন আপনি। আমি শক্তভাবে নিতে পারব।”
“ইন্সপেক্টর অধরা,আপনার অবগতির জন্য জানাপূর্ব বাধ্য হচ্ছি যে আমি একটা কথা দু’বার বলি না। সুতারাং চলি।”
আবার হাটা ধরল নিতিন।

“আচ্ছা বাকিদের কথা নাই-বা বললেন কিন্তু শিলার ব্যাপার তো স্পষ্ট করে যেতে পারেন।”
পিছন থেকে বলল অধরা। দরজার কাছে অবস্থান করা নিতিন কিছু একটা ভেবে থেমে গেল। পিছন ঘুরে বলল,
“তা পারি। বলুন কি প্রশ্ন শিলার ব্যাপারে?”

“অভিলাষ যদি প্রভাত মির্জাকে খুন করে তবে হিসেব অনুযায়ী প্রতিভাকেও খুন করেছে। শিলা প্রতিভাকে সাজিয়েছে মানে সেও অভিলাষের সাথে খুনের গ্যাংয়ে ছিল, তাই তো?”
চট করে প্রশ্ন করল অধরা। নিতিন ও চট করে উত্তর দিল,
“শিলা যদি জড়িত না থাকতো তবে নিশ্চয়ই অভিলাষ শিলাকে খুনের কাজে নিতো না, তাই না? শিলাকে খুনে শামিল করেছে মানে সে জড়িত আছে। সিম্পল।”
“শিলা যদি জড়িত থাকে তবে শিলা খুন হলো কেনো!”
“কে বলেছে শিলা খুন হয়েছে? ”
ভ্রু নাড়িয়ে বলল নিতিন। অধরা অবাক হয়ে বলল,
“আপনি বলতে চাচ্ছেন শিলা খুন হয় নি? তবে উদ্ধারকৃত লাশটা কার!”
শান্ত গলায় নিতিন বলল,
“আমাদের চোখে দেখা দৃশ্য সবসময় সঠিক হয় না, মিস অধরা। আমাদের চোখের আড়ালে অনেক কিছু থেকে যায়। যাই হোক একটা কথা বলতে হয়, শিলার হাতের রান্না হাত পাঁকা। স্বাদ একদম জিবে লেগে থাকার মতো।”

অধরা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমি বলছি কী আর আপনি বলছেন কী!কোথাকার কথা কোথায় লাগাচ্ছেন?”
খানিক থেমে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দিয়ে বলল,
” এক সেকেন্ড, আপনি শিলার হাতের রান্না পেলেন কোথায়? আপনি আসার আগেই তো শিলার ডেডবডি পাওয়া গেছে। ”

“কাল তুরাগের ফ্ল্যাটে গিয়েই তো খেলাম শিলার হাতের রান্না। খুব টেস্ট। জিহাদ ও খেয়েছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে জিহাদকে জিজ্ঞেস করুন ।আপনাকে ও টেস্ট করানো উচিত ছিলো। ইশ! কেনো যে আপনাকে টেস্ট করালাম না?”
আফসোসের সুরে বলল নিতিন। অধরা চোখ কুঁচকে বলল,
“কি বলছেন আপনি এসব! আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। প্লিজ স্পষ্ট করে বলুন! ”

অধরার কথায় নিতিন হেসে জিহাদকে ডাকল। জিহাদ আসার পর বলল,
“জিহাদ, কাল তুরাগের ফ্ল্যাটে আমি আর তুমি যে পাস্তাটা গেলাম সেটার রিভিউ দাও তো?”
নিতিনের কথা শুনে জিহাদের চোখে মুখে খুশির রেখা দেখা দিল। চট করেই খুশি মনে উত্তর দিল,
“ম্যাডাম পাস্তাটা খুব মজা ছিলো।”
তারপর আফসোসের সুরে বলল,
” কিন্তু স্যার এক চামচের বেশি খেতে দেয় নি।”

অধরা এবার অবাক হয়ে জিহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমিও খেয়েছো? মার্ডার স্পটের জিনিস তো ইউজ করা নিষিদ্ধ তবে তোমরা খেলে কিভাবে?”

“ম্যাডাম পাস্তাটা দেখতে এত মজা ছিলো যে তল্লাশি করার সময় ওভেনের ভিতরে দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। তাই টেস্ট করে নিয়েছি। যদিও প্রথমে টেস্ট স্যারই করেছে। দুজনেই এক স্পুন করে খেয়েছি জাস্ট।”
অনেকটা গর্বের সাথে বলল জিহাদ। জিহাদের খুশি দেখে নিতিন বলল,
“এত টেস্টি খাবার কে বানিয়েছে জানো? তুরাগের কাজের মেয়ে শিলা। যার ডেডবডি পাওয়া গেছে। মৃত ব্যক্তির রান্না সাধারণত মজা হয়। যদিও আমি এর আগে কখনো খাইনি। তাও আন্দাজ করতে পারি।”

নিতিনের কথায় জিহাদ যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে বিস্ময়ের চাপে কথা বলতে পারছে না। মাথার মধ্যে একটা কথা বাজছে, শিলা মারা গেলে তার রান্না তুরাগের ফ্ল্যাটে আসল কিভাবে! মরার পর কেউ রান্না করতে পারে! আচ্ছা আমি যা খেলাম তা শিলার আত্মা রান্না করেনি তো! জিহাদ ভয়ে ভয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,
“ভূউ…ত।”
“ভূত কোথায় পেলে?”
বিরক্ত কন্ঠে বলল অধরা। জিহাদ ঢোক গিলে বললো,
” শিলার আত্মা এসে তুরাগের ফ্ল্যাটে রান্না করেছে। আমি ভূতের রান্না খেলাম!”

জিহাদের কথা শুনে নিতিন উচ্চস্বরে হেসে দিলো। অধরা ধমকে বললো,
” একজন পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে তুমি ভূত বিশ্বাস করো! তাও এই যুগে এসে! কী সব বলো? তুরাগের ফ্ল্যাটে শিলার কোন আত্মা টাত্মা ছিলো না। ওটা শিলাই ছিলো। শিলা মরেনি, সে জীবিত। ”
“তাহলে লাশ? ”
কাঁপা গলায় বললো জিহাদ৷ নিতিন হেসে বলল,
“মিস অধরা আর তুমি বসে বসে সমাধান করো, শিলা মারা গেলে ফ্ল্যাটে আসল কিভাবে? আর না মারা গেলে লাশ আসল কিভাবে? এই দুইটা প্রশ্নের উত্তর বের কর। আমি যাই।”

বলে জিহাদ আর অধরাকে চিন্তার সাগরে ছেড়ে দিয়ে নিতিন চলে গেল।

****
দুপুর দুটো নাগাদ নিতিন মিরপুর থানার পৌঁছাল। ছ’ফুটের ফর্সা শরীরটাকে আজ বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। সকালের পরিধেয় সি আই ডি ইউনিফর্ম চেঞ্জ করেছে। সাদা চামড়ার দেহটায় ধবধবে সাদা শার্ট, ব্রাউন প্যান্ট জড়িয়েছে। শার্টের হাতা কনুই অবধি জড়ানো। চোখে কালো সানগ্লাস। হাতে একটা কাগজপত্রে ভরা ফাইল। গাড়ি থেকে নেমে তার হাতে থাকা ফাইলটা তার সহকারীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“ফলো মি।”
“ইয়েস স্যার।”

এসিস্ট্যান্ট সায় জানালে নিতিন তার দু’হাত প্যান্টের পকেটে রেখে অধরার কেবিনের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। ঠোঁটদ্বয়ের কোণে লেগে আছে মনমাতানো হাসি। সমস্ত শরীর জুড়ে লেগে আছে চমৎকার ভঙ্গি। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে থানায় নয়, কোন শুটিং স্পটে এসেছে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে। নায়ক নায়ক ভাব দেখা যাচ্ছে তার মাঝে। খানিকের জন্য হয়তো নিতিন নিজেকে নায়ক ভাবতে শুরু করেছে! মূলত, সে আজ ছদ্মবেশে সূত্র জোগাড় করতে গেছে কয়েকজায়গায়। তাই এমন রূপ নিয়েছে। তবে নিতিনকে কয়েক সেকেন্ড মনোযোগ দিয়ে দেখে চোখ বন্ধ করে বলা যাবে এই মূহুর্তে নিতিন বেশ খোশ মেজাজে আছে। চোখে মুখে জয়ের আনন্দ এসে ভর দিয়েছে।

নিতিন অধরার কেবিনে গিয়ে দেখল অধরা তার টিম নিয়ে মিটিংয়ে বসেছে। অধরা ডেস্কে বসে কিছু একটা ভাবছে। তার আশেপাশে তার ১০জন টিম মেম্বার দাঁড়িয়ে আছে। সবার চেহারায় ভাবুকতা ফুটে উঠেছে। যা প্রমাণ করে সবাই কোন একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত, চিন্তামূলক বিষয়টা সবাইকে বেশ ভাবাচ্ছে। নিতিন সবার দিকে একবার চোখ বুলাল তারপর বরাবরের মতোই অধরার বিপরীতমুখী চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়ল। নিতিনের পিছন থেকে তার সহকারী এসে নিতিনের সামনে ডেস্কের উপর ফাইল রেখে গেল। নিতিন চেয়ারটায় গা এলিয়ে হেসে বলল,
“লাঞ্চ হয়েছে সবার? নাকি খালি পেটে বসেই চিন্তায় ডুবে আছেন?”

নিতিনের কথায় অধরা ভ্রু কুঁচকাল। যার অর্থ খুনীর ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে আমাদের জান বেরুচ্ছে আর উনি এসেছে খাবারের কথা জিজ্ঞেস করতে! অধরার ভ্রু কুঁচকানো দেখে বরাবরের মতো আজো হাসতে ভুলল না নিতিন। রোদচশমা চোখ থেকে নামিয়ে টেবিলের উপর রেখে মাথার দু’ইঞ্চি উচ্চতা সম্পন্ন ঘন কালো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বলল,
” খালি পেটে মাথায় বুদ্ধি আসে না। ভরা পেটে মাথায় ভালো বুদ্ধি আসে৷ তাই আগে খেয়ে নিন তারপর ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন কে খুন করল। যদিও আমি খুনি অবধি পৌঁছে গেয়েছি। তবু ও অনুমান করতে গিয়ে আপনাদের মাথা খাটাতে হবে। তা ছাড়া খালি পেটে এত অভিঘাত নিতে পারবেন না। তাই খেয়ে নিন।”

কন্ঠে রাগ মাখিয়ে অধরা বলল,
“কেসের যা অবস্থা, সমাধান না করতে পারলে পেটে কিছু যাবে না। সুতরাং আপনি আগে কেসের জট খুলুন। তারপর আমরা লাঞ্চের কথা ভাবব। প্লিজ হেয়ালি না করে সোজাসাপটা বলুন!”

নিতিন সোজা হয়ে বসে বলল,
“আচ্ছা, হেয়ালি করব না। আমি আমার ধ্যান ধারণার উড়োজাহাজকে কাজের জায়গায় ল্যান্ড করলাম। এখন হেয়ালিপনার সিস্টেমকে ব্লক করে সোজাসাপ্টা সব স্পষ্ট করছি। ”

নিতিনের কথায় অধরা বিরক্ত হলেও প্রকাশ করল না। সে ডেস্কের উপর দু’হাত ভাজ করে রেখে বলল,
“প্রথমে শিলার ব্যপারটা পুরোপুরি স্পষ্ট করুন। আমি আন্দাজ করছি শিলা মরেনি। শিলা জীবিত আছে, এবং পরবর্তী সব খুনে তার হাত আছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, শিলা জীবিত থাকলে ওইদিন আমরা কার লাশ দেখলাম? ওটা যদি শিলা লাশ না হয় তবে শিলার চেহারার সাথে মিলল কিভাবে?”

নিজের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে নিতিন উত্তর দিল,
“শিলা জীবিত আছে এবং সব খুনে জড়িত ও আছে। কাল সে তুরাগের ফ্ল্যাটে অভিলাষের সাথে ছিল। তার সাথে অবশ্য আরো ক’জন ছিলো যাদের রহস্য আমি পরে উদঘাটন করব।
কাল আমরা তুরাগের ফ্ল্যাটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সবাই তুরাগের ফ্ল্যাটে ছিল। ওখানে রান্না করেছে। প্রভাত মির্জাকে খুন করে সব কিছু সেট করে সবার ক্ষিধে লাগবে । যার কারনে সবার জন্য পাস্তা বানিয়ে আগেই ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল শিলা। ফ্রিজে এক বক্স পাস্তা আমি দেখেছি। ওভেনে ও রেখেছিল পাস্তা। সম্ভবত গরম করছিল। খুন করে সবার ক্ষিধে পেয়েছিল কি না! আমরা যাওয়াতে তাড়াহুড়ো করে পাস্তা ওভেনে রেখেই ওভেন বন্ধ করে কোনমতে পালিয়েছিল। যেই কড়াইয়ে পাস্তা রান্না করা হয়েছিল সেই কড়াইটা তাড়াহুড়োয় ধোঁয়া সম্ভব হয় নি, যার ফলে কিচেন কেবিনেটের এক কোণায় লুকিয়ে রেখেছিল। আমার চোখ পড়ার সাথে সাথে আমি তা ফিংঙ্গার প্রিন্ট ব্যুরোকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আপনি তা খেয়াল করেন নি। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী কিচেনের চুলো, পেঁয়াজের জার, মসলার বক্স, কড়াই, ফ্রিজে থাকা পাস্তার প্লেট, ওভেন, এবং ওভেনে রাখা পাস্তার ট্রেতে শিলার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। যাতে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম এমন সুস্বাদু খাবার শিলাই বানিয়েছে। আর বাকি রইলো লাশের কথা, আমি আগেও বলেছি আমরা যা দেখি সবটা সত্যি হয় না। আমাদের চোখের সামনে অনেক কিছু ঘটে কিন্তু আমাদের চোখে পড়ে না।”

নিতিন থামলো তারপর তার হাতে থাকা ফাইলটা অধরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
” ফাইলের তৃতীয় পেপারটা দেখুন। শিলার লাশের ফরেনসিক রিপোর্ট। যা পড়ে শিলার ব্যাপারটা বুঝে আসবে। ”

অধরা নিতিন থেকে ফাইল নিয়ে একরাশ কৌতুহল ভরা দৃষ্টি ফেলল ফাইলের উপর। অধরার সাথে সাথে উপস্থিত সবার চোখ ফাইলের উপরে। সবার কৌতুহল দেখে অধরা জোরেশোরে পড়ল রিপোর্টটা। পড়ে শেষ করতেই সবার মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেল। মানুষ কতটা সাংঘাতিক হয় এই রিপোর্ট না পড়লে বুঝা যাবে না। রিপোর্টের সারমর্ম এই যে, শিলার চেহারা সদৃশ সম্পূর্ণ ঝলসানো যে ডেডবডি পাওয়া গেছে তা শিলার নয়। শিলার সাথে ওই লাশের ডি এন এ ম্যাচ হয় নি। সেই লাশের মৃত্যু হয়েছে শিলাদের নিখোঁজ হওয়ার আনুমানিক দিন পাঁচেক আগে। মেয়েটার মৃত্যু হয়েছে বিষপানে। মৃত্যু পর তাকে মেডিসিনের সাহায্যে সচল রাখা হয়েছে। লাশ পাওয়ার আগেই লাশের গলায় দড়ি পেচানো হয়েছে এবং শরীর না চেনার সুবিধার্থে এসিড ঢালা হয়েছে।
শিলার সাথে লাশের গায়ের গঠন ভিন্ন ছিলো বিধায় হয়তো এডিট ঢেলে ঝলসে দিয়েছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে,লাশের চেহারায় শিলার চেহারার সদৃশ ফেস মাস্ক পাওয়া গেছে। সেই সাথে প্লাস্টিক সার্জারীর নমুনা পাওয়া গেছে। ধারণা করা যাচ্ছে দুই তিনদিন আগেই মেয়েটার চেহারা প্লাস্টিক সার্জারি করে চেহারার পরিবর্তন আনা হয়েছে। রিপোর্ট পড়ে অধরাও থ বনে গেল। কাউকে খুন করার জন্য মানুষ এত কিছু করতে পারে?

অবাক কন্ঠে অধরা বলল,
“এই খুনী গ্যাং ভাবনার বাইরে। কেউ কল্পনাতেও আনতে পারবে? এরা নিজেকে বাঁচাতে একটা লাশ নিয়ে প্লাস্টিক সার্জারি করে নিজের নাক ঠোঁট বসায়। প্লাস্টিক সার্জারিতে করে লাশের চেহারাকে হুবুহু শিলার চেহারার মতো সম্ভব হয়নি বলে উপরে আবার শিলার চেহারার সাদৃশ ফেস মাস্ক লাগাল। এমন নিঁখুতভাবে সেট আপ করল যে কেউ ধরতেই পারবেনা। তাও যদি ধরতে পারে তবে মাস্ক উঠানোর পরে সার্জারি করা ফেস যাতে কাভার করে তাই প্লাস্টিক সার্জারি করেছে লাশকে। কী সাংঘাতিক পরিকল্পনা! কী মাস্টার মাইন্ড!”

জিহাদ বলল,
” শিলা মেয়েটার নোয়াখালীর ভাষায় ভাংচুরা করে কথা বলতেও কষ্ট হতো। আর এই মেয়েটা এত কিছু করছে! অবাক লাগে। আচ্ছা স্যার, এরা লাশ পেল কোথায়?”

নিতিন বললো,
” মর্গে থেকে লাশ চুরি হওয়ার ঘটনা আজকাল অহরহ ঘটে থাকে । হতে পারে বেওয়ারিশ কোন লাশ টার্গেট করেছে তারা বা শিলার চেহারার সাথে মিলে এমন চেহারার মেয়েকে বেছে নিয়ে তাকে মেরেই খুনীদের কার্যসিদ্ধি করেছে! আর তুমি যাকে নোয়াখালীর বলছো সে নোয়াখালীর মেয়ে নয়। সে ঢাকার মেয়ে। ঢাবিতে গনিত নিয়ে পড়ছে। প্রখর মেধার অধিকারী। চিরকুটের অংকগুলো তার গড়া। প্রতিভার কাছে বোকা সাজার জন্য অসহায় কাজের মেয়ে সেজে দু’বছর ছিল। বাসায় যাবার নাম করে পরীক্ষা দেয়। পার্লারে কাজ শিখেছিল আগে। সেগুলাও প্রতিভার উপর প্রয়োগ করেছে। মেয়েটার আসল নাম হৃদিতা জামান। বাবা আখতারুজ্জামান, পেশায় পান ব্যবসায়ী। মা মাজেদা বেগম, শয্যাশায়ী। তার স্থায়ী বাসা মোহাম্মদপুর। বস্তির মতো একটা ঘরে থাকে, নিন্মবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তিন ভাই বোনের মাঝে সেই বড়। অভাবের সংসার। টানাটানি সহ্য করতে না পেরে চাকরির নাম করে বাসা থেকে বের হয়ে তুরাগের বাসায় উঠেছে। গত দু’বছরে একবারও বাসায় যায়নি, তবে মাস শেষে কিছু টাকা বাবা মায়ের জন্য পাঠায়। আমি আন্দাজ করছি প্রতিভার সম্পত্তির জন্য দলের সাথে পরিকল্পনা করে তুরাগের বাসায় ছিল শিলা। তারপর সব কিছু ঠিকঠাক করে প্রতিভাকে খুন করেছে।”

শিলার পরিচয় জেনে আরেক ধপা ধাক্কা খেল সবাই। এত মেধাবী ছাত্রী কিনা শেষে তার মেধা এভাবে কাজে লাগাচ্ছে! লোভে পড়ে মানুষ কত কিছু করে! এত চল-চাতুরী ? চোখে দেখা নিষ্পাপ চেহারাটা হঠাৎ ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে যা বিশ্বাস হচ্ছে না কারোরই। বিস্ময় কাটিয়ে অধরা বলল,
“শিলার ডেডবডি যদি নকল হয় তবে স্বরূপা আর তুরাগের ডেডবডি ও নকল হওয়ার কথা। যেহেতু লাশ তিনটা একসাথে এবং একরকম পাওয়া গেছে। ”

” এ অবধি যত চিরকুট পেয়েছেন সব কে লিখেছে জানেন?”
কথা ঘুরিয়ে মুচকি হেসে বলল নিতিন। অধরা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আপনি আবারও কথা ঘুরাচ্ছেন?”

নিতিন এবার হেসে বলল,
“আমার কথার উত্তর দিন। প্রশ্ন উত্তরের মাঝে আপনার কাঙ্ক্ষিত উত্তর পেয়ে যাবেন। ”

অধরা এবার কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করল,
“আমার মনে হয়, কোন হ্যান্ডরাইটিং স্পেশালিষ্ট। যে কি না সবার লেখা নকল করতে পারে, সে?”

” সে শুধু হ্যান্ডরাইটিং স্পেশালিষ্ট না। সেই সাথে সর্বগুন সম্পূর্ণা, পাক্কা অভিনেত্রী ও বটে। কী চমৎকার অভিনয় তার! দেখলে গা জুড়ে যায়। ”
বাঁকা হেসে বলল নিতিন। আদাবর অবাক হয়ে বলল,
” চিরকুট যে লিখেছে সে মেয়ে?”

মাথা নাড়িয়ে বাঁকা হেসে নিতিন বলল,
“হ্যাঁ,সাধারণ কোন মেয়ে নয় একবারে মাল্টি ট্যালেন্টেড মেয়ে। ”
“কে সে?” কৌতুহলী হয়ে বললো অধরা। নিতিন তার হাসি বজায় রেখে বলল,
“সেই স্বর্ণপদক দাবিদার অভিনেত্রী হচ্ছে, স্বরূপা। প্রতিভার প্রাণের বান্ধবী, যার হাতের লেখা কি না ভীষন খারাপ, যে কি না সাজগোজ করতে পছন্দ করে না, যে সারাক্ষণ বইয়ের মাঝে ডুবে থাকে, যে কি না এতটাই ভদ্র যে যার কোন তুলনা হয়না। প্রচন্ড রকমের চতুর হয়েও তিন চার বছর ধরে এমন সহজসরল জীবনযাপনের অভিনয় করা কি বাড়ির কাছের কথা! কতটা দক্ষ অভিনেত্রী হলে এমন করা যায় বলুন তো?”

“স্বরূপা! ”
অবাক হয়ে হাঁকচেকিয়ে বলল অধরা। নিতিন বলল,
“হ্যাঁ, স্বরূপা-ই। প্রতিভার সবচেয়ে বড় শত্রু তার আপন বান্ধবী। প্রতিভা স্বরূপাকে আপন ভাবলেও স্বরূপা কখনো প্রতিভাকে আপন ভাবেইনি। আমি আন্দাজ করছি, খুন করার জন্যই প্রতিভার আথে বন্ধুত্ব করেছিল। স্বরূপা খুনের মূল কলাকাঠি ঘুরিয়েছে। সে-ই এতদিনের যাবতীয় চিরকুট সব দিয়েছে। সবার লেখা নকল করতে পারে সে। শকিং নিউজ কী জানেন? প্রতিভার ডায়েরিটাও স্বরূপার লেখা। ওই ডায়েরিতে স্বরূপার আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে। ডায়েরির কোন কথাই সত্য নয়। সব মন গড়ানো গল্প। নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য মনগড়া একটা কাহিনী লিখে দিয়েছে স্বরূপা। ”

“মানুষের চেয়ে ভয়ংকর জীব আর দ্বিতীয়টি নেই। ” আনমনে বলল অধরা।

জিহাদ বলল,
“কিন্তু স্যার আপনি এতসব জানলেন কিভাবে?”

“তোমরা মানুষকে যত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করো আমি তত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করিনা। সে জীবিত হোক কিংবা মৃত। কেস ফাইল পড়ার পরেই আমার সবার প্রতি সন্দেহ হয়। তিহানা জাহান বাদে সবাইকে সন্দেহ হয়। প্রতিভার বিস্মিত চেহারার ছবি দেখেই আমি নিশ্চিত ছিলাম প্রতিভার অতি আপনজনরাই প্রতিভাকে খুন করেছে। স্বরূপা তুরাগের লাশ দেখেও আমার বিশ্বাস হয়নি। আমি ক্লু খুঁজতে থাকি। কাল ফরেনসিক রিপোর্ট পাওয়ার পর আমার সন্দেহ ঠিক প্রমাণ হয়। আমি সর্বপ্রথম স্বরূপার খোঁজ নেয়া শুরু করি। স্বরূপার বাসায় গিয়ে তার বাবা মায়ের সাথে কথা বলি। স্বরূপার রুম তল্লাশি করে কিছুই পাই নি। স্বরূপার বাবার সাথে কথা বলার সময় এক ফাঁকে জেনে নিই স্বরূপার বাবার বাড়ি, ফ্ল্যাট সম্পর্কে। স্বরূপার বাবার সাথে খানিক আলাপ করে সেখান থেকে চলে আসি। আজ সকালে থানা থেকে বের হয়ে একসাথে চারটা ফোর্স রেড়ি করে স্বরূপার বাবার চারটা বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। আমি নিজে যাই মোহাম্মদপুরে স্বরূপার নামে কেনা ফ্ল্যাট। যেখানে মাঝে মাঝে স্বরূপা যেত। সেই ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখি তালা দেয়া। তালা ভেঙে ভিতরে তল্লাশি করতে গিয়ে লক করা কাভার্ডে চারটা পাসপোর্ট পাই। পাসপোর্ট থেকে সবার আসল তথ্য পাই। শিলার নাম দেখে সন্দেহ হয় এবং ওর ব্যাপারে আমি খোঁজ খবর নেই তাতেই এতসব বেরিয়ে এলো।”

“তুরাগ? সে ও তো জীবিত তাই না?”
নিতিনের সহকারী বলল। নিতিন বলল,
“ফরেনসিক রিপোর্ট তো তাই বলছে। শিলা,স্বরূপার মতোই তুরাগের মৃত্যুর কাহিনী একি। তাছাড়া আজ তো আমি তাকে স্বশরীরেই দেখলাম। সে কী মুখভঙ্গি তার!”

“তুরাগকে কোথায় এবং কিভাবে দেখলেন আপনি!”
দ্রুততার সাথেই প্রশ্ন করল অধরা। নিতিন ধীর কন্ঠে বলল,
“স্বরূপার ফ্ল্যাট থেকে থানায় আসার সময় জ্যামে আটকা পড়ি মাঝপথে। আনমনে বাইরে তাকাতেই চোখ পড়লো রাস্তার পাশে একটা শপিংমলের কাপড় দোকানে। একটা ছেলে উল্টে পাল্টে শাড়ি দেখছে। দোকানের সচ্চ কাঁচের দেয়াল দিয়ে ছেলেটাকে অনেকটাই তুরাগের মতো লেগেছিলো। যদি ও মুখে মাস্ক থাকায় চেহারা দেখিনি তাও কৌতুহলবসত নেমে গিয়ে সেই দোকানে গেলাম। ততক্ষণে তুরাগ উধাও। পুরো শপিংমল খুঁজে ও পাইনি। পরে সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে নিশ্চিত হলাম এটাই তুরাগ। মুখে মাস্ক লাগানো থাকলেও মাথা খোলা ছিলো যার কারনে চোখ আর চুল দেখা যাচ্ছিল। যা দেখে আমি নিশ্চত হই এটা তুরাগ। তুরাগ একটা নীল শাড়ি, এবং কেক কিনেছে শপিংমল থেকে। ”

“তুরাগের না পায়ের হাড় ভাঙা? সে হুইলচেয়ার ছাড়া চলতে পারে না তবে সে হাটছে কিভাবে?”
অবাক কন্ঠে বলল জিহাদ। নিতিন বলল,
“আজ তুরাগ তো স্বাভাবিকভবে হাটছিল, সামান্য খোঁড়াতেও দেখেনি। ”

“এর অর্থ দাঁড়ায় তুরাগের পা সম্পূর্ণ সুস্থ। কোনকিছুই হয় নি। প্রতিভার খুনের দায় তার কাধে না আসার জন্যই মূলত তুরাগ অসুস্থার ভান করেছে। তুরাগ ও এত সবে সামিল ছিল! তারমানে প্রতিভার সাথে সব ছিল তার অভিনয়। তার কার্যসাধনের মূল হাতিয়ার ছিল প্রতিভা। ”
অধরা রাগত কন্ঠে বলল।
নিতিন বলল,
” এত খুন,এত কিছু সব কিছুর মূলে ছিল তুরাগ। আশ্চর্যের বিষয় কী জানেন? প্রতিভার র‍্যাপিং পেপার,ট্যাভেল ব্যাগে তুরাগের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। প্রতিভার প্যাকিং তুরাগই করেছে। খুনের দলনেতা আর কেউ নয় স্বয়ং তুরাগ। তার দলে এ আছে, শিলা, অভিলাষ,স্বরূপা। তাই সব কাজ সহজ হয়ে গেছে।”

অধরা যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। সে গালে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল,
“স্ত্রীকে মেরে প্যাকিং করে নিজের বাসার সামনে রেখে সকালে আবার স্ত্রীর লাশ দেখে জ্ঞান হারিয়েছে। স্ত্রীর শানে সে কী ভাষণ! এর পর এত মানুষকে মেরে শপিং করে! এতটা নিখুঁত অভিনয় কিভাবে পারে মানুষ! কাছের মানুষ কিভাবে ধোঁকা দেয় প্রতিভার কেস না দেখলে বুঝা যেত না। সবাই ধোঁকা দিল!”

নিতিন রাশভারি কন্ঠে বলল,
“কাউকে বিশ্বাস করা উচিত, কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত বিশ্বাস করা উচিত নয়। সবসময় চোখ কান খোলা রেখে চলতে হয়। তবে কথায় আছে না? বন্ধু শত্রু হলে এর থেকে বড় শত্রু আর হয় না। প্রতিভার ও হয়েছে তেমন অবস্থা। ওর আপনজনই ওর পিঠপিছে ছুরি বসাল। গত চারপাঁচ বছরে প্রতিভার সাথে যা হয়েছে সব মিথ্যা অভিনয়।”

আদাবর চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
“আমার একটা কথা বুঝে আসছে না তা হলো, অভিলাষ আর তুরাগ দুজন দুজনের শত্রু ছিল। তবে দুজন এক হলো সেটা কিভাবে?”

নিতিন নিচের ঠোঁট কামড়ে বলল,
“এটাই রহস্য। এমন আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ওদের ধরতে পারলে। ”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here