#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_উনত্রিশ(প্রথমাংশ)
ডিভোর্সী একটা মেয়ের একা বেঁচে থাকার লড়াই কেউ জানেনা। কেউ বুঝে না। সমাজের মানুষ পাশে থাকার বদলে, আরো বেশি নিচে নামিয়ে দেয়। জলজ্যান্ত একটা মানুষকে কথার আঘাতে লা*শ বানিয়ে দেয়। কী সুন্দর সমাজ! তাইনা? উত্তপ্ত গরমে ফুটপাতের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে বেলী। মাথার মধ্যে জমাট বেঁধে আছে দুশ্চিন্তা। চোখ দুটো প্রাণহীন। মনে হয় এ চোখে প্রাণ নেই? পড়নের ধূসর শাড়িটা ভিজে একাকার অবস্থা। জীবনটা কী অদ্ভুত! এই ভালো তো এই খারাপ। ভালোবাসার মানুষটার থেকে ধোকা বেঁচে থাকার সুপ্ত ইচ্ছাটাকেও মে**রে ফেলে। বেলী আজ সব হারিয়ে নিঃশ্ব। আনমনে হাঁটছে। দুনিয়ার কোনোদিকে ল। পেছন থেকে কেউ হঠাৎ বেলী বলে ডেকে উঠল। পা জোড়া থেমে গেলো। পেছনে ফিরে তাকাল। পরিচিত মানুষটাকে দেখে ঠোঁটে কোনে হাসি ফুটল। বলে উঠল,
“রাকিব তুই?”
রাকিব এগিয়ে এলো বেলীর দিকে। মুখে হাসি নেই। পাশে এসে দাঁড়াল নিশ্চুপে। কিছু বলতে চাচ্ছে বোধহয়? কিন্তু পারছে না। বেলী তা বুঝতে পেরে পুনরায় প্রশ্ন করল,
“কিরে? তুই এখানে কেন? তুই না গ্রামে গিয়েছিলি? কবে আসলি?”
রাকিব অপ্রস্তুত ভাবে হাসলো। মুখে লেগে আছে বিষন্নতা। কীভাবে কথা শুরু করবে। বুঝতে পারছে না। রাকিবের অবস্থা বুঝতে পেরে বেলী হাঁটা শুরু করল। রাকিবও বেলীর পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলা শুরু করল,
“নীলাভ্র ভাই কোথায় বেলী?”
বেলী থামলো না। রাকিব ভেবেছিলো বেলী প্রশ্নটা শোনার সাথে সাথে রিয়েক্ট করবে। কিন্তু না! এমন কিছু বেলী করল না। স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,
“জানিনা।”
রাকিব থমকালো। হকচকালো। চক্ষু জোড়া থেকে বিস্ময়ের ঘোর কা*টল না। এত স্বাভাবিক! কিন্তু কী করে? এতকিছুর পর কী করে এত স্বাভাবিক বেলী? রাকিব পুনরায় প্রশ্ন করল,
“জানিনা মানে? নীলাভ্র ভাই নিখোঁজ এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। আর তুই বলছিস জানিনা?”
বেলী আগের ন্যায় উত্তর দিলো,
“যে সত্যিকারের নিখোঁজ হয় তাকে খুঁজে বের করা যায়। আর যে ইচ্ছেকৃতভাবে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। তাকে কী করে খুঁজে বের করব বল?”
রাকিব চুপ থাকল। কিছু সময়ের ব্যবধানে হাফ ছেড়ে উত্তর দিলো,
“তোকে তো বলে গেছে। তাহলে ইচ্ছেকৃত ভাবে লুকিয়ে থাকা হলো, কী করে?”
বেলী আপনমনে হাঁটতে লাগল। উত্তর দিলো না। উত্তর দিতে মন চাইছে না। রাকিব হাল ছাড়ল না। প্রশ্ন করল,
“সবটা খুলে বল, বেলী। কী হয়েছিলো?”
বেলী শাড়ির আঁচলটা টেনে মাথায় দিলো। মুখের ঘাম গুলো হাত দিয়েই মুছে নিলো। শান্ত, স্বাভাবিক কন্ঠে বলতে লাগল,
“হুট করে এক সপ্তাহ আগে ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় নীলাভ্র বাড়িতে এসে হাজির হয়। বলল, কী একটা কাজে চট্রগ্রাম যেতে হবে। পনেরো দিনের জন্য যাবে। কিন্তু কী কাজ তা বলেনি। সেদিনই সে চট্রগ্রাম চলে গেছে। আমাকে বা পরিবারের কাউকে কিছু জানানোর প্রয়োজনবোধ করেনি। চট্রগ্রাম চলে গিয়ে সবাইকে ফোন করে জানিয়েছে। যেদিন চলে গেছে তারপরের দিন থেকে তার ফোন অফ। হাজার চেষ্টা করেও তার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করে তার বন্ধুর কন্ট্রাক্ট নাম্বার জোগাড় করেছিলাম। ফোন করে জেনে ছিলাম, সে কাজে বেশ ব্যস্ত। কারোর সাথে এক মিনিট কথা বলার টাইম নেই। আমার সাথেও না। আমাদের সবার থেকে তার কাজটা অনেক বড়। এখন তুই বল? যে নিজ থেকে যোগাযোগ রাখতে চায়না। সে কী নিখোঁজ?”
রাকিব থেমে গেলো। বেলী মুচকি হাসল। এই হাসির মাঝে কোনো প্রাণ নেই। শুধু আছে তাচ্ছিল্য। অভিমান, অভিযোগ। বুকভরা অভিযোগ নিয়েও মুখে হাসি রেখে চলার নামেই জীবন। বেলী তাচ্ছিল্যের কণ্ঠে বলে উঠল,
“থেমে গেলি কেন? আসলে কী জানিস? আমার ভাগ্যটা হয়তো এমনি। কারোর ভালোবাসা বেশিদিন আমার কপালে লেখা নেই। হয়তো আমার ব্যর্থতা? তবুও সব কিছু মিলিয়ে আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী!”
রাকিব আর উত্তর দিতে পারল না। তবে মুখে দেখে মনে হচ্ছে কঠিন ভাবনায় ব্যস্ত? বাসার কাছে আসতেই বেলী বলে উঠল,
“আসছি। তুই বাসায় যা।”
বলে গেটের দিকে পা বাড়াতেই, রাকিব পেছন থেকে ডেকে উঠল। দৃঢ় কণ্ঠে স্বরে বলল,
“বেলী, তুই নীলাভ্র ভাইকে ভুল বুঝছিস। নীলাভ্র ভাই তোকে সত্যিই ভালোবাসে। হয়তো সে কোনো সমস্যায় আছে বা সত্যিই কাজে ব্যস্ত?”
বেলী হাসল। উত্তর না দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। রাকিবের কেন যেন সবটা এলোমেলো লাগছে। একটা ছেলে অন্য একটা ছেলের চোখের দিকে তাকালে সত্যি মিথ্যা সহজেই বুঝতে পারে। নিজে নিজেই বলে উঠল,
“এইসব কিছুর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে? কিন্তু কী কারণ? আমি খুঁজে বের করব।”
—
বেলী রুমে ঢুকেই দরজাটা আটকে দিলো। দরজা ঘেষে বসে পড়ল মেঝেতে। হাটুর ভাঁজে মুখ লুকাল। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে বলে উঠল,
“কেনো দূরে গেলেন নীলাভ্র ভাই? প্লিজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। যেই মানুষটা তার বেলীপ্রিয়াকে ছাড়া একদিন থাকতে পারত না। আজ সেই মানুষটা এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ। আমি একা বাঁচতে পারছি না, নীলাভ্র ভাই। প্লিজ ফিরে আসুন। ”
কান্নায় ভেঙে পড়ল। তখনি শুনতে পেলো। দরজার ওপাশ থেকে কেউ অনবরত ডেকে চলেছে। একটু খেয়াল করতেই বুঝতে পারল। এটা সীমার গলা। তাড়াহুড়ো করে চোখের জলটুকু মুছে নিলো। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে মুখে হাসির রেখা টেনে দরজা খুলল। সীমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করল,
“বড় মামী,, তুমি? কিছু কী হয়েছে?”
সীমা ভয়ংকর চাহনী দিলো বেলীর দিকে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বেলীর গালে সপাটে থা*প্পড় মে*রে বসল। চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“আমার ছেলেটাকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে শান্তি হয়েছে তোর। এইজন্যই আমি তোকে সহ্য করতে পারিনি। এইজন্যই আমার ছেলেটাকে বার বার বারণ করেছিলাম। যে মেয়ে প্রথম স্বামী ডিভোর্স দিয়ে আসতে পারে। সেই মেয়ে কত ভালো? আমি খুব ভালো করে জানি। কিন্তু আমার বোকা ছেলেটা বুঝে নাই। তাই আজ ওর এই অবস্থা।”
বেলী গালে হাত দিয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। এই সাতদিনে বেলীকে এমন নানা বিশ্রি কথা শুনতে হয়েছে। আশেপাশের মানুষ অব্দি কথা শুনাতে বাদ দেয়নি। বেলী নিজেকে সামলে নিলো মুহূর্তেই। প্রতিবাদ না করলে এই সমাজে বাঁচা যাবে না। রুঁখে দাঁড়াতেই হবে। চোখের পানি গুলো মুছে নিয়ে জোরেই বলে উঠল,
“মামী! কোন অধিকারে আপনি আমাকে এতগুলো কথা শুনাচ্ছেন?”
সীমা এবার আগের থেকেও দ্বিগুণ চ্যাঁচিয়ে উঠল। দ্বিতীয় দফায় থা**প্পড় মা**রার জন্য হাত উঠাতেই বেলী ধরে ফেলল। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরে বলে উঠল,
“আমার গায়ে হাত তোলার অধিকার আপনার নেই, মামী।”
বলে হাতটা এক প্রকার ছিটকে ফেলে দিলো। সীমা রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে। রাগে তার শরীর কাঁপছে। বেলী বুঝতে পেরেও চুপ করে রইল। শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“আমাদের সদর দরজাটা খোলা। আপনি এখন আসতে পারেন মামী।”
বলে সীমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। নিজে নিজেই বলে উঠল,
“আমি আপনাকে খুঁজে বের করব। আমার থেকে আপনি কী লুকাচ্ছেন? আমার সব প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দিতে হবে। আপনার জন্য আমি আর কারোর কথা শুনতে পারব না।”
—
ফজরের আযান কানে যেতেই বেলী উঠে পড়ল। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে নামাজ পড়ে নিলো। শাড়িটা পাল্টে একটা থ্রি-পিস পড়ে নিলো। তারপর বোরকা পড়ে, নিকাবের আড়ালে মুখ ঢেকে নিলো। ব্যাগটা কাল রাতেই গুছিয়ে রেখেছিলো। ফোনটা হাতে নিয়ে রাকিবকে কল করল। রাকিব রিসিভ করতেই এপাশ থেকে বেলী বেলী উঠল,
“আমি বের হচ্ছি। তুই সোজা বাস স্টেশন চলে যা।”
বলে রেখে দিলো। রুম থেকে বের হতেই রিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসি মুখে বলল,
“আসছি মা।”
রিতা কিছু বলল না। মেয়ের এই ডিসিশনে সে কিছুতেই খুশি না। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলছে না। বেলী নিজের মায়ের মনের ভাষা বুঝতে পারল। কিন্তু কিছু বলল না। নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে পা রাখতেই শুনতে পেলো,
“সাবধানে যাবি।”
পেছনে না ফিরেই হাসল। মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে কিছুটা সাহস বেড়ে গেলো। বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। গেটের সামনে এসে একটা রিকশা ডেকে নিলো। রিকশায় উঠার জন্য পা বাড়াতেই কেউ পেছন থেকে হাতটা টেনে ধরল। আচমকা এহেন কান্ডে ভয় পেয়ে গেলো বেলী। হকচকিয়ে পেছনে তাকাতেই শরীরটা জমে গেলো। শীতল রক্ত বইতে শুরু করল সর্বাঙ্গে। হাতের ব্যাগটা তৎক্ষনাৎ নিচে পড়ে গেলো। আঁখি জোড়ায় অশ্রুরা এসে ভীড় করল। ঠিক দেখছে তো? না-কি ভুল? এটা কী স্বপ্ন? না-কি সত্যি? মানুষটা তাহলে কী ফিরে এসেছে?
#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_উনত্রিশ (শেষাংশ)
চোখের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে কেঁপে উঠল বেলী। নীলাভ্রর চোখ জোড়া কোটরে ঢুকে গেছে। শুকিয়ে কেমন হয়ে গেছে! মুখটা ফ্যাকাসে। ঠোঁটে কোনে আজ হাসি নেই। কী হয়েছে ছেলেটার? ক্ষুধার্ত ব্যক্তি অনেকদিন পর খাবার পেলে যেমন করে হা/মলে পড়ে। তেমনি, প্রায় একসপ্তাহ পর প্রিয় মানুষটাকে দেখে বেলী তার বক্ষস্থলে হা/মলে প/ড়ল। নীলাভ্র ঠাঁই দাঁড়িয়ে। কোনো কথা বলার ভাষা বা শব্দ খুঁজে পেলো না। কোন ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করে বেলীকে নিজের অবস্থা বুঝাবে? বেলী শব্দ করে কাঁদছে। নীলাভ্র এখনও দাঁড়িয়ে। নাহ! বেলীকে আকঁড়ে ধরতে গিয়েও পারল না। হাত বড্ড কাঁপছে! ভয় না-কি সাহসের অভাবে? ইশারায় রিকশাওয়ালাকে নীলাভ্র চলে যেতে বলল। শুনসান রাস্তায় হাতে গোনা কয়েকটা রিকশা চলছে। সকালের মিষ্টি আবহাওয়ায় দুটি মানুষ প্রণয়ের দহনে জ্ব/লছে। বেলী ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আরো বেড়ে গেলো। এবার নীলাভ্রর টনক নড়ল। শক্ত করে বেলীকে আঁকড়ে ধরল। স্বান্তনার ভঙ্গিতে বলে উঠল,
“এত জোরে কেউ কান্না করে না-কি ব/লদ? সবাই কী ভাববে বল তো?”
বেলী এবার গর্জে উঠল। নীলাভ্রর শার্ট জোরে খা/মচে ধরল। বক্ষস্থল থেকে মাথা তুলে নীলাভ্রর চোখে চোখ রাখল। বেলীর চোখের দিকে তাকিয়ে নীলাভ্র তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে নিলো। এই চোখে তাকিয়ে থাকার সাহস নেই। বেলী সেদিকে তাকিয়ে চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“চুপ! একদম চুপ! আমাকে যে যা খুশি ভাবুক। খারাপ ভাবলে আমি খারাপ। ভালো ভাবলে আমি ভালো। আমার খারাপ, ভালো নিয়ে আপনার চিন্তা করা লাগবেনা। কে আমি? কেন ভাববেন আমাকে নিয়ে? যদি ভাবতেন তাহলে আমার থেকে দূরে যেতে পারতেন না। আপনার যখন ইচ্ছে হবে, আপনি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন। যখন ইচ্ছে হবে, ফিরে আসবেন। কী পেয়েছেন আমাকে? আমি কি মানুষ না? না-কি আমাকে মানুষ বলে আপনি গণ্য করেন না?”
কথাগুলো বলতে বলতে বেলী কেঁদে দিলো। এই মুহূর্তে নীলাভ্রর নিজেকে খুব অসহায় লাগল। কতটা অসহায় হলে একটা মানুষ কিছু বলার থাকলেও চুপ থাকে? বেলীর চোখে পানি গুলো নীলাভ্রকে বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে! নীলাভ্র কোনো উত্তর না দিয়ে বেলীকে বুকে জড়িয়ে ধরল। শক্ত করে। মনে হচ্ছে, ছেড়ে দিলে এক্ষুনি পালিয়ে যাবে। বেলী ছোটাছুটি করতে লাগল। তবুও নীলাভ্র ছাড়ল না। বরং, আরো শক্ত করে জড়িয়ে রাখল নিজের সাথে। এবার বেলী না পেরে, নীলাভ্রর বুকে কি/ল ঘু/ষি যা পারছে বসিয়ে দিচ্ছে। বেলীর কান্ড দেখে নীলাভ্র খানিকটা মুচকি হাসল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত কণ্ঠ বলা শুরু করল,
“তুই তো জানিস, যারা রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকে। তাদের কত কী সহ্য করতে হয়? সামনে নির্বাচন। তাই বিপক্ষ দলের মানুষেরা আমাকে ক্ষিপ্ত হয়ে খুঁজছে। হাতের কাছে পেলে আমাকে মে/রে ফেলতেও একবার ভাববে না। যখন আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তখন আমার ফ্যামিলির উপর আক্রমণ করবে। আমার বড় দূর্বলতা তুই। তাই ওদের ফাস্ট টার্গেট তুই। আমি যদি তোর থেকে দূরে না থাকতাম। তাহলে এতদিনে তুই বা আমি দুজনের একজন মা/র্ডার হয়ে যেতাম। তাই বাধ্য হয়ে তোর থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। আমি তোদের কাছে থাকলে তোকে বা আমার পরিবার কাউকে রক্ষা করতে পারতাম না। এই এক সপ্তাহ দিনরাত এক করে সমস্যার সমাধান করেছি। সব কয়েকটাকে হাজতে পাঠিয়েছি। এখন আমি আমার পরিবার সবাই বিপদমুক্ত। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু ঢাকাতেই ছিলাম। চট্রগ্রাম যাইনি।”
শেষ কথাটা শুনতেই বেলী বিস্ফোরিত চোখে তাকাল নীলাভ্রর দিকে। ওমনি নীলাভ্র চোখ মা/রল। তা দেখে বেলীর রাগ যেন দ্বিগুণ হয়ে গেলো। ঢাকা থেকেও মিথ্যা বলেছে। কী সাংঘাতিক! কোমড়ে হাত দিয়ে রাগান্বিত চোখে তাকাল নীলাভ্রর দিকে। দাঁ/তে দাঁ/ত চে/পে বলল,
“মিথ্যা কথা খুব ভালো শিখেছেন, তাইনা?”
নীলাভ্র মুচকি হাসল। শার্টের কলারটা ঠিক করতে করতে ভাব নিয়ে বলল,
“ইট’স মাই পাওয়ার! এই গুণটা সবার থাকেনা।”
ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলল কথাটা বলে। কথাটা বেলীর কর্ণদ্বয়ে পৌঁছাতেই বেলীর কপাল কুঁচকে এলো। দাঁ/ত কটমট করতে করতে শুধাল,
“আপনি একটা জ/ঘন্যতম ব্যক্তি! মিথ্যা কথা বলে আবার জোর গলায় বলছেন? লজ্জা করছে না আপনার? নি/র্লজ্জ লোক একটা! ”
বলে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। বেলীর রাগ দেখে নীলাভ্র শব্দ করে হেসে উঠল। নীলাভ্রর হাসির শব্দ বেলীর কানে আসতেই রাগে কান গরম হয় গেলো। আঁখি জোড়া রাগে লাল বর্ণ ধারণ করল। পেছন ফিরে দেখল নীলাভ্র কোমড়ে হাত দিয়ে হেসেই যাচ্ছে। হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাওয়ার উপক্রম। হঠাৎ ঝিনঝিনিয়ে উঠল সর্বাঙ্গ। ছেলেটার মুখে হাসি কী সুন্দর মানায়! হাসলে পৃথিবীর কুৎসিত ব্যক্তিটাকেও মা/রাত্নক সুন্দর লাগে! ভালো লাগার ছোঁয়ায় সারা অঙ্গ পুলকিত হলো। চেয়ে রইল এক ধ্যানে। হাস্যজ্বল মুখপানে তাকিয়ে নিজের সব কষ্ট, অভিযোগ, অভিমান ভুলে গেলো। মুছে গেলো হৃদয় থেকে। ভালোবাসার মানুষটা অন্যায় করলেও ঘৃণা করা যায় না। বড়োজোর ‘ঘৃণা করি’ কথাটা মুখে বলা যায়। কিন্তু, মন থেকে সত্যি সত্যি ঘৃণা করা যায় না। মানুষটার আড়ালে বুকের ভেতর হাজারটা অভিযোগ জমিয়ে রাখা যায়। কিন্তু দিনশেষে মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে অভিযোগ গুলো প্রকাশ করা যায়না। কী এক অদ্ভুত অনুভূতি! বেলীকে নিরলস চেয়ে থাকতে দেখে নীলাভ্র থমকালো। মা/দকতার মতো চাহনী মেয়েটার! দেখলেই নে/শা ধরে যাওয়ার মতো। রাগলে মেয়েটাকে আরো সুন্দর লাগে। আর হাসলে তো বক্ষস্থল চিনচিন করে উঠে। হৃদযন্ত্রটা লাফানো শুরু করে। চারদিকে সব বিষাদ ভুলে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তৃপ্তি সহকারে। হুট করে কোথা থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ কানে আসতেই দুজনের চৈতন্য ফিরে এলো। ধড়ফড়িয়ে উঠল দুজনেই৷ বেলী একটু লজ্জা পেলো বটে। বেলীর লজ্জানত মুখখানে দেখে নীলাভ্রর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধিরা এসে হা/না দিলো। উচ্চস্বরে অপকটচিত্তে বলে উঠল,
“তোমাকে দেখে আমার বুকের ভেতর ধুপধাপ করে, বেলীপ্রিয়া। তোমার প্রণয়ের দহনে আমি জ্ব/লে, পু/ড়ে ক’য়লা হয়ে যাচ্ছি। আমার বক্ষস্থলের এই জ্বা/লানি একমাত্র তুমি ছাড়া আর কারোর পক্ষা নিভানো সম্ভব না। তুমি আমার জ্বালাময়ী রানী।”
নীলাভ্র এহেন সব অদ্ভুত কথা শুনে বেলীর হাসি পেলেও দমিয়ে নিলো। কপট রাগ দেখিয়ে হাতের মোবাইলটা ছুঁ/ড়ে মা/রল নীলাভ্রর দিকে। নীলাভ্র কেস ধরে নিলো সাথে সাথে। বেলী সেদিকপানে তাকিয়ে মেকি হাসল। জোরেই বলল,
“আপনি এক কাজ করুন। সিনেমায় যোগদান করুন। ভালো উন্নতি করতে পারবেন। অভিনয়ে একদম সেরা! আর ডায়লগ তো মা/রহাবা!”
কথা টুকু শেষ করে। বিড়বিড় করে বলল,
“শা/লা এক নাম্বার পট্টিবা/জ!”
বলে বাসার দিকে পা বাড়াল। আর নীলাভ্র সেখানে দাঁড়িয়ে হাসিতে মত্ত হয়ে পড়ল। বেলী বাসার ভেতরে ঢুকে যেতেই নীলাভ্রর মুখের হাসিটা গায়েব হয়ে গেলো। বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। হাহাকার শুরু হলো মুহূর্তেই। এতক্ষণ হাসি মুখে থাকলেও এবার নয়ন জোড়ায় অশ্রু এসে হা/মলে পড়ল। কী এক যন্ত্রণা! এই যন্ত্রণার শেষ কোথায়? কে জানে? বেলীকে হারানোর ভয়টা মস্তিষ্কের মা/রাত্মক ভাবে ঘা/পটি মে/রে বসেছে। কিছুতেই দূর হচ্ছে না। এতদিন বেলীকে ছেড়ে থাকতে পারছিলো না। কিন্তু, ফিরে আসার কোনো রাস্তাও ছিলো না। সব সময় মন চাইলেই সব পাওয়া যায়না। যদি মানুষ চাইলেই সব পেয়ে যেতো তাহলে কী আর পৃথিবীতে না পাওয়ার হাহাকার থাকত? আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে নয়ন জোড়া বন্ধ করে নিলো। সাথে সাথে দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, চোখের কোন বেয়ে। তড়িঘড়ি করে মুছে নিলো। বুকের মধ্যে সূক্ষ্ম ব্যাথা টের পেলো। নিজে নিজেই বলে উঠল,
“তোকে ছেড়ে আর যাব না, বেলীপ্রিয়া। আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে পারিনা রে! আমার খুব কষ্ট হয়। আমি এতদিন ভালো ছিলাম না। কিন্তু ফিরতেও পারছিলাম না। এখন যখন একবার ফিরে এসেছি। তখন আর যাব না। প্রমিস। ভালোবাসি, বেলীপ্রিয়া। বড্ড বেশি ভালোবাসি তোকে!”
বলে বেলীর ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করল।
—
বেলী মুখ গুমরা করে সোফায় বসে আছে। রিতা অনেকক্ষণ যাবৎ একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। কিন্তু বেলী উত্তর দিচ্ছে না। এবার সে রেগে এক প্রকার ধমক দিয়েই জিজ্ঞেস করল,
“আমি কী বলছি? শুনতে পাচ্ছিস না তুই? ফিরে আসলি কেন? কী হয়েছে?”
বেলী বিরক্ত হয়ে কিছু কথা বলার জন্য মুখ খুলল। তখনি দরজার সামনে থেকে পরিচিত কণ্ঠ ভেসে এলো।
“কারণ আমি ফিরে এসেছি তাই।”
নীলাভ্রর কণ্ঠ পেয়ে বেলীর কোনো ভাবাবেগ প্রকাশ পেলো না। কিন্তু রিতা অবাক চোখে সেদিকে তাকাল। দরজার সামনে নীলাভ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আকাশ থেকে পড়ল যেন? তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নীলাভ্র শান্ত ভঙ্গিতে এসে দাঁড়াল রিতার সামনে। হাসি মুখে রিতাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। প্রশ্ন করল,
“কেমন আছো, ফুপ্পি? শরীর ঠিক আছে তোমার?”
নীলাভ্রর প্রশ্নটা শেষ হতে দেরি। কিন্তু গা/লে থা/প্প/ড় পড়তে দেরি হলো না। আচমকা এমন একটা কান্ড ঘটে যাওয়ায় বেলী বজ্রাহত চোখে তাকাল মায়ের দিকে। হকচকিয়ে উঠে, দাঁড়িয়ে পড়ল।
নীলাভ্র বো/কার মতো তাকিয়ে রইল শুধু…
#চলবে