#শ্রাবণের_ধারা ~(১২ম পর্ব)~
#লেখনীতে_ওয়াসেকা_তাবাসসুম ~
~মনের কথা শুনলাম আর শ্রাবণকে ডাক দিলাম। আমার ডাকে ঘুরে তাকালো শ্রাবণ তারপর বললাম,
— নিজেদেরকে আরেকটু সময় দেয়া যায় না?
— কিসের জন্য সময় চাচ্ছো ধারা?
— নিজের জন্য।
— বুঝলাম না?
— আমি জানি না তবে আমি চাই তুমি থেকে যাও।
— তুমি কি জানো তুমি কি বলছো? আমি তোমাদের একজন না, আমার একটা ভিন্ন পরিচয় রয়েছে। অনেকটা দায়িত্ব রয়েছে আমার, সব ফেলে এখানে থেকে যাবো কিভাবে?
— আসলে আমি না মানে…….
শ্রাবণ মৃদু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে আমার এখন কি বলা উচিত আমি এটাই বুঝে উঠতে পারছি না। যেতে দিতে চাই না আবার যেতে না দেয়ারও কারণ নেই। শ্রাবণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— যেতে হবে আমাকে, ভালো থেকো। পারলে এই কয়েকদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ভুলে যেও সেটাই ভালো হবে।
— সবকিছু এতো সহজ কেন তোমার কাছে? ভুলে যেতে বলছো কোন সাহসে? তোমার কি মনে হয় সব মুছে ফেলা খুব সহজ?
— চাইলেই সহজ, চেষ্টা করে দেখো পারবে।
— পারতে চাই না। অনেক হয়েছে, যা বলার সোজাভাবে বলবো এখন। সেই প্রথম দিন যখন তোমার সাথে পরিচয় হয়েছিল তোমাকে চিনতাম না পর্যন্ত। তূর্যর থেকে তার পরেও তুমি আমাকে বাঁচিয়ে ছিলে সেদিন। সেদিন রাতে আমি তোমার সাথে ছিলাম এইটা তুমি কাউকে বলোনি তাই না? এই জন্যই ওই রাতের কথা আমি জানি এইটা শুনে রাদিফ চমকে গেছিল। দূরের থেকে আমার সুবিধা অসুবিধার খেয়াল রেখেছো এগুলো আমি বুঝিনি এইটা ভেবেছো তুমি?
— আমি না মানে….
— আর কি মানে বলবে তুমি? আমি বলছি না এটুকুতে তোমার প্রতি অনুভূতির পাহাড় তৈরি হয়েছে আমার মনে। একবার বিরহের স্বাদ পেয়ে জীবনে আবার নতুন করে চিন্তা করা সহজ না। তবে তোমাকে অন্তত বন্ধু হিসেবে আমার চাই। এতো তাড়াতাড়ি পথচলা শেষ করতে চাই না।
— …………..
— কিছু বলবে না?
— আমাকে যেতে হবে, ভালো থেকো।
আর এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেল শ্রাবণ। এতো কিছু বলার পরও? একটাবার দাঁড়াতে মন চাইলো না? এতো দিন মনের ভুল নিয়েই ছিলাম তাহলে। সম্পূর্ণ আলাদা একটা মানুষ এখন সে, তার পরিচয়তে ফিরে গেছে। আমি তাকে পিছনে জীবন ডাকছি, এটা তো আমারই ভুল। চাইলেই সব হয় না এই হয় তো মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছিলো। সব হয় তো এখানেই শেষ।~
—————–
দুদিন পেরিয়ে গেছে এর মধ্যে শ্রাবণের সাথে দেখা হয়নি। আশাটাও হালকা হয়ে গেছে, কি আর আশা রাখবো? বললোই তো সময় শেষ তাহলে অপেক্ষা করে আর কি বা করবো। তার পরেও কেন জানি মনে হয় আমাদের আবার দেখা হবে। কবে বা কখন সেটা জানি না। আকাশের মেঘগুলো পুরো আকাশ ঢেকে রেখেছে, পাখিগুলো নিজ মনে উড়ে চলেছে। ওদের মতো উড়তে পারার ক্ষমতা থাকলে সেই কবে অন্য কোথাও চলে যেতাম।
হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পিছনে ঘুরে তাকালাম তখন দেখি তূর্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এই সময়ে ওকে এখানে সহ্য করার ইচ্ছা আর শক্তি কোনটাই আমার নেই। কি যে করতে এসেছে এখন কে জানে। তবে ওকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে কেন জানি। তূর্য একটু এগিয়ে এসে বলল,
— কেমন আছো ধারা?
— কি করতে এসেছো তুমি? দেখো তোমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা আমার নেই এখন। এমনিতেও আমার মন ভালো নেই।
— জানি আমাকে তোমার সহ্য হচ্ছে না। না হওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু আজকে তোমাকে জ্বালাতে নয় সবটা মিটিয়ে নিতে এসেছি।
— মানে?
— বিয়েটা ভেঙে দিতে এসেছি আমি।
তূর্যর মুখে এমন কথায় বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। যা বলছে ভেবে বলছে কি? তূর্য আবারও বলে উঠলো,
— আমি যা বলছি সত্যিই বলছি ধারা। এই বিয়ে ভেঙে দিতে এসেছি আমি। তোমাকে আর জ্বালাতেও আসবো না। চিন্তা করো না একদম।
— আমি না কিছুই বুঝতে পারছি না।
— আর কি বুঝাবো তোমায়। আমার জীবনটাই কেমন হয়ে গেছে, আর ক্ষমতা নেই এই জীবনের সাথে লড়ার, হাঁপিয়ে গেছি আমি।
— কি হয়েছে?
— বাবাকে পু’লি’শ ধরে নিয়ে গেছে।
— কিহ!?
— হ্যা। বাবা না কি অ’বৈধ কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। এইজন্যই উনি বেশিরভাগ সময়ে বিদেশেই থাকতেন। আর মনে আছে বলেছিলাম না? বাবা কয়েকদিন বেশ চিন্তিত ছিলেন, সেটাও এই কারণেই।
— এখন কি করবে?
— জানি না তবে তুমি চিন্তা মুক্ত থাকতে পারো। তোমার জীবন ন’ষ্ট করতে চাই না আমি। সত্যি বলতে হয় তো তোমার প্রতি কিছু একটা ছিল, আগের ভুলগুলোর কারণেই তোমাকে হারাতে হয়েছে কি আর করার। তুমি চাইলে অতীতের কথাগুলো বলে দিতে পারো তোমার মা বাবাকে এতে করে তারাও এই বিয়ে নিয়ে আর কিছু বলবে না।
— না তূর্য। অতীতকে বর্তমানে টানতে চাই না আমি। তুমি যা করেছো তার না হয় তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। পুরোনো জিনিস ভুলে যাও, নতুন করে জীবন শুরু করো এতেই আমাদের দুজনের ভালো।
— তোমাকে ধন্যবাদ ধারা। তুমি চিন্তা করো না আমি আর তোমার জীবনে বাঁধা হবো না। নিজেকে গড়ে তুলতে অনেক কাজ করতে হবে আমাকে।
— তাই ভালো।
— হ্যা তুমিও ভালো থেকো।
এরপর তূর্য চলে গেল। অদ্ভুত জীবন দুইদিন আগেও সেই মানুষটাকে সহ্য হচ্ছিল না আর আজকেই তার মধ্যে পরিবর্তন। ওর জীবনেও কতো কিছু ঘটে গেল। আশা করি তূর্যও নিজের জীবনটাকে সাজিয়ে তুলতে পারবে। যে যার জীবনে ভালো থাকুক এটাই চাওয়া।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জিনিসগুলো ভাবছিলাম এর মধ্যেই ফোনে একটা মেসেজ এলো,
— “আজ বিকেলে দেখা করতে পারবে? ভার্সিটির কাছের পার্কে চলে এসো”
অচেনা নম্বর থেকে মেসেজ আসায় ঠিক বুঝতে পারছি না কার মেসেজ। তবে মনে হচ্ছে চেনা কেউ, শ্রাবণ? হতেও তো পারে। আমার কি একবার গিয়ে দেখা উচিত? হয় তো।
—————–
পার্কে এসে দাড়িয়ে আছি অথচ কারো খবরই নেই। তাহলে কে আসতে বললো আমাকে? এই অসময়ে কি মানুষ মজা করছে না কি? হঠাৎ পিছন থেকে কারো ডাক পেলাম,
— ধারা..
— রাদিফ? তুমি?
— হ্যা আমি। কেমন আছো?
— আছি যেমন থাকার কথা। কিন্তু তুমি এখানে? তুমি মেসেজ দিয়েছিলে আমাকে?
— হ্যা আমিই দিয়েছিলাম।
— ওহ্ আমি তো ভাবলাম…
— শ্রাবণ দিয়েছে?
— না মানে ওই আর কি
— জানি আমি সবই, তোমরা দুজনই এক কি আর বলবো।
— মানে?
— দুজনেই সারাদিন একে অপরের কথা ভাববে কিন্তু মুখে শিকার করবে না। ভার্সিটি থেকে আসার পর থেকেই আমি শ্রাবণের মধ্যে পরিবর্তন দেখেছি। যেই ছেলে সারাক্ষণ কাজ নিয়ে পা’গ’ল তাকে আনমনে বসে থাকতে দেখেছি। আমি ভার্সিটিতে গেছিলাম ওর কাজে হেল্প করতে আর সেখানে গিয়েই তোমার সাথে পরিচয় হয়। বরাবর তোমার প্রতি শ্রাবণের আলাদা রকম ব্যবহার খেয়াল করছি আমি। তোমার প্রতি ওর কেয়ার দেখেছি, যা ওর নিজের থেকে প্রকাশ না করে আমাকে দিয়ে করিয়েছে। বড়ই হাস্যকর আমি নতুন এক শ্রাবণ দেখেছি ওই সময়টাতে জানো?
— সত্যি বলছো?
— মি’থ্যা বলে কি আমার লাভ আছে? আমি তো চাই যাতে তোমরা দুইজন ভালো থাকো। কিন্তু আমার মনে হয় না এইভাবে আলাদা থেকে সেটা সম্ভব হবে। তার জন্য তোমাদের আবার দেখা হওয়া জরুরি।
— সেটা মনে হয় না সম্ভব হবে।
— কেন হবে না? আমি থাকতে কিসের চিন্তা?
— কি করবে তুমি?
— করে ফেলেছি, পিছনে তাকাও।
রাদিফের কথা মতো পিছনে তাকালাম। সামনে দিয়ে সেই পুরনো রূপে কালো হুডি পরিহিত এক ব্যক্তি হেঁটে আসছে। সেই প্রথম দেখার মতো তবে আজ মানুষটা অচেনা নয় আর। আমাদের সামনে এসে দাড়ালো শ্রাবণ।
— দেখ ভাই আমার এইটুকুই করার ছিল বাকিটা তোমাদের উপর। এখনো যদি একই কাহিনী করো তাহলে দুইটা ধরে নিয়ে এক জায়গায় তালা দিয়ে চলে যাবো তাই ভালোয় ভালোয় বলছি সব ঠিক করে নাও।
তারপর রাদিফ প্রস্থান নিলো, এদিকে আমি আর শ্রাবণ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। দুইজনই চুপ হয়ে আছি, না আমি কিছু বলছি আর না শ্রাবণ কিছু বলছে। নিরবতা ভেঙ্গে আমিই বললাম,
— কিছু বলার আছে?
— না মানে আছে ওই একটু আধটু।
— তো সেটা কি বলতে এসেছো না কি খালি মুখ দর্শন দিতে এসেছো?
— না মানে বলবো না কেন? বলবো তো।
— তাহলে বলো।
— আসলে আমি…………..
চলবে……………….^-^