#শ্রাবণের_ধারা ~(১১ম পর্ব)~
#লেখনীতে_ওয়াসেকা_তাবাসসুম ~
~আজকে আবির আর রাদিফ আসেনি। বুঝলাম না ব্যাপারটা, দুজনে যে তলে তলে কি করছে আল্লাহ ভালো জানেন। গতকাল যেভাবে সিরিয়াস মুডে আলোচনা করছিল মনে তো হচ্ছিলো আজকে কি না কি আছে এমন। অথচ এখন তাদের পাত্তাই নেই। এর মধ্যেই সাজিদ স্যার ক্লাসে এসে হাজির হলেন। ক্লাসে এসেই বই খুলে পড়ানো শুরু করে দিলেন। উনি কথা খুব কম বলেন তবে যখন বলেন কেমন করে যেন বলেন।
ক্লাসে সবাই মনোযোগ দিয়ে পড়া চালিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন বাইরে থেকে অনেক মানুষের কথা শুনতে পেলাম। তবে ঠিক বুঝতে পারলাম না এতো চেঁচামেচির কারণটা কি। এতোক্ষণে ক্লাসের সকলের কানেই আওয়াজ গেছে। সবাই বুঝার চেষ্টা করছি বিষয়টা এর মাঝেই ক্লাসের সামনে দুজন এসে দাঁড়ালেন।
— সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ক্লাসটা এই মূহুর্তে স্থগিত করতে হবে, আমাদের একটু দরকার আছে এখানে। স্টুডেন্টরা সবাই একটু কষ্ট করে ক্লাসের বাইরে চলে যাও।
সাজিদ স্যার ওনাদের দিকে তাকিয়ে মেজাজ দেখিয়ে বললেন,
— আপনারা কারা? আর ক্লাস বন্ধ করার অনুমতি কে দিয়েছে আপনাদের কে?
— সেটা আপনি একটু পরেই বুঝতে পারবেন মি.সাজিদ আগে ওদের ভালো মতো চলে যেতে দিন।
সবাই এক এক করে ক্লাস থেকে বের হতে লাগলো। এদিকে আমি এখনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। জিনিয়াও হা করে তাকিয়ে আছে। আমি ওকে ডেকে বললাম,
— জিনিয়া? এখানে কি হচ্ছে রে?
— আমিও তো বুঝতে পারছি না কিছু। সবাই তো এক এক করে বের হচ্ছে চল আমরাও যাই। এইখানে থাকাটা সুবিধার নয়।
— এতো কিন্তু কোথা থেকে আসে তোর? দেখ সবাই প্রায় চলে গেছে তুই আর আমি বাকি আছি।
সামনে তাকিয়ে দেখি আসলেই সবাই প্রায় বের হয়ে গিয়েছে আমরাই লেট করছি। জিনিয়া তাড়া দিতে লাগল, আমিও ব্যাগ নিয়ে বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হতে লাগলাম। জিনিয়া আমার আগে থাকায় ও বেরিয়ে গেলেও আমি যেতে পারলাম না তার আগেই কেউ পিছন থেকে ধরে ফেলল আমায়। সবটা এতো তাড়াতাড়ি হলো যে আমি কিছু বুঝেও উঠতে পারলাম না। জিনিয়া ঘুরে তাকাতেই আতকে উঠল, সাজিদ স্যার তার পকেট থেকে একটা পি’স্ত’ল বের করে আমার মাথায় ঠেকালেন।
— স্যার কি করছেন আপনি!? ধারাকে ছেড়ে দিন! ওকে যেতে দিন। (জিনিয়া)
সামনে থাকা দুই ব্যক্তি জিনিয়াকে চলে যেতে বললেও জিনিয়া যাচ্ছিল না দেখে ওকে জোর করে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন ওনারা। এদিকে পি’স্ত’ল একদম আমার মাথার সাথে তাক করা। যে কোন সময়ে জীবন চলে যেতে পারে, কি করবো মাথাও কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললাম,
— স্যার আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।
— এই চুপ একদম চুপ! আমাকে ধরতে এসেছে আর ভেবেছে আমি কিছুই বুঝবো না?
সামনে থাকা দুজনও এতোক্ষণে তাদের পি’স্ত’ল বের করে আমাদের সামনে তাক করে বলতে লাগলেন,
— মেয়েটাকে ছেড়ে দে বলছি।
— এতো সহজ? আমাকে বোকা পেয়েছিস তোরা? তোরা যে পু’লি’শ আগেই বুঝেছি আমি। (সাজিদ)
— দেখ ভালোয় ভালোয় ওকে ছেড়ে দে বলছি। চুপচাপ আমাদের হাতে ধরা দে না হলে কিন্তু ভালো হবে না।
— আমার হাতে দেখতে পারছিস? একটা গু’লি বের হলেই শেষ, ওকে বাঁচাতে চাইলে আমাকে যেতে দে। সামনে থেকে সরে যা। (সাজিদ)
— তুই এখান থেকে পালাতে পারবি না। আমরা পুরো ক্যাম্পাস ঘিরে রেখেছি। এখান পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা নেই তোর তাই আমাদের কথা শোন চুপচাপ।
— হাতে যে সুযোগ নেই এমনটাও তো না। যতক্ষণ এই মেয়ের প্রাণ আমার হাতে ততক্ষণ আমার সুযোগ আছে। তাই তোরা আমার…………..
ওনার বলা বাক্য শেষ না হওয়ার আগেই একটা গু*লি এসে সোজা ওনার বাহুতে লাগলো আর সাথে সাথে ওনার হাতে থাকা পি’স্ত’ল পরে গেল আর আমিও মুক্ত হয়ে গেলাম। চারপাশ হঠাৎ কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে, চোখ দুটো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে খালি দেখতে পেলাম আবির আর রাদিফ দৌড়ে আসছে আমার দিকে। তারপরেই হারিয়ে গেলাম এক অজানা রাজ্যে।
————————
চারিদিক মানুষের ছড়াছড়ি, ভার্সিটির আশপাশ দিয়েও পু’লি’শ ঘুরে বেড়াচ্ছে। চোখের পাতাগুলো ধীর গতিতে খুলতে লাগলাম, চোখ মেলতেই পাশে জিনিয়াকে আবিষ্কার করলাম। জিনিয়া আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
— তুই ঠিক আছিস? জানিস কতো ভয় পেয়েছিলাম। তোর যদি কিছু হয়ে যেত? আল্লাহ বাঁচিয়েছেন।
— আমি ঠিক আছি এখন।
জিনিয়ার চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রু, ঝরে পরতে চেয়েও নিজেদের আটকিয়ে রেখেছে। মেয়েটা আসলেই অনেক ভয় পেয়েছিল। এখনো চোখে হালকা ঝাপসা লাগছে, সামনে তাকাতে আবিরকে দেখতে পেলাম। ওর চোখে মুখে চিন্তার ছাপ খেয়াল করলাম। আবিরেরও আমার জন্য চিন্তা হচ্ছিল না কি? এর মধ্যেই রাদিফ এসে হাজির হলো।
— ওরা চলে গেছে।
— কোনো সমস্যা হয়নি তো আর?
— না তবে আমাদের যেতে হবে।
— আচ্ছা ঠিক আছে একটু পরে যাচ্ছি।
— একটু তাড়াতাড়ি কর শ্রাবণ। হাতে বেশি সময় নেই।
কথাগুলো বলে রাদিফ আমার দিকে তাকালো তারপর মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল,
— ধারা তুমি ঠিক আছো তো? কোনো সমস্যা নেই তো?
— হ্যা আমি ঠিক আছি।
— যাক ভালো। তোমাদের সাথে একটা ছোটখাটো জার্নি শেষ করলাম। এতো দিনে কখনো কিছু ভুল বলে থাকলে সরি। ভালো থেকো।
তারপর আবিরের কাঁধে হাত রেখে রাদিফ চলে গেল। ওয়েট! রাদিফ তখন ওকে কি নামে ডাকলো? শ্রাবণ? শ্রাবণ বলে ডাকলো না? কিন্তু ওর নাম তো আবির। মানে কি এসবের? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
— আমি আবিরের সাথে আলাদা করে কথা বলতে চাই।
— কি বলবি এখন? তুই এখনিতেও এখনো পুরোপুরি সুস্থ না। (জিনিয়া)
— ওসব আমি জানি না। আমি আলাদা কথা বলতে চাই আবিরের সাথে।
আবির আমার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর আমার প্রস্তাবে সম্মতি জানালো।
——————-
আবার সেই ভার্সিটির পিছন দিকটায় এসে দাঁড়িয়ে আছি দুজনেই। আমিও কিছু বলছি না আর আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা তো আরো কিছু বলছে না। এদিকে আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো প্রশ্ন যেগুলোর উত্তর আমার এই মূহুর্তে চাই।
— তোমার নাম কি?
— মানে?
— তোমার নাম আবির না কি শ্রাবণ কোনটা?
— তুমি……
— আমি কি? রাদিফ তখন তোমাকে শ্রাবণ নামে ডেকেছে আমি শুনতে পেয়েছি বুঝলে? আর এখানে হচ্ছে কি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে?
— তোমার কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে লাভ আছে বলে মনে হচ্ছে না। এমনিতেও আমার উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেছে।
এরপরে ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল ওর। এইবার যেন ওর চেহারায় কোন রহস্যময় ভাব নেই মনে হচ্ছে নতুন এক মানুষকে দেখছি। যার মধ্যে নেই গম্ভীর সেই ভাব। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার দিকে সেই দৃষ্টির মানে হয়তো সে বুঝতে পারলো। মুচকি হেসে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
— কি ভাবছো ধারা? জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন আমাকে নিয়ে। আর ওই যে আমার নাম জিজ্ঞেস করছিলে না? হ্যা ঠিকই ধরেছো আমার নাম শ্রাবণ। এতো দিন “আবির” আমার একটা পরিচয় ছিল মাত্র যা আসল নয়। মনে আছে তোমাকে একবার বলেছিলাম আমি এখানে একটা প্রয়োজনে এসেছি। এটাই ছিল আমার প্রয়োজন, আর আজকে সেই প্রয়োজন শেষ।
— ঠিক বুঝলাম না। কিসের প্রয়োজন?
— এই ভার্সিটিতে মি.সাজিদ নামে নতুন জয়েন করা শিক্ষক আসলে একজন অপ’রাধী। উনি বে’আই’নি কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন আর ওনার জন্যই আমি এই ভার্সিটিতে এসেছি।
— তুমি…
— আমি একজন এজেন্ট। এখানে সম্পূর্ণ আলাদা একটা পরিচয় নিয়ে আসতে হয়েছে আমাকে। এই কারণে এতো দিন একটা ভিন্ন একটা ব্যক্তিত্ব বহন করেছি। তোমার সাথেও অনেক রুড ব্যবহার করেছি যার জন্য সরি।
— সেদিন রাতে কি করতে এসেছিলে ভার্সিটিতে?
— সাজিদের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ার জন্য ইনফরমেশন ফাইলগুলো চেক করতে এসেছিলাম। সেদিনও তোমার সাথে দেখা হয়েছিল।
— এখন?
— এখন আর কি চলে যেতে হবে আমাকে আবার নিজের আসল পরিচয়তে ফিরে যাওয়ার সময় এসে গেছে।
— এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে?
— এতো সময় নিয়ে তো আমি আসিনি ধারা। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে এসেছিলাম যা শেষ হয়ে এসেছে আর এখন ফিরে যেতে হবে।
— আর এই যে কিছু মানুষের জীবনে নিজের ছায়া রেখে যাচ্ছো তার বেলায়?
— ধারা….
— না আমাকে বলতে দাও, জানো তোমার সাথে কেন জানি না নিজেকে নিরাপদ মনে হয়। হয় তো তোমার ক্ষেত্রে এটা বিশেষ কিছু না তবে আমার নিজেকে তোমার সাথে সেফ মনে হয়। তুমি অনেকবার দূরের থেকে আমার খেয়াল রেখেছো আমি জানি, বুঝতে দাওনি আর দিতেও চাওনি।
— সেসব এমনিই এতে বিশেষ কিছু নেই।
— তোমার কাছে নাই থাকতে পারে।
— তোমার কাছে আছে?
— জানি না তবে তোমার সাথে পথচলা এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে এটা কেন জানি আমি চাই না।
— আর কতদূর যাবো বলো, এত থেকে বেশি দূরে গেলে অনেকটা সময় লেগে যাবে। কিছু কিছু পথচলা এই পর্যন্তই না হয় থাক।
এই বলে সোজা হাঁটা ধরলো শ্রাবণ। তবে এতো তাড়াতাড়ি তাকে যেতে দিতে মন সায় দিচ্ছে না। কিন্তু কেন? হয় তো মনে হচ্ছে একটা নিরাপদ স্থান হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে। মনের কথা শুনলাম আর শ্রাবণকে ডাক দিলাম। আমার ডাকে ঘুরে তাকালো শ্রাবণ তারপর বললাম,
— নিজেদেরকে আরেকটু সময় দেয়া যায় না?
চলবে……………..^-^