#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৬
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে প্রিয়াকে নিয়ে জারিফের মা এসেছেন জুয়েলারির ডিজাইন পছন্দ করতে। পছন্দ হলে বানাতে দিবেন। প্রিয়া আসতে চায়নি কিন্তু তামান্না ও তরুণীমা বেগমের অতি উৎসাহতে মানা করতে পারেনি। তাদের মতে, বিয়ে তোমার পরবেও তুমি তো পছন্দও তোমার হওয়া উচিত। কিছুটা সময় নিয়ে জুয়েলারির ডিজাইন পছন্দ করার পর পুরোনো চেনা কারিগরকে ডিজাইন দেখিয়ে ফিরে এসেছে।
বসন্ত ঋতুর বিদায় প্রহর আসন্ন। এপ্রিল মাসের আজ প্রথম দিন। সামনে প্রিয়াদের ফাইনাল পরীক্ষা আসছে। দিনগুলো খুব দ্রুতই পেরিয়ে যাচ্ছে। সেমিস্টার ফাইনালটা এপ্রিলের শেষ অর্ধে। নিশি, মিমরা প্রিয়ার বিয়েতে কী কী করবে ভেবে ফেলেছে। জারিফের শ্যালিকা হিসেবে তখন জারিফকে নাকা*নিচো*বানি খাওয়ানোর দায়িত্ব ওদের। প্রিয়া ওদের পরিকল্পনা শুনে নিজেও এক্সাইটেড!
“আরে ইয়ার! আমিও তোদের সাথে জয়েন হবো। উনার এক্সপ্রেশন কেনো মিস করব বল! কিভাবে না*কা*নিচো*বানি খায় তা দেখব না? উফ জোস হবে!”
প্রিয়ার এক্সাইটমেন্ট দেখে নিশি, মিমরা হেসে লুটোপুটি খাওয়ার দশা। সাদ রম্যস্বরে বলে উঠে,
“ওকে দোস্ত। তুই বউ সাঁজে আমাদের সাথে গেইট ধরবি। টাকা না দিলে আমরা বান্ধুবী দিবো না। স্লোগান হবে!”
আরেকদফা হাসির রোল। ওদের এই হাসি আড্ডা চলতেই থাকে। ফাইনালের সময় এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, কুইজ, ল্যাব সবকিছুর একটা এক্সট্রা প্যারা থাকে। এতো ব্যাস্ততার মধ্যে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মনে খানিকটা প্রশান্তির হাওয়া বয়।
______
এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে পহেলা এপ্রিল থেকে। মুন্নির চারটা পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সে সেই যে জারিফদের বাড়ি থেকে এসেছে তারপর এইচএসসি পরীক্ষার আগেরদিন তার মামা-মামিকে ফোন করে দোয়া চেয়ে আর কথা বাড়ায়নি। জাবেদ সাহেব তার বোনকে বলেছিলেন বিয়ের ডেটটা ওদের জন্যই মে মাসের প্রথম সপ্তাহের পর রাখছ । ততোদিনে মুন্নির প্র্যাকটিকেল পরীক্ষা বাদে অন্য সব পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু মুন্নি বিয়েতে আসতে চায় না সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে। সে কিছুতেই বিয়েতে আসবে না। সে বিয়েতে আসলে আবার যদি পা*গলামি করে কোনো ব্যাঘাত ঘটায়? এই ভয় নিয়ে মুন্নি মানা করে দিয়েছে তার জন্য বিয়ের তারিখে দেরি করতে। ওদের সুবিধাজনক সময়ে বিয়েটা হয়ে যাক। তাই এখন বিয়ের তারিখ মে মাসের প্রথম কয়েকদিনেই।
মুন্নিকে এখন আর আগের মতো হাসতে দেখে না ওর বাবা-মা। মেয়ের মনের বিষাদ তাদেরকেও আচ্ছন্ন করে তোলে। মুন্নি মনম*রা হয়ে বিকেলের সময়টা ছাদে বসে থাকে। ওদের বাড়িটা দুইতলা আর নিচের তলায় যেই দুই পরিবার থাকে তারা স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকে চাকুরী করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা চাকুরী তাদের। তাই ছুটির দিন ব্যাতিত অন্যসব দিন ছাদে কেউ উঠে না। মুন্নি একাই উঠে। এপ্রিল মাসের প্রথম দিন মুন্নিদের বাড়িতে ওর বাবার খুব কাছের বন্ধুর বড়োভাইয়ের ছেলে এসেছে চাকরিসূত্রে একমাসের জন্য থাকবে বলে। এক মাস পর মেসে উঠবে। ছেলেটার নাম রাদিফ। সে একজন মেকানিকেল ইঞ্জিনিয়ার। রাজশাহী থেকে দিনাজপুর এসেছে। রাদিফ প্রতিদিন বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে ছাদে একটা মেয়েকে খোলা চুলে বসে থাকতে দেখে। সে কেবল মেয়েটির মুখের একাংশই দেখে। মেয়েটি কখনও আকাশের দিকে আবার কখনও অদূরে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। আজ এতোদিন হলো এই বাড়িতে এসেছে সে, সেই প্রথমদিন রাতে খাবারের সময় মিরাজ সাহেব তার একমাত্র মেয়েকে ডেকে এনেছিলেন। সেদিনই প্রথম মুন্নিকে দেখে ও পরিচিত হয় রাদিফ। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত মুন্নির সাথে আর দেখাও হয়নি। ছাদে প্রতিদিন বসে থাকা উদাসী মেয়েটা মুন্নি কিনা সেই ব্যাপারেও সন্দিহান রাদিফ। প্রতিটাদিন দেখে মেয়েটাকে। আজ ভাবলো একবার সেই খোলা চুলের রমণীকে সামনাসামনি দেখতে ছাদে উঠবে। বাড়ির ভেতরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষণ আগে ছাদে উঠলো রাদিফ।
সূর্য অস্ত গেছে এই মাত্র। পশ্চিমাকাশে রক্তিম গোধূলি শেষ আভা ছড়াচ্ছে। ছাদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রাদিফ সেই গোধূলির রক্তিম আলোয় এলোকেশীকে দেখছে। আর মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যে মাগরিবের আজানের সুমধুর ধ্বনিতে কায়নাত মুখরিত হবে। রাদিফ ধীর পায়ের ছাদে প্রবেশ করলো তারপর নিঃশব্দে মুন্নির থেকে এক হাত দূরত্বে দাঁড়ালো। রাদিফ কয়েক সেকেন্ড মুন্নিকে অবলোকন করে বুঝলো মুন্নির ধ্যান নেই এখানে। সে অন্য কোনো অপার্থিব বা সম্মোহিত হয়ে আছে। রাদিফ কিছুটা ধীর কন্ঠে বলল,
“এই সন্ধ্যেবেলায় খোলাচুলে থাকতে হয় না। জানেন না?”
নিরবতার মাঝে কারও কন্ঠস্বরে সজ্ঞানে ফিরল মুন্নি। পাশ ঘুরে এক ঝাপসা পুরুষ অবয়ব দেখল। ঝাপসা দেখার কারণ নিরন্তর আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থীর করে রাখাতে এখন সবকিছু অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। মুন্নি চোখ হাত দিয়ে মুছে নেয় তারপর খানিক চোখ বুজে নিয়ে আবার খুলে। রাদিফ মুন্নির থেকে জবাব না পেয়ে আবারও বলে,
“আর কয়েক মিনিট পর আজান পরবে। এই সময় ছাদে আছেন আবার চুলও এলোমেলো করে খোলা। সময়টা কিন্তু তেনাদের ঘোরাফেরার সময়। এখানরার পরিবেশটাও গাছ-গাছালিতে ঘেরা। এসব জায়গা তেনাদের পছন্দ এমনিতেই।”
মুন্নি এবার রাদিফকে খেয়াল করলো। মস্তিস্কে একটু জোর দিয়ে মনে করতে পারলো রাদিফ তার বাবার বন্ধুর ভাতিজা। মুন্নি মলিন হেসে হেয়ালি করে বলে,
“তেনাদের বলতে যাদের বুঝিয়েছেন, তারা আমার উপর ভর করবে না। এমনিতেই আমার মন-মস্তিষ্কে যা ভর করে আছে তা তেনাদের থেকেও ভয়ংকর।”
রাদিফ বেশ মজা পেলো মুন্নির হেয়ালিপূর্ণ কথায়। রাদিফ ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে আরেক কদম সামনের পাশে এগিয়ে বলল,
“তেনারা ভর করলে তখন বুঝতেন। তখন আর এসব বলতেন না। কিছু আবার প্রেমিকও আছে! যারা রূপবতী কন্যাদের উপর নিজেদের নজর বহাল রাখে চিরকাল। তাই এসময় দাদী-নানীদের কাছে শুনেছি, চুল খোলা রাখলেও মাথায় কাপড় রাখতে হয়।”
মুন্নি হেসে উড়না টেনে মাথায় দিলো। রাদিফও নিঃশব্দে হাসলো। রাদিফ জিজ্ঞেস করে,
“আপনার তো এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। কেমন হচ্ছে পরীক্ষা?”
“জি আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো।”
রাদিফ আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে,
“আপনি সায়েন্স থেকে না?”
“জি।”
রাদিফ ঘার নাড়ালো। মুন্নি আসমানের দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
“আমি তাহলে যাই। এখুনি আজান পরবে।”
“আমিও যাবো। চলুন।”
ওরা ছাদ থেকে নেমে গেলো। একসাথেই বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। মুন্নির মা ওদের দুজনকে একসাথে ঢুকতে দেখে একটু অন্য নজরে তাকালো বটে কিন্তু কিছুটা খুশিও হলো। রাদিফ ছেলেটাকে তার ভালোই লেগেছে। ছেলেটার ব্যাবহারও সুন্দর। মুন্নির সাথে যদি এই কয়েকদিনে একটু ভাব জমে তবে তিনি মুন্নির বাবাকে বলবেন রাদিফের কথা।
রাদিফ নিজের রুমে যেতে যেতে মুন্নিকে বলে,
“কিছু মনে না করলে বিকেলে আমরা একসাথে চায়ের আড্ডা বসাতে পারি। অ্যাই মিন কালকে আমার অফিস একটু জলদি ছুটি হবে। তখন একটা চায়ের আড্ডা তো হওয়াই যায়।”
মুন্নি চোখে হাসলো তারপর বলল,
“কালকে পর্যন্ত যদি অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হয় তবেই।”
রাদিফের কাছে মুন্নির এই বলার ধরণও হেয়ালি লাগলো। মুন্নিতো নিজের রুমের দিকে চলে গেছে। রাদিফও নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।
________
রাতে প্রিয়া একটা টপিক বুঝতে পারছে না। টপিকটা অন্য সাবজেক্টের তাও সে ভাবলো জারিফকে জিজ্ঞেস করবে। এখন জারিফ যদি কিছু মনে করে? সেই দোটানায় আছে। ফাইনাল পরীক্ষার আর সপ্তাহ খানেক আছে। এর মাঝে প্রিয়ার একদিন চোখে এলার্জির কারণে ভার্সিটিতে যেতে পারেনি। সেদিনই সেই স্যার ওই টপিকটা পড়িয়েছে। প্রিয়া চাইলে আয়ানের থেকে বুঝে নিতে পারতো কিন্তু তার তো ভার্সিটিতে গেলে পড়া বোঝার কথা মনেই থাকে না। কিছুক্ষণ ভেবে পরে জারিফকে মেসেজই করলো। প্রিয়ার মেসেজ দেখে জারিফ হোয়াটসএপে কল দিলো। প্রিয়া সালাম দিয়ে বলে,
“আসলে অন্য একটা সাবজেক্টের একটা টপিকটা বুঝতে পারছি না। আপনি কি ফ্রি আছেন?”
“হ্যাঁ। মাত্রই কাজ শেষ করলাম। বলো।”
“ডিনার করেছেন?”
“করব। তুমি বলো।”
“না থাক। আগে ডিনার করে আসেন। তারপর আস্তে ধীরে বলব। যান যান ডিনার করে আসেন।”
জারিফ হেসে ফেলে অতঃপর বলে,
“তুমি ডিনার করেছো?”
প্রিয়া এবার অপ্রস্তুত হয়। কারণ সে তো ডিনার করেনি। সে সন্ধ্যায় নুডুলস আর কফি খেয়েছে। প্রিয়া আমতা আমতা করে বলে,
“রাতে খেয়েছি তো। যান আপনি খেয়ে আসেন। টাটা।”
দ্রুত ফোন কা*ট করে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। পাশে থাকা কুকিজের বয়াম খুলে কুকিজ খেতে থাকে। এই চকোলেট কুকিজ তার অনেক পছন্দের।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,