#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|ষষ্ঠ পর্ব |
আমরা বাঙালিরা যেমন সিনেমাটিক চিন্তায় ডুবে থাকি ঠিক তেমন বাস্তব জীবনকে সিনেমাটিক জীবনের সাথে গুলিয়ে ফেলি। বাস্তবতা যে খুবই কঠিন, ভুলে যাই। তিন রমণীর মধ্যমণি যাবির ভাইয়া। আমি লাজুক হেসে তাকিয়ে। ভাবী, বড়ো মা অবাক চোখে তাকিয়ে। তিনজনের তাকানোতে উনি অস্বস্তিতে পড়ে যান। আমার কোনো দিনকালের খেয়াল নেই। হারিয়ে গেছি দূর অজানায়। ক্ষণিক সময় অতিবাহিত হবার পর যাবির ভাইয়া কেশে জানান দেয়। আমিও তাকাই উনার পানে। ওমা! উনি তো বেশ রেগে! ভাবী, বড়ো মার দিকে তাকালাম। উনাদের দৃষ্টি অন্য কথা বলছে। বুঝতে পারলাম, ভুল স্থানে, ভুল মানুষের সামনে ভুল কথা বলে ফেলেছি। মুখে মেকি হাসির রেখা টেনে ভাবীর উদ্দেশ্যে বললাম, –” কই গো ভাবী, খাইয়ে দাও! এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? ননদ হয়েছি বলে কী ভাবীর হাত থেকে খেতে পারব না?”
মুহুর্তেই স্থান,কাল সব যেন পরিবর্তন হয়ে গেল। ভাবী,বড়ো মা হেসে ফেললেন। যাবির ভাইয়ার মুখখানা দেখার মতো হয়ে গেল। ভাবী মিষ্টির বক্স হাতে নিয়ে খাইয়ে দিলেন। বড়ো মা এই ফাঁকে নাস্তা পানির ব্যবস্থা করতে চলে গেলেন। ভাবী ননদীর আড্ডা শুরু হয়ে গেল। আমাদের গল্পের বিষয়বস্তু ছিল যাবির ভাইয়া। ভাবীর মুখে উনার প্রশংসা শুনে নিজেই ফুলে যাচ্ছি। স্কুল জীবনের দুর্দান্ত ঘটনা বর্ণনা করছেন। ভাবীর বলা ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা ঘটনা এমন ছিল,
–” যাবির ভাইয়া তখন দশম শ্রেণীতে পড়তেন। তিনি স্কুলের সবচেয়ে ভদ্র আর চুপচাপ স্বভাবের ছিলেন। ফুটবল খেলা উনার প্রিয় ছিল। শুক্রবার হলেই নাকি সারাদিন উনাকে পাওয়া যেত না। দূর দূরান্তে চলে যেতেন ফুটবল খেলতে। সেইবার যাবির ভাইয়াদের স্কুলের পাশেই ফুটবল খেলা হচ্ছিল। ভাবীর বাবার বাড়িও সেখানে ছিল। জানালা খুললেই নাকি মাঠ দেখা যেত। পুরো দমে খেলছিলেন যাবির ভাইয়া। এদিকে উনার মা নাকি খুঁজতে খুঁজতে পাগলপ্রায়। শেষে যখন দেখলেন উনি ফুটবল খেলায় ব্যস্ত, তখন পঁচা গোবরের ডোবা থেকে এক বালতি গোবর নিয়ে ঢেলে দেন উনার মাথায়। তাৎক্ষণিক খেলার পরিসমাপ্তি ঘটে এবং উনাকে টেনে ভাবীদের বাসায় ঢুকিয়ে শুকনো ধানের আগাছা দিয়ে ডলে ডলে গোসল করান। ভাবীকে সেদিনই পছন্দ করে ফেলেন বড়ো ছেলের জন্য।”
গোবরের কথা শুনে হাসি আটকাতে পারলাম না। এদিকে যাবির ভাইয়া তখনও আমাদের সাথে বসে আছেন। উনার দৃষ্টি আমার বইয়ের টেবিলের উপর। কী যেন দেখছেন। উঁকি দিয়ে আমিও চেষ্টা করলাম তখনই নজরে আসে গতকালের দেয়া সেই চিরকুট খানায়। আচ্ছা! উনি কী উওরের আশা করছেন? উনার চাহনি কি বলছে? বড়ো মা আবারও চলে আসেন। হাতে তিনটা শরবতের পাত্র। ভাবী এগিয়ে বড়ো মাকে সাহায্য করার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, –” সারাদিনই কাজ করেন? চলুন আপনাকে সাহায্য করি। আপনার চিংড়ির তরকারি সেদিন খুব মজা পেয়েছি। সাহায্য করতে করতে মুখে রান্না শিখেও ফেলবো।”
বড়ো মাকে নিয়ে ভাবী চলে যেয়েও থেমে গেলেন। যাবির ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললেন, –” তুমি বরং বাহিরে চলে আসো। মায়া বিশ্রাম করুক।”
আমার হাসিমাখা চঞ্চল মুখশ্রীতে মুহূর্তের মধ্যেই অমাবস্যার আঁধার নেমে আসলো। মন বলছে উনাকে বলতে, –” তুমি যেয়ো না, আরেকটু থাকো।”
কিন্তু কন্ঠনালী থেকে স্বর আসছে না। ভাবীর কথার প্রত্যুওরে উনি বললেন, –” আচ্ছা যাচ্ছি।
হৃদয় কেঁপে উঠলো। নিজের দিকে অবলোকন করে বুঝলাম, আরো চারদিন ঘরের কোণে বসে থাকতে হবে। উনাকে দেখার বা কন্ঠস্বর শোনার সুযোগ পাবো না। মাথা নিচু করে বসে ভাবছি তখনই কর্ণধারে যাবির ভাইয়ার কর্কশ আওয়াজ ভেসে আসে, –” এমনি এমনি তো আর তোমাকে পড়া চোর বলি না। ঔষধ খেয়েছো?”
ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছি যাবির ভাইয়ার দিকে। অপরাধীদের মতো মুখ লুকাচ্ছি। মাথা দুই পাশে নেড়ে জানালাম খাইনি। উনি আবারো বললেন, –” আমি যেই ঔষধ দিয়েছিলাম সেটা কি করছো?”
–” খেয়েছি।”
–” তাহলে খাওনি বলছো যে?”
কথার প্যাঁচে ফালাচ্ছেন খুব বুঝতে পারছি। মুখ ফুলিয়ে প্রত্যুওরে বললাম, –” বাবা এখনো ঔষধ আনেনি, তাই খাইনি বলছি।”
উনি হয়তো খানিকটা বিরক্ত হলেন যা উনার ভ্রু জোড়ার মাঝে সূক্ষ্ম ভাজ আমাকে জানান দিচ্ছে। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে আজও ট্যাবলেট বের করলেন। ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো আমার। মনে প্রশ্ন জাগ্রত হল, আচ্ছা উনি কী সবসময় পকেটে ট্যাবলেট নিয়ে ঘুরেন? আর কী কী আছে ঐ পুঁজিতে? জিজ্ঞেস করব কী? দেখা গেল আর প্রশ্ন করতে হল না। উনিই উওর দিলেন, –” ভেবো না ঔষধের বস্তা নিয়ে ঘুরে বেড়াই। নিজের জন্য কিনেছিলাম। পুরো পাতা দিবো না। অর্ধেক তোমার আর অর্ধেক আমার।”
ইশ যাবির ভাইয়া কত মিষ্টিভাষী। অর্ধেক ঔষধ না দিয়ে হৃদয় দিলেই তো হয়। আমার রোগ নিরাময় হবে। এক পাতা থেকে পাঁচটা আমাকে কে’টে দিলেন বাকিগুলো পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে বললেন, –” এখান থেকে একটা ট্যাবলেট এখন খেয়ে নাও। বিকেলের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবে।”
যাবির ভাইয়া চলে যাচ্ছিলেন। সেই সময়ে আমার মনে পড়ে সিভিটের কথা। লাজ শরম ত্যাগ করে বলি,
–” আজ সিভিট আনেননি?”
———————
চৈত্র মাসের প্রচণ্ড গরম জনজীবনকে অতীষ্ঠ করে তোলে। ঘর থেকে বের হওয়া যেন কষ্টকর হয়ে পড়ে। বাতাসও মাঝে মধ্যে উধাও হয়ে যায় এসময়। বসন্তও থাকে চৈত্রের বৈশিষ্ট্যও থাকে পুরোপুরি। প্রাকৃতিক নিয়মে চৈত্র তার বৈশিষ্ট্য নিয়েই হাজির হয়। তবু প্রকৃতিই মানুষকে একটু মেঘ একটু শীতলতা দিয়ে স্বস্তি এনে দেয় মাঝে মধ্যে। শুষ্ক ও খরার প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই চলতে থাকে এই মাসটি। চারিদিকে প্রচণ্ড রৌদ্র আর তার উত্তাপে উত্তপ্ত পরিবেশ একটু অসহনীয় হয়ে পড়ে। বেড়ে যায় গরম। বাড়ে মানুষের কষ্ট। নিরূপায় মানুষ অতিকষ্টে দিনগুলো অতিবাহিত করে থাকে। কার সাধ্য যে এই মাসটিকে একটু শীতল করে।
পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ফলাফল প্রকাশিতও হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ ভালো ফলাফল এসেছে। তবে আমার মন খুবই বিষন্ন। বিগত কয়েকদিন যাবত যাবির ভাইয়ার দেখা সাক্ষাৎ নাই। উনি এই এলাকায় আছেন কিন্তু আমার সামনে আসেন না। সকালে আরবি পড়ার পর উনার ঘরে উনাকে পাই না। বিকেলে পড়াতে আসলে মালার ঘরে দরজা আটকে বসেন। নির্ধারিত সময়ের আগেই আবার চলে যান। ভাবীর বাসায় কয়েকবার গিয়েছি। আমার যাওয়ার আভাস পেলে দরজা আটকে বসে থাকেন অথবা কাজের বাহানায় বাহিরে চলে যান। আমার সাথে দেখা না করা কাকতালীয় নয় বরঞ্চ উনি ইচ্ছে করেই করছেন। যাবির ভাইয়ার প্রতি আমার অনুভূতির নাম দিয়েছি ভালোবাসা কিন্তু উনার পক্ষ থেকে কোনো ইঙ্গিত ইশারা পাইনি। তারমানে আমি উনার অপছন্দের তালিকায়। তাহলে দূর থেকে আমার প্রতি এত সতর্কতা কেন? আর কেনই বা আমার যত্ন করেন? চুপচাপ হাঁটছি। আমার মন খারাপ বলে সায়মারও মন খারাপ। তবে আমি জানি সায়মার পেটের ভেতর কথা কিলবিল করছে তাইতো বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। হাঁটা থামিয়ে দাঁড়ালাম। সায়মাও প্রশ্ন বোধক চাহনিতে তাকিয়ে আছে। চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্তির স্বরে বললাম, –” পেটের ভেতর না জমিয়ে বলে ফেল, কি বলবি।”
হাসি ফুটে উঠলো মেয়েটির মুখে। চঞ্চলতায় কি বলবে বুঝে পারছে না। অবশেষ লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করে বলল, –” হ্যাঁ রে মায়া! যাবির ভাইয়ার কী অন্য কোন মেয়েকে পছন্দ হয়েছে? সেদিন দেখলাম একজন মেয়ের সাথে হাঁটছে।”
অন্তরে পীড়া আগে লঘু ছিল কিন্তু এখন বেশি মনে হচ্ছে। আমাকে অবহেলা করার কারণ কী ঐ রমণী? হয়তো। মনক্ষুন্ন হয়ে আবারো হাঁটা ধরলাম। সায়মা বুঝলে পারে আমি কষ্ট পেয়েছি।
–” আমি এভাবে বলতে চাইনি মায়া। তোকে জানালাম শুধু।”
আজ কথা বলার ইচ্ছে নেই। মরে গেছে সব। আমার স্বপ্ন, ইচ্ছা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে চৈত্রের আগমনে। ফাগুন ভালো ছিল। মন কারাপ হলে পলাশ ফুল গায়ে মাখিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারতাম। সায়মাকে বিদায় জানিয়ে শুভ্রপুষ্পে চলে আসলাম।
পলাশ গাছের ডাল দেখা যাচ্ছে। ফুলবিহীন গাছটা দেখে নির্জীব মনে হচ্ছে। আশেপাশে ছায়াদার গাছ তলায় বসে পড়লাম। কান্না পাচ্ছে প্রচুর। মনকে বললাম, –” এই বয়সে এমন হয়, আর ফিরে তাকাবি না।” মনকে মানাচ্ছি ঠিকই তবে নিজে ঠিক আছি? না, চোখ ভর্তি জল কয়েকবার মুছে নিলাম। বক্ষঃস্থলের বাম পাশটায় তীব্র ব্যথা হচ্ছে। হয়তো কান্না আটকে রাখার ফল। বালুর মরুভূমিতে দৃষ্টি রেখে ভাবছি, একসময় এখানেই সবুজ পাতার আগাছায় শুভ্র ফুলের দেখা মিলবে। কপোত-কপোতিরা হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াবে। চৈত্র মাসের কাঠফাটা রোদে পলাশ ফুল ঝড়া অবিশ্বাস্যকর। আমার কোল জুড়ে পলাশ ফুল ভর্তি। ক্ষণিকের ব্যবধানে মনটা ভালো হয়ে গেল। ফুলে হাত বুলিয়ে হাসছি। কাগজের খচখচের মত আওয়াজ হচ্ছে ফুলগুলোতে। নাকের কাছে নিলাম ঘ্রাণ নিতে। ফুলগুলো ভালোভাবে নাড়াচাড়া করে দেখলাম অনেক ফুল কাগজের আর অনেকফুল প্লাস্টিকের। কে দিবে এগুলো? গাছ থেকে তো আর কাগজের ফুল টপকে পড়বে না। পিছনে ফিরে তাকালাম। ফুল দেয়ার মালিককে দেখে আশ্চর্যিত হলাম।
যারিফ ভাইয়া পূর্ব অভ্যাসের মত নিচু হয়ে পাঞ্জাবী দিয়ে মাথা মুছে যাচ্ছেন। হয়তো রোদে মাথার চুল ঘেমে গেছে। ঠোঁটে চমৎকার হাসি। আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। মান হলো খুব। এতদিন অবহেলা করে কেন এসেছেন? মাথা মুছে উনি চলে যাচ্ছেন। অবাক নয়নে দেখছি। আমার উদ্দেশ্যে কি কিছু বলবেন না? ভাবনার মাঝেই উনার স্বর কানে আসে উনি বলছেন, –” আগামীকাল এই সময়ে এখানে থাকবে। শাড়ি পরে আসবে কিন্তু। আসল পলাশ না পাই! নকল পলাশ ফুলে বরণ করে নিবো তোমায়।”
অন্তরে ঝড় সৃষ্টি করে চলে গেলেন যাবির ভাইয়া। রেখে গেলেন বাকরুদ্ধহীন আমাকে। অশান্ত মনকে শান্ত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় বলছি, –” আমি পাগল হয়ে যাবো, আমি পাগল হয়ে যাবো।”
চলবে……
[গল্পটা অনেক বোরিং লাগছে তাই না? ]