#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|পঞ্চম পর্ব |
বাবা, মানুষটার সাথে সকলেই পরিচিত। বাবা যেমন সন্তানের প্রিয় বন্ধু ঠিক তেমন শাসনের দিকে উর্ধ্বে। মেয়েরা বাবার একটু বেশিই প্রিয় হয় বিশেষ করে বড়ো সন্তানেরা।
বাবা তীক্ষ্ম দৃষ্টি আমার হাতের কাগজের উপর। ভয় না পেয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কাগজ ভাজ করে টেলিবের উপর রেখে বললাম, –” পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে। নোটের লিস্ট।”
মিথ্যা বলা মহা পাপ। প্রেমে পড়লে আন্ধের রোগে ধরে। সত্যিই কি তাই! বাবার কাছে মিথ্যার প্রশ্রয় নাই। আমিও বলতে পারি না। আজ বলে ফেললাম। প্রেম যে অন্ধ সেটারও প্রমাণ পেলাম। বাবার হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করেছেন। তাইতো পাল্টা প্রশ্ন করেননি। কাছে এসে বসে রইলেন। পুরো ঘরে নজর ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে আমার দিকে মনোনিবেশ করলেন।
–” তোর মা কোথায়?”
আমি অসুস্থ হয়েছি। আমার কথা জিজ্ঞেস না করে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করছে কেন বুঝলাম না। মা তো নিজের ঘরেই আছেন। কোমড়ের দোহায় দিয়ে শুয়ে আছেন। এমন নয়তো বাবা বড়োমার কথা জিজ্ঞেস করছেন? ভাবতেই চোখ বড়ো হয়ে আসলো। বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখলাম উনি আলনায় থাকা বড়োমার একটা শাড়ির দিকে একমনে তাকিয়ে আছেন। আমার বাবার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মা হয়তো দুই তিন বছরের ছোট হবেন। আমার মার বয়স তার চেয়েও কম তবে দেখে বুঝা যায় ৫৫ বছরের রোগী। বাবার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালাম। প্রত্যুওরে বললাম, –” মা তো নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে?”
বাবা চমকে গেলেন। আমি বাবার চোখের অস্থিরতা পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম।
–” তোর বড়ো মার কথা জিজ্ঞেস করেছি।”
নাম নিতেই বড়ো মা ঘরে এসে উপস্থিত হোন। বাবার সামনে বড়ো মা গম্ভীর রমণী কিন্তু আমাদের সামনে সারাদিন সন্তানের আদর যত্ন করা একজন ব্যস্ত মা। বড়ো মায়ের দৃষ্টি নত, হাতে খাবারের প্লেট। ইতিমধ্যে ভাত মাখিয়ে লোকমা বানাতে শুরু করেছেন। বাবাকে এখনো খেয়াল করেন নি। খুবই তাড়াহুড়ো করছেন। লোকমা বানাতে বানাতে আমার উদ্দেশ্যে বললেন, –” বড়ো বড়ো লোকমা দিবো। গপাগপ খেয়ে ফেলবি। আমি কোন বাহানা চাই না। নে হা কর।”
কত বছর পর বাবা মায়ের উচ্চ আওয়াজে কথা শুনলেন হিসেব নেই। বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখে মুখে মুগ্ধতা। আর বড়ো মা! উনি বিস্ময়কর দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে তো একবার বাবার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। হাতের লোকমা এগিয়ে। বাবা মায়ের ভালোবাসা নাকি দেখতে নেই। তবে আমি এমন পবিত্র সম্পর্ক মুগ্ধ নয়নে দেখছি। যেন চোখে চোখে কথা বলছেন দুজন। মা হাত গুটিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেলেন। মাথার ঘোমটা কিছুটা টেনে নীচু স্বরে বললেন, –” আপনি এখানে?”
বাবার সাথে আমিও বাস্তবে ফিরে আসলাম। আমি জানি বর্তমানে যে কোনো একজন চলে যাবেন এই মুহূর্তে। কিন্তু আমি তা চাইছি না। বাবার হাত ধরি শক্ত করে। এরপর মায়ের উদ্দেশ্যে বলি, –” খাইয়ে দাও মা। আজ বাবা-মেয়ে একসাথে খাবো।”
চমকালেন দুজনেই যা উনাদের দৃষ্টির ভঙ্গিমা দেখে বুঝলাম। আমি কোনো পরোয়া করলাম না। হা করার ভঙ্গিতে রইলাম যেন মা বাধ্য হয়ে খাইয়ে দেয়। হলোও তাই। মা বাবার থেকে একটু দূরে বসে পরম যত্নে খাইয়ে দিচ্ছেন। বাবাকে আজ সুযোগ করে দিলাম মাকে মন ভরে দেখার জন্য। কেননা তাদের দেখা হয় শুধুমাত্র খাবারের সময়ে। আর সেই সময়ে বাবা, বড়ো মা একে অপরজনকে মায়ের আড়ালে আবডালে দেখেন।
দাদীর কাছে শুনেছিলাম বাবা যখন মাকে প্রথম দেখতে যায় সেদিনই নাকি পছন্দ করে ফেলেন। বাবা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করেন নি। দীর্ঘ সাত ঘন্টা হবু শ্বশুর বাড়ি বসে থেকে সেদিনই মাকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছিল বাবা মায়ের সংসারে। বিয়ের চার বছরেও যখন বড়ো মায়ের সন্তান হয় না তখন আমার দাদী কসম কে’টে বাবাকে আরেকটা মানে আমার মাকে বিয়ে করান। এরপর যেন সুখের সংসার অসুখে পরিণত হয়। বছর পাড় হতেই আমার জন্ম হয়। তার দুই বছর পর মালা,মেহেদীর। দ্বিতীয় বিয়ে মানে সাজানো সংসারের সমাপ্তি। তবে বড়ো মার সংসারে সমাপ্তি ঘটেনি। বাবাকে ভালোবাসে আর সন্তানের মা ডাকা শোনার লোভে পড়ে রইলেন এই বাড়িতে। মায়ের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, বাবার কথা শুনে আমার সম্বিত ফিরে আসে। বাবা বড়ো মার উদ্দেশ্যে অনাকাঙিক্ষত একটা কথা বলল, –” আমাকে এবার খাইয়ে দাও ফুলবানু।” বাবার কথা শুনে বড়ো মার হাত,পা কাঁপছে। আমি শুনেও না শোনার ভান করে পানি পান করে বাবার কোলে শুয়ে পড়লাম। সন্তানের সামনে অবাঞ্ছিত আবদারে বড়ো মা লজ্জা পেলেন। আমার দিকে কোণা চোখে তাকালেন। আমি চোখের ইশারায় বললাম খাইয়ে দিতে। মা কাঁপা কাঁপা হাতে খাইয়ে দিলেন বাবাকে। চোখ বন্ধ করে বাবা ভাত চিবুচ্ছেন যেন মায়ের হাতে অমৃতের স্বাদ। মা দাঁড়ালেন না। চোখের কোণা সেই কখন ভিজে গেছে, ঝরা বাকী। মা চলে যেতেই বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, –” তোর বড়ো মা আমার কাছে সেই ফুলবানুই আছে। যাকে প্রথম দেখায় পছন্দ করে ফেলেছিলাম। পরিস্থিতির চাপে আজ আমি অসহায়। তোর বড়ো মা কী আমায় ক্ষমা করতে পারবে?”
আমার আজ বাবার কথার প্রত্যুওরে বলতে ইচ্ছে করছে না। বাবা-মায়ের অসীম ভালোবাসা দেকে মুগ্ধ। আমার অসুস্থের অজুহাতে তো তারা একসাথে কিছু সময় কা’টি’য়ে’ছে এটাই অনেক। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এত ভালোবাসা পেয়েও সুখী নই। বাড়িতে প্রতিনিয়ত ঝগড়া হয়। মা বড়ো মাকে দেখতে পারে না হুকুমাদী করে। পরিবারের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালাম। বাবা হয়তো উনাদের দুষ্টু মিষ্টি পুরোনো কথাগুলো মনে করছেন। কেননা এই ঘর থেকেই তো উনাদের ভালোবাসা শুরু হয়েছিল কোনো একদিন।
—————-
সূর্য উদিত হয়েছে। রোদের প্রখোরতা অনুভব করতে পারছি। শরীর ঘামছে, চোখ জ্বলছে। পরিবেশ আজ খুবই শান্ত। বড়ো মা কী এখনো ঘুমাচ্ছেন? বিছানায় হাতড়ে, পেলাম না। তারমানে উঠেছেন তবে আমার কেন উঠতে ইচ্ছে করছে না! চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম। মিনিট পাঁচেক পর মাথায় হাতের ছোঁয়া পেয়ে চোখ খুলে তাকালাম। ঝাপসা চোখে দেখছি যাবির ভাইয়া হাসিমুখে ডাকছেন আমায়। স্বপ্ন দেখছি, মিষ্টি হাসছি উনাকে দেখে।
হাত বাড়িয়ে দিলাম উনাকে ছুয়ে দেওয়ার আশায়। উনার গালে হাত রেখে বললাম, –” আপনি এসেছেন?”
উত্তরে উনি হেসে বললেন, –” ভাবী আসতে চাইলেন তাই নিয়ে আসলাম।”
ইশ স্বপ্ন এত মধুর হয় কেন? বাস্তবে হতে পারে নে! চোখের সামনে থেকে যাবির ভাইয়ার প্রতিচ্ছবি যাচ্ছেই না তাই উনাকে বললাম, –” আমাকে একটা চিমটি কা’টে’ন তো!”
উনি তাই করলেন। দুই গাল ধরে খুব জোরেই টান দিলেন। এক প্রকার চিৎকার করে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। স্বপ্ন নয়, সত্যি উনি এসেছেন। আমাকে উঠতে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, –” পড়াশোনা না করে সারাদিন এসব চিন্তা করো তাই না! এজন্যই তো পরীক্ষায় গোল্লা পাও।”
–” আপনি তো খুব নির্দয় মানব! অসুস্থ মেয়েকে বকছেন?”
–” বকবো নয়তো কী করব। আদর?”
–” হ্যাঁ!”
মুখ চেপে ধরে রাখলাম। আজকাল বাঁচাল রোগে ধরেছে। যাবির ভাইয়া নির্লজ্জের মতো হাসছেন। আমি অসহায় দৃষ্টিতে শুধু অবলোকনই করছি। ইতিমধ্যে বড়ো মা ভাবীকে নিয়ে ঘরে আসেন। আমাকে দেখে ভাবী খুব আফসোস করে বলেন,–” আহারে আমার নাদুসনুদুস ননদিনীটা। কোমড়ে ব্যথা পেয়ে বেঁকে বসেছে।”
সামনের মানুষটার সামনে এমন কথা না বললেই নয় কি? শুকনো একজন মেয়েকে নিয়ে উপহাস, মানা যায়? ভাবীর হাতে বক্স ছিল। যাবির ভাইয়া সেই বক্স আমার হাতে দিয়ে বললেন, –” মিষ্টি পছন্দ না তোমার! এখানে টাটকা রসগোল্লা আছে। সব তোমার। খাওয়া শুরু করো।”
মিষ্টি মানুষের কন্ঠস্বরে মিষ্টি কথা! আমি যেন অন্য এক জগতে চলে যাচ্ছি। লাজুক হেসে দিক বৈদিক না ভেবে প্রত্যুওরে বলি, –” আপনি খাইয়ে দেন তবে।”
বোম ফাটানো কথা শুনে উপস্থিত মা,ভাবী একসাথে বলে উঠে, –” কী?”
চলবে…….