#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|চতুর্থ পর্ব |
লজ্জায় লাজরাঙা হয়ে চোখ ঢেকে রেখেছি। আমিই সবসময় বিব্রত পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। আজও হলাম। যাবির ভাইয়ার কাশি অনেক আগেই বন্ধ হয়েছে। উনি বর্তমানে আমার সামনে ভেজা গেঞ্জি পরিবর্তন করছেন। অবশ্য আমার চোখ ঢাকা আছে, লাজ আছে বটে। এমনি এমনিই মানুষের উদর দেখার ইচ্ছে নাই। শ্যাওলা রঙের পাঞ্জাবী পরেছেন যা আঙুলের ফাঁকে দেখতে পেলাম। টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে পান করে নিলেন। কিছুক্ষণ পূর্বের বলা কথা আবারো পুনরাবৃত্তির করে বললেন, –” দিনে দিনে দেখছি বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো। আমি তখন ঐভাবে না বললে তো মে’রে’ই ফেলতে।”
চোখ থেকে হাত সরিয়ে ফেললাম। আমার লজ্জা পাওয়াটা বৃথা গেলো। আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার দ্বারা অশালীন কাজ সম্ভবই না। নিজেকে সংযত করে বললাম, –” ছোটদের সামনে বাজে কথা না বললেই নয়?”
–” কে ছোট, তুমি?”
এত বড়ো অপমান। আমি যে ছোট, সাহেবের চোখে পড়ে না বুঝি! মান হলো খুব। মুখ ফুলিয়ে প্রত্যুওরে বললাম, –” আপনার চোখে কি ময়লা জমেছে? আমি তো ছোটই। মাত্র নবম শ্রেণীতে পড়ি।”
যাবির ভাইয়া হাসছেন। ছেলেরা সুদর্শন হলে নাকি হাসলে সুন্দর দেখায়। বয়সের তুলনায় উনি একটু বেশিই রোগা। খাবারের অনিয়ম করে বেশি তাইতো। হাসি থামিয়ে টেবিলের কাছে গেলেন। কিছুক্ষণ আগে রেখে দেওয়া কাগজ বইয়ের ভাজ থেকে বের করে সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, –” ছোট বাচ্চারা কী প্রেমপত্র লিখে বেড়ায়?”
চোর ধরা পড়লে যেমন সুযোগ খুঁজে পলায়নের জন্য আমিও তেমন সুযোগ খুঁজছি। যাবির ভাইয়া এখনো হাসছেন আগের ন্যায়। বিছানার তোষক উল্টিয়ে কিছু খুঁজছেন। সুযোগ বুঝে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। পিছন থেকে শুনতে পেলাম উনি বলছেন, –” যেয়ো না মায়া! তোমাকে কিছু দেখানোর আছে।”
—————–
ছুটির ঘণ্টা বেজেছে সাথে সকলের মনের ঘণ্টাও। দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষার রুটিন দেওয়া হয়েছে। ভালো ছাত্রীদের মনে আনন্দের দোলা খাচ্ছে আর আমার মত টেনেটুনে পাশ করা ছাত্রীদের মনে দুঃখে ধরাম ধরাম ড্রাম বাজছে। কারণ, বড়ো মার হাতে রুটিন তুলে দেওয়ার পর পরই আমার বাহিরে যাওয়া বন্ধ করে দিবে। সকালে মক্তবের অজুহাতে যাবির ভাইয়াকে দেখা হবে না দুই মাসের মত। ভাবতেই চোখ ভর্তি পানি টুঁইটুঁই। সায়মা পরীক্ষামূলক অনেক কথাই বলে যাচ্ছে এই যেমন, আজ বাসায় গিয়ে সে সর্বপ্রথম দৈনিক পড়ার রুটিন তৈরি করবে, প্রতিদিন কোন কোন বিষয়ের কোন কোন অধ্যায় শেষ করবে ইত্যাদি। আমার যে চিন্তা নাই তেমন না। পড়াশোনা সবারই প্রয়োজন ছেলেদের তুলনায় মেয়েদেরও। বর্তমানে শিক্ষা ছাড়া কোন মূল্যবোধ নেই। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড কথাটা ভুল নয়। একজন শিক্ষিত ব্যক্তির মর্যাদা অনেক। যে কোন স্থানে সম্মানের আসনে থাকে। কিছু কিছু ছাত্র-ছাত্রী কোনরকম পাশ করতে পারলেই বাঁচে আমি তাদের মধ্যে একজন। সায়মার কথা থামছেই না। মনে হচ্ছে, আজ সে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছাত্রী হয়ে গেছে। রেগে পিঠে আঘাত করে বললাম, –” আজ বাসা থেকে কী খেয়ে বের হয়েছিস? এত কথা আসছে কোথায় থেকে?”
–” তোর কী হয়েছে শুনি? চিন্তায় মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়েছে নাকি? পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে। তোর তো খুশি হওয়ার কথা। ভাই-বোনের মাস্টারের কাছে এই সুযোগে পড়তে পারবি।”
–” পড়া না ছাই। বাসায় আসলে ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারি না। রেগে গিয়ে চোখ দুটোকে রসগোল্লার মত বড়ো করে রাখে। যেন সে বাঘ আর আমি পিঁপড়ে।”
আমি আর সায়মা রাস্তায় হাঁটছিলাম। আমার কথা শুনে সে দাঁড়িয়ে গেলো। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উচ্চস্বরে হাসতে লাগল যেনো আমি মজার কথা বলেছি। রাগ হলো খুব। পায়ের কাছে পেপসির বোতল ছিল। রাগে লাথি দিলাম। সায়মা হাসতে ব্যস্ত ছিল আর এর মধ্যেই অঘটন ঘটে গেলো। বোতলের কিছু না হলেও আমার হয়েছে। সমতল শুকনো স্থানে পা পিছলে পড়ে গেলাম। হাস্যকর হলেও কোমড়ে প্রচুর ব্যথা পেয়েছি। সায়মা ভ্যাবলাকান্তের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। উপস্থিত বুদ্ধি লোপ পেয়েছে তার। ব্যথায় আর্তনাদ করছি এমন সময় বলিষ্ঠ এক জোড়া হাত এসে আমার কোমড় আঁকড়ে ধরে। আমার সম্মুখে সায়মা অবাক চোখে মুখে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। সায়মার দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে ফিরে তাকালাম। যাবির ভাইয়া আমাকে ধরেছেন এবং পিছনে উনার বড়ো ভাইয়া চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। লজ্জায় নতজানু হয়ে উনার হাতের উপর হাত রাখলাম। অজানা অস্বস্তির স্বীকার হলাম। আমার স্পর্শে তার কী হয়েছে জানি না, হাত সরিয়ে নিলেন। হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমার অস্বস্তির কারণ! দুই হাতে ধরে উঠাতে চেষ্টা করছেন। গভীর নয়নে উনার চোখ,মুখের ভাবগতি লক্ষ্য করছি। চিন্তিত আঁখিদ্বয় ছোট হয়ে রয়েছে, ভ্রু জোড়া কুঁচকে কপোলে ভাঁজ পড়েছে। ঠোঁট কামড়ে রেখেছেন। মনে মনে হাসলাম। চিন্তা মুখখানা কী আমার জন্যই নাকি সবার জন্য? প্রশ্ন করলাম না। ইতিমধ্যে উনি আমাকে দাঁড় করালেন। চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে প্রশ্ন করলেন, –” বেশি ব্যথা পেয়েছো?”
যাবির ভাইয়ার মুখশ্রী নিয়ে ভাবছিলাম। উনার প্রশ্নে আনমনে উওরে বললাম, –” আপনার ছোঁয়ায় এখন ব্যথা পাচ্ছি।”
ছেড়ে দিলেন হাত। আবারো আর্তনাদ করে উঠলাম। এবার সায়মা আমাকে ধরে রাখল। পাশ থেকে যাবির ভাইয়ার বড়ো ভাই মাহমুদ ভাইয়া বলেন, –” বাসায় যেতে পারবে?”
প্রত্যুওরে মাথা নাড়িয়ে হাঁটা ধরলাম সায়মার সাহায্যে। কোণা চোখে দেখতে পেলাম যাবির ভাইয়া চিন্তিত নয়নে আমায় দেখছেন। আমাদের এলাকায় রিকশা চলাচল খুব কম। জনসম্মুখে অবিবাহিত পুরুষের কোলে চড়াও দৃষ্টিকটু। যাবির ভাইয়া আবারো এগিয়ে আসলেন। পকেট থেকে দুইটা ট্যাবলেট বের করলেন। একটা আমার অতীব পরিচিত সিভিট, অন্যটা অজানা। উনার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করলাম। বুঝতে পারলেন হয়তো। আমার হাতে ট্যাবলেট দিয়ে বললেন, –” এখানে একটা ব্যাথার ঔষধ, অপরটা সিভিট। আগে ব্যথার ঔষধ খাবে, এরপর মুখে তিতা লাগলে সিভিট পুরে দিবে।”
পাল্টা প্রশ্ন করতে দিলেন না। ধপাধপ পায়ে হাঁটা ধরলেন বড়ো ভাইয়ার সাথে।
————
পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন হলো মা। মায়ের সাথে কারোর তুলনা হয় না। সায়াহ্নের সময়ে বিছানায় শায়িত হয়ে বড়ো মার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছি। পরীক্ষার রুটিন টেবিলে স্কচটিভ দিয়ে আটকে দিলেন। কলাম করে বইগুলো সাজিয়ে রাখলেন। পাশে প্রয়োজনীয় খাতা,কলম,পেন্সিল। যেন আজই পরীক্ষা দিতে চলে যাবো। মায়ের চিন্তার অন্ত নেই। আমার কাছে এসে কপোলে,গলায় হাত রেখে জ্বর আসছে কি না পরিমাপ করেলেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, –” আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, তোর জ্বর আসেনি। ব্যথা আছে এখনো?”
–” হ্যাঁ।”
–” বোস, আগুন ধরিয়ে রেখে এসেছি। মাটির পাতিলে করে কয়লা নিয়ে আসি। হালকা আগুনের গরম ছ্যাঁ’কা খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”
বড়ো মা বরাবরই আমার চিন্তা বেশি করেন। আমাকে বকতে বকতে চলে গেলেন। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। আমার ভাবনায় শুধু একজনই আসে আর তিনি হচ্ছেন যাবির ভাইয়া। উনার চিন্তিত চেহারা চোখে ভাসছে। দুপুরে ব্যথায় ঔষধ খেলেও সিভিট খাওয়া হয়নি সেটা এখন আমার হাতে মুষ্টিবদ্ধ। আদরের দেওয়া জিনিস শেষ হতে নেই। ফুরিয়ে গেলে পাওয়া দুষ্কর। কারোর পদচারণের আওয়াজে চোখ খুলে তাকাই। মেহেদী এসেছে। বাহিরে উঁকিঝুঁকি মেরে আমার কাছে এসে বসে বলল, –” আপা, আজ স্যার তোমার কথা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে।”
বিস্ময় ভর করলো চোখে। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। ভুল শুনছি না তো! মেহেদী পকেট থেকে কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে আবারো বলল, –” তোমাকে চুপি চুপি দিতে বলেছে। ঘুষ হিসেবে চারদিনের বাড়ির কাজ বন্ধ। হে হে দারুণ না!”
পিটপিট চোখে তাকিয়ে রইলাম শুধু। বড়ো মার আসার আভাস পেয়ে কাগজ লুকিয়ে ফেললাম। মেহেদীও ততক্ষণে নড়েচড়ে বসেছে।
–” দেখি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে যা তো, মায়া? আগুনের গরম ছ্যাঁকা দিলে আজ রাতের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবি।” আগুনের সরঞ্জাম সাজিয়ে নিলেন। মেহেদীকে এই সময়ে আমার ঘরে দেখে বললেন, –“কিরে মেহেদী, পড়া বাদ দিয়ে এখানে কি করছিস?”
–” আপাকে দেখতে আসলাম। কোমড় ঠিক আছে কি না যাচাই করতে হবে না! দুলাভাইয়াকে বলতে হবে না! অল্প বয়সে তার বউ কেমন ধুরতুরে ছিলো?”
উড়ন্তপাখি অথবা উড়চন্ডী অথবা চঞ্চল বলা সাজে। তাই বলে ধুরতরে! চোখ গরম করে তাকালাম। মালার মতো মেহেদীও ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে যেতে বলল,
–” চোখ গরম দেখাচ্ছো? বলে দিবো কিন্তু।”
–” কি বলবে রে,মায়া?”
বড়ো মায়ের কথায় মেহেদীর থেকে ধ্যানচ্যুত হলাম। কথা ঘোরানোর জন্য প্রত্যুওরে বললাম, –” কিছু না মা! কোমড়ে কি করবে করো। ব্যাথা করছে।”
অতীব যত্নে কোমড়ে কাপড়ের সাহায্যে গরম ছ্যাঁ’কা দিচ্ছেন। আরামে আঁখিদ্বয়ে ঘুম চলে আসছে। তবে আমার ঘুমোলে চলবে না। মন উসখুস করছে কাগজে কী লিখিত আছে তা পড়ে দেখার। মাকে বাহানা করে বললাম, –” ক্ষুধা পেয়েছে। আলু ভর্তার সাথে গরম ভাত খাবো।”
সন্তানের মুখের কথা মায়ের সামনে বের হতে দেরী হয় কিন্তু সেই খাবার হাজির হতে দেরী হয় না। বড়ো মা আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে চলে গেলেন।
অন্তরে ডিপডিপ আওয়াজ হচ্ছে, হাত কাঁপছে, অনুভূতিরা দলা পাকিয়ে উঠছে। উৎসুক মন,তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি। ভয়ে কাগজ খুলছি না। যদি অপ্রত্যাশিত কিছু লিখা থাকে তাহলে কি আমি সইতে পারবো? হয়তো! চোখ বন্ধ করে কাগজ খুললাম। দৃশ্যমান হলো গোটা গোটা অক্ষরের তিনটা শব্দ। ” কেমন আছো, মায়া?”
উওরে কী বলব, ভালো আছি? আমি তো বর্তমানে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছি তার তিন অক্ষরের বার্তা দেখে। এ রোগ নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত সুস্থ হতে পারব না।
–” তোর হাতে এটা কী, মায়া?”
কর্ণধারে কথাটা আসতেই চমকে তাকাই। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বলি, –” তুমি?”
চলবে….