#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২২
“তোর কিছু হবে না আরুপাখি। অপূর্ব আহসান তোকে এভাবে সবসময় আবদ্ধ করে রাখবে। ডোন্ট ওয়ারি।”
এরুপ কথায় বেশ অবাক হলাম। মাথা তুলে অপূর্ব ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তার শক্তপোক্ত চোয়ালের কারণে মুখশ্রী দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেল। সরে আসার চেষ্টা করে বললাম, “অপূর্ব ভাই, ডাক্তার কিছু বলেছে?”
“বলেছে তো! তুই প্রেগন্যান্ট নয়।”
ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। জ্বলজ্বল করল চোখের মণি। চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলাম। মিথ্যা অপবাদ থেকে আমি মুক্তি পেয়েছি। কেউ আমাকে কটুক্তি করতে পারবে না। তাহলে এগুলো কীসের লক্ষণ ছিল? ভয়ংকর কিছু ঘটবে না তো আমার সাথে। সন্দিহান গলায় বললাম,
“কী বলেছে?”
“সেটা নাহয় তোর অজানা রয়ে গেল। যেদিন এই অবস্থা থেকে আমি তোকে ফিরিয়ে আনতে পারব, সেদিন বলব কেমন? এখন চুপ করে থাক।”
চুপ করে থাকলাম। কারো মুখে কোনোরুপ বুলি নেই। রোদ্দুরের তেজ বেড়ে চলেছে। মাথা ঘুরছে। অপূর্ব ভাইয়ের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। সরে এলাম। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে বললাম, “নিন ধরুন। ব্রাশ করে আসুন। রাতে খাননি। আপনার জন্য আমিও অভুক্ত। ক্ষুধা লেগেছে।”
আমি নিজের ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে বারান্দা গেলাম ব্রাশ করতে। অপূর্ব ভাই ওয়াশরুমে ঢুকলেন। যেতে যেতে বললেন, “আমি জেনারেল ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি। তিনি অন্য একজন গাইনী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবে। কালকের খাবার ভালো আছে কি-না চেক কর। ভালো হলে হালকা গরম করে নিয়ে আয়। খেয়ে বের হবো।
তুই তৈরি হয়ে থাকিস। ফিরে এসে তোকে নিয়ে যাবো। এক্সরে করতে হবে।”
“এক্সরে কেন করতে হবে?”
মুখ ভর্তি পেস্ট থাকার কারণে প্রশ্ন করতে ব্যর্থ হলাম। উঁকি দিয়ে নিচে ফেলে মুখ খুলব। ততক্ষণে অপূর্ব ভাই ওয়াশরুমে ঢুকে গেছেন। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে খাবারের প্যাকেট নিয়ে ছুটলাম রান্নাঘরে। বেসিনে মুখ ধুয়ে নিলাম। অতঃপর গরম করতে ব্যস্ত হলাম।
__
বিদ্যালয়ে প্রথম পা রাখতেই অনুভূতির দোল খেয়ে গেল। অপূর্ব ভাই বের হওয়ার পরপরই ছুটে এসেছি। আজ তাড়াতাড়ি এসেছি। তুর বলছে ক্লাস টিচার ছুটিতে আছে কয়েকদিনের। এই সময়টা মিস্ করা ঠিক হবেনা। চঞ্চল পায়ে এগিয়ে গেলাম তুরের হাত ধরে। সেদিনের যেই ক্লাসের সামনে তন্বি আমাকে হোঁচট খেয়েছিল। সেখানে আসতেই তন্বি-কে দেখতে পেলাম। কঠিন তার দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে হাসি। দেখেও না দেখার ভঙ্গিমা করে এগিয়ে গেলাম। তন্বি পেছন থেকে ডাকল, “এত তাড়া কীসের? ঘণ্টা দিতে দশ মিনিট বাকি আছে। তবে আমার মনে হয়না, তুই আজকের পর থেকে এই স্কুলে আমাদের সাথে পড়তে পারবি।”
চঞ্চল পা জোড়া ধীরে ধীরে গতি হারিয়ে ফেলল। তুর ও আমি একত্রে পেছনের দিকে তাকালাম। পিছিয়ে তন্বির সমুখে দিয়ে দাঁড়ালাম। কঠিন গলায় বললাম, “সমস্যা কী তোর? আমার পিছু কেন পড়ে আছিস? লজ্জা লাগেনা, নিজের প্রতি ঘেন্না লাগে না? বে’হায়া মেয়ে। আমি পাত্তা দেইনা তবুও আমার সাথে কথা বলতে আসিস কেন?”
ততটা গম্ভীর হল না। তবে থমথমে হল পরিস্থিতি। কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “আমার সমস্যা তোর অপূর্ব ভাই। আমার সাথে প্রেম-প্রেম খেলা খেলে এখন তোকে বিয়ে করে নিয়েছি। বিয়ের আগে সন্তানের মা করে ফেলেছে। তুই এতদূর এগিয়ে গেছিস এজন্য আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। বে’হায়া নি’র্লজ্জ তুই।”
নাক কুঁচকে বললাম, “আমার আর অপূর্ব ভাইয়ের বিয়েতে তোর জ্ব’লছে তন্বি? জ্ব’লুক! বেশি করে।
এন্ড ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, আ’ম নট প্রেগন্যান্ট। ওকে!”
তন্বি কিস্তিমাত দিল। তবে তেমন কিছু বলে না। শান্ত হয়ে যায়। বন্ধুদের নিয়ে ক্লাসে চলে গেল। আমি তুর একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে নির্দ্বিধায় ক্লাসের দিকে অগ্ৰসর হলাম। পেছনের বেঞ্চিতে বসলাম। আজ স্যার আসেনি। নিশা ম্যাম এসেছে। ক্লাসে ম্যাম প্রবেশ করার সাথে সাথে তন্বি ম্যামের কানে কানে ফিসফিস করে কিছু বলে। অবিলম্বে ম্যাম আমার দিকে তাকায়। পরক্ষণেই ধপাধপ পায়ে হেঁটে প্রস্থান করলেন। তন্বির মুখে তখন বিশ্বজয়ের হাসির রেখা। বোঝা গেল ভয়ংকর কিছু করেছে। একটু পর দত্তরি এলেন। আমার ডাক পড়েছে অফিস রুমে। আমি একাই গেলাম সেখানে। প্রিন্সিপাল স্যারের কক্ষে। ম্যাম বসে আছেন। অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করলাম। স্যার বসতে বললেন। ‘শিক্ষকদের চেয়ারে বসা’ – মোটেও ভালো চোখে দেখা হয়নি। কুণ্ঠা নিয়ে বাঁধ সাধলাম। অগত্যা বসতে হল। স্যার প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, “শরীর কেমন আছে আরু?”
স্মিত হেসে জবাব দিলাম, “জি আলহামদুলিল্লাহ।”
“বিয়ের পরের সংসার কেমন চলছে? সব ঠিকঠাক আছে?”
ফেকাসে হয়ে গেল মুখশ্রী। স্যারের নিকট পৌঁছে গেছে বিয়ের কথা। নতজানু হয়ে জবাব দিলাম, “ভালো।”
কড়া নাড়ল দরজায়। পিছু ফিরে বাবাকে দেখতে পেলাম। এখন বাবার আগমনের কারণ জানতে ব্যর্থ। বেশ চমকে গেলাম। বাবা আমাকে দেখে বেশ চমকালেন। পাশে বসলেন। ইতস্তত নিয়ে বললেন, “হঠাৎ আমাকে জরুরি তলব করেছেন। কোনো সমস্যা হয়েছে স্যার?”
স্যার দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, সমস্যা হয়েছে। শিক্ষকমন্ডলী এবং কতৃপক্ষ মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কীভাবে যে বলি?”
“সমস্যা নেই স্যার, বলুন।”
দু’কাপ চা নিয়ে হাজির হলেন দত্তরি। বাবা আর আমাকে খেতে দিলেন। কেউ মুখে তুললাম না। স্যার থমথমে গলায় বললেন, “আরু ভালো ছাত্রী। পড়াশোনায় ভালো, আচার-আচরণ ভালো। সব ঠিকঠাক কিন্তু ওকে আমাদের স্কুলে রাখতে পারছি না। দুঃখিত।”
বজ্রপাতের মতো আঘাত হানল কর্ণপথে। কেন আমাকে বের করে দিবে? আমার পড়াশোনা এখানেই কি থেমে যাবে? কিন্তু কেন? নত গলায় প্রশ্ন করলাম, “স্যার আমার অপরাধ?”
“বিয়ের আগে ছাত্রী প্রেগন্যান্ট। আমাদের স্কুলের বদনাম হচ্ছে। কীভাবে ধামাচাপা দিবো? বলেন। অনেক ছাত্রীরা এসে জানিয়েছে গেছে। অভিভাবক এসে অভিযোগ করেছে। তোমাকে টি.সি না দিলে তারা চলে যাবে। আমরা বাধ্য। এগেইন স্যরি।”
চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ল। আমি যে প্রেগন্যান্ট নই, কথাটা ভেতরে রয়ে গেল। কীভাবে বলব বুঝতে পারলাম না। মহিলা হলে যেত, পুরুষের সাথে কথাটা শোভা পায় না। আমি নত হয়ে থাকলাম। অপূর্ব ভাই-কে অত্যাধিক প্রয়োজন এই মুহূর্তে। স্যার টি.সি দিয়ে দিলেন। রিকশায় বাড়িতে ফিরলাম। বাবা মাথায় হাত রেখে শুধু বললেন, “চিন্তা করিস না মা, যা হয় ভালোর জন্য হয়। বেবীটা পৃথিবীতে আসুক। আগামী বছর তোকে অন্য স্কুলে ভর্তি করে দিবো নে।”
বাড়িতে এসে বালিশে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলাম। এক এক করে সবকিছু বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে আমার থেকে। প্রিয় জিনিসগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে আমার সাথে? দরজা খোলার শব্দ পেলাম। না তাকিয়ে মুখ গুজে বসে থাকলাম বালিশে। অপূর্ব ভাই এসেছেন। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “স্কুলে গিয়েছিলি? সকালে বলেছিলাম না, ‘ডাক্তারের কাছে যাবো’ শোন, আর স্কুলে যাবি না। আগে সুস্থ হয়ে নে। বাড়িতে ফিরে তোকে খুঁজতে খুঁজতে আমি আধম’রা হয়ে গেছি। কোথাও পেলাম না।”
কান্নার আওয়াজ একটু বেড়ে গেল বৈ-কি। অপূর্ব ভাই একটু থমকে গেলেন। দ্রুত বিছানায় বসে জিজ্ঞেস করলেন, “আরু কী হয়েছে, কাঁদছিস কেন?”
আমি প্রত্যুত্তর না দিয়ে কেঁদে গেলাম। তিনি ধমকে উঠলেন, “কী জানতে চাইছি, কানে যাচ্ছে না?”
ফট করে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। হতবুদ্ধ হলেন। গালে হাত দিয়ে নরম গলায় বললেন, “স্যরি, কী হয়েছে বলো আমাকে। তবুও কাঁদিস না।”
বলতে পারলাম না। গলায় পেঁচিয়ে গেল। হেঁচকি উঠে গেল। অপূর্ব ভাই পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। আমি পানি পান করলাম। উপায়হীন হয়ে ব্যাগের চেন খুলে এগিয়ে দিলাম টি.সি। আড়চোখে তাকিয়ে ধরলেন তিনি। ভ্রু কুঁচকে বললেন, “কী এটা?”
গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। রাগান্বিত হয়ে বললেন, “তোকে টি.সি কেন দিয়েছে আরু?”
মৃদু স্বরে বললাম, “আমি বিয়ের আগে প্রেগন্যান্ট, তাই। স্যার তাদের স্কুলে আমাকে রাখবেন না। তাতে তার স্কুলের ব’দনাম হবে।”
ভ্রু কুঁচকে বললেন, “স্যার জানল কীভাবে তুই প্রেগন্যান্ট? তুই তো প্রেগন্যান্ট ন। কালকে নিজেই তুই সেই প্রমাণ পেলি। তাহলে?”
“আমি লজ্জায় বলতে পারিনি অপূর্ব ভাই। বাবা আর স্যার তারা আমার গুরুজন। গুরুজনের সামনে কীভাবে বলব?”
অপূর্ব ভাই ফুস ফুস করছেন। ভয়ংকর রেগে আছেন তিনি। ঘরে কিছুক্ষণ পদচারণ করলেন। অতঃপর টেবিলের উপর থেকে রিপোর্ট নিলেন একহাতে। ফট করে আমার হাত শক্ত করে ধরলেন অন্যহাতে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “আর লুকোচুরি নয়। সবার সবটা জানার সময় এসেছে।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]