#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
||পর্ব: ০৮||
“আরু, মাঝরাতে কাশা-কাশি করে আমার ঘুমের বারোটা না বাজিয়ে উপরে এসে শুয়ে পড়। বাইরে অনেক ঠান্ডা পড়েছে। জ্বর এলে মা আমাকে পিটুনি দিবে। সো কুইক।”
প্রথম দিকের কথাগুলো ঘুম মিশ্রিত কণ্ঠে বললেও শেষ বাক্য ঘুমের রেশ ছিলনা। আমি দ্রুত চাদর বালিশ নিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। বরফের রাজ্য থেকে বেরিয়ে এসেছি। অপূর্ব ভাই পুনরায় তন্দ্রা বিলাসে ব্যস্ত। তুর সোফার ছোটো হয়ে শুয়েছে। প্রকট শরীরের ভাঁজগুলো। আমি ধীরে ধীরে তুর-কে ডাক দিলাম। তুর একবার তাকাল। বিছানায় শোয়ার জন্য বললাম। সে ভালোভাবে না তাকিয়ে হুরমুড়িয়ে ছুটে এলো। একদম মাঝখানে হাত পা ছুঁড়ে শুয়ে পড়ল। বিছানার উপর দিয়ে সাইক্লোন বয়ে গেল। অপূর্ব ভাই ধরফরিয়ে উঠে বসলেন। আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, “আমি তোকে শোবার অনুমতি দিয়েছি, ওকে নয়। বিদেশে থাকতে আমাকে প্রচুর জ্বালিয়েছে। ওর তখন অনেক ছোটো। ভয় পেত। একটা ঘরে আমি আর তুর থাকতাম। বড়ো একটা বিছানায় আমার জায়গা হতো না। মাঝরাতে সাইকেল চালাতো। ক্ষুধা লেগেছে বলে জ্বালাতে থাকত ততক্ষন খাবার না পাবে।”
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। অপূর্ব ভাই তাহলে আমাকে অনুমতি দিবেন না। তুর যদি বিছানায় থাকে, অপূর্ব ভাই শোবার জায়গা পাবেনা। তারচেয়ে আমি সোফায় ঘুমায়। আর তো মাত্র কয়েকঘণ্টা। আমি সোফার দিকে এগিয়ে গেলাম। মাঝপথে অপূর্ব ভাই ডেকে বললেন, “তোকে কি এখন নিমন্ত্রণ করে বিছানায় আসতে বলবো?”
“ওটা নিমন্ত্রণ নয়, আমন্ত্রণ হবে। আমন্ত্রণ আর নিমন্ত্রণ আলাদা।”
“এত জ্ঞান দিতে পারিস, আমাকে না দিয়ে পরীক্ষার সময় খাতায় দিতি। অন্তত ফেল আসত না, যত্তসব।”
আমি মুখ ফুলিয়ে বিছানায় বসলাম। একটুখানি জায়গা আছে। সেঁটে শুয়ে পড়লাম। তুরের একার দোষ কেন দিবো, আমারও ঘুমাতে অনেক জায়গা লাগে।
একটু পরপর তুর আমার দিকে এগোচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মাঝে বিরক্ত লাগছে। আমি সেঁটে যাচ্ছি বিপরীত দিকে। একসময় ঠাস করে নিচে পড়ে গেলাম। কোমরে হাত দিয়ে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে ঘুমন্ত তুরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ক্ষতগুলো জোড়ালো হয়ে গেছে। রাতে মলম লাগাইনি। ইচ্ছে করছে ওকে ফেলে দেই। আমি হাত বুলাতে বুলাতে সোফায় বসলাম। কী এক ঝামেলা। গলায় ঠান্ডা স্পর্শ পেলাম। গন্ধ পেলাম মলমের। অপূর্ব ভাই মলম এগিয়ে দিলেন। পুরো ডানহাতে লাগিয়ে দিলেন। আরাম লাগছে। গালে হাত রেখে বললেন, “বেশি লেগেছে?”
চাপা হেসে বললাম, “একটু লেগেছিল, সেরে গেছে। তবে গন্ধটা বাজে। মাথা ধরে যাচ্ছে।”
“সবকিছুর আলাদা একটা গন্ধ থাকে। এর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। একটু পর মিলিয়ে যাবে, ঠিক হয়ে যাবে। বিছানায় আয়।”
.
ভাঙাচোরা শব্দ পেয়ে তন্দ্রা ব্যাঘাত ঘটল। নিভু নিভু চোখে উঠে বসলাম দ্রুত। ঝাপসা চোখে অপূর্ব ভাই-কে দেখতে পাচ্ছি। ভিশন রেগে আছেন তিনি। পাশে তুর বসে আছি। আমি ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম রাগার কারণ, তুর জানাল তার নিজেরই জানা নেই। অপূর্ব ভাইয়ের পড়নে কালো জিন্স আকাশি শার্ট। ঘরের জিনিসপত্র ভাঙাচোরা। ভয়ংকর রেগে আছেন। আমার দিকে এগিয়ে এলেন। বামহাত চেপে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “তন্বির ফোন নাম্বার দে আমাকে। আজকে ওর একদিন আর আমার যে কয়দিন লাগে। মাটিতে পুঁতে রেখে দিবো আজকে। তাড়াতাড়ি নাম্বার দে।”
ভাষা হারিয়ে ফেললাম। ভয়ে শরীর জড়োসড়ো। কয়েকদিন তন্বির সাথে ভালোবাসা করে এনে ফোন নাম্বার চাইছে। অস্ফুট স্বরে বললাম, “আপনার কাছে তন্বির নাম্বার নেই।”
“দেবো কানের নিচে এক চড়। বত্রিশটা দাঁত হাতে চলে আসবে, সাথে তিন দিন ঘুরতে থাকবি। আমাকে তোর পাবলিক টয়লেট মনে হয়, সবাইকে জায়গা দিয়ে থাকব।”
মাথা নিচু করে চুপ থাকলাম। বালিশের তলা থেকে ফোন এগিয়ে দিলাম। চার্জের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে। বিদ্যুৎ শেষ রাতে এসেছে। আমি লাফ দিয়ে মানতি ফ্লাক্সের কাছে গেলাম। চার্জার পিন ফোনে লাগালাম। একটু চার্জ হলেই খোলা যাবে। অপূর্ব ভাই এমন কাজে বেজায় বিরক্ত। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “অপূর্ব ভাই, আপনি এতো রেগে আছেন কেন?”
“রেগে থাকব না কেন? তোর তন্বি বান্ধুরন্নী কালকে ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। সাথে একটা সুইসা’ইড নোট লিখেছে, আমি না-কি ওকে প্রেমে দাগা দিয়েছি। একবার সামনে পাই, ওকে..
এজন্য কিশোরীদের সাথে প্রেম করতে নাই।”
মনটা একটু বিষাদময় হল। হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয় বৈ-কি! তন্বি আমার ছোটো বেলার বন্ধুবী। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে পরিচয়। অপূর্ব ভাইয়ের অনেক গার্লফ্রেন্ড। অনেকের সাথে টাইমপাস করে, নতুন কিছু নয়। শুধু শুধু ও কেন ম’রবে। আমি ওকে বুঝাবো। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে জড়তা কাটিয়ে বললাম, “অপূর্ব ভাই আপনি জানলেন কীভাবে?”
“তোর মনে হয় আমি ঘাসের মুখ দিয়ে চলি। কিছুদিন আগে তন্বির পাড়ায় একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছিল। সে জানিয়েছে।”
ফট করে বললাম, “আমাকে আপনার সাথে নিয়ে যাবেন?”
ফিসিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, নেবো না কেন? তোর জন্যই তন্বি আমার ঘাড়ে উঠেছে। জেলে গেলে তোকে নিয়েই যাবো। তোর বোকা বোকা ভাবে জেল কর্তৃপক্ষের মাথা নষ্ট হলে, যদি একটু ছাড়া পাওয়া যায় আর-কি।”
পাঁচ পার্সেন্ট চার্জ দেখা যাচ্ছে। ফোন খোলা গেল। আমি তন্বির নাম্বার দিলাম অপূর্ব ভাই-কে। অপূর্ব ভাই কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন।
বৃষ্টির পরে প্রকৃতির শান্ত। আকাশ ঝরঝরে। গাছ গাছালিতে থাকা ধূলোকণা বিদায় নিয়েছে। সবুজে ঘেরা চারপাশ। রাস্তাঘাটে কোথাও কোথাও পানি জমেছে। দেখতে দেখতে হাসপাতালের সামনে চলে এলাম। সিএনজি থামল। ভাড়া মিটিয়ে আমি আর তুর নেমে দাঁড়ালাম। শো শো করে সিএনজি ছুটে গেল। সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে অগ্ৰসর হলাম। লিফ্টে আমার প্রচণ্ড ভয়। থার্ড ফ্লোরের কাছাকাছি আসতেই ভাওয়াল শুনতে পেলাম। অপূর্ব ভাইয়ের গলা শোনা গেল। আমি তুর-কে নিয়ে সেদিকে গেলাম। তন্বির বাবা মায়ের সাথে অপূর্ব ভাই-কে দেখলাম। সাথে কয়েকজন ছেলে। সবার হাতে লাঠি। ডাক্তারও আছেন। থামানোর প্রচেষ্টা করছে, কিন্তু অপূর্ব ভাই তো অপূর্ব ভাই। তাকে কি থামানো যায়?
অপূর্ব ভাই বেঞ্চিতে আঘাত করে বলছেন, “আমার নামে পুলিশি মামলা? যারা এই সাহস দেখিয়েছে তাদের সবাইকে ধোলাই করে তারপরে জেলে যাবো।”
ডাক্তার বলেন, “পেসেন্ট আপনার নাম লিখেছে চিরকুটে। আমরা কী করতে পারি?”
“আপনিও দেখছি ওর সাপোর্ট টানছেন। তরুণী হলে মানা যেতো। ও একটা কিশোরী মেয়ে, কিশোরী বয়সে মেয়েদের মন থাকে গিরিগিটির মতো। যখন তখন রং বদলায়।”
ডাক্তারের মনে ধরল কথা। পড়লেন গভীর ভাবনায়। অপূর্ব ভাই পুনরায় বললেন, “দুই-তিনটা ওষুধ খেলে মানুষ ম’রে না। তাল হুস থাকেনা, কিন্তু বেঁচে থাকে।”
অপূর্ব ভাই হুরমুরিয়ে ঢুকে গেলেন কেবিনে। যেখানে ভর্তি আছে তন্বি। পাশের টেবিলে আঘাত করলেন স্বজোরে। লাফিয়ে উঠে বসল তন্বি। লাঠি উঁচিয়ে বলে, “আমার জন্য ওষুধ খেয়েছিস তাইনা, ওষুধ না-খেয়ে ছাদ থেকে ঝাঁপ দিতি। চল আজ তোকে ছাদ থেকে ফেলে দিবো।”
অপূর্ব ভাই সাবধানতা অবলম্বন করে স্যালাইনের ক্যানেল বিচ্ছিন্ন করলেন। তন্বির হাত ধরে উঠানোর প্রয়াস করলেন। এই প্রথম স্বচোখে তন্বি-কে স্পর্শ করতে দেখি। একটু মন খারাপ হয়। তন্বি দ্রুত অপূর্ব ভাইয়ের পা ধরলেন। কেঁদে কেঁদে বললেন, “আমি আর কখনো এমন করব না।”
“কান ধর।” সংক্ষেপে বলেন। তড়িগড়ি করে কান ধরে তন্বি। অপূর্ব ভাই বলেন, “উঠ-বস কর দ্রুত।”
তন্বি উঠ-বস করতে লাগল। অদূরে দাঁড়িয়ে হেসে কুটিকুটি হচ্ছি আমরা। “কী দিলো, পুরো এক’শ টাকা কিলো। হি! হি! হি! এই খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলনা। বাড়িতে যেতে সুদে আসলে উসুল করল।
হাসপাতালে নিচে অপূর্ব ভাইয়ের সাথে দেখা হল। সকালে না খেয়েই বেরিয়ে এসেছি। এখানে ছোটোখাটো একটা রেস্তোরাঁয় গেলাম। কয়েকটা টেবিল ছাড়া কিছু নেই। অপূর্ব ভাই প্রথমবার জিজ্ঞেস করলেন, “কী খাবি তুই? সেদিন তোর কথা না শুনে আমাকে প্রচুর বকেছিল মা। এবার সেই রিক্স নিতে ইচ্ছুক নই।”
“সেদিন বাদাম খেয়ে আমার শিক্ষা হয়েছে। বাদাম ছাড়া সব খেতে পারব।” সংক্ষিপ্ত জবাব।
অপূর্ব ভাই উচ্চশব্দে হেসে উঠলেন। লজ্জায় রাঙা হলাম। মা সেদিন সব ফাঁস করেছেন। মাথা নিচু করলাম চটজলদি। আমার জন্য সমুচা আর কোক অর্ডার দিলেন। তাদের জন্য পরোটা ভাজি। পাঁচ মিনিটের পূর্বে হাজির হলাম। আমি সমুচা কামড় দিতেই চিৎকার করে উঠলাম। গালে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সমুচা প্রীজে রেখে ছুটে গেলাম পেছনের দিকে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]