শৈবলিনী পর্ব ১০

0
1004

#শৈবলিনী—১০
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★র্র্যাম্প শোতে ডিজাইনার পোশাক পড়ে ক্যাট ওয়াক করছে সুশ্রী রমনী আর সুদর্শন যুবকেরা।হল জুড়ে রঙ বেরঙের লাইটের আলো পড়ছে সর্বত্র। ব্যাকগাউন্ডে মিউজিক বাজছে, মিউজিকের তালে র্র্যাম্পের ওপর এঁকেবেঁকে হেঁটে এক এক করে মডেল এসে তাদের পোশাকের প্রদর্শন করে আবারও চলে যাচ্ছে। সবার শেষে এলো শোর মেইন এট্রাকশন শো স্টপারের পালা। র্র্যাম্পে এলো আদিত্য, পরনে তার রয়াল ব্লু রঙের সুট প্যান্ট, হাতা কাটা সুটের ওপরে আরেকটা লং সুট। যা হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঝুলে আছে। মুখে অমায়িক হাসি ঝুলিয়ে হেঁটে এলো র্র্যাম্পের সামনে। করতালিতে মুখরিত হলো চারপাশ। এরপর ডাকা হলো এসব পোশাকের ডিজাইনার আবিরকে। আবির হাসিমুখে এলো র্র্যাম্পে। আদিত্যর পাশে এসে দাঁড়িয়ে সবাইকে ধন্যবাদ স্বরূপ হাত নাড়ালো।

শো শেষে হলো, আফটার পার্টি। পার্টি শেষ হতে হতে রাত প্রায় বারোটা বেজে গেলো। বাকি মেহমান প্রায় সবাই ঘরমুখো হয়েছে। আবির ততক্ষণে অ্যালকোহলের অফার ডোজ নিয়ে নিয়েছে। জোস জোসে আদিত্যও আজ অনেকটা ড্রিংক করে ফেলেছে। জিদানও কম যায়না। আবিরের পামে পড়ে সেও আজ নাক পর্যন্ত ড্রিংক করে ফেলেছে। ড্রাংক হয়ে সোফায় আবিরের পাশে হেলে বসে আছে। আবির জিদানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–তো জিদান মিঞা, র্র্যাম্প শো কেমন লাগলো বললে নাতো?

জিদান ঢুলুঢুলু কন্ঠে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল আর তর্জনী আঙুল মিলিয়ে গোল করে দেখিয়ে বলল,
–সুপার হয়েছে স্যার। কিন্তু স্যার আমার একটা প্রশ্ন আছে। আপনি বেছে বেছে এতো গরীব মডেল কেন এনেছেন?

–তোমার কেন মনে হলো তারা গরীব?

–গরীবই তো, তাদের শরীর দেখলে মনে হয় জন্মের পর তাদের খাবারের সাথে সাক্ষাৎ হয়নি। বেচারারা জনমভুখিনী। শো করার আগে তাদের একটু কিছু খেতে দিলে ভালো হতো।গরীবেরে একবেলা খাওয়াইলে তারা দুহাত তুলে দোয়া করতো আপনার জন্য।

আবির হো হো করে হেঁসে উঠলো। জিদানের গাল টেনে দিয়ে বলল,
–ইউ আর সো কিউট জিদান মিঞা।

জিদানে লজ্জায় গদগদ হয়ে বলল,
–আমার মাও তাই বলে স্যার। আসলে সব ওই ফেয়ার এন্ড লাভলীর যাদু।

–তবে তুমি ঠিকই বলেছ। এবার থেকে আমি গরীব মডেল না,ধনী মডেল আনবো। যেগুলোর পেট এক একটা তেলের ড্রাম হবে। একজন হাঁটলেই যাতে র্র্যাম্পে ভূমিকম্প এসে যায়। চিকন মডেল দিয়েতো সবাই র্র্যাম্প শো করায়। এবার নাহয় কিছু ভিন্নধর্মী করবো কী বলো।

–জি স্যার। আচ্ছা স্যার, সুন্দরী মডেল গুলো র্র্যাম্পে গটগট করে এসেই আবার চলে যায় কেন? চোখের সামনে আরেকটু বসে থাকলেও তো পারে।

–এটা হলো ধৈর্যের পরিক্ষা বুঝেছ? মানে তারা বোঝাতে চাইছে এগুলো সব মোহ মায়া। যা ক্ষণিকের জন্য আসে।

কথার মাঝে আবির খেয়াল করলো আদিত্য বারের সামনে বসে হাতে থাকা অ্যালকোহলের গ্লাসের দিকে কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। আবির উঠে এগিয়ে গেল আদিত্যর কাছে। ওর সামনের উঁচু টুলে বসে আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলল,
–কিরে কী ভাবছিস এতো? আর গ্লাসের দিকে এমনে তাকাই আছোস ক্যান? এর মধ্যে থেকে কী আলাদীনের জ্বিন বের হবে, যে তোর তিনটে উইশ পূরণ করবে?

আদিত্য মাতাল কন্ঠে বলল,
–আই উইশ এমনটাই হতো। আমার তিনটে উইশের দরকার নেই। শুধু একটা উইশ পূরণ করলেই হবে। আমার নূরকে এনে দিতে পারলেই হতো। আমার আর কিছু চাইনা। জানিস ও না আমাকে অনেক জালায়। সবসময় সবজায়গায় এসে হাজির হয় ও। জানিস সেদিন আমার হৃদপিণ্ড চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। আবার বদের মতো আমার হৃদপিণ্ড দিয়ে খেলছিলো।

–কস কী মামা! তোর কেসতো একেবারে সিরিয়াস পর্যায়ে চলে গেছে।

–তাহলে আর বলছি কী! শুনেছি ড্রিংক করলে নাকি মানুষ সব ভুলে যায়। কিন্তু দেখ এতো ড্রিংক করলাম তাও শুধু ওর চেহারাই চোখের সামনে ভাসছে। ওই রাগী রাগী চোখের নজর, ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ওই আঙুল নাচানো, ওই রাগে লাল হওয়া গাল দুটো। সবই যেন থ্রিডি সিনেমার মতো চোখের সামনে ভাসছে। জানিস ওকে নিয়ে ভাবতেও আমার ভালো লাগে। ওর সবকিছুই আমার ভালো লাগে।এতো ভালো কেন লাগে ইয়ার! মা বলে কোনো কিছু বেশি দেখলে নাকি নজর লেগে যায়। ওরও যদি আমার নজর লেগে তখন কী হবে? এক মুহূর্তের জন্যেও ওর কথা মাথা থেকে যায়না। যেন কেউ সুপার গ্লু আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে।

–সুপার গ্লু না ইয়ার। এটা হলো পিরিতের আঠা। পিরিতি কাঁঠালের আঠা,লাগলে পরে ছাড়েনা। তুই তো শেষ, খাল্লাস।

–কিন্তু নূরের তো সেই আঠা লাগেনি।ওতো আমাকে দেখতেই পারেনা। ওকে কীভাবে পিরিতের আঠা লাগাবো? এই ঢাকায় কোথায় কাঁঠাল গাছ আছে রে? চল গাছ থেকে আঠা নিয়ে ওকে লাগিয়ে দেই। তাহলে ওরও পিরিতের আঠা লেগে যাবে। তখন দুজনের আঠা মিলে এক হয়ে যাবে।

–চিন্তা করিসনা।তোর এই ভাই আছে কীসের জন্য! আমি কালই সার্চ কইরা বাইর করবো কোথায় কাঁঠাল গাছ আছে। আরে আমার ল্যাংটা কালের বন্ধুর লাভ স্টোরি বলে কথা। দরকার হলে অনলাইন অর্ডার করবো আঠা। তাও তোদের জোড়া লাগিয়েই ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এটা আমার বচন,আর আমার বচনই আমার শাসন।

আদিত্য আবেগে আপ্লূত হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
–থ্যাংকস ইয়ার। জানিস আজকে ওকে ত্রিশ দিনের চ্যালেঞ্জ দিছি। বলেছি এই ত্রিশ দিনে ওর মনে জায়গা করতে না পারলে, ওর সামনে আর কখনো যাবোনা। কিন্তু আমার ভয় করছে। যদি ত্রিশ দিনেও ওর মনে যদি কোনো জায়গা করতে না পারি তখন কী করবো আমি? ওকে যে আমার চাই-ই চাই আবির। এই কয়দিনেই আমি বুঝে গেছি, নূরকে ছাড়া বাঁচতে পারবোনা আবির। হ্যাঁ হয়তো নিঃশ্বাস চলবে, তবে এই আমি বলতে আর কিছু থাকবেনা । দেখ, ওকে হারানোর কথা ভাবতেও আমার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওযে আমার সবকিছুতে কব্জা করে নিয়েছে। তোর ভাইযে নূরকে ছাড়া নিঃশেষ হয়ে যাবে আবির।

কথা বলতে বলতে কেমন গলা জড়িয়ে এলো আদিত্যর। আবির অবাক হয়ে দেখছে আদিত্যকে। আদিত্যর এই রুপ সে আগে কখনো দেখেনি। ওর বন্ধু যে কখনো কাউকে এতোটা চূর্ণ হয়ে ভালোবাসবে তা ভাবনার বাইরে ছিলো। নূরকে না পেলে যে আদিত্যর কী অবস্থা হবে তার আভাস পাচ্ছে আবির। আদিত্যকে স্বাভাবিক করার জন্য আবির হাসিমুখে বলে উঠলো।
–আরে সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য কারোর মনে জায়গা করতে পারবেনা এইটা কোনো কথা হলো! আরে তুই চাইলে তো ক্যাটরিনা, আলিয়া ওদের জামাইকে ইঁদুর মারা বি,ষ খাইয়ে তোর কাছে ছুটে আসবে। সেখানে নূর কী জিনিস।

আদিত্য মাতলামো কন্ঠে বলল,
–কিন্তু আমারতো নূরই চাই। নূরকে না পেলে আমি সাগরে ঝাপ দিবো।

–কিন্তু সাগরে ঝাপ দিলে তো তুই মরতে পারবিনা।

–কেন?

–ক্যান শুনিস নি? প্রেমের মরা জলে ডোবে না।

বলেই হো হো করে হাসতে লাগলো আবির। আদিত্য বিরক্তির সুরে বলল,
–ছিহ্ ইয়ার, এরচেয়ে বেহুদা জোক্স জীবনে শুনিনি। তোর সেন্স অফ হিউমারে পচন ধরছে। চিকিৎসা করা। আমি বন্ধু দেখে হজম করে গেলাম। অন্য কেউ হলে এমন ফালতু জোক মারার দায়ে এতক্ষণে তোর পেছনে জোঙলি কু,কু,র ছেড়ে দিতো। পুরো নেশাটাই কাটিয়ে দিলি। এখন যাইগা, থাক তুই।

আদিত্য কোট টা হাতে এলোমেলো পায়ে এগুলো । জিদানও ছুটলো তার পিছে। আবির পেছন থেকে বলতে লাগলো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ যা,আরে তুই কী বুঝবি আমার জোক্স! এসব লেজেন্ডদের ব্যাপার স্যাপার। সাধারণ ব্যক্তির মাথায় ঢোকেনা। আর তোর তো এমনিতেই প্রেমে পড়ে মাথা-মুন্ডু, কলিজা, ফোপরা সব মিক্সড জেলী হয়ে গেছে। এইজন্যই এইসব কাঁঠালের আঠা টাইপ ভালোবাসা থেকে আমি হাজার মাইল দূরে থাকি। আমিতো শুধু প্রাকটিক্যালে বিশ্বাস করি। অনুভূতির কোনো ক্যাচালই নাই। ওইযে ওই ঘড়ি ডিটারজেন্টের অ্যাডভারটাইজে বলে না,পেহলে ইস্তেমাল কারো ফির বিশ্বাস করো। আমিও এই পলিসি মেনে চলি।

আদিত্যর রেখে যাওয়া গ্লাসের ড্রিংক টা এক ঢোকে খেয়ে নিলো আবির। চেহারায় কাঠিন্য ভাব এনে বলল,
–বিকজ ফর মি, দিস কাইন্ড অফ লাভ ইজ নট এগজিস্ট। ইটস অল বুল শিট!
__

আজও অমালিয়া বাসায় ফেরেনি। রাত এগারোটা বেজে গেছে তবুও ওর ফেরার নাম নেই। তারওপর আবার ফোনও ধরছেনা। আজকে তো নূরেরও ভীষণ রাগ হচ্ছে। মেয়েটা দিনদিন কেমন বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। ও বুঝতেই পারছেনা বাস্তবতা কতো কঠিন। এভাবে অবুঝের মতো চলাফেরা করলে যেকোনো সময় বিপদে পড়তে পারে। আমার মতো ও এতটা স্ট্রং না। দুনিয়ার কঠিন ক্রুরতার সাথে ও লড়তে পারবেনা। কিন্তু এই মেয়ে সেটা বুঝতেই পারছেনা। আজকে একটু কড়া শাসন করতেই হবে।

রাত বারোটা প্রায়, তখন অমালিয়া বাড়ি ফিরলো। পড়নে তার আগের তুলনায় একটু বেশিই মডার্ন ড্রেস। ইভান তো আগে থেকেই রেগে ছিলো। অমালিয়ার এই অবস্থা দেখে সে আরও রেগে গেল। তবে বড়ো বোনের সামনে আগেই কিছু বললো না সে । নূর অমালিয়ার সামনে গিয়ে কড়া গলায় বলল,
–লিয়া,কী শুরু করেছিস তুই হ্যাঁ? কোন ভদ্র ঘরের মেয়েরা একরাতে ঘরে ফেরে? আর এসব কী ধরনের পোশাক? দিনদিন কী তুই নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছিস?

অমালিয়া তিক্ত স্বরে বলল,
–ও প্লিজ আপু। এগুলো এখনকার ফ্যাশান। তুমি বুঝবেনা।

–আচ্ছা তাই নাকি! এসব অশালীন ড্রেস পড়ে রাত-বিরেতে বাইরে পার্টি করা যদি ফ্যাশন হয়ে থাকে তাহলে এমন ফ্যাশনের গুল্লি মারি । তুই জানিস এভাবে চলতে চলতে একদিন কতবড় বিপদে পড়তে পারিস।

–কী এক কথাই প্রতিদিন বলো শুধু। আমি কী এতটাই বোকা নাকি? আর আপু সবকিছুতে এতো ওভার রিয়্যাক্ট করা বন্ধ করো প্লিজ। আমি এখন আর ছোট নেই। নিজের ভালো মন্দ নিজে বুঝতে পারি। এখনকার যুগের সাথে মিশে না চললে লোকে গেয়ো ভুত বলে। তুমি কী করে সেটা বুঝবে? নিজেকে তো ছেলে বানিয়ে রেখেছ।নিজেকে দেখেছ একবার? কে বলবে তুমি একজন মেয়ে মানুষ? আমাকে তো আমার বন্ধুরা খেপায় তোমাকে নিয়ে। তোমার জন্য হাসির পাত্র হতে হয় আমাকে। কতোটা লজ্জায় পড়তে হয় তুমি কী করে বুঝবে। নিজেতো হাসির পাত্র হয়েই আছো, এখন আমাকেও তোমার মতো জোকার বানাতে চাও?

কথা শেষ হতে না হতেই গালে সজোরে এক থাপ্পড় এসে পড়লো অমালিয়ার। চড়টা নূরের মা মেরেছে। ইভানও রাগে কাঁপছে। মা না মারলে সে নিজেই আজকে অমালিয়াকে চরম শিক্ষা দিয়ে দিতো। লতিকা বেগম থাপ্পড় মেরে ক্রোধিত কন্ঠে বলল,
–লজ্জা করে না তোর? এসব কথা বলতে একবারও তোর বিবেকে বাঁধলোনা? হ্যাঁ আমার মেয়ে ছেলে হয়ে গেছে । কিন্তু কেন হয়েছে? এই তোদের কারণেই হতে হয়েছে ওকে ছেলে। আমাদের সবার জন্য হতে হয়েছে ওকে ছেলে। ওকে তুই জোকার বলছিস? আরে ও ছেলে না হলে আমাদের সবাইকে জোকার হয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করতে হতো। সেই দশা ঠেকাতেই আমার মেয়ে ছেলে হয়েছে। নিজের জীবনের আনন্দ আহ্লাদ ভুলে আমাদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছে। আজ যদি ও ছেলে না হতো তাহলে তোদের পড়াশোনা, এই নতুন ফ্যাশনের কাপড়, এই বন্ধুদের সাথে আড্ডা এগুলো কোথায় পেতি তুই? তখন কোথায় থাকতো তোর স্টাটাস? বল? আজ খুব কথা বলতে শিখেসিছ তাইনা? নূর যদি তোর মতো শুধু নিজের কথা ভাবতো তাহলে আর তুই এসব কথা বলার মতো অবস্থায় থাকতিনা। এতদিনে হয়তো টাকার জন্য নিজের শরীর…..

এবারে নূর ওর মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
–ব্যাস মা, চুপ করো এখন। কী বলছ এসব? ওর সাথে তুমিও কী অবুঝ হয়ে গেলে নাকি?

অমালিয়া তিরস্কার করে নূরের উদ্দেশ্যে বলল,
–এখন থামাচ্ছ কেন? এটাই তো চাচ্ছিলে না তুমি? এখন খুশিতো? যাও আনন্দ করো।

বলেই অমালিয়া দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। ইভান রাগী কন্ঠে বলল,
–দেখেছ আপু,এই মেয়ের মাঝে কোনো অনুতপ্ত নেই। শুধু একটা চড়ে হবেনা। ওকেতো ভালোমতো শাস্তি দিতে হবে। ছুট দিতে দিতে মাথায় উঠে গেছে একেবারে। কেমন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।

নূর শান্ত সুরে বলল,
–হয়েছে, আর কিছু করতে হবে না। তুই যা শুয়ে পড়।

ইভান চলে গেলে নূর ওর মাকেও গিয়ে শুয়ে পড়তে বললো। লতিকা বেগম ছলছল চোখে তাকিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
–তুই ওর কথায় কষ্ট পাস না মা। ওকে আমি শাসন করে দিবো।

–আরে ধুর মা কিযে বলোনা! আমি কী ছোট বাচ্চা নাকি যে, এসব ছেলেমানুষী কথায় মনে কষ্ট পাবো। লিয়া এখন টিনেজার। আর এই বয়সে ভালো মন্দের বুঝটা ওদের থাকেনা। তুমি চিন্তা করোনা সব ঠিক হয়ে যাবে। যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো।

মাকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজের রুমে পা বাড়ালো নূর। উপরে নিজেকে যতোই শক্ত রাখুক। ভেতরে যে তারও একটা কষ্ট নামক জিনিস হয়।বিশেষ করে সেটা যখন কোনো আপনজন দেয়। যাদের জন্য নূর খুশি খুশি নিজের জীবনও দিয়ে দিবে, তারাই যখন আঘাত করে তখন আঘাতের যন্ত্রণা যে তারও হয়৷ যদিও সেই যন্ত্রণা ধামাচাপা দেওয়ার কাজটা সে খুবই সন্তর্পণে করে ফেলে নূর। ওরযে মন খারাপ হওয়ার অনুমতি নেই। রুমে এসে লাইট না জ্বালিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল নূর। টিমটিম করতে থাকা তারাটার পানে তাকিয়ে জোরপূর্বক মুচকি হেঁসে বলল,
–আরে বাবা, তুমি কেন মুখ বেজার করে রেখেছ? তোমার মেয়ে একদম ঠিক আছে। তুমি তো জানোই তোমার মেয়ে সবচেয়ে স্ট্রং। এখন সুন্দর করে একটু হাসোতো।এইতো আমার লক্ষী।জানো বাবা, আজ তোমাকে অনেক মিস করছি। ছোটবেলায় আমার জন্য তোমার গাওয়া সেই গানটা খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। আজকেও একটু ওই গানটা গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবে আামকো?
♬ হাঁটি হাঁটি পা, মিঠি মিঠি মন
রাজকুমারীর ঘুম যায় যায়,
খেলনা বাগান, চরকির গান
বটের ঝুরি বেয়ে আয় আয়।
সোনার কাঁঠির পাশে
ওই ময়না মতির ঘর,
ঘুম সোহাগী গালের তিলে
জোছনার আদর।

আয় খুকু আয় ঘুম আয় রে
চাঁদ মামা দিয়ে যায় টিপ,
আয় খুকু আয় ঘুম আয় রে
রাত পরী চাঁদ তারা টি।।

কে ছুঁলো রূপসায়রের জল
রাজকন্যা পাবে কি অতল,
রাজকুমার উড়িয়ে পক্ষীরাজ
এক রঙিন ঘুম এনে দে আজ।

রুপোর কাঁঠির কাছে
ওই নিদমহলের গান,
কোন অজানা চোখের আলো
ভাসালো সাম্পান।

আয় খুকু আয় ঘুম আয় রে
চাঁদ মামা দিয়ে যায় টিপ,
আয় খুকু আয় ঘুম আয় রে
রাত পরী চাঁদ তারা টি।

নিজেই গুনগুন করে গানটি গাইতে গাইতে গলা জড়িয়ে এলো নূরের। বাবার সামনে চোখের পানি লুকাতে ঘরের ভেতর পা বাড়ালো নূর।
___

গাড়িতে বসতেই ভ্রু কুঁচকে এলো আদিত্যের। কুঁচকানোর হেতু হলো আজকে জিদানের ড্রেসআপ। কোনো ওকেশন ছাড়াই তার হঠাৎ এমন মাত্রাতিরিক্ত সাজগোজের কারণ খুঁজে পাচ্ছেনা সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আদিত্য বলল,
–তুমি কী বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছো জিদান?

–নাতো স্যার।

–তাহলে এমন নতুন জামাইয়ের মতো সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছো?

–কোথাও না স্যার। আমিতো আপনার সাথেই যাচ্ছি। আসলে কাল নূর ম্যামের কথা শুনে মনে হলো আমি নিজেকে অনেক আন্ডারেস্টিমেট করি। তাই নিজেকে একটু ফিটফাট করলাম।

এবার আসল কাহিনি বুঝতে পারলো আদিত্য।তাহলে সে নূরকে দেখানোর জন্য এমন নতুন জামাই সেজেছে। বিরক্তিতে ছেয়ে গেল সারা শরীর।কী দিন এসে গেল তোর আদিত্য! শেষমেশ কিনা এই জিদান, তোর কম্পিটিটর হলো? হোয়াট দ্য!! আদিত্য ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল।গাড়ি থামালে আদিত্য জিদানের উদ্দেশ্যে বলল,
–নামো গাড়ি থেকে। বাসায় না যেখানে খুশি যাও কিন্তু আজ তুমি আমার সাথে আসতে পারবেনা। আর কাল যদি আর এই বেশে এসেছ তো কালই তোমার চাকুরির শেষ দিন।
কথা শেষ করেই গাড়ির দরজা আটকে দিলো আদিত্য। জিদান বেচারা বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ওখানে। ওর সাথে আসলে কী ঘটলো সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে।

গতকালের কথা অনুযায়ী যথাসময়ে আদিত্যর ভ্যানিটিতে চলে এলো নূর। আদিত্য নেই এখন।হয়তো শুট শেষ হয়নি। নূর ডিভানে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। চোখ গেল সামনে টেবিলের ওপর রাখা আদিত্যর ল্যাপটপে। অভদ্র একটা চাওয়া জাগলো মনে। আদিত্যর ল্যাপটপে কী সে একটু নিজের কাজ করবে? এক মন বলছে,না না ধুর কী ভাবছি। এমন ছ্যাচড়ামী করার কথা ভাবলামো কী করে। না বলে এভাবে কারোর জিনিসে কীভাবে হাত দিতে পারি আমি।তাও আবার ওই ফালতু নায়কের। কখনো না। আরেক মন বলছে,কী এমন হবে? আমিতো শুধু নিজের কাজ করেই রেখে দিবো।কোনো চুরিটুরি তো আর করছিনা। সে আসার আগ পর্যন্ত নাহয় একটু নিলাম।

নূরের ভাবনা চিন্তার মাঝে সে খেয়ালই করলোনা এক যুবকের নেশাময় দুটি চোখ শুধু তার পানেই আবদ্ধ আছে।বুকে দুই হাত ভাজ করে দরজার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কখন থেকে তৃষ্ণার্থ আঁখির পিপাসা মেটাতে ব্যাস্ত আদিত্য। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই মনে হচ্ছে কতকাল দেখেনা তার মনপাখিকে। আকুল দুটি নয়ন যেন সিক্ত হচ্ছে প্রনয়ীর দর্শন পেয়ে। তবে নূরের চোখ বরাবর তাকিয়ে দেখলো নূর কেমন চোরা চোখে বারবার ওর ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপার কী? নূর কী ল্যাপটপে কিছু দেখতে চায়? সেকি আমার বিষয়ে আমার ল্যাপটপ থেকে তথ্য নিতে চায় নাকি অন্যকিছু? আদিত্য পা টিপে টিপে নূরের কাছে গিয়ে হঠাৎ নূরের দিকে ঝুঁকে জোরে বলল,
–ভমমমম….

তবে আদিত্যর কার্যে আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া এলো না নূরের পক্ষ থেকে। চমকানো তো দূরের কথা, চেহারায় সামন্য একটু পরিবর্তনও এলো না। একেবারেই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকালো নূর,আদিত্যর পানে। যেন এখানে আদিত্য না,কোনো মশা এসে গুনগুন করলো। নূর ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
–এইসব প্লে নার্সারি টাইপ প্রাঙ্ক শেষ হলে এখন আমরা কাজ শুরু করতে পারি?

আদিত্য হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে নূরের সামনে এসে বসে বলল,
–আচ্ছা, আগে বলো চা নিবে না কফি? নাকি ঠান্ডা কিছু?

–কিছুই না। কাজ শুরু করুন। সারাদিন সময় নেই আমার।

আদিত্য একটা স্ক্রিপ্ট বের করে বলল,
–দেখ এখানে একটা ভার্সিটির বন্ধুদের সিন আছে। তুমি দেখে বলো এটা কীভাবে করলে আরেকটু রিয়্যাল লাগবে? কোথাও কোনো চেঞ্জ করা লাগলে তুমি করতে পারো।

নূর স্ক্রিপ্ট টা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো। একটা কলম নিয়ে কিছু কিছু জায়গায় একটু চেঞ্জ করতে লাগলো। সেটা আবার আদিত্যকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। নূর কাজে মগ্ন, তবে আদিত্যর হুশ কই! তার সব মগ্নতা শুধুই নূরে আবদ্ধ। কাজে মগ্ন ওই রমনীকে দেখতে ব্যাস্ত সে। হাতে গাল ঠেকিয়ে মুগ্ধ আঁখি যুগল হিমশীতল করছে নূরকে দেখে।নূরের ওই নেত্রপল্লবের নৃত্য, কপালের ওই সুক্ষ্ম ভাজ, ঠোঁটের কোনে ওই নজর টিকার ন্যায় কালো তিলটা, বাতাসে উড়তে থাকা কপালের এলোমেলো চুলগুলো সবই খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আদিত্য। তার এই পর্যবেক্ষণের পরিপেক্ষিতে তার মন জানান দিলো,এই অতি সাধারণ, কিছুটা অগাছালো আর কৃত্রিমতা থেকে হাজার গজ দূরের এই মেয়েটা সুন্দর। শুধু সুন্দর না অসাধারণ,অপূর্ব সুন্দর। যতটা সুন্দর হলে শুধু এক ঝলকেই যে কারো জান কেঁড়ে নিতে পারে। হ্যাঁ এতটাই সুন্দর নূর। আমার নূর। তবে এই সৌন্দর্যে শুধু আমার জান যাবে। আর কারোর না। নূরের জন্য জান দেওয়ার অধিকারও অন্য কারোর নেই।

কাজের মাঝেই হঠাৎ আদিত্যর দিকে নজর গেল নূরের। আদিত্যকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল সে। চোখ দুটো দ্রুত বেগে ঝাপটিয়ে মুখ চোখা করে বলল,
–কী হচ্ছে এটা?

আদিত্যর সোজাসাপটা জবাব,
–কী হচ্ছে? চোখের ট্রিটমেন্ট হচ্ছে।

–মানে?

–মানে আবার কী? তোমাকে দেখে আমার চোখের ভিটামিন বাড়াচ্ছি। তুমিও চাইলে ট্রাই করতে পারো। ইট রিয়েলি ওয়ার্ক।

–আপনি আবার শুরু করেছেন?

–শুরু করতে কোথায় দিলে? আর আমি কোনো শর্ত কিন্তু ভাঙ্গিনি। আমিতো শুধু আমার প্রিয়তমাকে দেখছি। তুমি তোমার কাজ করোনা।

–এভাবে তাকিয়ে থাকলে কাজ করবো কি করে? অন্যদিকে তাকান।

–পারবোনা। তোমাকে দেখার পর থেকে আমার সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আমার অবাধ্য হয়ে গেছে। একটাও আমার কথা শোনে না। তুমি পারলে ঠিক করো।

নূর কটমটে চোখে তাকালো আদিত্যর দিকে। দাঁত কিড়মিড় করে কিছু বলতে যাবে তখনই হঠাৎ আদিত্য বলে উঠলো।
–নূর,তুমি কী কেঁদেছ? তোমার কী মন খারাপ?

হঠাৎ আদিত্যর এমন কথায় এবার কিছুটা চমকে উঠলো নূর। আদিত্যর চোখের দিকে এবার সরাসরি তাকালো সে।আদিত্য কীভাবে ওর মনের অবস্থা বুঝে গেল? ওতো কিছুই বলেনি। তবে লোকটা কীভাবে জানলো। নূরের মৌনতা দেখে আদিত্য আবার বলল,
–কী হলো নূর? বলনা কী হয়েছে তোমার?

নূর শান্ত সুরে বলল,
–আপনার কেন মনে হলো আমার কিছু হয়েছে?

আদিত্য নূরের চোখে চোখ রেখে বলল,
–এইযে তোমার চোখ দুটো। এই দুটোই সব বলে দিলো আমাকে। তোমার চোখের কোনের ওই জমে থাকা ছোট্ট লালিমায় বলে দিচ্ছে এই চোখে বরষা নেমেছিলো। বলে দিলো মন খারাপ তাদের। কী হয়েছে নূর? ইজ দেয়ার এনি প্রবলেম?

নূর কিছুটা আনমনা হয়ে তাকিয়ে ছিলো আদিত্যর পানে। তবে কিছু মুহূর্ত পরেই চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। স্বাভাবিক সুরে বলল,
–এমন কিছুই না। আমার কখনো মন খারাপ হয়না। এসব ন্যাকামি আমার জন্য না। এখন এসব ছাড়ুন আর কাজে মন দিন।

কিছুতো অবশ্যই হয়েছে। তবে আমি জানি আমাকে কিছু বলবেনা তুমি। তোমার এই বিষন্ন চোখ দুটো যে আমার ভালো লাগছে না। কী করবো? ওর মনটা কীভাবে ভালো হবে? আমি কী আমার ভালোবাসাকে একটু হাসানোর ক্ষমতাও রাখিনা? ওর বন্ধু ওকে হাসাতে পারে তাহলে আমি কেন পারছিনা। হ্যাঁ পারবো। আজকে তো ওকে আমি হাসিয়েই ছাড়বো। কিন্তু কীভাবে হাসাবো। আদিত্য কিছু একটা ভেবে ওর বাসার নাম্বারে ফোন দিলো। নূরকে শোনানোর জন্য ফোন লাউড স্পিকারে রাখলো। রিং হচ্ছে, ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করলো বাবলু। আদিত্য বাঁকা হাসলো। এটাই চাচ্ছিলো ও। আদিত্য বলল,
–হ্যালো।

ওপাশ থেকে বাবলুর উত্তর এলো।
–হেলছি।

–হেলো।

–হেলছি

–হেলো।

–হেলতে হেলতে তো মাটিতে শুয়ে পড়লাম । আর কতো হেলবো?

–কে বাবলু?

–কে বাবলু না, বি বাবলু। বাবলু বিতে হয়। আপনি এইটুকুও জানেন না। আনপড়াশোনা লোক।

–বাবলু তুমি জানো, তুমি কার সাথে কথা বলছ?জানো আমি কে?

–ওমা আপনি নিজেকে চিনেন না? আপনার গাজনী রোগ আছে নাকি?আহারে শুনে খুব দুঃখ হলো। আল্লাহ জলদী আপনার রোগ সারিয়ে দিক। আর আপনি যেন নিজেকে চিনতে পারেন। নিজেকে মনে পড়লে আবার ফোন দিয়েন ঠিক আছে?

কেটে গেল ফোন। নূর অনেক কষ্টে নিজের হাসি চেপে রেখেছিল। কিন্তু এবার আর পারলোনা। এমন হাস্যকর ফোনালাপ শুনে আটকে রাখা হাসি বাঁধ ভেঙে ফোয়ারার মতো বেড়িয়ে এলো।খিলখিল করে হেঁসে দিলো নূর। যে হাসির মুগ্ধতায় ডুবে গেল আদিত্য। এতে এতো এওয়ার্ড পেয়েও এতোটা খুশি হয়নি আদিত্য যতোটা আজ নিজের প্রিয়তমার মুখে হাসি ফোটাতে পেরে খুশি লাগছে। মনে হচ্ছে বিশ্বজয় করে ফেলেছে সে। আজতো বাবলুকে জোরদার পাপ্পি দিতে মন চাচ্ছে। জিও বাবলু মিঞা।

নূরের এই হাসিমাখা মুখটা কতই না সুন্দর। তোমার এই হাসি কখনে বিলীন হতে দেবো না
আমি নূর। কখনে না। ব্যাস শুধু আমার সামনে বসে এভাবেই সারাজীবন হেঁসে যেও। এতটুকুই শুধু চাই তোমার কাছে নূর।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here