#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-৩৫
সমুদ্রের নোনা জল শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে। আদনান শক্ত করে জয়ীর হাত ধরলো। চিৎকার করে বলল,
“জয়ীতা এবার ফিরে চলো। ”
জয়ী যেন শুনেও শুনছে না। পরনের শাড়ি ভিজে গেছে পুরোপুরি। চুলগুলোও ভেজা। চুলে বালি গিজগিজ করছে। তবুও জয়ীতার আরও কিছুক্ষন থাকতে ইচ্ছে করছে। আদনান নিজেও তাল মিলিয়ে আজ জয়ীর সঙ্গে পাগলামী করছে। আশেপাশে যে যার মতো ছবি তুলে নিচ্ছে। আজ আদনানও লোকলজ্জা সব ভুলে গেল। জয়ীতার আজ ইচ্ছে হলো আরও বেসামাল হতে। শাড়ি পরে না এলে পাগলের মতো কিছুক্ষন লাফিয়ে নিতো আরও। শাড়ির জন্য ঠিকঠাক পারছে না। জয়ীতা মুগ্ধ গলায় বলল,
“ইশ! সমুদ্র এতো সুন্দর কেন! কী স্নিগ্ধ! ”
আদনান তখনও জয়ীতাকে দেখছে। মনে মনে ভাবছে কে বেশী স্নিগ্ধ! সমুদ্র নাকি ওর একান্ত আকাশ!
আদনান চোখ বন্ধ করে ফেলল। জয়ীতার হাত তখনও শক্ত করে ধরে রাখা। সূর্য ডুবে যাবার সময় হয়েছে। প্রকৃতির রুপ পাল্টাচ্ছে। এতো সুন্দর একটা মুহুর্ত! আদনান মনে মনে বলল,
এরকম হাজার টা দিন সামনের দিনগুলোয় আসুক। প্রতিটি দিন একেক রকম সুন্দর মুহুর্তে ভরে যাক।
জয়ীতার আজ আর ভয় নেই। আদনান শক্ত করে ধরে আছে। হারাতে দিবে না কিছুতেই। আর যদি হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করেও তবে আদনান কে নিয়ে হারাবে। জয়ীতা গুনগুন করে গেয়ে উঠলো,
“আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব
হারিয়ে যাব, আমি তোমার সাথে….
***
সমুদ্র দর্শন শেষে ওদের ফিরে আসতে হলো। আদনানের ব্যস্ত সময় থেকে দুটো দিন বের করেছে অনেক কষ্টে। তবে আদনান কথা দিলো ব্যস্ততা শেষ করে আবারও কোথাও সমুদ্র দর্শনে যাবে। জয়ীতার সব অভিমান সমুদ্রের জলে ধুয়ে মুছে গেছে। আর কোনো অভিযোগ, অভিমান নেই।
***
জয়ীতা জুলিনার বাসায় গেল বিনা নোটিশে। বাসার দরজা আজ খোলাই আছে। ভেতরে ঢুকে দেখলো জুম্মন আংকেলের নাতি, নাতনি আছে। ওরা জয়ীতা কে দেখে হাসলো। জুলিনার মা বাচ্চাদের বলল,
“ও ভালা না। ওর কাছে যাইবা না। ওরে দেখলেই ছ্যাপ দিবা।”
বাচ্চাগুলো জয়ীতার কাছে চকলেটের বায়না ধরলো। জয়ীতা দুঃখী গলায় বলল,
“তোমরা যে এখানে আছ সেটা তো আমি জানিনা। জানলে অনেক চকলেট নিয়ে আসতাম। তবে যাবার আগে চকলেট দিয়ে যাব। কথা দিচ্ছি। ”
বাচ্চাদের শান্ত করে ঘরে ঢুকতেই দেখলো জুলিনা রান্নাঘরে যুদ্ধ করছে। জয়ী অবাক গলায় বলল,
“আন্টি রান্না করছ! তুমি?”
জুলিনা বিরক্ত হলো। এবং সেই বিরক্তিভাব প্রকাশ করে বলল,
“না জানায়ে আসছ ক্যান? ”
জয়ী অবাক গলায় বলল,
“তোমার বাসায় আসতে হলে আমাকে পারমিশন নিতে হবে৷ ”
“হ হবে। তুই সুবিধার লোক না। ”
জয়ীতা হাই তুলে বলল,
“উই আর সেম আন্টি। কেউ আসবে নাকি?”
জুলিনা গলা খাকারি দিলো। শুকনো কেশে বলল,
“গেস্ট আসবে।”
জয়ী মৃদু হাসলো। বলল,
“ওয়াও! সেই গেস্ট কত্তো লাকি! তার জন্য তুমি রান্না করছ! ”
জুলিনা একবার অগ্নিদৃষ্টিতে জয়ীতাকে দেখলো। তারপর আবার রান্নায় মনোযোগ দিলো। জয়ীতাও ধৈর্য্য ধরে সব দেখতে লাগলো। একবার জিজ্ঞেস করলো ,
“আমি হেল্প করব?”
“না লাগবে না। তুই যা পানিতে লাফালাফি কর। ”
উল্লেখ্য, জয়ীতা আর আদনানের সমুদ্রস্নানের কিছু ফটো সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং এ আছে।
জয়ীতা তাসিন, নওশিন কে ফোন করে বলল চলে আসতে। তাসিন বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে জুলিনার রান্না খেতে চলে এসেছে। নওশিন বাড়িই ছিলো, ও এসেছে।
জুম্মন আলী নয়টার মধ্যে পৌছে গেল। ভদ্রলোক কিছু ফুল নিয়ে এসেছে। ফুল দেখেই জুলিনা তেলে বেগুনে গর্জে উঠলো। বলল,
“ফুল কী জন্য? আমি কী ফুল ভাজি করে খাব। কী দিয়া ভাজি করব? রুপচাঁদা মাছ দিয়া?”
জুম্মন আলীর কাশি রোগ বেড়ে গেল। আজ বেচারা কথাও বলছে কম।
খাওয়ার সময় দেখা গেল কিছু আইটেম ভালো হয়েছে আর কিছু আইটেম মুখে দেয়া যাচ্ছে না। সয়া সস দিয়ে ইলিশ মাছের আইটেম করেছে যেটা অন্য কেউ ছুঁয়েও দেখে নি। কিন্তু জুম্মন আলী দুই পিস খেলেন।
আবার চানার ডালে উপর দিয়ে মধু ছড়িয়ে দিয়েছে খানিকটা। সেটাও জুম্মন আলী তৃপ্তি করে খেলেন।
জুলিনার মা জুম্মন আলীকে খুব একটা পছন্দ না করলেও বাচ্চা দুটোকে পছন্দ করছে। কিছুতেই যেতে দিবে না। জুম্মন আলী নিয়ে যেতে চাইলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিলো।
***
জুলিনা আর আলম সাহেবের ডিভোর্স হয়েছে অবশেষে। আলম সাহেবের নামে একটা ফ্ল্যাট আর একটা ফ্ল্যাটের ভাড়া দেবার চুক্তি হয়েছে। ডিভোর্স এর সময় আলম সাহেবের মুখ থমথমে ছিলো। কিন্তু তার স্ত্রী খুশিতে টগবগ করে ফুটছিল। কালোজাম এনে সবাইকে বিলাচ্ছে।
সব কাজ কর্ম শেষে যখন জুলিনা চলে আসবে তখন খানিকটা অভিনয় করে বলল,
“আপা ভুল ত্রুটি হইলে মাফ করবেন। ছোট বোন রে অন্তরে রাখবেন। ”
জুলিনা আজকের দিনেও শান্ত থাকতে পারলেন না৷ সকলের সামনেই চুলের মুঠি ধরার চেষ্টা করে বলতে লাগলো,
“বড় বোনের স্বামীরে বিয়ে করে আবার অন্তরে থাকতে চাস! আয় তোরে অন্তর দেখাই!”
সঙ্গে যারা ছিলো তারা সামলে নিলো।
ভরা সংসার এর স্বপ্ন কম বেশী সবার ই থাকে। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া জুলিনা আরও একবার নতুন করে স্বপ্ন দেখার লোভ সামলাতে পারে নি বলে জুম্মন আলীকে জীবনে জায়গা দিয়েছে। কিংবা নিজের মতো উড়ে, ঘুরে বেড়ানো স্বাধীন জীবনেও বিরক্ত হয়ে গেছে। তাছাড়া ভালোবাসাহীন জীবন ক’দিন ই বা ভালো লাগে!
***
শীত কমতে শুরু করেছে। দিনের বেলা তেমন বোঝা যায় না, তবে রাত হলে শীতের টের পাওয়া যায়। বসন্ত আসবে আসবে করছে। আদনান, জয়ীতা বারান্দায় বসে আছে। আজ পূর্নিমা। দুজনের কেউই কোনো কথা বলছে না। বারান্দায় বসে মৃদুমন্দ বাতাসটুকু উপভোগ করছে। জয়ীতা বলল,
“আপনি আমাকে একটা গোপন কথা বলতে চাইছিলেন?”
“কী গোপন কথা?”
“আমি কী জানি! আপনি বলবেন বলছিলেন। ”
আদনান চেয়ার টেনে জয়ীতার গা ঘেঁষে বসলো। বলল,
“হ্যাঁ মনে আছে।”
“এখন বলুন। ”
“এখন না। ”
“তাহলে কবে?”
“যেদিন থেকে তুমি আমাকে তুমি সম্বোধন করতে শুরু করবে সেদিন বলব। ”
জয়ীতা ভারী লজ্জা পেল। গালও বোধহয় একটু লাল হলো। জুলিনাদের মতো ওরও কাশি রোগ হলো। শুকনো কেশে কথা বলতে শুরু করেও থেমে গেল৷ আদনান নিঃশব্দে হাসলো। জয়ীতা বলল,
“তুমি যেন কী গোপন কথা বলতে চাইছিলে?”
আদনান আবারও নিঃশব্দে হাসলো। আরেকটু এগিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। জয়ীতার কানের কাছে মুখ এনে মৃদু গলায় বলল,
“আমার একটা আকাশ আছে। নীল আকাশ। সেই আকাশে রোদ থাকে। মাঝেমধ্যে মেঘ জমে। ভীষণ কালো মেঘের পর এক পশলা বৃষ্টিও হয় আমার জন্য। অন্যদের আকাশ অন্যরা ছুঁয়ে দিতে পারে না। কিন্তু আমার আকাশ আমি চাইলেই ছুঁতে পারি। আমার সেই ব্যক্তিগত আকাশের একটা নামও আছে। শুনবে? ”
জয়ীতা আদনান কে জড়িয়ে ধরলো। আদনানও জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
চলবে…
(সম্ভবত আর একটা পর্ব বাকী। দুটোও হতে পারে।)