কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে পর্ব ৩৩

0
1058

#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-৩৩
জুম্মন আলী ভদ্রলোক কে আদনানের একটুও পছন্দ হলো না। ভদ্রলোক বিশ্ব বাচাল। মাত্র পনেরো মিনিটেই আদনানের মাথা ধরে গেছে। অথচ এই লোক কে জয়ীতা পছন্দ করে বসে আছে। সেই সঙ্গে তাসিন, নওশিনও। বোন দুটো আগে কতো ভালো ছিলো! আর এখন ভাবীর কথায় উঠতে বসতে সায় দেয়। আদনান নিজেও ভারী অবাক এদের দেখে। জয়ীতা যা বলছে তাতেই গলা মিলিয়ে হ্যাঁ বলছে। আদনান বাসায় ফিরে জয়ীতাকে বলল,

“এই বাঁচাল টা’কে তুমি কোত্থেকে খুঁজে বের করছ?”

“মেট্রিমোনি সাইট থেকে। ”

“আর কাউকে পাও নি?”

“না উনি ছাড়া আর কেউ রেসপন্ড করে নি। ”

“ওনাকে দেখে তো আমারই বিরক্ত লাগছিল। মামী কী করবে কে জানে!”

জয়ীতা ল্যাপটপে কাজ করছিল। এতক্ষন আদনানের সঙ্গে ওভাবে কথা বললেও এবার ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলো। চেয়ার টেনে আদনানের মুখোমুখি বসে বলল,

“ভদ্রলোক কে আপনার খারাপ কেন লাগলো আগে সেটা বলুন?”

“এতো কথা বলে! তার উপর তাল গাছের মতো লম্বা।”

“শুনুন, আপনার মামীর জন্য বেল গাছ, সুপুরি গাছ কিছু খুঁজে পাবেন না। কারণ কী জানেন? ”

“বেল গাছ, সুপুরি গাছ আমি খুঁজতেও চাচ্ছি না। ”

“আগে আমার কথা শুনুন। আপনার মামীও ডেঞ্জারাস মহিলা। ওনার মর্জিমাফিক কিছু না হলেই মারামারি করে। তাছাড়া জুম্মন আংকেলের সঙ্গে দেখা করতে গেছে ব্যাগে ঝাড়ু নিয়ে। ”

জুলিনার ঝাড়ু বিষয়ক ঘটনায় আদনান একটুও অবাক না হলেও জয়ীতার আংকেল ডাকে খুব অবাক হলো। অবাক গলায় বলল,

“ভদ্রলোক কে এর মধ্যে আংকেল ডাকতে শুরু করে দিলে?”

“হ্যাঁ। উনি কথা একটু বেশী বলেন। তবে লোক ভালো। ”

আদনান বিড়বিড় করে বলল,

“রতনে রতন চিনে। ”

জয়ীতা চোখ পাকিয়ে বলল,

“অনেক দিন পর আবার ফাজলামি করতে শুরু করলেন।”

আদনান সেকথার পাত্তা না দিয়ে বলল,

“তোমার চয়েজ খুব খারাপ। ”

জয়ীতা খানিকটা রুক্ষ গলায় বলল,

“আপনার মামীও আমার বিয়ের সময় চয়েজ খারাপ করেছিল। তাই আমিও চয়েজ খারাপ করছি। ”

জয়ীতার বলার ধরণ দেখে আদনান শব্দ করে হেসে ফেলল। জয়ীতা খানিকটা অপ্রস্তুত হলো।

****
আজ রাতে সবাই মিলে বাইরে খেতে যাবার প্ল্যান করেছে। জয়ীতা প্রথমে ভাব দেখিয়েছিল যে যাবে না। কিন্তু আদনান সেটা শুনে বলল, ইটস ওকে জয়ীতা যখন যেতে চাইছে না তখন আমরা যাই। এটা শুনে জয়ীতা যাওয়ার জন্য তৈরী হওয়া শুরু করলো। ভেবেছিল আদনান খুব সাধাসাধি করবে। কিন্তু এমন বদমায়েশ যে সাধাসাধি তো দূরে থাক একবার ফর্মালিটি করে জিজ্ঞেসও করলো না কেন যাবে না।

যাওয়ার সময় জয়ী খানিকটা গম্ভীর হবার ভাব করলেও বেশীক্ষন গম্ভীর থাকতে পারলো না। পুরো রাস্তা তাসিন, নওশিনের সঙ্গে নানান কথাবার্তা বলে সময় কাটালো। রেস্টুরেন্টেও ভালো সময় কাটলো। একসঙ্গে খেতে খেতে আড্ডা, হৈ হুল্লোড় করছিল। হঠাৎ একটা মেয়ে গলা তাসিন কে ডাকলো,

“এই তাসিন না?”

তাসিন, নওশিন দুজনেই তাকালো। জয়ীতাও তাকালো। মিডিয়াম বয়সী মেয়ে। আদনানের বয়সী হবে হয়তো। একটু মোটা হবার কারণে বয়স বেশী লাগছে। জয়ীতা মেয়েটাকে খেয়াল করতে ব্যস্ত বলে আদনান কে খেয়াল করলো না।

মেয়েটা কাছাকাছি এসে বলল,

“তাসিন, নওশিন কেমন আছিস তোরা?”

নওশিন মৃদু হেসে জবাব দিলো, ভালো।

তাসিন আদনানের দিকে তাকালো। এতক্ষনে জয়ীতার কাছে পুরো ব্যাপার টা খটকা লাগলো। ভদ্রমহিলা ওদের পরিচিত কেউ, কিন্তু তার উপস্থিতি ওরা ঠিক মেনে নিতে পারছে না।

মেয়েটা এবার আদনানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কেমন আছ আদনান?”

আদনানের চোখে, মুখে রুক্ষ ভাব। গলার স্বরে যে বিনয় গলে পড়ছে সেটাও কৃত্রিম। আদনান বলল,

“এই তো ভালো। তোমার কী অবস্থা? ”

“ভালো। হাজবেন্ড আর মেয়ের সঙ্গে এসেছি। আমার হাজবেন্ড তোমার অনেক ভক্ত। দাঁড়াও ডেকে আনি। ”

মেয়েটা চলে যেতেই জয়ীতা প্রশ্ন করলো,

“উনি কে?”

তাসিন, নওশিন একে অপরের দিকে তাকালো। আদনান বলল,

“ওঁর নাম নোভা। ”

জয়ীতা আর প্রশ্ন করার সাহস পেল না যে নোভা কে! আদনানের কথা বলার ধরন ই কেমন যেন পাল্টে যাওয়া।

নোভা এলো হাজবেন্ড আর মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটা দেখতে পুতুলের মতো। হাজবেন্ড ভদ্রলোক খানিকটা বয়স্ক। আদনান ভদ্রলোকের সঙ্গে দুই একটা কথা বলেই গম্ভীর হয়ে গেল। মেয়েটার সঙ্গেও ঠিকঠাক কথা বলল না। জয়ীতা এবার ব্যাপার টা বুঝতে পারলো। ঠিক যখনই ব্যাপার টা বুঝে উঠলো তখনই ওর খারাপ লাগতে শুরু করলো। আশ্চর্য! এতে ওর খারাপ লাগার কী আছে! তবুও এতো খারাপ লাগছে!

আদনান যখন নোভার সঙ্গে জয়ীতাকে পরিচয় করিয়ে দিলো, তখন বলল,

“মাই ওয়াইফ, জয়ীতা। চিনে থাকবে নিশ্চয়ই! ”

নোভা জয়ীতার দিকে তাকিয়ে বলল,

“হ্যাঁ চিনি। ”

তারপর জয়ীতার দিকে তাকিয়ে হ্যালো বলল। জয়ীতাও একটু হাসার চেষ্টা করলো। নোভা হয়তো আরও কিছুক্ষন কথাবার্তা বলতো কিন্তু আদনান আর ওর দুই বোনের অনাগ্রহের কারণে আর কথা বাড়ালো না।

ফেরার পথে সবারই ম্যুড অফ হয়ে রইলো। কেউই কোনো কথা বলছিল না। পরিস্থিতি হালকা করতে তাসিন দুই একটা কথা বললেও বাকীদের রেসপন্স না পাওয়ায় থেমে গেল।

গাড়ি মিডল রোডে আসার পর জয়ীতা বলল,

“আমাকে ভাইয়ার বাসায় নামিয়ে দিয়েন তো। ভাবী বলছিল শরীর টা ভালো না। আজ রাত টা ওখানে থেকে আসি।”

আদনান গম্ভীর গলায় বলল,

“আজ তুমি বাড়িতেই যাবে। যেহেতু ভাবীর বাসার উদ্দেশ্যে বের হও নি সেহেতু তুমি বাড়িই যাবে।”

জয়ীতা আদনানের সঙ্গে কথা বলল না আর।

***
আদনান ঘরে ঢুকে জয়ীতাকে বলল,

“কাল সকালে ভাবীর বাসায় যেও। ”

জয়ীতার মেজাজ খারাপ হলো। বলল,

“আমি কী আপনার কাছে পারমিশন চেয়েছি।”

“না চাওনি।”

“তাহলে? ”

আদনান জয়ীতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

“অহেতুক রিয়েক্ট করা ব্যাপার টা আমার পছন্দ না জয়ীতা।”

জয়ীতাও আদনানের চোখের দিকে তাকালো। বলল,

“যে জিনিস পছন্দ না, সেটা নিজেই বা কেন করছেন। ”

আদনান চুপ করে রইলো। নোভার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে মেজাজ টা বিগড়ে আছে। এই মেজাজ বিগড়ে যাবার কারণ অন্যকিছু না। অনেক বছর আগের করা বেইমানি গুলোর কথা মনে পড়ে যায়। ময়মনসিংহ গিয়ে সারাদিন না খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, মায়ের টাকা চুরি, বিয়ের পর নোভার শাড়ি, গয়নার শো অফ সব মনে পড়ে গেছে। নোভা হয়তো সব ভুলে গেছে কিংবা ভুলে যাবার ভান করছে। হয়তো ভুলেই গেছে। বেইমান, অকৃতজ্ঞরা নিজেদের কুকর্মের কথা অল্পতেই ভুলে যায়। তাই নির্লজ্জের মতো সামনে এসে কথাও বলেছে। কিন্তু আদনানের বেশী মেজাজ খারাপ হচ্ছে জয়ীতাকে দেখে। ওর এই মুহুর্তে ম্যুড অফ করতে হবে কেন!

জয়ীতা ওয়াশরুমে ঢুকে খানিকক্ষণ কাঁদলো। কান্নাকাটির পর মাথা ঠান্ডা হলো। নোভা মেয়েটার সঙ্গে আদনানের সম্পর্ক ছিলো। কতটা ক্লোজ সম্পর্ক ছিল কে জানে!

নানানরকম হাবিজাবি ভেবে কান্নাকাটির পর জয়ীতার হঠাৎ মনে হলো ও একটা অশিক্ষিত মূর্খ। ও ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাজের বেটিদের মতো কাঁদতে গেল কেন! ওই মেয়েটার মেয়ে আছে, পেট মোটা একটা স্বামী আছে। তাছাড়া আদনানের একমাত্র বউ তো ও। ও কেন কান্নাকাটি করবে! ছিঃ ছিঃ! জয়ীতা নিজেকে খানিকক্ষণ ধীক্কারও দিলো। কী বোকা ও! আরে যা গেছে তা তো গেছেই। এখন কেঁদেকেটে কী লাভ! তাছাড়া এখন যদি সাইমুনের সঙ্গে ওর হুট করে দেখা হয় তাহলে আদনান তো এমন রিয়েক্ট করবে না। ও তো নরমাল ই থাকবে। জয়ীতা শুধুই এবনরমালের মতো আচরণ করছে।

জয়ীতা ভালো করে হাত, মুখ ধুয়ে বের হলো। আদনান কে কিছুতেই বুঝতে দেয়া যাবে না যে কেঁদেছে। হাসাহাসি করবে শিওর।

জয়ীতা বেরোতেই আদনান বলল,

“আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আজকের রাত টা আমাদের জন্য খুব স্পেশাল। আজ আমরা প্রথম বার ঝগড়া করেছি। বারান্দায় বসে সেলিব্রেট করি?”

জয়ীতা গম্ভীর গলায় বলল,

“তার আগে একটা কথা শুনুন, আমি কিন্তু কোথাও যাব না। এই বাসায় ই থাকব। ”

বাকী কথাটা আদনান কে না বলে মনে মনে বলল। আর আপনার জীবন থেকেও যাচ্ছি না।

আদনান জবাব দিলো, বেশ তো। কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। এই বাসাও তোমার। বাসায় যারা আছে তারাও তোমার।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here