কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে পর্ব ৩১

0
1051

#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-৩১
আদনান হাড়েমজ্জায় টের পেল যে তার একমাত্র বউ তাকে ভীষণ ই মিস করছে। তবে আরেকটু বাজিয়ে দেখার জন্য নিজে ঠিকঠাক ধরা দিচ্ছে না। পাখি শিকার করতে শিকারীকেও তো একটু আধটু লুকোচুরি খেলতে হয়। দিনের বেলায় জয়ীতা যখনই ফোন করে আদনান ভাব দেখায় খুব ব্যস্ত আছে। ব্যস্ত না থাকলেও ভাব দেখায় ব্যস্ত আছে। জয়ীতা এতে রেগে যায়। আদনানের ভালো লাগে। আরও রাগাতে ইচ্ছে করে। আদনানের এবারের সিরিজ টা ভালো যাচ্ছে না। পারফরম্যান্স তুলনামূলক এর চেয়েও বেশী খারাপ। এই নিয়ে জয়ীর মন খারাপের শেষ নেই। ওর ধারণা ও আদনানের ম্যাচগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখছে বলেই এমন হচ্ছে। এই ভয়ে দেখা অবধি বন্ধ করে দিয়েছে। তবে অন্য সমস্যাও দেখা দিয়েছে। জয়ীতা এখন আর রাত জাগতে পারে না। আদনান কে ভোর বেলা উঠে ফোন করতে হতো বলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তো। টানা দুই সপ্তাহ এরকম করতে করতে এখন অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে। বারান্দার গাছগুলোর যত্ন নিচ্ছে আদনানের অনুপস্থিতিতে। তাসিন, নওশিন কে আগলে রাখছে। অস্কার কেও একটু একটু করে ভালো লাগতে শুরু করেছে। অস্কারও ও’কে এখন পছন্দ করে। দেখলেই আহ্লাদে ঘাড় কাত করে দেয়।

এই কাজগুলো জয়ীতাকে দিয়ে কেউ জোর করে করাচ্ছে না। এমনকি সকালে ঘুম থেকে উঠে চা’টুকু করার ব্যাপার টাও মনে, মস্তিস্কে আপনাআপনি এসে যায়।

পুরো ব্যাপার গুলো আদনান যখন বোনেদের কাছ থেকে জানে, তখন ভাবে কবে এভাবে একটু একটু করে ও’কেও ভালোবাসতে শুরু করবে! প্রথমে এক ধাক্কায় অনেকখানি ভালোবাসা চায়ও না। বিন্দু বিন্দু জলের মতো করে ভালোবাসাটা জমলেই হবে।

তবে আদনান যদি জয়ীতার লেখা অসংখ্য ছোট চিরকুট খুঁজে পায় তখন ভালোবাসার সংজ্ঞা ভিন্ন হবে।

****
জুলিনা খবর পেল যে জয়ীতা ওর বিয়ে দিতে চায়। এই খবর যখন জানলো তখন জুলিনা দাঁতে ব্যথায় কাতর। খবর শোনার পয়তাল্লিশ সেকেন্ডেই ব্যথা দূর হয়ে গেল। সাথে সাথে জয়ীতাকে ফোন করলো। জয়ীতা তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলো। ফোন কানে ধরে বলল,

“আন্টি আমি একটু পরে ফোন করছি। ”

জুলিনা দাঁতে দাঁত চাপতে গিয়ে খেয়াল করলো যে ওর দাঁতে ব্যথা। একটু জোরে কথা বলতে গেলেও ব্যথাটা টের পাওয়া যাচ্ছে। চাপা গলায় বলল,

“একটু পর কিরে! এসব ঢং তোর জামাইর সাথে করিস। আমি এখন ফোন করছি তুইও এখন কথা বলবি ফাজিল মেয়ে।”

জয়ীতা চুলা টা অফ করে বলল,

“আচ্ছা বলো।”

“তুই নাকি ভন্ড’র বাসায় গেছিলি দুই চুন্নিরে নিয়া?”

“হ্যাঁ গিয়েছিলাম। আর তাসিন, নওশিন কে এভাবে বলবে না। তোমার আমার ঝগড়াঝাটিতে শুধু শুধু বাচ্চাদের টেনে আনবে না।”

জুলিনা হা হয়ে গেল। অবাক গলায় বলল,

“তাসিন, নওশিন বাচ্চা? ওদের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। ”

“না ওদের বিয়ের বয়স হয় নি। ”

জুলিনার শরীর জ্বলে উঠলো রাগে৷ কিছুদিন আগে ওর হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়ে নওশিনের জন্য মেট্রিমোনি সাইটে একাউন্ট খোলা পর্যন্ত হলো। আর আজ বলছে বাচ্চা! এই মেয়ের কী মাথা খারাপ হলো! হলে হোক। আজ এই বিষয়ে তর্ক করা যাবে না। আগে ভন্ড’র বাসায় কেন গিয়েছিল সেই ফয়সালা হোক।

“ভন্ড’র বাসায় কেন গেছিলি?”

জয়ীতাও ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,

“উনি তো আমার মামা শ্বশুর হয়। তার বাসায় তো যেতেই পারি।”

জুলিনার ইচ্ছে হলো বাঁশের কঞ্চি দিয়ে জয়ীতাকে ইচ্ছেমতো পিটায়। গমগমে গলায় বলল,

“ওই ভুটকির বাসায় যাইতে লজ্জা করে না? আবার সেইখানে যাইয়া বলছস আমারে বিয়ে দিবি। তুই কী মদ খাইছ?”

জয়ীতা ঠান্ডা গলায় বলল,

“মদ তো দূরের কথা, আমি শরবতও খাই না। ডায়েটে আছি এখন। পেট টা ভারী লাগলো৷ তারপর তুমি আমাকেও ভুড়িওয়ালী ডাকো তাই আগেভাগে ডায়েট শুরু করেছি৷ ”

“তোর ভুজুংভাজুং বাদ দিয়া আমার বিয়ার কথা বল। ”

জয়ীতা হেসে ফেলল। বলল,

“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার বিয়ে দেব। তাই ভুড়িওয়ালার কাছে ডিভোর্স চাইতে গেছিলাম। ”

জুলিনা অবাক গলায় বলল,

“আমার বিয়ে দিবি? ”

“হ্যাঁ। ”

“এতো সাহস কই পাইছিস? আমি কী পারমিশন দিছি তোরে?”

“আদনান ফয়সালের সাথে বিয়ে ঠিক করার সময় তুমি কী আমার পারমিশন নিয়েছিলে?”

“শোধ নিচ্ছিস?”

“হ্যাঁ। ”

“তোর বাপ, মা রাজী ছিলো। ”

“তোমার বাপ নেই, মা’ও না থাকার মতো। আপাতত আমিই তোমার বাপ, আমিই তোমার মা।”

জুলিনার রাগ এক নিমিষেই পানি হয়ে গেল। গলাটা ভিজে উঠলো। কী সুন্দর করে বলল! জুলিনা নরম গলায় বলল,

“পাগলামী করিস না জয়ী, আমি পাগল দেখে তুইও পাগল হবি৷ আমার কী এখন বিয়ে করার বয়স আছে। লোকে কী বলবে!”

“ভুড়িওয়ালা যখন আরেকটা বিয়ে করেছিল তখন কী লোক ছেড়ে দিয়েছিল?”

জুলিনার চোখে এবার পানি এসে গেল। আলম সাহেবের সাথে জুলিনার বিয়ে দিয়েছিল ওঁর বাবা৷ তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে কেবল। বিয়ের পর পড়াশোনা চুকেবুকে গেল। আলম সাহেবের তখন কাপড়ের ব্যবসা ছিল। স্বচ্ছল অবস্থা। শ্বশুরের নিজের বাড়ি৷ ভরা সংসার, ননদ, ভাগ্নে-ভাগ্নী, শাশুড়ী, দেবর সবাই আছে। বিয়ের পাঁচ টা বছর ভালোই কাটলো। তারপর এলো দুঃসময়। জুলিনা মা হতে পারবে না। ডাক্তার, কবিরাজ, পীর, ফকির সব দেখানো হচ্ছে তবু কাজ হচ্ছে না। এরমধ্যে বেরোলো আলম সাহেবের আরেক রুপ। খারাপ পাড়ায় যাওয়া, বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক!

তবুও কয়েক বছর পর যখন হাটুর বয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করলো তখন লোকে বলল, সব দোষ বউটার। বাচ্চা না হইলে পুরুষ মানুষ বিয়ে তো করবেই।

জুলিনার চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছে। এতক্ষন খেয়াল করে নি। জয়ীর ডাকে খেয়াল হলো। জয়ী বলল,

“আন্টি এখন রাখব?”

জুলিনা কিছু বলল না। খট করে রেখে দিলো। কোনো কথা বললে মেয়েটা যদি ওর কান্না বুঝে ফেলে।

***
আদনান এর আজ দেশে ফেরার কথা। সকাল সকাল ই জুলিনার কাছ থেকে ফোন পেল। একবার ভাবলো ফোন টা ধরবে না। সব অভিযোগ, অনুযোগ দেশে ফিরে শুনবে। কিন্তু জুলিনার ননস্টপ ফোনে সেটা আর সম্ভব হলো না। ফোন ধরতেই জুলিনা চিৎকার করে বলল,

“তুই দেশে কবে আসবি?”

“আস্তে মামী…. কাল সকালে।”

“এসেই সবার আগে তোর বউরে একটা থাপ্পড় দিবি চুলের মুঠি ধরে। ”

“কেন?”

জুলিনা ওর বিয়ে সংক্রান্ত যাবতীয় কথাবার্তা আদনান কে জানালো। যেটা আদনান আগে থেকেই জানে। তারপর বলল,

“লঘু পাপের জন্য এতো শাস্তি!’

“লঘু পাপ! আদনান শুধু পয়সা পাতি আর নাম কামালেই হবে না। বউ কন্ট্রোলে রাখতে হবে। কথা না শুনলে ধমক দিবি যেন দুই তিন দিন কাঁপতে থাকে।”

আদনান নিঃশব্দে হাসলো। বলল,

“আমার ভয় হয় মামী। আশেপাশে দেখেছি যে ওয়াইফ হাজবেন্ড কে মারে, কামড়ায়, আঁচড়ায়। ”

জুলিনা থতমত খেল। এই নিয়ে চূড়ান্তরকম ঝগড়া করার ইচ্ছে থাকলেও সম্ভব হলো না শুধুমাত্র জুম্মন আলীর জন্য। সে কল ওয়েটিং পেয়েও সমানে জুলিনাকে ফোন করে যাচ্ছে।

***
আদনান এয়ারপোর্টে জয়ীর দেখা পেল। এতো ভোরেও ওর জন্য এসে অপেক্ষা করছে। দূর থেকে হাত নাড়লো। শীত ভালোরকম পড়েছে। জয়ীতার গায়ে কালো হুডি জড়ানো। কোনো সাজগোজের প্রলেপ নেই। তবুও আদনানের মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। জীবনে আর চাওয়ার বা কী আছে!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here