কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে পর্ব ২৮

0
991

#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-২৮
জয়ীতা আর আদনানের সম্পর্ক চলছে একইরকম। টক, মিষ্টি, ঝাল ঝাল টাইপ। জয়ীতা আদনান কে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে না পারলেও আদনান জয়ীতাকে ঠিকঠাক বুঝলো। বাইরে থেকে যতই হম্বিতম্বি রাগ দেখাক। ভেতরের মন টা একদম টলটলে দীঘির জলের মতো স্বচ্ছ। সবচেয়ে যে বিষয় টা ভালো লাগে সেটা হলো ওর মধ্যে ভনিতা ব্যাপার টা নেই বললেই চলে। ভালো হতে হবে, ভালো প্রমাণ করতে হবে এই ব্যাপার গুলোও নেই। ও নিজে যেমন নিজের মর্জিতে চলে তেমনি অন্যদেরও কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেয় না।

জয়ীতাকে নিজের জীবন সঙ্গী বানানোর সময় আদনান শুধু একটা ব্যাপার ই ভেবেছিল। ও তাসিন, নওশিনের চমৎকার বন্ধু হতে পারবে। এটুকু ওর কাছে অনেক বড় কিছু। তবে নিজের বন্ধু বানানোর লোভটুকুও ছিলো। সেটা যে খুব কঠিন হবে এমনটাও কখনো ভাবে নি।

অন্যদিকে জয়ীতাও আদনান কে নতুন ভাবে চিনছে। আদনান কে দেখতে একটু অহংকারী লাগলেও অতোটা খারাপ সে না। জয়ীতার এতো বছরের বিশ্বাস আদনান কে দেখার পর ই ভেঙেছে। এর আগে ওর ধারণা ছিলো সব ছেলেরা বুঝি সাইমুনের মতোই। এখন সেই ধারণা পাল্টেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আদনান কে ওর একটুও খারাপ লাগছে না। বরং বাড়িতে যতটুকু সময় না থাকে ততটুকু সময় কেমন যেন অস্থির লাগে। এমন কেন হচ্ছে! কী কারনেই বা হচ্ছে! জয়ীতা ঠিক করে বুঝে উঠতে পারে না।

***
কথা ছিলো মাস খানেকের মধ্যেই ওদের বিয়ের রিসিপশন হবে। বিয়েতে সবাইকে ইনভাইট করা হয় নি সেটা নিয়ে অনেকের মনেই আক্ষেপ আছে। কিন্তু আদনান চাইলেও জয়ীতা চাইলো না। আদনান কে বলল,

“আমাদের রিসিপশন টা পরে করলে হয় না।”

“হ্যাঁ হয়। কিন্তু পরে করতে চাওয়ার কারণ কী? ”

“এমনিই। কোনো কারণ নেই।”

আদনানের মনে হলো জয়ীতা কিছু হয়তো চেপে যাচ্ছে। ও আর এই বিষয়ে প্রশ্ন করলো না।

***
জুলিনার জীবন টা রীতিমতো অতিষ্ট করে ফেলল জুম্মন আলী নামক ভদ্রলোক। গত এক মাস ধরে জুলিনাকে সমানে ফোন করে যাচ্ছে। জুলিনার অকথ্য গালাগালিতেও কাজ হচ্ছে না। এই উটকো লোক টা কোত্থেকে যে ওঁর নাম্বার পেয়েছে সেটাই বুঝতে পারছে না। তবে লোকটা যে এক নম্বরের মিচকে শয়তান সেটা বুঝতে পারছে। জুলিনার মতো লোকও বিরক্ত হয়ে গেল। এই নিয়ে একদিন আলম সাহেবের বাড়িতে গিয়েও ঝগড়াঝাটি করে এলো। ওর ধারণা এই কাজ আলম সাহেবের। আলম সাহেবই মেছো, গেছো টাইপ লোকজন ওর পিছনে লাগিয়েছে। এই বিষয়ে কথা বলতে গেলে আলম সাহেবের বউয়ের সঙ্গেও ঝগড়া লেগে গেল। জুলিনা অসংখ্য গালাগালি করলেও তাতে কোনো দোষ হলো না। কিন্তু আলম সাহেবের বউ শুধু বলেছে যে বস্তির বেটি। ব্যস এতেই জুলিনা ক্ষেপে গেল। আজ আর আলম সাহেবের বউকে কিছু বলল না। কিন্তু আলম সাহেবের ভুড়িতে কষে একটা ঘুষি মেরেছে। বেচারা হতভম্ব হয়ে গেল জুলিনার ঘুষি খেয়ে।

পুরো ঘটনা শুনে জয়ী খুব রেগে গেল৷ কঠিন গলায় জুলিনাকে বলল,

“আন্টি তুমি আর ওই বাড়িতে যাবে না। ”

জুলিনা ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। বলল,

“একশ বার যাব। আমি কী ওদের চেহারা দেখতে যাই। অমন তেলতেলা চেহারা দেখার ইচ্ছা আমার নাই। আমার কলোনীর সুইপারের চেহারাও ওই ভন্ডর চেয়ে ভালো। আমি যাই আমার টাকা আনতে।”

“তোমার টাকা বাড়িতে যেন দিয়ে যায় সেই ব্যবস্থা আমি করে দেব।”

জুলিনা এবার ক্ষেপে গেল জয়ীর উপর।
রুক্ষ গলায় বলল,

“ওই ছেমড়ি, তোর এতো দরদ ক্যান? ওই ভুড়িওয়ালার জন্য আমার সাথে ঝগড়া করো!”

“উনি তো আদনানের মামা আন্টি। তাছাড়া উনি যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করেছে আমার সঙ্গে। আমি কেন খারাপ ব্যবহার করব!”

জুলিনা এই কথা শোনার পর রাগে কাঁপতে লাগলো। কথা বলতে গিয়ে গলা আটকে গেল। এক নাগাড়ে অনেক কিছু বলে গেল। জয়ীতা সবকিছু ভালোভাবে শুনলোও না। একটা কথাই ভালোভাবে বুঝতে পারলো সেটা হলো,

“আমার বিড়াল আমারেই বলো ম্যাও!”

জয়ীতা ফোন রেখে দুই গ্লাস পানি খেল। নওশিন পাশে ছিলো। জয়ীতাকে বলল,

“ভাবী বোলতার বাসায় ঢিল মেরেছো। এবার তৈরী হও। যেকোনো সময় এসে যাবে। ”

***
জয়ীতার সঙ্গে জুলিনার বাক বিতন্ডা হয়েছে সন্ধ্যের পর। সারাদিন জুলিনা অসংখ্য অকাজে ব্যস্ত থাকে। এই সময়ে ফ্রী হয়ে মুখে ফেসপ্যাক লাগায়, হেয়ারপ্যাক লাগিয়ে আরামসে এটা সেটা খেতে খেতে সবার সঙ্গে কথা বলে। আজও তেমন করছিল। জয়ীতার কথা শুনে এতো মাথা গরম হয়ে গেছে যে ফোন রেখে উঠে মুখ টা ধুয়ে ব্যাগ টা নিয়ে রওনা হলো আদনান দের বাসায়। যেতে যেতে জয়ীতার মা’কে ফোন করে বলল,

“আপা তোমার মেয়েরে আমি আজ দুইটা থাপ্পড় দেব। তুমি তারজন্য কিন্তু রাগ করবা না। ”

তারপর আদনান কে ফোন করলো। আদনান ফোন ধরতেই বলল,

“শোন, তোর ফাজিল বউটারে আমি দুইটা থাপ্পড় দেব। তুই কিন্তু নাক গলাবি না। ”

আদনান অবাক গলায় বলল,

“কেন মামী?”

“কারণ আমার সাথে মুখে মুখে তর্ক করে।”

“মামী আপনি কোথায়?”

“আমি রাস্তায়। সিএনজি খুঁজি। ”

“আপনি বাসায় চলে যান। আমি ব্যাপার টা দেখছি। ”

“তুই বউ কোলে নিয়া বইসা থাক। আমি আসতেছি। ”

জুলিনা ফোন কেটে দিলো। আদনান হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

জুলিনার শেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো না। কথায় আছে না, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। ওর অবস্থা তাই হয়েছে। হঠাৎ মাথায় হাত দিয়ে দেখলো মেহেদী প্যাক টা তোলা হয় নি। ওই অবস্থায় এসেছে। তারপর আরও খেয়াল করে দেখলো যে,
ঘরে পরা ম্যাক্সি পরেই এসেছে। তাড়াহুড়োয় ওড়নার বদলে গামছা পরে এসেছে। শেষমেস তাই বাসায় চলে গেল।

***
জয়ীতা তিন ভাই বোন কে একসঙ্গে ডেকেছে কিছু বলবে বলে। তাসিন, নওশিন আদনান তিনজনই অপেক্ষা করছে। আদনান তাসিন কে জিজ্ঞেস করলো,

“কিছু জানিস কী? কী বলবে?”

তাসিন উল্টো আদনান কে বলল,

“ভাইয়া কিছু জানো কী? ভাবী কী বলবে?”

নওশিন হাসলো। তাসিনও হাসতে লাগলো। আদনান হাসলো না। ওর টেনশন হচ্ছে। ভয়ংকর কিছু বলে ফেললে তো মহাবিপদ।

জয়ী এলো সবার জন্য চা নিয়ে। আদনান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

“এখন আবার চা খাব?”

“আমি যে কথাগুলো বলব সেই কথাগুলো চা ছাড়া শুনতে ভালো লাগবে না। ”

তিন জনেই চা নিলো। আদনান চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে রইলো। এই সময়ে চা খেলে রাতের ঘুমের বারোটা বেজে যাবে।

তাসিন, নওশিন চা খেতে শুরু করলো। জয়ী নিজে এখনো চা’য়ে চুমুক দেয় নি। বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

“আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ”

সবাই জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। বিশেষ করে আদনান।

জয়ীতা আবারও বলল,

“আমি জুলিনা আন্টির আবারও বিয়ে দিতে চাই। ”

আদনান কপাল কুচকে তাকালো। তাসিন বেখায়েলে অনেকখানি চা ফেলেও দিলো।

আদনান বলল,

“যা বলতে চাও ডিটেইলে বলো। ”

“বলছি। আন্টিকে আমি যতটুকু চিনেছি তাতে মনে হয়েছিল যে উনি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষদের একজন। যা ইচ্ছে করতে পারছে, লোকের পরোয়া করছে না। বাট আই ওয়াজ রং। উনি দুঃখী মানুষদের একজন। ওনার পাগলামীর আড়ালে দুঃখ, যন্ত্রনা ছাড়া কিছু নেই। ভদ্রমহিলা রাতে এক ফোঁটা ঘুমানোর জন্য কাজ না থাকলেও সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে এটা সেটা করে বেড়ায়! এভাবে তো একটা মানুষের জীবন চলতে পারে না। তাছাড়া উনি ওনার হাজবেন্ড কে প্রচন্ডরকম ভালোবাসতেন। তার করা অন্যায়ের জন্য পুরোপুরি ঘৃনাও করতে পারছেন না প্রবল ভালোবাসার কারণে। উনি মূলত ওখানে যায় ওনার হাজবেন্ডের সাজানো সংসার দেখতে। কিন্তু দেখার পর সহ্য করতে না পেরে রিয়েক্ট করে ফেলে। এভাবে আসলে চলতে দেয়া যায় না। যে সবাই কে নিয়ে এতো ভাবে তাকে নিয়ে ভাবাটা কিন্তু আমাদের কর্তব্য। ”

আদনান পুরো কথাটা শুনলো। জয়ীতার কথায় লজিক আছে। নওশিন বলল,

“আমরা কখনো মামীকে নিয়ে এভাবে ভেবে দেখিনি। ”

জয়ী হেসে বলল,

“বাইরের রুপ দেখে কখনো ভেতর টা বোঝা যায়! উনি আমার বাসায় যখন থাকতে গিয়েছিলেন তখন সামান্য ভর্তা, ভাত দেখে চোখের জল ফেলেছিলেন। তখনই প্রথম বার বুঝেছি যে উনি আসলে ভালোবাসার কাঙাল।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here