কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে পর্ব ২৬

0
1068

#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-২৬
নওশিনের সঙ্গে যে ছেলেটা ছিলো সে ওর প্রেমিক তো দূরের কথা বন্ধুও না। ছেলেটা ওর সঙ্গে পড়ে ঠিকই কিন্তু কথাবার্তা তেমন হয় না। ডিপার্টমেন্টের ট্যুরে ওদের দুজন কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সেই বিষয়েই দুজনের কয়েকদিন ধরে কথাবার্তা হচ্ছিল। প্ল্যানিং, প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্ট এসব নিয়ে আলোচনা আর কী। তাছাড়া নওশিন কে আদনানের সুবাদে প্রায় সবাই ই চিনে। ওর স্বভাবগত কারণে হোক, কিংবা অন্য কারনে হোক সবাই ই সম্মান করে।

জুলিনাকে নওশিন কয়েকবার বোঝাতে চেষ্টা করলো যে প্রেম, টেম কিচ্ছু না। এমনকি বন্ধুও না। কিন্তু জুলিনা সেসবের ধারে কাছেও গেল না। সে তার মতো গল্প বানাতে লাগলো। এই খবর পৌছে গেল জয়ীতা আর আদনানের কাছেও। জুলিনার খামখেয়ালীপনা আর বেশী বোঝার কারণে নওশিনেরও মেজাজ খারাপ হলো। নওশিন জুলিনার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিলো। জয়ীতাকে ব্যাপার টা জানালে জয়ীতা বলল, ও ফিরে এসে সবকিছু নিয়ে কথা বলবে। আপাতত তাই জুলিনার মাথা ঠান্ডা আছে।

***
জয়ীতা ঘুমিয়ে আছে আদনানের শরীর ঘেষে। এতো কাছে যে নিঃশব্দ নিঃশ্বাসও উপলব্ধি করা যায়। ওদের আজ দেশে ফেরার কথা। সকাল সকাল উঠতে হবে। আদনানের ইচ্ছে করছে না জয়ীতাকে ঢেকে উঠাতে। কী সুন্দর আদুরে বিড়ালের মতো ঘুমিয়ে আছে। আদনান কপালের পাশের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে আলতো করে চুমু খেল। তারপর নিঃশব্দে হাসলো। জয়ীতাকে নিয়ে ওর খানিকটা দ্বিধা দ্বন্দ ছিলো। কিন্তু এখানে এসে এমনভাবে সবকিছুতে মানিয়ে নিয়েছে যে আদনান নিজেও অবাক। প্রতিটা ম্যাচে জয়ীতা দর্শক সারিতে বসে শেষ অবধি খেলা দেখেছে। এমনকি আদনানের ব্যাটিং না থাকা অবস্থায়ও দেখেছে। দুটো ম্যাচে আদনানের পারফরম্যান্স কিছুটা খারাপ হলে জয়ীতা মন খারাপ করা গলায় বলল, থাক মন খারাপ করবেন না।

তবে একটা ব্যাপারে চূড়ান্ত নাস্তানাবুদ করে ছাড়লো। টিমমেট দের সঙ্গে ওর একটা ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক হবার দরুন অনেকেই জিজ্ঞেস করলো, আদনানের সঙ্গে কিভাবে আলাপ।

এই প্রশ্নের উত্তর জয়ীতা দেবার আগে আদনান দিলো। বলল,

“আমাদের এরেঞ্জ ম্যারেজ।”

জয়ীতা লাফ দিয়ে উঠে বলল, ইশ! মিথ্যুক, মোটেও না।

তারপর সকলের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেবার মতো করে বলল,

“আমাদের লাভ ম্যারেজও না, এরেঞ্জ ম্যারেজ ও না। অনেক বছর আগে একবার ট্রেনে দেখা হয়েছিল। তখন উনি সেলিব্রিটি ছিলেন না। চিকন হাত, পা ওয়ালা কোনো বান্ধবীও ছিলো না। সেই সময় উনি আমার ছয়শ বিশ টাকা নিয়ে ভেগে গেছিলেন। তারপর অনেক বছর পর দেখা কিন্তু উনি আমাকে দেখে চিনতে পারলেন না। ”

উপস্থিত লোকেদের মধ্যে একজন প্রশ্ন করলো,

“তাহলে বিয়ে অবধি কীভাবে গড়ালো ব্যাপার টা? ”

“আমি একদিন সিড়ি দিয়ে ধপাস করে পড়ে গিয়েছিলাম। সেটা দেখে উনি প্রেমে পড়েছিলেন। ”

বাকীরা রিয়েকশন দেবার আগেই আদনান শব্দ করে হেসে ফেলল। বাকীরাও এক সঙ্গে হো হো করে হাসতে লাগলো।

সবাই কে একসঙ্গে ওভাবে হাসতে দেখে জয়ীতা প্রথমে অপ্রস্তুত হলেও পরে নিজেও হাসতে শুরু করলো। শেষমেস টিমের সবচেয়ে সিনিয়র প্লেয়ার ঘোষণা দিলো যে এটা তার শোনা সবচেয়ে ইউনিক বিবাহ ঘটিত গল্প। বাকীরাও তার সঙ্গে তাল মেলালো।

আদনান এবার আরেকটু সাহস করে জয়ীতার গালে চুমু খেল। নিজের বউকে চুমু খেতে হচ্ছে না জানিয়ে। জানতে পারলে হয়তো আরেক কান্ড হয়ে যাবে। আদনান তৃতীয় বার চুমু খেতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। জয়ীতা চোখ খুলে তাকালো। আদনান এক সেকেন্ডের জন্য অপ্রস্তুত হলেও জয়ীতাকে সেটা বুঝতে দিলো না। এমনকি আদনান সরেও গেল না। জয়ীতাকে হাই ভোল্টেজ চমক দিয়ে তিন নম্বর চুমুটাও দিলো। জয়ীতা গালে হাত দিয়ে উঠে বসলো। ঘুম ঘুম চোখে স্পষ্ট বিস্ময়। আদনান নিজে উঠে ওয়াশরুমের দিকে গেল। জয়ীতার দিকে তাকালোও না।

***
বাসায় এসে আদনান জানালো আগামী দুদিন ও শুধু ঘুমাবে। ও’কে যেন কোনো প্রকার ডিসটার্ব কেউ না করে। কথাটা যার উদ্দেশ্যে বলা সে ফিরেও তাকালো না।

তাসিন, নওশিন কে দেখে জয়ীতার খুব ভালো লাগলো। ওরাও খুব খুশি হলো। জয়ীতার খুব যত্নও করলো। জুলিনা বারবার ফোন করছে যেন তার বাসায় যাওয়া হয়। সে কিছুতেই এই বাসায় আসবে না। তাকে অপমান করা হয়েছে। সে এক বাপের বেটি। কিছুতেই তাই ওই বাসায় পা রাখবে না। এটা তার সাফ কথা।

জয়ীতা অবশ্য তাসিন, নওশিন কে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। ব্যাপার টা ও আগে থেকে শুনলেও কিছু জানতে চাইলো। নওশিন একবার বলার চেষ্টা করলেও জয়ীতা বারন করলো। বলল, আমি তোমাকে যেমন চিনি তেমনি তোমার মামীকেও চিনি। তাছাড়া কখনো কোনো ব্যাপারে আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমি তোমাদের গার্ডিয়ান না। বন্ধু হতে চাই।

***
আজও দরজা খুলল জুলিনার মা। জয়ীতাকে দেখে চোখ সরু করে ফেলল। জয়ীতা দাঁত, মুখ খিচিয়ে খুবই বিশ্রীভাবে একটা ভেংচি কাটলো। দরজার সামনে আয়না থাকার কারনে নিজেই নিজের বিশ্রী রুপ দেখতে পেল। জুলিনার মা চিৎকার করে ডাকলো, ওই জুলেখায়ায়ায়ায়া পেত্নী টা আইছে।

জয়ীতা গলা খাদে নামিয়ে বলল,

“যাওয়ার সময় ঘাড় টা মটকে দিয়ে যাব বুড়ি।”

জুলিনার মা আবারও কর্কশ গলায় বলল, হা/রাম/জাদি কই গেলিইইইইই

জুলিনা গিয়েছিল গোসলে। ওর আবার শাওয়ারে গোসলের অভ্যাস নেই। বড় বালতি পানিতে ভর্তি করে মগে করে গায়ে পানি ঢালে। আজ বালতিতে পানি ভরার জন্য রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। মায়ের ডাকাডাকিতে উঠলো।

জয়ীতা জুলিনাকে দেখে বলল,

“ওয়াশরুমে ঘুমাচ্ছিলে?”

“গোসলে গেছিলাম রে। একটু চোখ টা লেগে গেল। ”

“এই সন্ধ্যেবেলা? কমোডে ঘুমাচ্ছিলে? ছিঃ!”

“ছিঃ এর কী আছে? আমি কী কমোডের ভিতরে ঢুকে ঘুমাইছি বেক্কল! ”

জয়ীতা সোফায় বসলো। সারা ঘর অগোছালো। সোফার উপর জামাকাপড় এর স্তুপ। ডাইনিং টেবিলে বাসী থালা, বাসন। জয়ীতাকে কপাল কুঁচকে তাকাতে দেখে জুলিনা বলল,

“কাজের বেটিটা আসে না। এইজন্য ঘরের এই অবস্থা। আমার ঘর দেখে এমন করতেছিস! ভন্ড’র বউর বাসা দেখলে কী করবি? এখানে *গু ওখানে মুত।”

জয়ীতা বিরক্ত গলায় বলল,

“সব কথায় ঘুরে ফিরে ভন্ড’র কথা কেন আসে! ”

জুলিনা ঝাঁঝালো গলায় বলল,

“বড়লোকের বউ হইয়া কথাবার্তার সাইজ পাল্টায়ে ফেলছ। ”

জয়ীতা সেকথার জবাব দিলো না। পাশে রাখা একটা ব্যাগ দিয়ে বলল,

“তোমার জন্য শাড়ি এনেছি। ”

জুলিনা খুব খুশি হলো। শাড়ি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তারপর নওশিন প্রসঙ্গে কথা বলল। বলল,

“আরে জানিস না কী অবস্থা! ছেলেটার লম্বা লম্বা চুল। দাঁত সবগুলো লাল। কী বিশ্রী গায়ের গন্ধ! নখে ময়লা। এমন ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় নওশিন।”

“আন্টি ছেলেটা তো নওশিনের বন্ধুও হতে পারে। ”

“আরে রাখ তোর বন্ধু। অমন দুই পয়সার বন্ধু আমারও অনেক ছিলো। দুইদিন রিকশা নিয়া ঘুরে, আর একটা রাজ্জাকের সিনেমা দেখায়ে বলে জুলি আসো বিয়া করি। ”

“তারপর? ”

“তারপর আর কী! দিছি দুইটা জুতা ধরায়ে। এক নম্বরের গাজাখোর। এসব গাজাখোর দের আমি চিনি। কতো দেখছি। ”

“এখন আমি কী করব।”

“যা করতে হবে গোপনে করতে হবে। নওশিন ওই ছেলের কথায় চলে। তাবিজ টাবিজ করছে মনে হয়। তাবিজের খুব পাওয়ার। ভন্ডরেও তো বস্তির বেটি তাবিজ করে বিয়ে করছে। ”

“ভন্ডর বউ এখানে আসলো কেন! নওশিনের ব্যাপারে কথা বলছিলাম আমরা। ”

“আচ্ছা শোন, নওশিন কে এই ছেলের সঙ্গে প্রেম করতে দেয়া যাবে না।”

“ও প্রেম করতে চাইলে আমরা আটকাবো কী করে?”

“আমরা ছেলে ঠিক করে দেব। সেই ছেলের সঙ্গে প্রেম করবে।”

“কীভাবে? ”

“আদনান কে বলবি না। ”

“আচ্ছা।”

“মেট্রিমোনি সাইট থেকে। এদেশেও কিন্তু এর মাধ্যমে বিয়ে হয়। ”

জয়ীতা বুঝতে পারলো না। জুলিনা ভালো করে বুঝালো। কিভাবে প্রফাইল তৈরী করতে হবে। সবকিছু শিখে জয়ীতা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বলল, বাকী ব্যবস্থা ও করবে।

যাবার সময় জয়ীতা আশেপাশে জুলিনার মা’কে দেখলো না। ভদ্রমহিলা দরজা বন্ধ করে বসে ছিলো ওর ভয়ে।

***
জয়ীতা যখন বাসায় ফিরলো আদনান তখনও ঘুমে। জয়ীতা জামা, কাপড় না ছেড়ে আগে মেট্রিমোনি সাইটে প্রোফাইল তৈরী করলো। তারপর পাত্রীর ডিটেইলস আপলোড করলো।

পাত্রীর নামঃ জুলিনা (নিজের দেয়া নাম) বাবা, মা কর্তৃক দেয়া নাম জুলেখা বেগম।

স্বভাবঃ বাচাল, বদমেজাজী, মিথ্যুক, পরোপকারী

বয়সঃ মেয়েদের বয়স জানতে চাওয়া অন্যায়। মাথার চুল পাকে নি। নিয়মিত পার্লারে যায়। বাকীটা বুঝে নিবেন।

শারীরিক গড়নঃ রোগা, পাতলা ফর্সা। স্টাইলিশ।

যেমন পাত্র চাইঃ মধ্যবয়সী পাত্র। যার কোনো বর্তমান বউ নেই। কথা শোনার ধৈর্য্য থাকতে হবে। ভুড়ি থাকলে সমস্যা নেই। অবশ্যই স্টাইলিশ হতে হবে। কোনো টাকলা এলাউড না। মাঝেমধ্যে খামচি, কামড় সহ্য করার মানসিকতা থাকতে হবে। মিথ্যুক, বাচাল এগুলো কোনোটাই হওয়া যাবে না। পরোপকারী হলে সমস্যা নেই।

নোটঃ যৌতুক গ্রহনকারী কেউ আবেদন করবেন না। কারণ পাত্রীর হাতে মা/র্ডা/র হলে সেই দায়ভার আমরা বহন করব না।

সবকিছু লিখে আপলোড করে জয়ীতা নিশ্চিন্ত হলো।

চলবে….
(পেজে চোখ রাখুন। বৃষ্টিলেখার প্রি অর্ডার শুরু হবে কিন্তু শিগগিরই)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here