#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-১৮
নিজের বিয়ের প্রতিটা ইভেন্টই জয়ী খুব উপভোগ করছে। অবশ্য ও জানে যে ওর বিয়ে দুই মাসও টিকবে না। বেচারা আদনান ও’কে দুইমাসের মধ্যেই ফেরত দিয়ে যাবে। তবুও এই মুহুর্ত টা ওর কাছে ভালো লাগছে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে অন্যদের আনন্দগুলো দেখতে। ওর বিয়েতে আত্মীয় স্বজন কাউকে ডাকা হয় নি। বাবা একদিন এই বিষয়ে ও’কে কঠিন লেকচার দিয়েছে। টানা পঁচিশ মিনিট ও’কে আত্মীয় স্বজন বিষয়ক মাসালা শুনিয়েছেন। সব শুনে জয়ী হাই তুলে বলল,
“এগুলো আমাকে বলে লাভ নেই বাবা। আমার একটা রোগ আছে। কারোর কথা এক কান দিয়ে শুনলে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। ”
বাবা আরও কিছু কথা শোনালেন। দুদিন পর বিয়ে হয়ে যাবে এমন মেয়েকে বকাঝকা করা ঠিক না। মন খারাপ করে শ্বশুর বাড়ি যাবে বিষয় টা ভালো দেখায় না। তাই রাগারাগি করলো না।
আর মায়ের অভিযোগ হচ্ছে এতো কাজ কে সামলাবে! আত্মীয় স্বজন থাকলে সবাই হাতে হাতে কাজ করলেও কিছু তো এগুতো। জয়ী এই সমস্যার সমাধানও করেছে। ওর কিছু বন্ধুবান্ধব কে ডেকেছে। তারা এসে বাড়িটা’কে এমন বানিয়ে ফেলল যে ভালো না লাগার উপায় নেই। হৈ, হুল্লোড়, হাসি আনন্দে ভরে গেল। জয়ীর বাবা, মা অন্য সময়ে মেয়ের ছেলে বন্ধুদের দেখলে চোখ ছোট করে ফেলতো৷ এখন অবশ্য সেসব হচ্ছে না। সহজ ভাবেই মেনে নিচ্ছেন। আর জয়ীর বন্ধুবান্ধব সবচেয়ে বেশি এক্সাইটেড আদনানের জন্য। একটু পর পর জয়ীকে জিজ্ঞেস করলো, কীভাবে কী সম্ভব হয়েছে। জয়ী সেসব প্রশ্নের জবাবে লম্বা হাই তুলে বলে, খুব ঘুম পাচ্ছে রে।
***
আদনান দের বাসার দৃশ্যপট সম্পূর্ণ আলাদা। একঝাক মেহমানে ঘর ভর্তি। তাসিন, নওশিন এমনিতে বয়সের তুলনায় পরিপক্ক হলেও মেহমান সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। আর এসব মেহমান একেকজন বারাক ওবামার আত্মীয়। হাত, পা গুটিয়ে বসে থাকে আর হুকুম করে৷ আদনানের দুই ফুপু চৌদ্দ গুষ্টি নিয়ে হাজির হয়েছে। আদনান দেখে খানিকটা বিরক্ত হলো। ও নিজেও খুব বেশী লোকজন কে জানায় নি। এরা এভাবে মৌমাছির মতো ছুটে এলে মহাবিপদ। মিডিয়ার লোকজন এমনিতেই ওঁত পেতে আছে। আদনান যে বিরক্ত হচ্ছে সেটা বোনেরাও টের পাচ্ছে। আদনানের বিরক্তির কারন আছে। আদনানের বাবার ক্যান্সার হয়েছিল। পারিবারিক অবস্থা স্বচ্ছল হলেও ট্রিটমেন্টের জন্য ফুপুদের দ্বারস্থ হলে তখন তারা টাকা দিতে অস্বীকার করেন। বলেন যে জমি লিখে দিলে তবেই টাকা দিবেন। এমনকি বাবা, মায়ের মৃত্যুর পরও স্বার্থ ছাড়া ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন নি।
বিয়েতে সেই সমস্ত আত্মীয় স্বজন ই উপস্থিত থাকা উচিত যারা সত্যিকার অর্থে ভালো চায়। নতুন বর বউকে প্রানভরে দোয়া করে। মুরগীর রোস্ট চিবুতে যারা আসে তারা ওই একদিন খেতে আসলেই হয়। আগে থেকে এসে বিরক্ত করার কী যে মানে সেটা ও বুঝতেই পারে না।
***
গায়ে হলুদের আগের রাতে আদনান জয়ীকে ফোন করলো। জয়ী ফোন ধরে বলল,
“আমি ভীষণ ব্যস্ত। মেহেদী লাগাচ্ছি হাতে। কী বলবেন বলুন।”
আদনান বলল, এমনি র্যান্ডমলি ফোন করা। আপনি কাল, পরশু আজগুবি স্বপ্ন টপ্ন দেখছেন না তো?
“আজগুবি স্বপ্ন মানে? আমার স্বপ্নকে আন্ডারেস্টিমেট করছেন?”
“একদম না। বরং ভাবছি এসব স্বপ্ন আপনিই কেন দেখেন? কই আমি তো কিছুই দেখি না। ”
“কী বলতে চান আমি বানিয়ে বানিয়ে কথা বলি?”
“না সেসব বলতে চাই না। অন্য একটা কথা বলার আছে। ”
“কী?”
“জয়ীতা আপনার কাছে একটা রিকোয়েস্ট আছে। বিয়ের রিসিপশনে এমন কিছু করবেন না যাতে আমাকে লজ্জায় পড়তে হয়। যা করার পরে করবেন। ”
“আমি কী করি? কিছুই তো করি না।”
আদনান আমতা আমতা করে বলল,
“কিছু না, জাস্ট পায়ের দিকে খেয়াল রাখলেই হবে। খুব বেশী হাটাহাটি না করলেই হবে। ”
“মানে?”
“আপনার তো পড়ে যাবার রোগ আছে। এতো মানুষের মধ্যে পড়ে গেলে ব্যাপার টা একটু লজ্জার ই হবে।”
জয়ীতার রাগে গা জ্বলে গেল। ব্যটা আস্ত ইবলিশ। আগে থেকেই জানে, এখন আবার ভালো করে জানলো৷
জয়ীতা রাগ দেখিয়ে বলল,
“রাখছি। আর আমি অতটাও আনসোশ্যাল না। আগে নিজেদের বাড়ির সিড়ি ঠিক করুন। দুই নম্বর সিমেন্ট, বালু দিয়ে সিড়ি বানালে যেকোনো মানুষ ই পড়ে যাবে স্বাভাবিক। ”
আদনান নিঃশব্দে হাসলো। বলল,
“ব্যাপার টা মাথায় রাখলাম। ”
***
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো ধুমধাম করে। আদনানের ইচ্ছে যদিও সবকিছু সাদামাটা হোক। তবে তার ইচ্ছেতে কিছুই হচ্ছে না। এই বিয়ের আয়োজক হলো জুলিনা। আর তার দুই সাগরেদ তাসিন আর নওশিন। এমনকি জয়ীর কোনো কথাও খাটছে না। ওর ডিমান্ড অনুযায়ী কমলা রঙের লেহেঙ্গাও আনা হয় নি। মেরুন রঙের লেহেঙ্গা কেনা হয়েছে তাসিনের পছন্দে। জয়ী দেখে বলেছে,
“ঠিক আছে তোমার মুখ চেয়ে নাহয় পরে নেব। ”
***
জুলিনার সঙ্গে জয়ীর মিল মহব্বত গায়ে হলুদের দিন হলো। তাও নানান নাটকের মাধ্যমে। বিয়েতে আলম সাহেব আর তার স্ত্রীও এসেছেন। আলম সাহেবের স্ত্রীর সাজগোজ দেখে মনে হচ্ছে তারও আজ গায়ে হলুদ। হলুদ শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে ফুলের গয়নাও পরেছে।
জুলিনা অবশ্য বাড়াবাড়ি রকমের সাজগোজ করে নি। তার হাবভাবে গার্ডিয়ান গার্ডিয়ান ভাব৷ খুব একটা সময়ও পাচ্ছে না। জয়ী যখন পার্লার থেকে এলো তখন ছুটে এসে জয়ীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কী সুন্দর লাগছে! একদম ডানা কাটা পরী। ”
জয়ী তখনও কপট রাগের অভিনয় করলো। ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে একবছর জুলিনার সঙ্গে কথা বলবে না। ওর সঙ্গে এমন বাটপারি করেছে! কই ও তো মন থেকেই ভালোবেসেছে।
জুলিনা যেভাবে ছুটে এসেছিল ঠিক সেভাবেই ছুটে গেল অন্য কাজে।
***
আজ শুধু জয়ীতার গায়ে হলুদ। আদনানের গায়ে হলুদ হবে পরের দিন। তাই হলুদের অনুষ্ঠানে আদনান উপস্থিতও নেই। ওর অবশ্য যাবার ইচ্ছে ছিল। কেউ যদি বলতো তাহলে চলেও যেত। একা একা বাড়িতে ভালো লাগবে না বলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। তখন তাসিনের নাম্বার থেকে টেক্সট এলো৷ ওপেন করতেই দেখলো জয়ীতার বিভিন্ন পোজের ছবি। হাবভাবে মনে হচ্ছে নিজের বিয়েতে নিজেই নাচছে। আদনান মুগ্ধ চোখে ছবিগুলো দেখলো। তাসিন কে টেক্সট লিখলো, জয়ীতাকে কটকটে কমলা রঙেও বোধহয় দারুণ লাগতো রে। তোরা শুধু শুধু ঝামেলা করলি!
লিখেও মুছে ফেলল। বোনের সামনে এতটা বেহায়া হওয়া যায় না।
***
জয়ীতা স্টেজে বসে আছে। বন্ধুদের সঙ্গে একবার নাচতে উঠলেও নামতে হলো। মা কটমট চোখে তাকিয়ে ছিলেন। না নামলে তখনই ভষ্ম হয়ে যেতে। তবে ওর খুব ভালো লাগছে। বন্ধুদের এভাবে ওঁর বিয়েতে আনন্দ করতে দেখতেও ভালো লাগছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে জুলিনাও নাচলো। তবে তার নাচটা খানিকটা হাস্যকর হলেও সবাই খুব উপভোগ করলো। জুলিনা বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, পায়ে দিয়ে সোনার নুপুর এই টাইপ গানে নাচলো। জয়ীতা নিজেও বার দুয়েক হেসে ফেলল।
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে জয়ী হঠাৎ খেয়াল করলো জুলিনার মা’ও এসেছেন। খানিক দূরে একটা চেয়ারে বসে কপাল কুচকে তাকিয়ে আছেন। একটু পর পর বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। জয়ী সুযোগ পেয়ে একবার সেদিকে গেল। ভদ্রমহিলা ও’কে দেখে আরও বিরক্ত হলো। জয়ীও শয়তানি করে বলল,
“কী ব্যাপার খাইতে আসছেন? কার কল্লা চিবিয়ে খাবেন? বুড়া কল্লা নাকি কচি কল্লা?”
ভদ্রমহিলা তারস্বরে ডাকতে লাগলেন, জুলেখায়ায়ায়া….
জয়ী দ্রুত প্রস্থান করলো।
***
হলুদ লাগানোর সময় বিপত্তি ঘটলো। এমনিতে জুলিনার সঙ্গে জয়ীর বাবা, মায়ের সম্পর্ক ভালো। জুলিনা তো সারাক্ষন আপা, দুলাভাই করে বেড়ায়। কিন্তু গায়ে হলুদের সময় জয়ীর মা তাসিন কে ডেকে বলল,
“তোমার মামীকে একটু বলবা যেন জয়ীর গায়ে হলুদ না দেয়?”
জয়ী পাশেই ছিল। বলল,
“কেন মা?”
“হলুদ সবার দিতে নাই। সমস্যা আছে। ”
জয়ী বুঝতে পারলো না কী সমস্যা। বলল,
“কী সমস্যা মা?”
“আছে। তুই বুঝবি না।”
“যার জন্য এই বিয়ে, অনুষ্ঠান হচ্ছে সে কেন হলুদ দিতে পারবে না। যে সমস্যাই হোক আন্টিকে কিছু বলার দরকার নেই। ”
জয়ীর মা আর কিছু বলল না। তাসিন, নওশিন দুজনেই মন খারাপ করলো। এই সমস্যার ব্যাপার টা জয়ী বুঝতে না পারলেও ওরা বুঝতে পারছে।
জুলিনা যখনই হলুদ দিতে যাবে তখনই আলম সাহেবের বউ বলে উঠলো, বাজা মেয়ে মানুষের হলুদ দিতে নাই।
জুলিনা রেগে তাকালো। কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদনানের দুই ফুপু বলে উঠলো, কথা তো সত্যি । এই মেয়ের সংসারে অশান্তি হতে পারে। জুলিনা চুপসে গেল। চুপচাপ সেখান থেকে চলে এলো। জয়ীতা এতক্ষনে পুরো ব্যাপার টা বুঝলো। মৃদু হেসে জয়ী বলল,
“অন্যের জামাই ভাগানো মহিলা আমার গায়ে হলুদ দিলেও সমস্যা আছে। কেউ যদি আবার আমার জামাই ভাগিয়ে নেয়। তখন কী হবে?”
আলম সাহেবের স্ত্রীর মুখ ভার হয়ে গেল। সকলে হতভম্ব। জয়ীর মা মেয়েকে বারন করলেও লাভ হলো না। জয়ী জুলিনার হাত ধরে বলল,
“আন্টি আপনি হলুদ মাখান। স্বচ্ছ হৃদয়বতী একজনের ভালোবাসার সামনে এসব সমস্যা তুচ্ছ। ”
জুলিনার চোখে পানি এসে গেল। হলুদ মাখালো ইচ্ছেমতো।
হলুদ পর্ব শেষ হবার পর আদনান জয়ীতাকে ফোন করলো। জয়ীতা ফোন ধরতে পারলো না। আদনান টেক্সট পাঠালো,
“থ্যাংকস জয়ীতা। আজকের ঘটনার কথা আমি মনে রাখব। ”
***
মাঝরাতে আদনান ফোন পেল। জুলিনা নাকি আলম সাহেবের বাসায় গিয়ে তার স্ত্রীকে মেরে এসেছে। মেরে এসেছে বললে ভুল হবে। এক গোছা চুল টেনে উঠিতেছে আর হাতে কামড়ে এসেছে। রাগের সময়ও খেয়াল রাখলো যে চড়, থাপ্পড় দিলে ঝামেলা আছে।
চলবে….