কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে পর্ব ১৬

0
1109

#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-১৬
জয়ীর টেক্সট পেয়েও আদনান কোনো রিপ্লাই দেয় নি। ও সারাদিন অপেক্ষায় ছিলো আদনানের রিপ্লাই এর। একটু পর পর ফোনের দিকে তাকিয়েছেও৷ কিন্তু কোনো খবর নেই। জয়ীর মেজাজ আরও খারাপ হলো। এই ব্যটা নিজেকে কী ভাবে! সেলব্রিটি হয়ে যা খুশি তাই করবে! জয়ী নিজেও কম না, ও তো একদিন সেলিব্রিটি হবে। ভালো, ভালো ফিল্ম বানাবে। চারদিকে শুধু জয়ীতার জয় জয়কার থাকবে৷ তখন ও কাউকে পাত্তা দিবে না। আদনান ওর ফিল্ম দেখে ও’কে ফোন করবে। আজকের ঘটনা মনে রেখে ও ফোন রিসিভ করবে না৷ কিংবা রিসিভ করে ভাব নিয়ে বলবে, আদনান ফয়সাল কে? ওহ সরি ক্রিকেটে আমার কোনো আগ্রহ নেই তাই চিনতে পারিনি। আদনান তখন ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলবে, আপনার ডিরেকশনে ফিল্ম টা দারুণ ছিলো৷ সবকিছু পারফেক্ট। জয়ী তখন ভাব নিয়ে বলবে, থ্যাংকস। প্লিজ কিছু মনে করবেন না আমার একটা ইন্টারভিউ আছে। বাই।

জয়ী এসব ভেবে মজা পাচ্ছে। আর একটু পর পর খিলখিল করে হেসে উঠছে।

সারাদিনে একবারও আদনান ফোন করে নি। জয়ী আরও অপেক্ষা করলো। রাত দশ টার মধ্যে ফোন করলে ভালো, নাহলে ও ফোন করবে।

****
তাসিন, নওশিন বিকেলে এসে সিলেটে পৌছালো। আদনান রিসোর্টেই আছে। ওদের আনার জন্যও যায় নি। ওরা আসার পর জম্পেশ আড্ডাও চলল। এরকম আড্ডা প্রায় ই হয় তবে আজকের আড্ডা টা একটু স্পেশাল। কারন আজ সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি৷ ঠান্ডা বাতাসে বসে থাকতেও ভালো লাগছে। সবে সন্ধ্যে নেমেছে। বৃষ্টি নেই তবে ভেজা মেঘের গন্ধ আছে বাতাসে। আদনান নিজের হাতেই বোনেদের জন্য কফি বানালো। কফির মগ হাতে তুলে দিয়ে আদনান বলল,

“তোরা এভাবে উইদাউট নোটিশে চলে এলি কেন?”

তাসিন বলল,

“তোমার সঙ্গে আমাদের খুব ঘুরতে ইচ্ছে করছিল। ”

নওশিন বলল,

“তুমি তো কোথাও আমাদের নিয়ে যাও না। বিয়ে হয়ে গেলে আরও যাবে না। ”

আদনান ব্যাপার টায় অপ্রস্তুত হলো। সত্যিই বোনেদের নিয়ে ওর কোথাও যাওয়া হয় না। ওর একাই ভালো লাগে ঘুরতে। এইবছর দিল্লী, মথুরা, আগরা একাই ঘুরে এলো। তারপর আবার সুযোগ পেতেই বন্ধুদের সঙ্গে গেল।

আদনান বলল,

“তোরা তো কখনো কোথাও যাবার কথা বলিসও না। তাছাড়া তোদের পড়াশোনা থাকে…..

এরপর দুই বোন মিলে ভাইকে নানানভাবে ক্ষ্যাপাতে লাগলো।

রাত দশটার দিকে ওরা ডিনারে গেল। খাবারের অর্ডার করে অপেক্ষা করছিল তখনই জয়ীর ফোন পেল নওশিন। নওশিন ফোন দেখে হেসে ফেলল। তাসিনকে দেখাতেই ও আদনানের উদ্দেশ্যে বলল,

“ভাইয়া কী করব?”

আদনান একদম স্বাভাবিক গলায় বলল,

“তোর যা ইচ্ছে। কথা বলতে ইচ্ছে হলে বলবি আর নাহলে বলবি না। ”

নওশিন ফোন টা রিসিভ করে স্পিকারে দিলো। জয়ী হড়বড় করে কথা বলতে লাগলো।

“এই তোমরা শুনছো, জুলিনা আন্টির মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”

নওশিন বলল,

“কী বলছ? মামীর মাথা তো আগে থেকেই খারাপ হয়ে আছে। তুমি নতুন জানলে?”

“আমি তো আগে বুঝিনি ওনার মতলব। হাবাগোবা দেখে ভালো ভেবেছি। ”

তাসিন স্বভাবসুলভ মুখ টিপে হাসতে লাগলো। নওশিন বলল,

“কী আর করা বলো!”

ফোনের ওপাশে জয়ী কথাগুলো সাজিয়ে নিচ্ছে। ও আসলে নিস্তার পাচ্ছে না বাবা, মা’র হাত থেকে। মা ও’কে দেখলেই কেঁদে ফেলে। একটা মানুষের চোখে এতো পানি থাকতে পারে ওর ধারনাতেই ছিলো না। ওদিকে জুলিনাও সমানে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। সৌমি থাকলে একটা কিছু বুদ্ধি দিতে পারতো। সৌমিকে ও বাসা থেকে বের করে দিয়েছে ঘাড় ধরে। এই চক্রান্তে ও যুক্ত ছিলো। বেচারি মামার বাসায় গিয়ে বসে আছে। এখন মনে হচ্ছে ও’কে বের করে দেয়াটা ভুল হয়েছে। থাকলে একটা কিছু বুদ্ধি দিতে পারতো। ইশ! কবে যে ওর বুদ্ধিশুদ্ধি হবে!

নওশিন বলল,

“আপু ঘুমিয়ে পড়েছো?”

জয়ী বলল,

“না আছি তো। ”

“তুমি কিছু বলতে চাইছেলে…

জয়ীতা বড় করে নিঃশ্বাস নিলো। তারপর বলল,

“নওশিন, আমি যে তোমাকে কত্তো পছন্দ করি! ”

পাশ থেকে তাসিন বলে উঠলো, আর আমাকে?

জয়ী বলল, হ্যাঁ তোমাকেও।

আদনান সব টা শুনছে। বাম হাতের তালু দিয়ে মুখ ঢাকা থাকলেও ওর ঠোঁটের হাসিটা বোঝা যাচ্ছে।

জয়ী আবারও বলল,

“আপু ডাক টা কতো সুইট! আমার নিজেরও তো বোন নাই। তোমরা আজ থেকে আমার বোন কেমন৷ লতাপাতা টাইপ বোন না একদম আপন বোন কেমন। ”

নওশিন আদনানের দিকে তাকালো। তাসিন বলে ফেলল,

“আমাদেরও বড় বোন নেই আপু৷ তুমি যদি আমাদের বড় বোন হও তাহলে আমরা আদনান ফয়সাল কে দুলাভাই ডাকতে শুরু করব। ”

এই কথার পর জয়ী এক সেকেন্ডও সময় নিলো না ফোন রাখতে। ফোন রেখে ওরা দুই বোন ই হাসতে লাগলো। শুধু আদনান কে কেমন গম্ভীর দেখালো৷

***
জয়ীতাকে আদনান ফোন করলো রাতে। জয়ীতা ফোন ধরেই বলল,

“আপনার খেলা শেষ হয়েছে?”

“না। ”

“তাহলে ফোন করলেন যে?”

” আপনি ফোনের অপেক্ষা করছিলে যে!”

জয়ী থতমত খেল। আমতা আমতা করে বলল,

“আমার কী খেয়েদেয়ে কাজ নেই! আমি কেন অপেক্ষা করব!”

“আচ্ছা! আমি তো শুনলাম আমি ফোন করছি না বলে তুমি ঘর থেকে বের হচ্ছো না। ”

জয়ী ঘর থেকে বের হচ্ছে না এটা সত্যি। কারণ বাবা, মা ঝাপিয়ে পড়ছে৷ জয়ী বলল,

“আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে। কাল সকালে অবশ্যই দেখা করবেন।”

“দেখাটা সকালে না হয়ে বিকেলে হলে আমার জন্য সুবিধা হতো। আমি ঢাকার বাইরে আছি তো। ”

জয়ী একটু ভেবে বলল,

“আচ্ছা। ”

আদনান ফোন রাখতে গিয়েও জিজ্ঞেস করলো,

“দেখা হলে কী বলবেন?”

জয়ী বিস্মিত গলায় বলল, সেটা তো দেখা হলেই বলব। আশ্চর্য!

আদনান তাড়া দেখিয়ে বলল,

“রাখছি। ”

****
জয়ী আদনান কে যে সময় আসতে বলেছে তারও এক ঘন্টা পর জয়ী বাসা থেকে বেরোলো। ব্যটা মজা বুঝুক। মামীকে দিয়ে ওর মতো সহজ, সরল মেয়েকে বোকা বানিয়েছে তার মজা তো বুঝতেই হবে। আজকের ওয়েদার টা খুব সুবিধার না। বৃষ্টি হচ্ছে না, কিন্তু আকাশের মুখভার হয়ে আছে। জয়ী রিকশা নিলো। রিকাশায় গেলে সময় একটু বেশী লাগবে। ভাবওয়ালা ব্যটা আরও বিরক্ত হবে।

আদনান বিরক্তিহীন ভাবেই বসে আছে। নিয়মের বাইরে গিয়ে তিন কাপ কফিও খেয়ে ফেলেছে। জয়ী যে ইচ্ছে করেই এতো দেরি করছে সেটাও বুঝতে পারলো।

জয়ী এসেছে পাক্কা সাড়ে তিন ঘন্টা পর। এসে দায়সারা গলায় বলল,

“হ্যালো। ”

আদনান হাই বলে ঘড়ির দিকে তাকালো। জয়ী মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“বিজি ছিলাম তাই দেরি হয়েছে। এরজন্য মোটেও সরি, টরি বলতে পারব না। আমাদের কাজ করে খেতে হয়। ব্যাটের সঙ্গে বল লাগিয়ে আমরা টাকা পাই না। ”

আদনান চোখ বড় করে তাকালো। গলায় কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে বলল,

“ব্যটের সঙ্গে বল লাগানো খুব ই ইজি?”

“অফ কোর্স। ”

“আপনি পারবেন?”

“কেন নয়? এ এমন কঠিন কী!”

আদনান ঠোঁট উল্টে বলল, আচ্ছা!

জয়ী ফোনে ব্যস্ত হবার ভান করলো। আদনান ঠোঁটের হাসিটা আড়াল করার চেষ্টা করলো। সাড়ে তিন ঘন্টা বসিয়েও রেখেও হয় নি। আরও অপেক্ষা করাবে। আদনান জয়ীকে ভালো করে দেখলো। হাল ফ্যাশনের সালোয়ার কামিজ পরেছে। চুলগুলো সব ই পিঠময় ছড়ানো। কোকড়া চুলও যে এতো সুন্দর লাগতে পারে সেটা আদনানের প্রথম দেখা। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়েছে মেরুন রঙের। তবে আদনানের মনে হলো জয়ীকে হালকা রঙের লিপস্টিকেই বেশী মানায়। চোখে কাজল, আইলাইনার কিচ্ছু নেই। তবুও এই সাজে দেখতে ভালো লাগছে।

জয়ী আড়চোখে আদনানের দিকে তাকালো। চোখাচোখি হতেই আদনান হাসলো। তারপর বলল,

“কী খাবেন? ঠান্ডা পানি নাকি অন্যকিছু। ”

জয়ী কপাল কুঁচকে ফেলল। আদনান হাসতে গিয়েও হাসলো না।

জয়ী আবারও ভাব নেয়ার চেষ্টা করলো৷ কাল রাতে অনেক ভেবে ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে আদনান কে বিয়ে করবে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে অনেকগুলো কারন আছে। প্রথম কারন হচ্ছে ও যদি এই বিয়ে ভেঙেও দেয় তবুও বাবা, মা হাল ছাড়বে না। ও’কে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। দেখা যাবে ক্যাবলা অনীশের সঙ্গে আবার বিয়ে দিয়ে দিলো। ইশ! বেহায়ার মতো সারাক্ষণ ম্যাসেজ দিতেই থাকে৷ ম্যাসেঞ্জারে গেলেই ওর হাই, হুই দেখা লাগে। এমন ছেলের চেয়ে হাজার গুন ভালো আদনান। অহংকারী, দেমাগী হলেও ইরিটেটিং তো আর না।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আদনানের পরিবার। বাবা, মা যদি অন্য জায়গায় বিয়ে দেয়ও সেখানে যদি রাক্ষস, খোক্কস টাইপ শ্বশুর শাশুড়ী জুটে যায়! তাদের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি, কথাবার্তা খরচ করে যদি এনার্জিই নষ্ট হয় তাহলে কাজ করবে কখন! তাছাড়া সব শাশুড়ীরাই বউদের খুঁত ধরার জন্য বসে থাকে। ওর নিজের মা’ও তো লিজার সঙ্গে একটুতেই লেগে যায়। সেখানে তাসিন, নওশিন আদুরে দুটো বাচ্চা মেয়ে। ওরা কোনো ঝামেলা করবে না। আর জয়ীও ওদের খুব ভালোবাসবে।

তিন নম্বর কারন হলো , ও খুব ভালো করে জানে যে ঘর সংসার করা টাইপ মেয়ে ও না। ভালো করে এক কাপ চা বানিয়েও খেতে পারে না। তাছাড়া আদনান কে প্রচুর বিরক্ত করলে আদনান নিজেই ও’কে ছেড়ে দিবে। তারপর শান্তি! ইচ্ছেমতো নাচবে, গাইবে।

বাবা, মা আপাতত শান্ত। জয়ীর মনে হলো বিয়েটা ওর জীবনের সব সমস্যার সমাধান৷ আসল স্বাধীনতাটুকু এই বিয়ে করলেই পাওয়া যাবে।

আদনান ছয় সাত মিনিট ধরে জয়ীর দিকে তাকিয়ে আছে। জয়ী কী যেন ভাবছে আর মাথা নাড়ছে। চোখের পাতাও কাঁপছে। আদনান হাসলো নিঃশব্দে।

**
জয়ী বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

“শুনুন।”

আদনান নড়েচড়ে বসলো। বলল,

“শুনান। ”

“বিয়েতে আমি রাজি। তবে দুটো শর্ত আছে। ”

আদনান জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। জয়ী বলল,

“বিয়ের পর আমার হাত, পা বেঁধে রাখার কথা ভুলেও ভাববেন না। আমার যেখানে যেতে ইচ্ছে করবে যাব। আর দ্বিতীয় শর্ত হলো আমি অনেকক্ষন ঘুমাই। সকালে আমাকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে তোলা যাবে না। অনেক রাত জাগি, তারজন্যও বিরক্ত হওয়া যাবে না। ”

“এতো শর্ত মেনে আমার লাভ?”

“বিনিময়ে আপনার দুই বোন কে আমি প্রচুর ভালোবাসবো৷ অস্কারের সঙ্গেও ভাব করব। তবে আপনি কিছু এক্সপেক্ট করবেন না৷ ”

আদনান বলল,

“এবার কফি দিতে বলি?”

***
দুজন যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোলো তখন রাত। আদনান জয়ীকে বলল,

“বৃষ্টি হতে পারে। গাড়িতে আসুন।”

“এতক্ষন যখন বৃষ্টি হয় নি, এখনো হবে না। ”

আদনান আর জোর করলো না। জয়ীতা রিকশা নিলো। হঠাৎ পিছু ফিরে দেখলো আদনানের গাড়ি পিছনে আসছে। আদনানের উল্টো দিকে যাবার কথা থাকলেও ওর পিছনে আসছে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here