শূণ্যতার পূর্ণতা তুমি পর্ব ১

0
1014

তরকারিতে সামান্য লবণের পরিমাণ বেশি হওয়াতে আমার শাশুড়ি মা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন,
“কি বউ নিয়ে এলাম, রান্নাটাও ভালো করে জানে না।বাপের বাড়িতে কলাগাছের মতনই বাড়ছে খালি!বলি কি এদের বিয়ে না দিয়ে বাসার ফিলারের বানিয়ে রাখতে পারলো না!?

শাশুড়ী মায়ের কথা শুনে আমার চোখ দিয়ে টলটল পানি বেয়ে পড়ে।আমার স্বামী আকাশ তার মায়ের সামনের সোফায় বসে বসে ল্যাপটপের কি-বোর্ড গুলোতে টাইপিং করতেছে।শাশুড়ী মা যে উনার সামনে বসে আমাকে এসব বলতেছেন উনি শুনেও যেন শুনছেন না!আমার ননদী শাশুড়ী মাকে থামাতে থাকে,
” মা ভুল হতেই পারে মানুষের!একটু লবণই তো বেশি দিয়ে ফেললো আর তো কিছু না।এটা নিয়ে প্লিজ চিল্লাপাল্লা করো না!”
“কিসের ভুল?মেয়ে মানুষের ভুল কিসের?!এদের হাত থাকবে ঝুনা!এত ছোট্ট বাচ্চাদের মতন কাজ করলে সংসার ধরে রাখতে পারবে!?আমার একটা ছেলে!বউ যদি সেই একটার মতন না হয় তাহলে একে দিয়ে আমি কি করবো!একে ধুঁয়ে ধুঁয়ে পানি খাবো?

এবার আমার যেনো আরো কান্না পেয়ে যায়!আর শুনতে ইচ্ছে হলো না শাশুড়ী মায়ের কথা,নিজের রুমে চলে এলাম।বালিশের উপর মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকি!কি ছিল আমার জীবনে?সেইদিন শাশুড়ী মা-ই-তো শখ করে নিজেই আমাকে এ ঘরের বউ বানিয়ে আনলেন!বাবা সামান্য একটুখানি মুড়ি কম দেওয়াতে সেই থেকে আমি এবং আমার পরিবার শাশুড়ী মায়ের কাছে খারাপ হয়ে গেলাম!?সবই তো বাবা দিয়েছিলেন–চিড়া,ফ্রাইড রাইস থেকে শুরু করে সন্দেশ-পুয়া অকেশনাল যাবতীয় যা ছিল সব দিয়েছেন!তারপরও উনাদের মন জোগাতে পারি না।সামান্য কিছু একটু ভুল করলেই দোষ ধরে ওমনি!আমার স্বামী আকাশও কিছু বলে না এ নিয়ে!সে শুধু নিজেকে নিয়েই থাকে!নিজের কাজেই মনোযোগ রাখে।কে কি বলছে,বা কি করছে এসবে একদমই নজরে আনে না।আর এটা আমি বিয়ের রাত থেকেই দেখতেছি!
বুঝলাম আমাকে পছন্দ হয়নি।আমাকে যদি তার পছন্দ না-ই হতো তাহলে কেনো বিয়ে করেছিলো!??কেনো?
দরজা ঠেলে রুমে কারো ঢোকার শব্দ পেয়ে তরহর চোখের পানি মুছে ফেলি।তারপর পেছনের দিকে হালকা দৃষ্টি দিয়ে বুঝলাম আকাশ রুমে ঢুকেছে!সে আমার দিকে একটুও না তাকিয়ে বিমূঢ় মূর্তির মতন কাবাব থেকে জামাকাপড় নেয়।বোধহয় গোসল করবে।উনি বাথরুমে ঢুকতে আমি এলোমেলো চুলগুলো কোনোভাবে একটা হাতখোপা করে বেলকনির দিকে চলে আসি।চুপচাপ দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি।কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর পেছনে তাকালাম।আকাশ বাথরুম থেকে বের হয়েছে।কালো কালােরর টি-শার্ট পড়েছে একটা,সাথে গাবাড়ী প্যান্ট।ভেঁজা চুলগুলো থেকে শিরশির করে পানি পড়ে সারামুখে লেগে আছে!ফর্সা মুখে একটু বেশিই মানানসই দেখাচ্ছে!ছোট্ট একটা তপ্তশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার!আমি উনার থেকে কিছুটা ঘোর,শ্যাম-উজ্জ্বল বর্ণের,তাইতো আমাকে সবাই এতটা ছোট নজরে দেখে!চোখ আবার ভিঁজে আসতে চাইলো!খুব কষ্টে সামলালাম!এমন সময় আমার ননদী ভেতরে ঢুকে!বেলকনির দিকে এগিয়ে এসে,

“ভাবী?খেতে আসো তাড়াতাড়ি।”

আমি হেসে জবাব দিলাম,
“খেতে ইচ্ছে করতেছে না।”
“কি বলো এসব?দুপুরে খাবে না মানে?মায়ের উপর রাগ ভাবী?এই মা-না একটু অন্যরকম!আমিও যদি কোনো কিছু ভুল করি ওমনি চিল্লাপাল্লা করতে থাকেন।বয়স বেড়ে গিয়েছে তো তাই আর কি…এমনিতে মা খুবই ভালো।”

বলে ননদী হাসতে থাকে।হাসার সময় গালে ওর টোল পড়ে।বয়স বেশি না।পনেরো আর কি।এবার ক্লাস নিউ টেনে।দেখতে খুবই মিষ্টি।এবং ব্যবহারও।এই বাসায় আসার পর থেকেই এই মেয়েটি আমাকে একটু বুঝে।
“আহা, ভাবী!আর দাঁড়িয়ে থেকো না তো?আসো!”

এ বলে হাত টেনে নিয়ে যেতে থাকে।তারপর রুমে আসার পর এবার আকাশের দিকে তাকিয়ে,
“তুমিও তাড়াতাড়ি খেতে আসো ভাইয়া!”

আকাশ ননদীর কথায় বলে,
“যা।”

ব্যাস্ এটুকুই।কথার শব্দ খুবই ছোট্ট উনার।স্বল্পভাষী যাকে বলে।ননদী হাঁটতে হাঁটতে বলে,
“ভাবী,জানো ভাইয়া কেনো এত কম কথা বলে?”
“কেন?”
“প্রিয় কিছু যদি…
এতটুকু বলেই ননদী বাক্যটা অসমাপ্তি রেখে আরেকটা বাক্য টানে,
… আচ্ছা ভাবী প্রেম করেছো কখনো?”

ননদীর শেষ কথাটা আমার মাথায় পাত্তা পেল না।ছুটে গেলাম অসামপ্ত বাক্যটিতে!
“সুবর্ণা?প্রিয় কিছু মানে?ক্লিয়ার হলাম না!একটু বুঝিয়ে বলবে?”

সুবর্ণার ননদীরই নাম।সে হেসে উঠে আবার।বলে,
“আরেহ ওইটা তো এমনিই জাস্ট বললাম।আগে খেতে আসো ত!”

সুবর্ণার কথা আমার ঠিক মাথায় ঢুকলো না।মনটা এই “প্রিয়” শব্দটিতে আঁটকে রইলো!আর সে যে কথা ঘুরিয়ে ফেলেছে তা বুঝতে পেরেছি!টেবিলের কাছে যেতে শাশুড়ী মা আমার দিকে ভ্রু যুগল কুঁচকে একপলক তাকিয়ে আবার দৃষ্টি অন্যদিক করে নেন!সুবর্ণা চেয়ার টেনে বসে।আমি আর বসি নি।ভাত বাড়বো সব প্লেটে।তাই হাতটা বাড়িয়ে দিলাম ভাতের বাটির দিকে,ওমনি শাশুড়ী মা বলে উঠেন,

“তোমার ভাত বাড়তে হবে না।আমিই বেড়ে আমার ছেলেমেয়েকে দিচ্ছি।নাহলে এখনও ভুল করে বসবে!এটাতো তোমার স্বভাব আবার!”

সুবর্ণা মুখটা কালো করে ফেলে।এরমাঝে আকাশ আসে।আকাশকে দেখে সুবর্ণা বলে উঠে,
“ভাইয়া?মাকে কিছু বলবা?”

আকাশ চেয়ারে বসতে বসতে লাগামছাড়া কন্ঠে বলে,
“মা আবার কি করেছে?”

সুবর্ণার রাগ উঠে যায়।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে,
“ভাবী?তুমি বসো ত!মা তো বলেছেন মা বাড়বে!”

আমি তারপরও দাঁড়িয়ে রইলাম।কেননা বসতে গেলেও যদি আবার দোষ ধরে?

———————————————————
খাওয়াটা শেষ হলে রুমে এসে বসলাম।হাতে ফোন নিয়ে একটু ইউটিউবে ঢুকলাম।মনটা ভালো নেই।দুঃখের গান শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তে। তাই একটি গান সারচ করলাম সেই শিল্পী খালিদ হাসান মিলুর সেই পুরনো,এখনো শুনলে বুকের ভেতরের সব দুঃখকষ্ট দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে—–আমার মত এত সুখী,নয়তো কারো জীবন..!কি আদর স্নেহ-ভালোবাসা,হারালো মায়ার বাধন।জানি এই বাঁধন ছিঁড়ে গেলে কভু,আসবে আমার মরণ..!”

ঠিক তখনই,
“একটু শান্তিতেও কি ঘুমতে পারবো না!সময়-অসময় গান!মানে…!”

তখনই আমার টনক নড়ে উঠলো।আসলে গানটি দেখতে দেখতে গভীরে চলে গেলাম।চোখে পানিও চলে এলো।চর আকাশও কখন রুমে ঢুকলো খেয়ালই ছিলনা।তাড়াতাড়ি গানটা অফ করে সামনে তাকালাম।আকাশ দাঁড়িয়ে আছে বিছানার সামনে।চোখমুখে বিরক্তি উনার।আমি নিজেকপ শান্ত করে নিজের জায়গায় এসে বসলাম।উনি ওমনি উল্টোদিক ফিরে শুয়ে পড়লেন!আমি আর নড়লাম না।ওভাবেই, ওই ভঙ্গিতেই বসে রইলাম
সেখানে।বসার সময় কতক্ষণ ছিল খেয়াল নেই ঠিক।আর কখন আবার উনার পায়ে ঘুমিয়ে রইলাম তাও খেয়াল নেই।আর ঘুম থেকে জাগতেই দেখি বুকের উপরের কাপড়টা সরে গেছে!পাশ ফিরে তাকিয়ে আকাশ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলের ভাঁজ ঠিক করতেছে!আমি লজ্জায়,অণুশোচনায় তরহর করে শোয়া থেকে উঠে বসি।বুকে আঁচল টেনে নিই।জিভ কাঁটি-ইয়া আল্লাহ এটা কি হলো?উনি তাহলে সব দেখে ফেলেছেন!ভেবে আবারো জিভ কাঁটি!ঠিক তখন উনি আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ান।আর বলেন,

“আমার পাশে শোয়ার সময় নিজেকে যথেষ্ট শালীনতায় যেন রাখা হয়।ইচ্ছে করে লজ্জাস্থান
অনাবৃত রেখে আমার মন পাওয়া যাবে এটা ভাবাও বোকামি!”

এই বলে আকাশ বাইরে যেতে ব্যাগ্র হয়।আমি বলে উঠি,
“স্ত্রীর কি এটা অধিকার নয়?আর স্বামীর সামনে স্ত্রী অর্ধ-উলঙ্গ,অথবা উলঙ্গ থাকারও নিয়ম আছে!”

আকাশের চোখমুখ লাল হয়ে যায়!বলে উঠে,
“আর ইউ ম্যাড?তুমি কি বলতেছো তুমি নিজেই বুঝতেছো?মানে…উলঙ্গ!অধিকার!বিয়ের পর থেকে তোমার সাথে আমি তেমন কথা বলিনা।আমার হাবভাবে কি তোমার অধিকারের বিষয়টা খাঁটে,ভেবে দ্যাখো ত একবার!”
“আমি কি দোষ করেছি?কি ভুল করেছি?কারণ তে বলবেন।আমার সাথে কথা বলেন না।কিছু জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে যান!কেনো আমার সাথে এরকম করেন আপনারা?আমি কি মানুষ না?আমি রোবট?
” আজ তোমাকে একটা কথা বলি–তুমি এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছো মায়ের পছন্দে!আমার নয়!
এ বলে আকাশ আর দাড়ালো না।গমগম পায়ে বেরিয়ে গেল সামনে থেকে।বুক ফেঁটে কান্না বেরিয়ে এলো!কেঁদে উঠলাম আওয়াজ করে!

#শূণ্যতার_পূর্ণতা_তুমি
#রোকসানা_আক্তার
#সূচনা_পর্ব

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here