গোধূলিলগ্ন ৩৬

0
280

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৩৬

মিতুর চারপাশ জুড়ে সুন্দরী রমণীদের ছড়াছড়ি। তাদের বেশভূষা, পোশাক-আশাকের ধরণ দেখে মিতুর মাথা ঘোলায় খারাপ ভাবে। মায়ার সঙ্গে সম্ভবত দশ কি পনেরো মিনিটের মতো ভিডিও কলে কথা বলতে পেরেছিল। সময়সীমা বেঁধে না দেওয়া হলে, মা-মেয়ের কথা হয়তো থামবার জো রইত না। মিতু চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ব্যস্ত মেয়েদের পরখ করে চলেছে। বুঝতে চেষ্টা করছে তাদের কথার ধাঁচ। তাদের অনর্গল বলে চলা ইংরেজি শব্দের ব্যবহার মিতুকে বেশ কৌতূহলী করে তুলছে। মেয়েরাও কম যায় না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মিতুর দৃষ্টি অনুসরণ করে আড়চোখে চেয়ে ফিসফিস করে চলেছে। একজন মিতুকে ডেকে বলল, ‘এই এদিকে এসে আমার চুলগুলো একটু উঁচু করে ধরোতো।’

নীল গাউন জড়ানো লম্বাটে শরীরের মেয়েটার ডাকে সায় দিল মিতু। কাছে গিয়ে শুধায়, ‘আমারে কইতাছেন?’
মেয়েটি মুখ ঝামটি দিল। ঝাঁঝ কন্ঠে বলে উঠল,
‘তো এখানে তুমি ছাড়া অন্য কাউকে কি সার্ভেন্ট মনে হচ্ছে? আমার শ্যুট রয়েছে তাড়াতাড়ি চুল উঁচু করে ধরো আমি নেকলেস পরবো।’
মিতু কাঁধ অবধি মাথা কাত করে মেয়েটির সিল্কি চুল দু’হাতের মুঠোয় আগলে খানিক উঁচু করে ধরে। তখন একজন পুরুষালী কন্ঠ শোনা গেল, ‘রাইমা, তোমার স্টেজে যাবার সময় হয়ে এসেছে আর তুমি এখনও রেডি হচ্ছো?’
রাইমা নামের মেয়েটি তাগাদা দিয়ে বলল,
‘আই অ্যাম ডান, অনিক ভাইয়া।’
রাইমা নিজেকে আয়নায় দেখে নিয়ে পার্স থেকে একশো টাকার একটা নোট মিতুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নাও।’

মিতু নির্লিপ্ত চোখে তাকালো। অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘কিহের লাইগ্যা?’
রাইমা সূচাগ্র তীক্ষ্ণতা নিয়ে মিতুর মুখপানে চাইল। রূঢ়ভাবে বলল, ‘ধরোতো ফাউল!’ টাকাটা মিতুর হাতে গুজে দিয়ে হাইহিলের টকাসটকাস ধ্বনি তুলে লাল পর্দার ওপিঠে হারিয়ে গেল রাইমা। মিতু টাকাটার দিকে মনস্থির করে তাকিয়ে থাকল ক্ষণকাল। হঠাৎই কোত্থ থেকে লুৎফর প্রকট হলো মিতুর চোখ সম্মুখে। ঠোঁটে টান টান হাসিসমেত বলল, ‘আপনার ট্রেইনার চলে এসেছে, চলুন আমার সাথে।’
মিতু মৌনতা ধরে লুৎফরের চরণ অনুসরণ করে হাঁটল। নিরাক পড়া এক নিস্তব্ধ কক্ষে দুটো চেয়ার আর একটা কাঠের টেবিল ফেলানো। দুটো চেয়ারের একটায় রোগা-সোগা পাতলা গড়নের একটি মেয়ে বসা। পরনে ওয়েস্টার্ন পোশাক। চুল এক পাশ থেকে ছেলেদের মতো ছোট এবং অন্যপাশ থেকে কিছুটা বড়ো। অর্থাৎ, এক পাশের চুল হাতের মুঠোয় আসবে তো অন্যপাশেরগুলো আসবে না এমন। মিতুর প্রথমে লিঙ্গ বুঝতে সমস্যা হলেও মেয়েটার শরীরের গঠন ও মুখের সাজগোছ স্পষ্ট জানান দিল যে, সে মেয়ে। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে নানান কিছু বিচিত্র দৃশ্যের সাক্ষী হলো মিতু। যা মস্তিষ্ক জুড়ে স্নায়ুযুদ্ধ চালাচ্ছে প্রবলভাবে। মিতুর সম্বিৎ ফেরে লুৎফরের কন্ঠস্বরে, ‘হ্যালো মিস নাবিলা, আপনাকে বসিয়ে রাখার জন্য স্যরি।’
নাবিলা হেসে বলল, ‘ইট’স ওকে, হোয়্যার ইজ মাই নিউ স্টুডেন্ট?’

লুৎফর মিতুকে দেখিয়ে বলল, ‘মিট হার, সি ইজ মিতু, ইওর নিউ স্টুডেন্ট।’
নাবিলা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বিস্ময়াহত কন্ঠে বলে, ‘আর ইউ জোকিং?’
লুৎফর গগনবিদারী অট্টহাসি হেসে প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘আই অ্যাম সিরিয়াস।’
নাবিলা মিতুর আপাদমস্তক এক নজরে দেখে বলল, ‘একজন চাকরানীকে মডেল বানানোর আইডিটা কার বলুনতো? আই কান্ট বিলিভ দিস! হাউ ইট’স পসিবল?’
‘অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্যই আপনাকে মনে করা। এনার গ্রুমিং কেবল আপনিই করতে পারবেন।’
‘পাগল নাকি? এর গ্রুমিং কিভাবে করবো আমি? আচ্ছা আপনারা ফ্যাশন-শো এর সঙ্গে ফ্যান্সিড্রেস কম্পিটিশনও করে থাকেন নাকি? এই মেয়ে কি ইচ্ছে করে এমন গেট-আপ নিয়েছে?’ নাবিলার বিরতিহীন প্রশ্নে লুৎফর শব্দ তুলে হাসল। যা নাবিলার মেজাজ আরও তুঙ্গে তুলল।
‘সবসময় হাসবেন না তো মিস্টার লুৎফর! আমার প্রচুর রাগ হচ্ছে কিন্তু!’
লুৎফর হাসি থামিয়ে বলল, ‘মনোযোগী হয়ে আমার কথা শুনুন, সবটা পরিষ্কার হবে।’
_______
শহরে ফিরছে কাব্য,রাত্রি ও সাজিদ। গাড়ির পেছনের সীটের এক প্রান্তে কাব্য তো অন্যপ্রান্তে রাত্রি। সাজিদ সামনে বসেছে। প্রবাহমান গাড়ি হতে সৃষ্ট শব্দ ব্যতীত অন্য কোন শব্দ কারো কান স্পর্শ করছে না। গভীর ধ্যানমগ্নে নিমজ্জিত কাব্যর বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ কোনরূপ হেলদোল নেই। রাত্রি ক্ষণে ক্ষণে মূর্তিভাব কাব্যকে আড়চোখে দেখে নিচ্ছে। অনেকবার কথা বলার প্রচেষ্টা চালাতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছিল সে। কি মনে করে রা করল না যেন। শেষে অতিষ্ঠ হয়ে সাজিদকে ম্যাসেজে বলল, ‘স্যারের সঙ্গে কথা বলছো না কেন? কথা বলে তাকে স্বাভাবিক রাখতে পারো না, আহাম্মক!’

সাজিদ ম্যাসেজটি পড়ে থতমত খেল। অনভ্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘স্যার কিছু বলছেন না যে! কিছু খাবেন স্যার? গাড়ি থামাবো কি?’
কাব্য সংক্ষেপে জবাব দিল, ‘না।’
‘চুপ করে থাকবেন না স্যার। আমরা ঢাকা পৌঁছে গেলে কোন না কোন একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। আমরা মিতু ও তার মেয়ের সন্ধান পেয়ে যাব। এ নিয়ে চিন্তা করে নিজের ক্ষতি করবেন না।’
কাব্য কিছু বলল না। রাত্রি বলল,
‘ঠিক বলেছো সাজিদ। আমাদের স্যারের বুদ্ধির কাছে দুষ্টু লোকেরা আজ অবধি কখনো টিকতে পেরেছে কি? পারেনি তো। যে বা যারা এমন কুৎসিত খেলা খেলছে, তাদের ঠিক বের করে ফেলবেন আমাদের স্যার। তাইনা স্যার?’
‘আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করবেন আপনারা? আমাকে একটু শান্তি মতো ভাবতে দিন দয়া করে!’ কাব্যর কঠোর ধমকে রাত্রি ও সাজিদ মুখে কুলুপ এঁটে পুনরায় জবুথবু হয়ে বসল।
_____
মিতু একবার লুৎফরের দিকে তাকাচ্ছে, তো একবার নাবিলার দিকে। তার মধ্যে কোন রকম ভাবান্তর বা খারাপ লাগার সৃষ্টি হচ্ছে না তার দিকে নিক্ষেপ করা নাবিলার তুচ্ছার্থক বাক্যবাণে। আচমকাই নাবিলা তীক্ষ্ণ মেজাজে বলে ওঠে, ‘তার মানে এই গ্রামের অশিক্ষিত, আনস্মার্ট, গেঁয়ো মেয়েটাকে আমার গ্রুমিং করতে হবে? আই কান্ট ডু দিস!’
নাবিলা হাতের ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে পুনরায় বলল, ‘আমার দ্বারা এই দুর্লঙ্ঘনীয় কাজটি টোটালি ইম্পসিবল। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি ফর দ্যাট মিস্টার লুৎফর।’
নাবিলা চলে যাবার জন্য উদ্যত হতেই লুৎফর বাঁধাসমেত বলল, ‘চলে গেলে আর কখনো আমাদের কাজে আপনাকে ডাকা হবে না। বস স্পষ্ট তা জানিয়ে দিয়েছেন।’
নাবিলা সময় নিয়ে ভাবল। মিতুর সামনে গিয়ে বলল, ‘তুমি কি একেবারেই মূর্খ, নিরক্ষর?’

মিতু নড়বড়ে কন্ঠে জবাবে বলে, ‘ক্লাস সিক্সের বার্ষিক পরীক্ষাডা খালি দেই নাই।’
‘ছি! লজ্জা করেনা এতটুকু কোয়ালিফিকেশন নিয়ে মডেলিং এর স্বপ্ন দেখতে?’ নাবিলার উচ্চ ধমকে বুক কেঁপে উঠল মিতুর। লুৎফর এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘ইনি মডেলিং করতে চাননি, বসের ইচ্ছে এসব। আপনি ফারদার এমন বিহেভ করলে, আমি স্যারকে তা জানাতে বাধ্য হবো। স্যার কিন্তু অন্য কোন ট্রেইনার দিয়ে কাজ করাতে পারবে। তবে আপনি কিন্তু আমাদের হয়ে আর কাজ করতে পারবেন না। এই সিম্পল কথাটা মাথায় নিচ্ছেন না কেন?’
নাবিলা দাঁতে দাঁত পিষে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বলল, ‘কবে থেকে ক্লাস নিতে হবে? সময় কতদিনের?’
লুৎফর বলল, ‘এখন থেকেই। সময় মাত্র ১৫ দিন।’
চলবে ইনশাআল্লাহ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here