গোধূলিলগ্ন ৩৪

0
297

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৩৪

পুলিশের জোড়ালো ধমক ও লাঠি চালানের ভয়ে ভীড় ভেঙেছে অনেক আগে। মিতু তখনও আগের অবস্থা ধরে রেখেছে। গোসল, খাওয়া জলাঞ্জলি দিয়ে মেয়ের চিন্তায় বিভোর মিতুকে মানসিক রোগীর চেয়ে কম কিছু মনে হচ্ছে না। পাশের টং দোকান থেকে কাব্য খাবার কিনে এনেছে৷ তার এক হাতে চা, অন্যহাতে পাউরুটি। যদিও বাসি, তবুও এখনকার জন্য এটাই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ধারেকাছে কোন হোটেল বা রেস্তোরাঁ নেই বলে এটাই শেষ আশ্রয়। কাব্য সেতুকে ডাক দিয়ে বলল, ‘তোমরা দুই বোন গতকাল থেকে কিছু খেয়েছো?’

সেতুর পরিশ্রান্ত শরীর। এরপরও খাবারের জন্য কোন আকুতি নেই। মায়া যেন তার সব ক্ষুধা গ্রাস করে হারিয়ে গিয়েছে। মায়াকে পেলে পুনরায় সে তার ক্ষুধার তাড়না রপ্ত করতে পারবে। মিতুও তাই।
সেতু অনভ্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘খিদা নাই আমগো। মায়ারে না পাইলে যে আমগো দুইজনার গলা দিয়া এক ফোঁট পানিও নামবো না। মায়ারে ছাড়া আমরা পাথর। শ্বাস-প্রশ্বাস চালিত মানুষগো খিদা, ঘুম, গোসলের দরকার পড়ে। আমগো লাগান জড়বস্তুগো না।’
কাব্য সেতুর পাশ কেটে মিতুর সামনে গিয়ে বসল। পাউরুটি ছিড়ে মিতুর মুখের সামনে ধরে বলল, ‘খেয়ে নে মিতুবুড়ি। তোর চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না মোটেই। সুস্থ না থাকলে মেয়েকে খুঁজবি কি করে? বিছানায় পড়লে তোর মেয়ে কি চলে আসবে বল?’

মিতু নিশ্চুপ, নির্লিপ্ত ভাব ধরে রেখেছে। কাব্য কিছুক্ষণ বৃথা চেষ্টা করে উঠে দাঁড়ায়।। কিছুতেই মিতুকে স্বাভাবিক করতে পারছে সে। আর না পারছে মিতুকে একা ফেলে কোথাও যেতে। রাতে ঘুম হয়নি কাব্যর। শরীরে তেমন এনার্জি নেই। রাত্রি দুপুরে অনেক বুঝিয়েও কাব্যকে খাবার খাওয়াতে পারেনি।

সন্ধ্যা কাটিয়ে জ্যোৎস্না রাতের আবির্ভাব ঘটে। কাব্য রাতের খাবার কিনে দিয়ে সাজিদকে নিয়ে হোটেলে চলে যায়। রাত্রিকে রেখে যায় সেতু ও মিতুর খবরাখবর জানার জন্য। রাত্রি বিভিন্ন কথায় আটকে ফেলে সেতু,মিতুকে গোসল করাতে পারল। প্রায় এক ঘন্টার ব্যবধানে একশো বত্রিশটি ম্যাসেজ রাত্রির ম্যাসেজবক্স দখল করে নিয়েছে। প্রতিটি ম্যাসেজ কাব্যর নাম্বার থেকে আসা। দুই,তিন লাইনের মুঠো বার্তায় অন্যান্য শব্দ ব্যতীত, কেবল ‘মিতুবুড়ি’ নামটি জ্বলজ্বল করে উঠছে রাত্রির চোখ সম্মুখে। মিতুবুড়ি স্নান করেছে কিনা? মিতুবুড়ি খেয়েছে কিনা? মিতুবুড়ি কান্না থামিয়েছে কিনা? মিতুবুড়ি করছে কি? মিতুবুড়ি কিছু বলছে কিনা? একই সব বার্তা ঘুরে ফিরে এসেই চলেছে। রাত্রি ফোন হাতে নেওয়ার সময় পাচ্ছিলো না বিধায় বিরক্ত হয়ে সাইলেন্ট করে রেখেছিল। মিতু স্নান করেছে-সংবাদটি জানাতেই মূলত ম্যাসেজগুলো নজর কাড়ে। রাত্রি মলিন হাসল। অস্ফুটে বলল, ‘আমার কথা একবারও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করেননি? আশ্চর্য! আমি কে? কাব্য কেন জিজ্ঞেস করবে আমাকে নিয়ে?’
এর কিছুক্ষণের মাথায় কাব্যর আরেকটি ম্যাসেজ আসে। রাত্রি দেখবে না করেও দেখল, ‘আপনিও তো না খেয়ে আছেন, তিনজনই খেয়ে নিয়েন। আমি খেয়েছি, আমাকে নিয়ে ভাববেন না।’
কাব্যর এই কথায় রাত্রির সব অভিমান ফুড়ুৎ করে পালালো। কাব্য তার কথা ভুলে যায়নি, এইটুকুতেই জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেল।

মিতু মায়াকে নিয়ে সবসময় নিচতলায় মাঝখানের ঘরটায় ঘুমোয়। আজও সেখানেই শুয়েছে। রাত্রির জোরাজোরিতে হার মেনে গপাগপ কটা খেয়েছিল। সেতু খাবার পর চলে গিয়েছিল নিজ বাসায়। মিতু অনেক জোর করেও সেতুকে নিজের কাছে রাখতে পারেনি। রাত্রি নিচতলার শেষের ঘরটায় ঘুমোচ্ছে। সেই ঘরটা পরিষ্কার ছিল বিধায় তাকে সেখানেই থাকতে বলা হয়। জানালা দুটো খোলা। খোলা জানালা দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে দক্ষিণা বাতাস ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। মিতু হঠাৎ উঠে বসল। তার কোমড় পর্যন্ত চুল বাতাসের তোড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে দোল খাচ্ছে। জ্যোৎস্না রাতের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মিতুর ভারাক্রান্ত মুখশ্রী। ঘুম মিতুর চোখ ছুঁতে নারাজ। চোখ বুজলেই মায়াকে নিয়ে খারাপ চিন্তারা দলবেঁধে হানা দিয়ে যাচ্ছে বারংবার। রাত তখন ভালোই। সময় বারোটার ঘর অতিক্রম করেছে। গ্রামাঞ্চলে রাত বারোটা মানে গভীর রাত। মিতু বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথা একটু ঝুকে আছে। হঠাৎ জানালা দিয়ে কারো ফিসফিসানির আওয়াজ ভেসে আসল।
‘শুনছেন, এইদিকে তাকান।’
মিতুর কান অবধি সেই আওয়াজ পৌঁছালো না দেখে হাতের আংটি খুলে ছুড়ে মারা হয় মিতুর দিকে। আংটিটা মিতুর কনুই এ গিয়ে লাগল। দ্রুত চোখ খুলে এলোমেলো শরীরে আশেপাশে তাকাতে লাগল মিতু। জানালার পাশে থাকা লোকটি হাতের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ধরল মিতুর দিকে। মিতু ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। কাঁপা কন্ঠে বলল,
‘কে ওখানে?’
লোকটি স্পষ্ট স্বরে বলল, ‘নিজের মেয়েকে চাইলে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন।’

মিতু জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে লোকটার মুখ দেখার চেষ্টা করল। ভালো করে তাকাতেই চিনে ফেলল বাদশার পার্সোনাল সিকিউরিটি লুৎফর রহমানকে। মিতুর চোয়াল শক্ত হলো। কিড়মিড় করে বলল, ‘তুই চেয়ারম্যানের পোলার চামচাডা না? এইহানে কি তোর?’
লুৎফর ফিক করে হেসে বললেন, ‘ভালোই চিনেছেন। কিন্তু তুইতোকারি কেন করছেন? অভদ্রতার একটা সীমা থাকে।’
‘তোগো লাগান মাইনষের লগে ভদ্র হইয়া কথা কইলে আমার গতর জ্বলবো। কি দরকারে আইছোস এইহানে?’
‘বললাম না আপনার মেয়েকে চাইলে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। সেটার জন্যই…
‘আমার মায়া কই? কই লুকাইছোস তারে?’ মিতু জানার ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে লুৎফরের গলা টিপে ধরল। লুৎফর জোর খাটিয়ে গলা থেকে মিতুর হাত সরাতে পারলেন। তিনি জানালা থেকে একটু দূরে সরে বললেন, ‘কথার আগে হাত চলে কেন আপনার? আমিতো আপনার মেয়ের খোঁজ দিতেই এসেছি নাকি! দাঁড়ান দেখাচ্ছি।’
লুৎফর বুক পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা ভিডিও ওপেন করে মিতুর সামনে ধরল। ভিডিওতে মায়াকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মায়াকে একটা চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। পাশে আরেকটা চেয়ারে খাবারের প্লেট ও পানির গ্লাস রাখা। মায়ার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কান্না করছে। তবে সাউন্ড অফ করে রাখায় মায়ার কথা শোনা যাচ্ছে না। মিতু ফোনটা ধরতে গেলে লুৎফর হাত সরিয়ে আনে। তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, ‘মেয়েকে দেখে কষ্ট হচ্ছে, নাকি আনন্দ লাগছে?’
মিতু হাতজোড় করল। উম্মাদের ন্যায় বলল, ‘আমার মেয়েরে ফিরায় দেন। ওর ক্ষতি কইরেন না। ওইটুক বাচ্চা মেয়েরে কষ্ট দিয়া আপনাগো লাভ কি ভাই?’

লুৎফর গগনবিদারী অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে৷ পেটে হাত চেপে বলে,
‘লাভ কি জানেন না? আমার বস আপনাকে কি বলেছিল মনে নেই? ওনার প্রস্তাবে রাজী হয়ে যান, তাহলে মেয়েও পাবেন আর টাকাও।’
‘আপনারা কি মানুষ না? ক্যান বুঝতে চাইতাছেন না আমি যাত্রাপালা করুম না। করতে চাই না।’
‘আপনাকে যাত্রাপালা কে করতে বলেছে? মডেলিং আর যাত্রাপালা এক নয়। তবে দুটোই লোক দর্শনের কারণ। অর্থাৎ ধরণ ভিন্ন হলেও, দুটো কাজই মানুষ দেখতে আসে।’
‘যেইডাই হোক, আমার দেহার বিষয় না। আমার মাইয়ারে ছাইড়া দেন আপনারা। কত মাইয়া মানুষ আছে দুনিয়ায়, যারা চায় তাগোরে গিয়া ধরেন এই মডেলিং ফডেলিং এর লাইগ্যা৷ আমি চাইনা টাকা-পয়সা। যাগো লাগব তাগো গিয়া কন।’
লুৎফর এবার বেশ কঠোর হয়ে বলল,
‘আপনি কি মেয়েকে জীবিত চান? নাকি মেয়ের লাশ চান?’
‘কি কইতাছেন এইগুলা?’ আঁতকে উঠল মিতু।
‘আমার কথা শেষ, এবার সিদ্ধান্ত আপনার। মেয়ে চাইলে আমাদের সঙ্গে চলুন, নইলে মেয়ের মরা মুখ দেখার জন্য প্রস্তুত থাকুন। আল্লাহ হাফেজ।’ লুৎফর কয়েক কদম হেঁটে যেতেই মিতু বাঁধাসমেত বলল, ‘খাড়ান, আমি রাজী। আপনারা যা যা কইবেন, আমি তাই তাই করমু। খালি আমার মাইয়ারে আমার থেইক্যা কাইড়া নিয়েন না। আমি বাঁচমু না তাইলে।’
লুৎফর নিজের পিঠ থাপড়ায়। ঠোঁটের হাসি আরও চওড়া করে বলল, ‘মেয়ের কাছে নিতেই তো আসলাম। মেয়ে অপেক্ষা করছে তার মায়ের জন্য। আপনি যত দেরী করবেন, ততই মেয়ের কষ্ট বাড়বে বৈকি কমবে না।’
‘কিন্তু এহন আমি যাইতে পারুম না। সকাল হোক, বুবুরে জানাই তারপর যামু। বুবুরে নিয়াই যামু আমি।’
লুৎফর দুদিকে মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ সে সহমত নয়।
‘তাহলে মেয়ের চিন্তা ছাড়ুন। আমরা শুধু আপনাকেও নেব, অন্য কাউকে না। তাছাড়া প্রায় মাস খানেক ঢাকায় থাকতে হবে আপনাকে৷ আপনার বুবুর তো স্বামী সংসার রয়েছে। তাকে যদি যেতে দেয় তাহলে ঠিক আছে, নেব।’
মিতু কিছু সময় ভাবল। বেশ সময় নিয়ে বলল, ‘বুবুর যাইতে হইব না তাইলে। আমি তাইলে কাইল যামু আপনাগো লগে।’
‘আচ্ছা, তবে কেউ যেন এ ব্যাপারে কিছু না জানে। যেহেতু আপনার বুবু আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন না, সেহেতু তাকেও জানাবেন না। যদি চালাকি করার চেষ্টা করেন, তাহলে মেয়ের মায়া ত্যাগ করতে হবে। আমাদের ফাঁসিয়ে দেবেন, এই ভুল করলে আরও খারাপ কিছু হয়ে যাবে।’

মিতু সম্মতি জ্ঞাপন করল। বলল, ‘আমি কাউরে কমু না কিছু। আমার মাইয়ারে খালি বাঁচায় রাইখেন।’
‘তাতো রাখবোই কথামতো কাজ করলে। তাহলে সেই কথাই রইল, আমাদের গাড়ি ভোর পাঁচটার দিকে আসবে। তৈরি থেকেন।’ বলল লুৎফর।

মিতু সারারাত আর ঘুমোতে পারেনি মেয়ের চিন্তায়। কিছুক্ষণ পর পর ভোরের খোঁজে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছিল। কথামতো ভোর পাঁচটার সময় বাদশার পাঠানো গাড়ি উপস্থিত হলো দেওয়ান বাড়ির উঠোনে। রাত্রি তখনও গভীর ঘুমে। মিতুর এক মন বলল, রাত্রিকে ডেকে বলে যাবে যাতে সেতু বা কাব্য দুশ্চিন্তা না করে। আরেক মন বলল, মায়ার ক্ষতি হতে পারে বলে দিলে। মিতুর কাছে এখন তার মেয়ের জীবন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে কাউকে কিছু না বলেই শহরের মতো এক অজানা দুনিয়ায় পাড়ি জমালো একবুক বিতৃষ্ণা নিয়ে।
চলবে ইনশাআল্লাহ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here