গোধূলিলগ্ন

0
513

উপন্যাসঃঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ৩২

এতগুলো বছর পর মিতুকে চোখের সামনে দেখার চরম আনন্দের প্রকোপে গত রাতে দু’দন্ডের জন্যেও ঘুম হয়নি কাব্যর। ফলে ভোর হতে না হতেই রাত্রি ও সাজিদকে নিয়ে মিতুর শ্বশুরবাড়ির পথে রওয়ানা দিয়েছিল। সেতুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায়, মিতু পর্যন্ত নির্ঝঞ্ঝাটে পৌঁছেও যায়। তবে কে জানতো, দেখা করাই তার এবং মিতুর জন্য কালো অধ্যায় হয়ে দাঁড়াবে! কাব্য নিজেকে দোষ দিয়ে চলেছে বারবার। দোষ দিয়েও বা কি? মীমাংসা যে হবার নয়। রাত্রি কাব্যর সঙ্গে যায়নি, কারণ কাব্য ও মিতুর আবেগাপ্লুত মুহুর্ত সে কিছুতেই দেখতে পারতো না। রাত্রি বাধা দেওয়ায় সাজিদও যায়নি। ফলে রাত্রিও নিজেকে দোষারোপ করে চলেছে। তার আফসোস, সে কাব্যকে দেওয়া কথা রাখতে পারেনি। সে পারেনি কাব্যর কাছাকাছি থেকে, কাব্যকে রক্ষা করতে। সেতুরও একই খেদ। সে কেন মিতুর ঘর দেখিয়ে দিয়েছিল? কেন ফিরিয়ে দেয়নি কাব্যকে? এই প্রশ্নটা মাথায় এলে নিজের প্রতি ভীষণ করে বিরক্তি চাপে সেতুর। এইযে তারা নিজেদেরকে দোষারোপ করে চলেছে, এতে আফসোস ব্যতীত কি বা হচ্ছে! মছিদা বেগম আজ বিশাল খুশি৷ গোটা দুনিয়া জয় করলেও বোধয়, আজকের মতো বিনোদন পেতেন না। নাহিদ, নুরুলের ঠোঁটেও লোক-লুকানো হাসি। মিতু ও কাব্য উভয়কেই পানাহার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। সকাল থেকে দুজনের কেউ-ই এক ফোঁটা জল অবধি স্পর্শ করেনি। অবশ্য এ নিয়ে দুজনের কোনরূপ অভিযোগও নেই। বিকেল হয়ে এলে খালেক বেপারি উপস্থিত হলেন দেওয়ান বাড়ি। তিনি কাঠের তৈরি খোদাই করা কারুকাজের নিদারুণ এক চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে সালিস কার্যক্রম শুরু করেন। প্রথমে কাব্যর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘শুনলাম আপনি নাকি একজন নামী সাংবাদিক। আমার প্রশ্ন, নিজের নাম ডোবানোর আগে একটুও বিবেকে বাঁধেনি আপনার?’

কাব্য জবার দেওয়ার আগেই রাত্রি বলে ওঠে,
‘উনি অন্যায় কিছুই করেনি, আমরা এখানে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে দুস্ত মহিলাদের নিত্য জীবনের ঘটনাগুলো লিখি। প্রয়োজনের তাগিদে ভিডিও তৈরি করি। এটা আমাদের কাজ। আপনারা অযথাই দুজন নিরীহ মানুষকে কষ্ট দিয়ে চলেছেন সকাল থেকে।’
রাত্রির সুর ধরে সেতুও বলল, ‘একদম ঠিক কইছে এই সাংবাদিক আপায়। আমিও হেই জন্যই কাব্য সাহেবরে মিতুর ঘরখান চিনায় দিছিলাম। ভাবছিলাম হেগো মাধ্যমে আমার ছোডো বোইনডার জামাই যদি শুধরায়। কাব্য সাহেব আইজই প্রথম আইছে এইহানে। দয়া কইরা আপনারা এমন অবিচার কইরেন না নিরুপায় দুইখান মাইনষের উপর।’

খালেক অসীম রাগে চেয়ার ছাড়লেন। সভা ত্যাগ করার উদযোগ পেতে বললেন,
‘আমি কেন এসেছি এখানে? আপনাদের নিজেদের মধ্যকার আলোচনা শেষ হলে নাহয় আমাকে ডেকেন, আপাতত আমি যাচ্ছি।’

সকলে তীব্র ক্রোধ নিয়ে রাত্রি ও সেতুকে শাসিয়ে দিল। রাত্রি ও সেতু খালেকের নিকট ক্ষমা চাইলে খালেক পুনরায় মেজাজ ঠান্ডা করে চেয়ারে বসলেন। কাব্যকে একই প্রশ্ন পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হলে, কাব্যর সোজা জবাব,
‘মিতু কোন দোষ করেননি। যা দোষ করার আমি করেছি, তাই শাস্তি আমার প্রাপ্য। যদিও আমাদের উপর দেওয়া অপবাদটি সম্পূর্ণ মিথ্যে, তবুও আমি যেকোন শাস্তি মাথা পেতে নেব।’

‘তার মানে কি? কি বোঝালেন আপনি? কিছুক্ষণ আগে দুজন মহিলার বলা কথা সত্যি বলে দাবি করছেন কি?’

কাব্য সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। নুরুল চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে আসল। কাটা হাতে এগারোটা সেলাই লেগেছে। বর্তমানে তার ব্যান্ডেজ করা হাতটি অন্যহাতের উপর নির্ভরশীল। তিনি তুমুল আক্রোশে এগিয়ে এসেও জোরপূর্বক মুখে কুলুপ এঁটে দিলেন। খালেক তা লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো, নুরুল।’
নুরুল দু সেকেন্ডের জন্যেও ভাবলেন না। চোখে ঝরা রাগ মুখে টেনে বললেন, ‘ইনি যদি সাংবাদিকতাই করতে আসেন, তাহলে একা কেন আমার স্ত্রীয়ের ঘরে গেলেন? বাকী দুজনও তো ছিল। বিশেষ করে মেয়ে সাংবাদিক ম্যাডাম। তিনি না গিয়ে উনিই কেন গেলেন? তাছাড়া বিয়ের আগে এই লোকটার সাথে আমার স্ত্রীর গভীর সম্পর্ক ছিল। বিয়ের আগের দিনও এরা দেখা করে। এসব ঘটার পরও আজকের বিষয়টা আমি কি করে সহজ ভাবে নেব চেয়ারম্যান সাহেব? আমি স্বামী হয়ে নিজের স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সাথে কিভাবে মেনে নেই?’

খালেক বেপারি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তার গভীর ধ্যানমগ্নের অবসান ঘটল উপায়ের সন্ধান পেয়ে। তিনি গম্ভীরমুখে বললেন,
‘যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে, এখন নুরুল যদি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চায়, তাহলে এই ভরা সভাই তার জন্য উপযুক্ত সময়। আর সাংবাদিক সাহেবের শাস্তি হচ্ছে, তালাকের পর উনি নুরুলের স্ত্রীকে বিয়ে করবেন। নুরুল যদি তার মেয়েকে নিজের কাছে রাখে তাও রাখতে পারে, যদি না রাখে, তাহলে সেই মেয়ের দায়ভারও সাংবাদিকের কাঁধে পড়বে। তুমি আমার সিদ্ধান্তে রাজী তো নুরুল?’

সবাই নুরুলের দিকে চোখ রাখল। নুরুলের সোজা স্বীকারোক্তি, ‘আমি আমার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইনা। তবে তাদের এত সহজে ছেড়ে দিলেও তা মারাত্মক প্রশ্রয় হয়ে যায়৷ চেয়ারম্যান সাহেবের নিকট বিনীত আবেদন, তিনি যদি আমার উপর শাস্তির দায়িত্ব সঁপেন, তাহলে আমি স্বস্তি পাব। নইলে সারাজীবন মনের মধ্যে বিশাল একটা খুটখুট রয়েই যাবে। দয়া করে আমাকে সেই সুযোগ দিন।’

খালেক বললেন, ‘সেই শাস্তি যদি ব্যবহারযোগ্যতা পায়, তবে আমি রাজী। শুনি তবে।’

নুরুল সেতুর দিকে ইশারা করে বলে, ‘নাহিদের বউ যদি এদের দুজনের মুখে চুনকালি মেখে দেয়, তাহলে আমি বিচারে সন্তুষ্ট। আর এই সাংবাদিক যেন দ্বিতীয়বার আমার স্ত্রীয়ের ধারেকাছেও না ঘেঁষে। এই দুটো বিষয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের সম্মতি পেলে, আমি আর একটাও অভিযোগ তুলব না বরং আজকের দিনটা চিরতরে ভুলে যাব। এখানেই মাটিচাপা দিয়ে দেব।’

খালেক নির্দ্বিধায় সম্মতি জ্ঞাপন করেন৷ সাথে চুনকালি আনার নির্দেশ দেন৷ অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে চুনকালি চলে আসল। সেই চুনকালির পাত্রটি সেতুর মুখের সামনে ধরা হয়। খালেক বেপারি সেতুর উদ্দেশ্যে আদেশ ছাড়েন,
‘দু-হাতের তালুতে চুনকালি মেখে নাও দ্রুত৷’

সেতু কাঠ গলায় বলল, ‘আমি পারুম না এই কাজ।’
নাহিদ বাজখাঁই কন্ঠে বলে উঠল, ‘চেয়ারম্যান সাহেব যা বলছেন, তাই কর। নইলে মিতুরই ক্ষতি হবে। এর থেকেও কঠিন শাস্তি হতে পারে তোর বোনের। বোনের ভালো চাস তো কথামতো কাজ কর।’
সেতু আগের কন্ঠেই জবাব দিল, ‘চেয়ারম্যান সাহেব প্রথমে যেই শাস্তি দিছিল, আমি হেইডায় খুশি। আমি চাইনা আমার বোইন আপনার ভাইয়ের সংসার করুক।’

নাহিদ রাগ চেপে নেয় বহু কষ্টে। খালেক বললেন, ‘আমি শাস্তির কায়দাটি ঘুরিয়ে ফেলেছি। তোমাকে যেটা করতে বলেছি তাই করো নইলে তোমার বোনের মাথা ন্যাড়া করে পুরো গ্রামের চক্কর কাটাব। নিশ্চয়ই তা চাইবে না তুমি? আর যদি চাও, তাহলে তাই হবে। গ্রামের সবচেয়ে ভালো নাপিতকে ডেকে আনা হোক তবে।’

‘না, এইডা কইরেন না চেয়ারম্যান সাহেব! আমি রাজী।’ সেতুর কন্ঠে আতংক। সে কাঁপা হাত জোড়ায় চুনকালি লেপে নেয়। প্রথমে কাব্যর দিকে এগিয়ে গেল। কাব্যর দু-গালে হাত ছুঁইয়ে দ্রুত হাত সরিয়ে এনে বলল, ‘পরপুরুষের গতরে আমি এইটুকুনই হাত দিতে পারলাম। আমারে মাফ কইরেন চেয়ারম্যান সাহেব।’
‘এইটুকুই যথেষ্ট।’ বলল খালেক।

এরপর পরই নুরুল বলে ওঠে, ‘এটা নাহয় মেনে নিলাম, কিন্তু মিতু তো আর পরপুরুষ না। ওর বেলায় যেন কোন অযুহাত না খাটানো হয়। ওর মুখের একটা অংশও যেন বাকী না থাকে। তাহলে কিন্তু আমার মন ভরবে না, চেয়ারম্যান সাহেব।’
কাব্য আগুন ঝরা চোখ দিয়ে ভস্ম করে দেয় নুরুলকে। ঝামেলা বাড়াতে চায়না বলে আপাতত ক্রোধ চাপল। তবে মনে তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ঝড় বইছে। সঠিক সময়ের অপেক্ষায় বর্তমানের নিষ্ঠুর খেলায় নিজেকে গুলিয়ে নিল দাঁত কামড়ে। সেতু মিতুর দিকে হাত নিয়েও সরিয়ে আনল। পুনরায় হাত বাড়াতেই মিতু মলিন হেসে বলল, ‘কাইন্দো না বুবু, লাগায় দেও চুনকালি।’
সেতু বাধ্যের ন্যায় মিতুর সর্বমুখে চুনকালি মেখে দিল। সভা শেষে ভীড় কমতে থাকে। কাব্যদের অফিসিয়াল গাড়িটি গ্রামের লোকেরা ভেঙে ফেলেছে। অফিস থেকে আরেকটি গাড়ি পাঠানো হলে কাব্যকে ধরে গাড়িতে তুলল সাজিদ। এর মধ্যে একবার কাব্য বলেছিল, সে মিতুকে ফেলে যাবে না। তখন সাজিদ কাব্যর মুখ চেপে কানে কানে বলেছিল, ‘কেউ শুনতে পেলে এই কথা আপনার জন্য আরও ক্ষতিকর হতে পারে। সবাই উল্টো বুঝবে, আজকের মতো চলুন এখান থেকে। অন্যভাবে দেখা যাবে বিষয় টা।’ রাত্রিও কম যুক্তি দাঁড় করায়নি ওইসময়। হিসাব মিলিয়ে বাধ্যের ন্যায় সায় দিল কাব্য।

মিতু মুখের কালি তোলেনি। নুরুলকে খুন না করে মুখের কালি তুলবে না সে। তার জেদে শামিল হলো সেতও। মায়াকে পাওয়া যাচ্ছে না। মায়াকে যেখানে শুইয়ে দিয়ে গিয়েছিল, সেখানে মায়া নেই। সেতু কান্না করে হয়রান প্রায়। শোকে মিতু পাথর হয়ে গিয়েছে। তার মতে, এই কাজ নুরুল ছাড়া অন্য কারো না। এবার নুরুলের মৃত দেহ না দেখা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না মিতু। রাতটা খুব ভয়ানক রূপে শেষ হলো। বাড়িতে গতকালের মতোই ভীড় জমেছে। সেই সাথে মরাকান্নার আসর জমেছে। আজ সকালে পুকুরপাড় হতে নুরুলের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার হয়েছে। তবে খুনীর সন্ধান পাওয়া যায়নি এখনও।
চলবে ইনশাআল্লাহ….
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। পারলে ধরিয়ে দেবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here