শালুক ফুলের লাজ নাই (২৮)

0
1092

#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (২৮)

মাস শেষ হতেই ধ্রুব টের পেলো সামনের দিনগুলো তার জন্য বেশ কঠিন হতে যাচ্ছে যদি না এর মধ্যে সে আরেকটা টিউশনি যোগাড় করতে পারে।

সামনের মাসে ফাইনাল পরীক্ষা ধ্রুবর, ভার্সিটিতে ফি বাবদ অনেকটা টাকা খরচ হয়ে গেছে,এরপর আবার ফ্রিজ কিনতে হয়েছে।ফ্রিজ কেনার পর ধ্রুবর জমানো টাকা ছিলো ৯হাজার টাকা।
বেতন আর দুইটা টিউশনি থেকে পাচ্ছে ২২ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া দিতে হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা। এর উপর মাসে বিদ্যুৎ বিল যায় প্রায় ১ হাজার টাকা, ধ্রুবর ভাড়া যায় মাসে ২ হাজার টাকা।
বাকি ৪ হাজার টাকা দিয়ে সারা মাস চালাতে হয়।
প্রতিদিন খাবারে মাছ,মাংস না থাকলে ধ্রুবর কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। তার মনে হয় সে শালুককে ভালো রাখতে পারছে না।
শালুক হয়তো এসব দিয়ে খেতে পারছে না আরাম করে।
খাবার সময় ধ্রুবর বেশ খারাপ লাগে। ইদানীং সকালে আর রাতে খেতে বসলে ধ্রুব মাছ,মাংস খেতে চায় না।

শালুক বুঝতে পারছে না ধ্রুবর সমস্যা কোথায়।বাসায় আসলে ধ্রুবর চেহারায় কেমন চিন্তার ছাপ দেখতে পায় শালুক।
কিন্তু কেনো এতো চিন্তা করছে ধ্রুব সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না শালুক।

ধ্রুবর এই চিন্তিত চাহনি শালুকের সহ্য হচ্ছে না। ভীষণ কান্না পায় শালুকের ধ্রুবকে এভাবে বিমর্ষ হয়ে থাকতে দেখলে।

ধ্রুব হন্যে হয়ে আরেকটা টিউশনি খুঁজছে। কিন্তু কিছুতেই সময় মিলছে না তার।
দুর্মূল্যের বাজারে ৪ হাজার টাকায় নিজেদের সংসার চালানো ও ধ্রুবর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

রাতে ধ্রুব বাসায় এলে শালুক আজ মুখ ফুলিয়ে রাখলো।বিকেলে শালুক নিজেই রান্না করেছে। প্রতিদিন মাছ,মংস খেতে খেতে শালুকের কেমন অরুচি ধরে গেছে খাবারে।
শালুক আজ আলু ভর্তা,শিম ভর্তা,ডাল ভর্তা,ডিম ভর্তা,বেগুন ভর্তা,টমেটো ভর্তা,পেঁয়াজ -মরিচ দিয়ে ডিম ভেজে নিলো। বিকেল ধরেই আস্তে আস্তে এসব আয়োজন করেছে শালুক।আর শালুকের এই আয়োজনে সবচেয়ে বড় সহায়ক ছিলো ইউটিউব। মায়ের থেকে শুনেছে বাহারী রকমের ভর্তা, খুদের ভাত ধ্রুবর ভীষণ পছন্দ।
সেটা দেখেই শালুক ইউটিউব থেকে ভর্তা রেসিপি দেখতে লাগলো। দেখে তার নিজের ও ইচ্ছে হলো ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে।তার উপর কয়েক দিন ধরেই মাছ মাংস খেয়ে শালুকের ও অরুচি এখন।

ধ্রুব বাসায় এসে চেঞ্জ করে নিলো। শালুকের গম্ভীর মুখখানা দেখে শঙ্কিত হয়ে গেলো। শালুকের চিবুক তুলে ধরে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?”

শালুক মাথা নাড়িয়ে জানালো,”না।”

ধ্রুব আবারও জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? ”

শালুক বললো, “কিছু হয় নি,এমনিই ভালো লাগছে না। ”

ধ্রুব তারিখ হিসেব করলো, বাড়ি থেকে এসেছে বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। কে জানে হয়তো বাড়ির কথা মনে পড়েছে।ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো, “বাড়ির জন্য মন খারাপ লাগছে শালুক? বাড়ি যেতে চাও?”

শালুক আগের মতো গম্ভীর হয়ে বললো, “না।”

ধ্রুব আবারও চিন্তা করলো কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কি অন্য সমস্যা হয়েছে? ন্যাপকিন শেষ হয়ে গেছে? ”

শালুক লজ্জা পেলো না মোটেও,তেমনই আগের সুরে বললো, “না।”

ধ্রুব আর ভেবে পেলো না তাহলে কি হতে পারে। শালুকের পাশে বসে পড়লো ধ্রুব শালুকের বাম হাতের আঙুল নিজের ডান হাতের আঙুলের মধ্যে রেখে বললো, “কি হয়েছে তাহলে শালুক? এভাবে মন খারাপ করে আছো কেনো? তোমার মন খারাপ হলে আমার পুরো পৃথিবী অন্ধকার মনে হয়। তোমার মুখের হাসি আমার পৃথিবীকে আলোকিত করে তোলে।জেনে ও কেনো তুমি এরকম করে আছো বলো?সারাদিন পরে বাসায় এসে তোমার মলিন মুখ দেখলে মনে হয় আমি বুঝি ব্যর্থ।রাজকন্যাকে রাজরানীর মর্যাদা দিতে পারছি না।নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হয় শালুক। ”

শালুক ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বললো, “এই যে কয়েকদিন আপনি মন খারাপ করে থাকেন,আপনার হাসির আড়ালে ফুটে উঠে গভীর চিন্তা।তখন আমার কেমন লাগে?আপনি তো সারাদিন বাহিরে থাকেন,কাজে ব্যস্ত থাকেন।আমার সময় কিভাবে কাটে বলেন? আমার পড়া শেষ হয়ে গেছে সব বিষয়, বই নিয়ে বসলে আপনার চিন্তিত চাহনি ভেসে উঠে মনের পর্দায়। সারাদিন ধরে অপেক্ষায় থাকি কখন আপনি বাসায় আসবেন।আমি চাতকের মতো আপনার অপেক্ষায় বসে থাকি কিন্তু আসলে দেখি আপনার চিন্তাযুক্ত মুখ।তখন আমার অবস্থা কেমন হয় তা ভেবে দেখেছেন আপনি?
আমি হয়তো আপনাকে ততটুকু ভালোবাসতে পারি নি যতোটুকু আপনি আমাকে ভালোবেসেছেন।কিন্তু বিশ্বাস করেন,আপনার ভালোবাসা মহাসাগর সমান হলে আমার ভালোবাসা যদি বিন্দুসম ও হয়,তাও আমার কাছে আমার দিক থেকে সর্বোচ্চ।
সেখানে আমার ও ঠিক এরকম কষ্ট হয়।আমি আপনাকে বলতে পারি না, ভাবি আজ না হয় কাল ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু বিগত কয়েকদিন ধরেই দেখছি এই অবস্থা। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। ”

ধ্রুবর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। শালুককে বুকে নিয়ে বললো, “আমার বোকা ফুলের যে আমার জন্য এতো কষ্ট হয় তা তো আমি আগে বুঝি নি।বুঝলে কিছুতেই তাকে এই কষ্ট করতে দিতাম না আমি। এই যে দেখো,আমি এখন হাসছি।আর এরকম হবে না শালুক।”

শালুক ধ্রুবর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার নিজের চোখ জলে টইটম্বুর হয়ে গেলো।
ধ্রুব আস্তে একটা ফুঁ দিতেই দুই চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পড়লো। ধ্রুব দুই হাত পেতে তা তুলে নিলো।
তারপর মুচকি হেসে বললো, “আমার রাজরানীর চোখের এক ফোঁটা জল ও যে আমার হৃদয়কে রক্তাক্ত করে দেয়।মনে হয় যেনো কোনো এক অদৃশ্য তীরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে আমার হৃৎপিন্ড।”

শালুক বললো, “তাহলে আমাকে বলেন, কেনো আপনার মন এতো খারাপ ছিলো? কি নিয়ে এতো চিন্তায় আছেন আপনি? ”

ধ্রুব হেসে বললো, “কিছু না শালুক। আমার সব চিন্তাই তোমাকে নিয়ে।কিভাবে তুমি খুশি থাকবে এটা ছাড়া আমার আর দ্বিতীয় কোনো চিন্তা নেই।”

শালুক ধ্রুবর হাত চেপে ধরে বললো, “আমি আপনার সহধর্মিণী, আপনার অর্ধাঙ্গিনী। আপনার সমস্যা মানে আমার সমস্যা। আপনার কষ্ট মানে আমার কষ্ট। আমার কষ্টের ভাগিদার যেমন আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ হতে পারবে না তেমনই আপনার সকল কষ্ট, চিন্তা ভাবনার অর্ধেক ভাগিদার আমি ও।আমাকে বলেন আপনার কি হয়েছে। ”

ধ্রুব মুচকি হেসে বললো,”আমার শালুক তো দেখি মাশাল্লাহ অনেক বুঝদার হয়ে গেছে। অনেক গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছে। বিশ্বাস করো,আমি তোমার চিন্তাই করছি।কিভাবে তোমাকে ভালো রাখতে পারবো এটাই ভাবছি শুধু।মনে হচ্ছে আমি তোমাকে সেভাবে রাখতে পারছি না যেভাবে চাচা চাচী তোমাকে যত্নে রাখতো। আমার সেই সামর্থ্য এখনো হয় নি।এই ব্যাপারটা আমাকে ভীষণ পীড়া দেয়।”

শালুক বললো, “আপনি আমাকে যেভাবে ভালোবাসা দিয়ে যত্ন করে রাখছেন আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির স্ত্রী ও তার স্বামীর থেকে এই ভালোবাসা পাচ্ছে না। আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না কোনো কিছুতে।জানি না জীবনে কোন দিন কোন পুণ্য করেছি নিজের অজান্তে, আর তার বিনিময়ে আল্লাহ আমার জোড় আপনার সাথে মিলিয়ে দিয়েছে। ”

ধ্রুবর বুকের ভেতর কেমন খুশীর জোয়ার বইতে লাগলো শালুকের কথা শুনে।তারমানে তার শালুক তাকে পেয়ে সুখী। ধ্রুব মনে মনে আল্লাহকে বললো, “এই মেয়েকে যেনো আমি আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত খুশী রাখতে পারি। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।”

ধ্রুব হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গেলো। ঢাকনা দিয়ে সব কিছু ঢেকে রাখা দেখে ধ্রুব ঢাকনা সরিয়ে দেখতে লাগলো। এতো রকমের ভর্তা দেখে চমকে গেলো ধ্রুব।সেই সাথে তার জিবে জল চলে এলো।

শালুকের পাশে এসে জিজ্ঞেস করলো, “এতো কিছু কেনো করতে গেলে তুমি? হাত জ্বলছে নিশ্চয়? ”

শালুক হেসে বললো, “হাতে পলিথিন পেঁচিয়ে নিয়ে করেছি।আপনি খুশি হন নি?আমি জানি ভর্তা আপনার প্রিয়।”

ধ্রুব হাসলো। তারপর বললো, “বাহ!আমার বউয়ের দেখি আমার পছন্দ, অপছন্দ নিয়ে ও ভাবনা রয়েছে। আমার কেমন আনন্দ লাগছে তুমি বুঝবে না শালুক। আমি ভীষণ খুশী। তবে এতো কিছু করার দরকার ছিলো না। একটা ভর্তা হলেই আমার হতো। ”

দুজন মিলে পরম তৃপ্তি নিয়ে রাতের খাবার খেলো।

শালুক ধ্রুবর কাছ ঘেঁষে ঘুমালো। আদুরে বেড়ালের মতো ধ্রুবর গায়ের সাথে লেপ্টে গেলো ঘুমের ঘোরে। ঠান্ডা পড়ছে ঝাঁকিয়ে। ধ্রুব বুকের মধ্যে টেনে নিলো শালুককে,তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো।

আদনান বাড়িতে ফিরলো ১ মাস ১৫ দিন পরে।আদিবা বেগম আদনানকে বসার রুমে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলেন।তারপর তেড়ে গিয়ে বললেন,”কেনো এসেছি এই বাড়িতে? তোকে কে ঢুকতে দিয়েছে? ”

আদিবা বেগমের চিৎকারে হাসনা বেগম ছুটে এলেন।বড় জা কে জড়িয়ে ধরে বললেন,”আমি ওর জামিন করে ছাড়িয়ে এনেছি ভাবী।আপনার পায়ে পরি আপনি ওকে কিছু বলবেন না।আমি জানি ভাবী আপনার কেমন বুক পোড়ে ওর জন্য। ভাবী,আদনান এই বাড়ির বড় ছেলে।সবার আগে ওই তো আমাকে চাচী বলে ডেকেছে । ও হয়তো অনেক বড় অন্যায় করেছে, কিন্তু তাই বলে বাড়ির ছেলেকে এতো দিন জেলে থাকতে দেখতে আমার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে। সেখানে আপনার কি কষ্ট হচ্ছে তা আমি টের পাই ভাবী।আপনার নির্ঘুম রাত, চোখের নিচের কালো দাগ সাক্ষী দেয় আপনার মনে প্রচন্ড যন্ত্রণা।
আর যার জন্য ওকে জেলে যেতে হয়েছে সে তো এখানে নেই এখন তাহলে কেনো ছেলেটা কষ্ট পাবে?শয়তানের ধোঁকায় পড়ে মানুষ ভুল করে। আদনান হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে এতোদিনে। ওকে আর শাস্তি দিয়েন না।”

আদিবা বেগম হাসনা বেগমকে ছেড়ে দিয়ে আদনানের সামনে এসে দাঁড়ালেন।তারপর হঠাৎ করেই আদনানের চুলে খামচি দিয়ে ধরে বললেন,”এখনই ক্ষমা চা তুই হাসনার পায়ে ধরে। তোকে দুধকলা দিয়ে সবাই আদর করে পুষেছে পরিবারের বড় ছেলে বলে কিন্তু সেই তুই কালসাপ হয়ে ছোবল দিলি বাড়ির মেয়েকে।ক্ষমা চা তোর চাচীর পা ধরে। ওর জায়গায় আমি থাকলে জীবনে ও তোকে ছাড়িয়ে আনতাম না।”

আদনান মাথা নিচু করে বললো, “জানি মা।এটুকু বুঝতে পারছি এতোদিনে সবাইকে কি পরিমাণ কষ্ট দিয়েছি। আমি আর দেশে থাকবো না মা।তোমাদের সবাইকে সুখী করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাহিরের দেশে চলে যাবো।তখন আর তোমাদের কারো আমাকে নিয়ে ভয় পেতে হবে না।
আমার একটাই আফসোস মা,আমার মনের কথাটা আমি কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারি নি।”

চলবে….

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here