প্রিয় সুখ-২৯

0
492

প্রিয় সুখ-২৯
_______________
লুকিয়ে লুকিয়ে অফিসে ঢুকেছে মিতু আপু। তার শরীর ভালো না। এতো চিন্তায় মাথা ধরেছে। নিজের ডেস্কে বসতেই শিরিন ছুঁটে এসে বলল,’ মিতুয়া তুমি এসেছ? ওহ তোমার জন্য আমি প্রচন্ড টেনশনে ছিলাম।’ মিতু আপুর মুখ ঝুলে গেল। বললেন,’ তোমার আমাকে কি প্রয়োজন শিরিন?’
‘ প্রয়োজন তো আমার না শাহিন ভাইয়ার।’ মিতু আপু লাফিয়ে উঠে দাড়ালেন। তার সাথে সাথে শিরিনও দাড়িয়ে গেল। মিতু আপু চারপাশে গোয়েন্দা নজরে দেখে নিয়ে চুপি চুপি প্রশ্ন করলেন,’ কেন? আমাকে কেন প্রয়োজন?’
শিরিনও চুপি চুপি বলল,’ আমি জানি না। স্যার বলেছে আশা মাত্র যেন তার কেবিনে তোমাকে পাঠানো হয়।’
‘ আমাকে? কেন?’ ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ মিতু আপুর। শিরিন প্রবোধ দেওয়া গলায় বলল,’ ভয়ের কিছু নেই। তুমি নতুন তো তাই হয় তো কিছু বুঝিয়ে দিবে। কালকে তুমি একটু অদ্ভুত কাজকর্ম করেছ তো।’ শিরিন তাড়া দিলো। মিতু আপু যেতেই চাইছিল না। কেবিনের সামনে এসে তিনি বুকে ফুঁ দিতে লাগলেন। জীবনটা অসহ্য লাগছে তার। এখানে এক প্যারা বাড়িতে আর এক প্যারা। মিতু আপু দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে অবাক। রুম খালি। এদিক সেদিক তাকিয়ে মিতু আপু চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। তখনই শাহিন ভাই শক্ত হাতে তাকে টেনে পাশের সোফায় ফেলে দিলেন। মিতু আপু ভয়ে মৃদু চিৎকার করে নিজের মুখ চেপে ধরল। শাহিন ভাই পাশে বসে হাসছে। মিতু আপু রাগে গজগজ করতে করতে বলল,’ সমস্যা কি আপনার? কি চাই?’
‘ যা চাই তা কখনো দিবার পারবি না তুই।’ শাহিন ভাই একটু কাছে আসল। যা দেখে মিতু আপু সোফার পিঠে এটে বসল। বলল,’ আবার তুই তাঙ্গারি করছেন। এটা অফিস ভুলে গেলেন? আপনি আমার বস। আমি এমপ্লয়ি।’
‘ সেটাই তো। দুঃখিত।’ শাহিন ভাই হাসছেন। তার হাসি দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে মিতু আপুর। শাহিন ভাই বললেন,’ এমন কইরা তাকানের কি আছে? আমার সুখ তো তোর সহ্য হয় না।’
‘ হ হয় না। আপনারেই আমার সহ্য হইতাছে না। কি কাজ সেটা বলেন? দ্রুত।’
‘ দ্রুত বলমু? চল তাহলে।’
‘ কোথায়?’ মিতু আপু উঠে দাড়িয়ে গেলেন। শাহিন ভাই গম্ভীর গলায় বললেন,’ বিয়ে করতে।’
মিতু আপুর কি যে হাসি পেল তবে হাসল না। বললেন,’মজা করা বন্ধ করেন। কাজ বলেন।’
‘ সেটাই তো বলতে চাচ্ছি।’
‘ তো বলছেন না কেন?’
‘ এখানেই বলে দিব?’ শাহিন ভাই ভারী অবাক হয়ে গেলেন। মিতু আপু কিছুই বুঝতে না পেরে বললেন,’ এখানে বলবেন না তো কি আপনার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে বলবেন?’
‘ সেটাই তো বলার কথা। কবুল তো ছেলেরা শ্বশুর বাড়িতেই বলে। তাই না?’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তার। মিতু আপু বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কিছু বলার মত ভাষা পেলেন না। শাহিন ভাই এবার মিতু আপুর হাত ধরে বললেন,’ চলো আমার শ্বশুর বাড়িতে।’
‘ আপনি পাগল হয়ে গেছেন? কি সব শুরু করেছেন বুঝলাম না। আপনারা রিজেক্ট, বাদ, ভেঙ্গে দেওয়া এসব বুঝেন না? এক কথা এতো বার বুঝানো লাগে? বিয়ে থেকে পালিয়ে আসার পরেও আপনারা পিছা ছাড়েন না। আসলে মানুষ তো না কি? জাওয়াদ একটা আপনি আর একটা। আজব।’
‘ একদম জাওয়াদের সাথে তুলনা করবে না। আমি ওর মতো মোটেও নই।’ রেগে গেলেন শাহিন ভাই। মিতু আপু সরে এসে হেসে উঠে বললেন,’ সেটাই তো। উনি হচ্ছেন রূপবান, আপনি হচ্ছেন কালাচাঁদ।’ শাহিন ভাই আগুন চোখে তাকালেন। মিতু আপু উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছিলেন। শাহিন ভাই খুঁজে খুঁজে তাকে কঠিন কিছু কাজ ধরিয়ে দিলেন। মিতু আপু অবাক। বললেন,’ আমি নতুন এতো কাজ কিভাবে করব?’
‘ সে তো জানি না। ভালো অফার তোমাদের পছন্দ হয় না। এবার করো কাজ। বিয়ে করা সহজ না কাজ দেখি।’ শাহিন ভাই শিস বাজিয়ে নিজের চেয়ারে বসলেন। ল্যাপটপ খুলে কাজে মন দিলেন। মিতু আপু হাতে এক গাদা ফাইল নিয়ে তাকিয়ে আছেন। মনে মনে খুব গালি দিচ্ছেন। শাহিন ভাই নিচু হয়ে হাসছেন। কণ্ঠে রাগ মেখে বললেন,’ যাচ্ছ না কেন? এখানে থাকতে ভালো লাগছে? না কি বসকে পটানোর ধান্ধা?’ কড়া চোখ তার। মিতু আপু তাজ্জব গলায় বললেন,’ বসকে পটাতে চাই আমি? পাগলে পাইছে?’
‘ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা বসের রুমে তুমি কি করছ? যাও।’
‘ এতো কাজ আমি কিভাবে করব শাহিন ভাই?’ নারী জাতীর বিখ্যাত ইমোশনাল মুখশ্রী তৈরি করে মিতু আপু বললেন। শাহিন ভাই মশা তাড়ানোর মত তার ইমোশনালকে উড়িয়ে দিয়ে কাটকাট গলায় বললেন,’প্রথম রুলস ভেঙ্গেছেন আপনি। শাড়ি বিহিন ঢুকেছেন। পরের থেকে এমন হলে আপনাকে আমি অফিসের বাহিরে সারাদিন দাড় করিয়ে রাখব। দ্বিতীয়ত বসের অনেক সময় নষ্ট করেছেন। এখন কাজ করতে চাইছেন না? আপনাকে কি বসিয়ে বসিয়ে টাকা দিব? আপনার জামাইর অফিস না কি এটা? যান কাজ করুন। আমি আজকের মধ্যে সব কাজ চাই। আউট।’ শাহিন ভাই চেঁচিয়ে গলা ফাঁটালেন মনে হয়। মিতু আপু ভয়ে কাঁপে উঠলেন। মনে মনে ক্ষুদ্ধ হয়ে তিনি ভাবলেন কে বলেছে মেয়েরা ভালো অভিনয় পারে? উনাকে দেখলে এই বাক্য আর কেউ বলবে না। শয়তান একটা।’ যেতে যেতে গ্লাসের সাথে জোড়ে বারি খেলেন তিনি। শাহিন ভাই চেয়ার ছেড়ে উঠে আবার বসে গেলেন। নিজের ললাট মালিশ করে মিতু আপু তাযিন ভাইকে একটা চরম গালি দিলেন। ঠিক করলেন এই মানুষটাকে চরম ভাবে শাস্তি দিয় ছাড়বে। চরম।
__________________
ঘুমঘুম চোখে উঠে বসেছে রূবাইদা। ফোনটা খুঁজে নিয়ে দেখল মাত্র দুপুর দুটো বাজে। বিরক্ত হয়ে সে আবার শুয়ে পড়ল। হঠাৎ তাযিনের কথা মনে পড়তেই সে লাফিয়ে উঠে গেল। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে সোজা তাযিনের রুমে এসে হাজির সে। রুমের খবর নিয়েছে আনজুম থেকে। তাযিন তখন নীহারিকার টেবিলে কাজ করছে। সামনে ফাইল, ল্যাপটপ, বই খোলা। রূবাইদার দিকে না তাকিয়ে সে বলল,’ এখানে কেন এসেছেন?’ রূবাইদা রেগে মেগে আগুন হয়ে প্রশ্ন করল,’ তুমি এমন কেন করেছ তায? এসব কি শুরু করলে?’ তারপর রুমের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে সে অবাক হয়ে গেল। এটি সত্যি নীহারিকার রুম। আনজুম ঠিক বলেছিল। রাগ আরও বেড়ে গেল। তেজি সিংহের মত চেঁচিয়ে উঠে ইংরেজিতে বলল,’ ইউ লিভ ইন নীহারিকা’স হাউজ, এরাউন্ট হিম? দ্যাট ইজ নট হ্যাপেনিং? ইউ কাম ট্যু হিজ রুম? দ্যাটস হোয়াট ওয়াজ গোয়িং ট্যু হ্যাপেন? ইউ ওয়ার সাপোসেড ট্যু মেরি মি তায।’
তাযিন নিজের কাজে গভীর ভাবে মগ্ন। এসব কথা তার কর্ণ ছুঁয়েছে কি না বলা যাচ্ছে না। রূবাইদা রুমটা ভালো করে দেখছে। আর রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। কণ্ঠ স্বাভাবিক করে সে লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,’ তায বাদ দেও এসব। আর আব্বির সাথে কথা বলো যে তুমি বিয়েটা করছ।’
‘ করছি না।’ তাযিনের সোজাসাপটা উত্তর।
‘ নীহারিকার জন্য? সে তোমার জীবনে তোমার আব্বির থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয় তায।’
‘ সে আমার জীবনে তার মত গুরুত্বপূর্ণ।’
রূবাইদা বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে রইল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ তুমি জানো এর ফল কি হবে? আনজুম মাঝে কষ্ট পাবে।’
‘ এবার খেলা মজার হবে মিস রূবাইদা। আনজুমকে আপনি যতটা দূর্বল ভাবছেন ততটা সে নয়। সে আমার বোন। সামান্য একটি ছেলের জন্য মরে যাবে না।’
‘ তুমি খুব স্বার্থপর ছেলে তাযিন।’
‘ আই নো ।’ তাযিন ফিচেল হাসল।
‘ তুমি নিজের বোনের সাথে এমনটা করতে পারো না।’
‘ আমি আমার বোনের সাথে কিছুই করছি না। আপনি রুম থেকে বের হচ্ছেন এখন।’
‘ না আমি হচ্ছি না। আনজুম এবং এরিকের সাথে আমার এবং তোমার বিয়েটাও হচ্ছে। এটাই ফাইনাল।’
‘ আমার ফাইনাল ডিসিশন আমি আব্বিকে জানিয়ে দিয়েছি। আর তা যে আপনি শুনেছেন সেটা আপনার এখানে আসা থেকেই বুঝা যাচ্ছে। গো।’
‘ নেভার। তুমি কি বুঝতে পারছ না নীহারিকা তোমার আর তোমার আব্বির মাঝে আসছে? তুমি কখনো তার কথার অমান্য করোনি তায। অথচ তুমি চারদিন আগে তাকে বলেছ তুমি বিয়ে করছ না। যা জীবনে করোনি তা করছ। কারণ অবশ্যয় নীহারিকা। একটি মেয়ের জন্য? সামান্য একটি মেয়ের জন্য তুমি নিজের বাবার সাথে কথা কাটাকাটি করতে পারো না। কিছুতেই নয়।’
‘ সে আমার আব্বি। আমি দেখে নিব। আর নীহারিকা সামান্য নয়। রুম থেকে বের হয়ে যান। এখনই।’ তাযিনের এমন চিৎকারে রূবাইদা কিছুই বলতে পারল না। সে নিরবে জায়গা ত্যাগ করতে করতে দেখল নীহারিকাকে। প্রচন্ড রুষ্ট নয়নে তাকিয়ে ছিল কিছুমুহূর্ত। নীহারিকা নিজের জিনিসপত্র নিতে এসেছিল। এমন কিছু সে আশা করেনি। রূবাইদা তার সামনে দিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেল। নীহারিকা বাকরুদ্ধ।

বিমুগ্ধ চেয়ারে হেলান দিয়ে পূর্বের কথা কল্পনা করল। যখন সে নীহারিকাকে দেখেছিল তখনকার কথা। দাদির ছবির সাথে সে নীহারিকার ছবি মিলাতে ব্যস্ত। আব্বির আগমন হুট করে। বিমুগ্ধ তখন হাসছিল। সত্যি তো দারুন মিল। সে চমকে গেল। চোখেমুখে চকচকা ভাব। নবীন উদ্দীন ছেলের এমন হাসির কারণ জানতে টেবিলের উপরে নজর দিয়ে তিনিও চমকে গেলেন। বেশ আগ্রহ নিয়ে কিছুক্ষণ দেখে বললেন,’ তুমি মায়ের ছবি কোথায় পেয়েছ? তাও এতোটা রঙ্গিন?’ বিমুগ্ধ তখন মুগ্ধ হয়ে হাসছিল। আব্বির কথা তার কানে তো যাচ্ছে। কিন্তু তার হাসি কমছে না। বিমুগ্ধ নয়নে সে নীহারিকাকে দেখতে ব্যস্ত। নবীন উদ্দীন চোখের সামনে থেকে দু’টি ছবি নিয়ে নিলেন। বললেন,’ তুমি এগুলো কথায় পেয়েছ?’
বিমুগ্ধ দ্রুত ছবি নিতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাত থেকে নিতে নিতে বলল,’ এ দাদু নয়। নীহারিকা।’
চমকিত নয়ন নবীনের। অবাক গলায় জানতে চাইলেন,’নীহারিকা কে?’
‘ তোমার ছেলের এই মেয়েকে পছন্দ হয়েছে।’ শামা হাসতে হাসতে ঘরে প্রবেশ করল। নবীন উদ্দীন বেশ আশ্চর্য হয়ে বললেন,’ দেখতে মায়ের মত।’
‘ তা তো হবেই।’ শামা একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। নবীন উদ্দীন ছবি দু’ টো গভীর ভাবে দেখে বললেন,’ পছন্দ মানে কি? বিয়ে টাইপ? তোমার তো আবার অনেক গার্লফ্রেন্ড।’ বিমুগ্ধ হেসে উঠল শব্দ করে। আবেগী গলায় বলল,’ আপনার ছেলের ক্যারেক্টার যথেষ্ট ভালো। গার্লফ্রেন্ড তার সারা জীবন থাকবে। তবে এই মেয়েটি ভিন্ন আব্বি।’
‘ কেমন ভিন্ন?’ কৌতুহলি গলায় জানতে চাইলেন তিনি।
‘ লাভ এট ফার্স্ট সাইট চাইপের আব্বি। আপনার মাকে তো আমি অনেক আগে থেকে পছন্দ করতাম। তাই মনে হয় সৃষ্টিকর্তা তার মত দেখতে একজনকে তৈরি করে পাঠিয়েছেন আমার জন্য।’ বিমুগ্ধ বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। তার পাশে বসেছে শামা আর নবীন। দু’ জনে আগ্রহ নিয়ে ছেলেকে দেখছেন। বিমুগ্ধ আবেগে আপ্লুত হয়ে এক হাত মাথার নিচে রেখে বলল,’ মেয়েটিকে আমি বেশ চমকে দিয়েছিলাম। সে তো প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল আব্বি।’ বিমুগ্ধ জোড়ে শব্দ করে হাসছে। নবীন সেই হাসির সাথে তাল মিলিয়ে বললেন,’ দেখা কোথায় হয়েছিল?’
‘ অনেক আগে একবার হয়েছিল। খুব ছোট ছিল তখন।’
‘ ভালোবাসা হয়েছে কখন?’ ভ্রু নাচালেন তিনি। বিমুগ্ধ লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গি করে আম্মির কোলে মুখ গুঁজে রাখল। আনজুম লাফিয়ে এসে বিমুগ্ধের বুকের উপরে পড়ে বলল,’ট্রেনে আব্বি। ওই যে হিন্দি সিনেমা আছে না দিল ওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে?’
‘ শারুখ আর কাজলের?’
‘ জি আব্বি। সেম সিন হয়েছে। তবে একটি মিসটেক হচ্ছে দাভাই নয় মেয়েটি তার হাত ধরেছে।’ হো হো করে হেসে ফেললেন নবীন। ছেলে মেয়ের প্রেমের গল্প তিনি আনন্দের সাথেই শুনেন।
‘ তারপর কি হয়েছে?’
‘ তারপর আর কি তোমার বাঁদর ছেলে নিজের গুণ দিয়ে তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। আসলে নীহারিকা নিজের বিয়ে থেকে পালিয়েছে।’
‘ কি বলছো? এতো সাঙ্ঘাতিক কাহিনী। তারপর?’
চা কফি খাবার এসে হাজির। আজকে শুধু গল্প হবে। বিমুগ্ধ বিছানার উপরে গোল হয়ে বসল। তার এক পাশে আম্মি অন্য পাশে আব্বি। আনজুন সামনে। মুলত সেই আবৃতির সুর ধরেছে। বিমুগ্ধ কফি খেতে ব্যস্ত। আনজুম বলল,’ আব্বি তোমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে সেই মেয়ের জন্য।’
‘ তা তো দেখতে পাচ্ছি। থাকে কোথায়?’
‘ থাকে ঢাকায়। পরিবারের সাথে। বাবা মা ছোট ভাই দাদা আর সে।’ বিমুগ্ধ শান্ত গলায় বলল। নবীন বললেন,’ঠিকানা, পরিবার সব দেখি জোগাড় হয়ে গেছে। ভেরি সিরিয়াস বিমুগ্ধ। আই এম ইমপ্রেস। বিয়ে থেকে পালিয়ে কোথায় গেলো সে? তার প্রেমিক নেই তো আবার?’
‘ না। বিয়ে করবে না বলে পালিয়েছে। ডাঃ জাওয়াদের সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।’
‘ তোমার কলিগ ডাঃ জাওয়াদ?’
‘ হুম।’
‘ কেন? সে তো খুবই ভালো এবং পারফেক্ট মানুষ শুনেছি।’ বিমুগ্ধ কথাটা শুনেই নিজের আব্বির দিকে তাকাল। কথাটি তার মোটেও ভালো লাগেনি। নবীন উদ্দীন পিঠ চাপড়ে চোখ টিপে বললেন,’ জেলাস? ও হো হো ইউ আর জেলাস মাই সন।’ শব্দ করে হাসতে লাগল সবাই। আনজুম বলল,’জেলাস তো হবেই জাওয়াদকে আমি দেখেছি অসম্ভব সুন্দর আব্বি।’
‘ সিরিয়াসলি?’
‘ ইয়েস। আর তোমার ছেলে নীহারিকাকে দেখেছে জাওয়াদের টেবিলের উপরে রাখা ছবি থেকে। চিন্তা করো জাওয়াদ যদি জানতে পারে তোমার ছেলে তারই হবু বউ মানে হতে হতে না হওয়া বউয়ের প্রেমে এভাবে মরছে অবস্থা কেমন হবে বেঁচারার।’ আনজুম ডাকাতের মত হাসছে। সবার হাসি দেখে বিমুগ্ধও হেসে ফেলল। তারপর রাগ দেখানোর অভিনয় করে বলল,’ হবু, বা বউ কিছুই নয় জাওয়াদের সে ওকে। নীহারিকা জাস্ট বিমুগ্ধের।’ বিমুগ্ধ ছবিটি তার নিজের বেড সাইডের টেবিলের উপরে রাখা ফটো ফ্রেম থেকে নিজের একটি ছবি বের করে সেট করে রাখল। এক পাশে বিমুগ্ধের সাদা কালো ছবি অন্যপাশে নীহারিকার রঙ্গিন ছবি। এই ছবি সে বহু কষ্টে জোড়ার করেছে। তাও অর্পণকে দিয়ে। বিমুগ্ধ হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নবীন উদ্দীন আরও একবার ভালো করে ছবিটা দেখে বললেন,’ মেয়েটি মায়ের মত দেখতে। কিভাবে সম্ভব?’
‘ কারণ সে তোমার মায়েরই নাতনী আব্বি।’ আনজুম কথাটা বলেই একটি তুফান সৃষ্টি করল। যা সে ঠিক তখন বুঝতে পারেনি। যদি পারত কখনো বলত না। কখনো না। নবীন উদ্দীন ভালো করে দেখে বললেন,’ রাবেয়ার এমন কোন মেয়ে নেই। তার মেয়েদের আমি চিনি।’
আনজুম বলল,’ দাভাই তো বলল আমাদের কোন আত্মীয়ের মেয়ে। নাতনী বলেছে। নিশ্চয়ই ফুফুর মেয়ে হবে ভেবেছিলাম।’ আনজুম বিমুগ্ধের দিকে তাকাল। বিমুগ্ধ তখন চুপ হয়ে বসে আছে। নবীন উদ্দীনের শরীরে খেলে গেল একধরনের অজানা ক্ষোভ, রাগ, প্রতিহিংসা। তিনি চিৎকার করে বললেন,’ নাফিসের মেয়ে? বিমুগ্ধ প্রশ্ন করছি নাফিসের মেয়ে? তুমি এদিক সেদিক কেন তাকাচ্ছ? নাফিসের সাথে তোমার দেখা হয়েছে? এসব কি তার চাল? তোমার সাহস কিভাবে হলো তার সাথে যোগাযোগ করার? কে এই মেয়ে?’ ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি বিমুগ্ধের পাশের ফটোফ্রেম ছুঁড়ে মারলেন। সাথে সাথে সকলে চমকে গেল। কাঁচ ছড়াছড়ি ফ্লোরে। বিমুগ্ধ বাদে সবাই দাড়িয়ে পরেছে। শামা ছুঁটে এসে নিজের স্বামীকে শান্ত করতে বললেন,’ এতো উত্তেজিত হচ্ছ কেন? নাফিসের মেয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে?’
‘ কি হয়েছে তুমি বলছ? তুমি? ওই মেয়ের নাম যেন আমি জীবনে না শুনি। কখনো না। নাফিসের মেয়ে কিভাবে তোমার পছন্দ হলো বিমুগ্ধ? কিভাবে? পৃথিবীতে কি মেয়ের অভাব পড়েছে?’ নবীন উদ্দীন খুড়িয়ে খুড়িয়ে ছবিটি বের করে নিলেন। কয়েক টুকরো করে তিনি বললেন,’ তোমাকে সাবধান করছি বিমুগ্ধ এই মেয়ের থেকে দূরে থাকবে। আজ থেকে তুমি একে চিনো না।’
বিমুগ্ধ জীবনে প্রথম নিজের আব্বির কাছে ঝাড়ি খেয়ে ভাষা হারা হয়ে পড়ল। কিন্তু তা প্রকাশ না করে হেসে বলল,’চিনি না বললে তো হবে না।’
‘ হবে। হতেই হবে। তুমি আজ থেকে এই মেয়েকে ভুলে যাবে।’ নবীন উদ্দীনের শরীর তখন কাঁপছে। বিমুগ্ধ এবার সিরিয়াস হয়ে বলল,’ আপনি কেন এতো রিয়েক্ট করছেন?’
‘ তোমাকে কি বলেছি ভুলে গেলে?’
‘ না ভুলিনি। আপনি শান্ত হন।’
‘ হতে পারছি না। তুমি কিভাবে এই মেয়েটাকে পছন্দ করতে পারো? নাফিসের মেয়েকে?’ তিনি যেন অবাক হয়ে গেলেন। এ যেন অসম্ভব কান্ড। বিমুগ্ধ হেসে বলল,’ নাফিসের মেয়ে বাদেও তার পরিচয় আছে আব্বি। সে একজন মানুষ। একটি মেয়ে। আলাদা একটি অস্তিত্ব। আর সে নীহারিকা।’
‘ সে কি আমি তোমার থেকে জানতে চাইছি না।’ বিমুগ্ধ স্বাভাবিক হয়ে বসে আছে। অতি উত্তেজিত হয়ে নবীন উদ্দীন বসে পড়লেন। পায়ের বৃদ্ধা আঙ্গুল নাচাতে শুরু করলেন তিনি। চোখ বন্ধ। মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে। অনেকক্ষণ পরে বললেন,’ আমার চা দেও শামা।’
শামা চা এগিয়ে দিলেন। আনজুম ভয়ে দূরে দাড়িয়ে আছে। তিনি এবার বেশ আয়েশি ভঙ্গীতে চায়ে চুমুক দিলেন। মুখের ভাবটা ভালো নয়। যেন বিষ পান করছেন। বিমুগ্ধের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বললেন,’তুমি মেয়েটিকে ভুলে যাবে।’
বিমুগ্ধ চুপ করে রইল। তিনি আবার বললেন,’ তুমি তাকে চিনো না। জানো না। কখনো দেখনি। ঠিক আছে?’
বিমুগ্ধ নিরব। শামা নির্নিমেষ ছেলের দিকে চেয়ে আছেন। তার ছেলেকে এতো বেশি সিরিয়াস তিনি কখনো দেখেননি। মেয়েটি কি সত্যি খুব ভালোবাসার? নাফিসের মেয়ে মানে তো আফিয়ার মেয়ে। খুশিতে আনন্দে তার চোখে জল জমেছে। ইশ ছবিটা ভালো করে দেখা হলো না। কষ্টে চোখমুখ কুঁচকে রাখলেন। নবীন উদ্দীন আবার আওড়ালেন,’ তুমি সেই মেয়ের সাথে কোন রকম যোগাযোগ করবে না। ঠিক আছে?’
বিমুগ্ধ এবারও চুপ। নবীন উদ্দীন রেগে আগুন হয়েও শান্ত গলায় বললেন,’ তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না?’
‘ জি পাচ্ছি।’
‘ তাহলে উত্তর দিচ্ছ না কেন? আব্বির বিরুদ্ধে যাবে? ওই মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করবে? তুমি কিভাবে একজন খুনির মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছ? কিভাবে? সে একজন জঘন্য লোকের মেয়ে।’ বিমুগ্ধ একবার তাকাল। শামা দ্রুত হাত চেপে ধরে বললেন,’ কি করছ? এসব কি ধরনের মজা। এসব কথা আর বলবে না।’ চোখমুখ শক্ত করে লাল হয়ে গেলেন নবীন। বিমুগ্ধ চুপ করে আছে। তাকে এমন নিশ্চুপতার বেস ধরে থাকতে দেখে নবীন বিক্ষিপ্ত প্রায়।
‘ তুমি একজন মেয়ের জন্য আমাদের মাঝে কোন রকম সমস্যা তৈরি করবে না আশা কি।’ তিনি রুম ত্যাগ করলেন। বিমুগ্ধ অনেক ভাবলো। নীহারিকা তার পছন্দ। হয় তো ভালো লাগা। বা এর থেকে একটু বেশি। এক রাতে কেউ এতো ইম্পর্টেন্স হয়ে গেছে তার জীবনে ভেবেই সে সরে আসতে চাইল। কিন্তু কেন যেন সে ভুলতে পারলো না। অনেক চেষ্টাও তাকে এই নারীকে ভুলিয়ে দিতে পারেনি। আব্বির সাথে সূক্ষ্ম দুরত্ব তৈরি হয়েছে। যা জীবনে প্রথম ছিল। কিন্তু যখন আম্মি নিজের মায়ের বাড়ি যেতে চাইল। তখন বিমুগ্ধকে জীবনের বড় একটি অধ্যায় ছাড়তে হলো। আব্বির সাথে সে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হলো। নীহারিকাকে সে চিনবে না। তাদের যে দেখা হয়েছিল কখনো, সেটাও কখনো বলবে না। আম্মির জন্য তাকে এটি করতেই হয়েছে। অথচ সেই নীহারিকা! বিমুগ্ধ মাথা উপরের দিকে রেখে ছাদের দিকে তাকিয়ে আওড়াল,’ ওহ নীহারিকা! শুধু তুমি আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিলে। শুধু তুমি।’
বিমুগ্ধ কখনো ভাবেনি কাউকে সে এতোটা চাইবে। সে কখনো ভাবেনি নীহারিকার জন্য সে এতো কিছু করবে। কখনো কল্পনাও করেনি মেয়েটি তার নিঃশ্বাসে মিশে যাবে। বিমুগ্ধ চুল টেনে ধরল। চোখ বন্ধ করেও সে বুঝতে পারছে নীহারিকা তার পাশে। তাকে দেখছে। গভীর তার লোচনজোড়া। কপালে বেশ ভাঁজ পড়ছে। ভ্রু গুলো কুঁচকে আছে। ছোট নয়নে সে বিমুগ্ধের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিমুগ্ধ হাসল। ঠোঁট প্রসারিত হয়ে আসল। তার ইচ্ছে করছে এখন উঠে একটি গভীর চুম্বন দিতে। ভাঁজ পড়া সেই কপালে কপাল ঠেকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিতে। একটি চুম্বন গালে আঁকতে। নীহারিকা কি চমকে যাবে? তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? কত জোরে চিৎকার করবে? থাপ্পড় দিবে? পূর্বের ন্যায় থেকে চোখ জুড়ানো হাসি ঠোঁটে মেখে সে বলল,’এভাবে তাকিয়ে থাকলে তো সত্যি প্রেমে পড়ে যাবে। ভালোবাসা আর প্রেম কিন্তু ভিন্ন। প্রেমে পড়লে তুমি খুব পাগলামি করবে। হুট করে বদলে যাবে। রাগ হবে না তোমার। কান্না পাবে। সেই নীহারিকাকে দেখতে ভালো লাগবে না। তাই এভাবে তাকিয়ে থাকবে না। আমি চাই তুমি আমার প্রেমে যেন কখনো না পড়ো।’ বিমুগ্ধ বুঝতে পারছে নীহারিকা আগের মতই আছে। না তার দৃষ্টি পরিবর্তন হয়েছে না মুখশ্রীর ভাবভঙ্গী।
‘ নিজের ড্রেস নিয়ে বের হও রুম থেকে। আমার রুমে তোমাকে বেশিক্ষণ এলাউ করতে পারছি না।’
বিমুগ্ধ উঠে বসল। মনোযোগ দিয়ে সে কাজ করছে। কিভাবে হুট করে সিরিয়াস হয়ে যায় এই মানুষটা? নীহারিকা শান্ত গলায় বলল,’ বিয়ে নিয়ে কি হয়েছে?’
বিমুগ্ধ হাসলো। কিছু বলল না। নীহারিকা আবার বলল,’আপনি আপনার আব্বির সাথে কি নিয়ে ঝামেলা করেছেন? রূবাইদা আপু আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে ছিল কেন? আপনি এসব কেন করছেন? প্রতিশোধ নিচ্ছেন? আমার বাবার থেকে? না কি আমার থেকে? আমি তো তেমন কিছুই করিনি। তাহলে আপনার সাথে শত্রুতা কিসের?’
বিমুগ্ধ শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,’ রাগেশ্বরী যাও। দ্রুত।’
‘ আপনি এতো অসভ্য কেন? আমাকে একদম এসবের মাঝে নিয়ে আসবেন না। রূবাইদা আপু কখনো আমার দিকে এভাবে তাকায়নি। আজ আপনার জন্য তাকিয়েছে। আপনাদের বিয়ের কি হয়েছে?
‘ কারণ আমি তোমাকে বলতে চাইছি না। রুম থেকে বের হও। কারো কথা বাহিরে দাড়িয়ে শুনা অপরাধ।’
‘ কথার মাঝে আমি ছিলাম দেখেই শুনেছি।’ নীহারিকা মুখ বাকিয়ে নিজের আলমারির সামনে গেল। দরজা খুলে সে বিরক্ত হয়ে গেল। বিমুগ্ধের জামাকাপড় তার আলমারির অর্ধেক দখল করে রেখেছে। ওহ অসহ্য। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নীহারিকা বিমুগ্ধের দিকে তাকাল। সে এদিকে তাকিয়ে আছে দেখে চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিল। নীহারিকা বিমুগ্ধের জামাগুলো ধপধপ করে ছুড়ে দিল কয়েকটা। এটা দেখে বিমুগ্ধ শব্দ করে হেসে উঠল। নীহারিকা নিজের কিছু জামা নিলো। সব নেওয়া সম্ভব না। মনোযোগ দিয়ে কাজ করার সময় খেয়াল হয়নি বিমুগ্ধ তার পিছনে দাড়িয়ে আছে। নীহারিকা ঘুরতেই চমকে গেল। আলমারির সাথে ঠেসে দাড়িয়ে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,’ আপনি কি পাগল?’ বুক ধরাস ধরাস শব্দ করছে। বিমুগ্ধ আলমারির এক পাশ ঘেঁষে দরজায় হাত রাখল। নীহারিকা ভয় পেয়ে গেল। এই প্রথম বিমুগ্ধকে তার ভয় করছে। নীহারিকা মুখে তা প্রকাশ করল না। রাগে গমরঙ্গা মুখ লালাভ হয়ে উঠল। চোখ হয়ে উঠল হরিদ্রাবর্ণ। বিমুগ্ধ কোমল চোখে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল,’ তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য নীহারিকা আমি সব কিছুর বিরুদ্ধে যাচ্ছি। তুমি কি আমাকে বুঝতে পারছ না? না কি বুঝতে চাইছ না?’ বিমুগ্ধের চোখ লাল। কান লাল। তার ছোট ছোট কাঁটা চুলের ভাজে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নীহারিকার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। বিমুগ্ধের দিকে সে তাকাতে পারছে না। ওই চোখ স্বাভাবিক নয়। একদম ভিন্ন। আলাদা। চোখের কি আলাদা ভাষা হয়? হলে নীহারিকা বলবে এই চোখ কথা বলতে জানে। শুঁকনো ঢোক গিলল নীহারিকা। বিমুগ্ধর শীতল চাহনী। গা হিম করা শ্বাস। অতিশয় আকুল আবেদনে ভাসছে দু’টি নয়ন। নীহারিকা কিছুই বলতে পারল না। তার কণ্ঠ রোধ হয়ে আসল। বিমুগ্ধ হাসল। বলল,’ তোমার চোখ আমি এখন পড়তে পারছি। সব সময় পারি না।’ নীহারিকা দ্রুত চোখ এদিক সেদিক করছে। বিমুগ্ধ আর তার মাঝে দূরত্ব অর্ধ হাত।
‘ আমি এখানে একটি গেম খেলেছি। নিজের পরিকল্পনা আমি কাউকে বলি না। তোমাকে বলছি। আমি যে বিয়ে করবনা ঘোষণা দিয়েছি ফলস্বরূপ তোমার জেঠা এই বাড়িতে এসে হাজির হবে। একঘন্টার মাঝে তোমাদের বাড়িতে আরও দু’জন মানুষের সংখ্যা বাড়বে। আমি কথা রাখতে জানি। তাদের মিলিয়ে দিব। তুমি কি একটু হাসবে? আমি কখনো তোমাকে খিলখিল করে হাসতে দেখিনি। আমার ইচ্ছে, তুমি হাসবে। রেগে যাবে। মাঝে মাঝে আমার উপরে চওড়া হয়ে কিছু অকথ্য ভাষা শুনিয়ে দিবে। তোমাদের বাংলাদেশি গালি।’
নীহারিকা সরে গেল। বারান্দার পাখির খাঁচা নিজের হাতের মুঠোতে নিয়ে পিছনে ফিরে দেখে বিমুগ্ধ গ্রিলের সাথে বুকে হাত ভাঁজ করে দাড়িয়ে আছে। নীহারিকা চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল,’ পিছনে ঘুরছেন কেন?’
‘ আমি সাথে ঘুরতে চাই।’
‘ ফাতলু কথা বলবেন না। আপনার বাবা মা কখন আসবে?’
‘ আর ৪৫ মিনিট পরে।’
‘ আপনাকে বলেছে?’
‘ না। আমি ধারণা করেছি।’
‘ খবরদার এভাবে তাকাবেন না। চোখ স্বাভাবিক করুন।’
‘ করেছি।’
‘ আমার মনে হচ্ছে না।’ নীহারিকা রেগে রেগে তাকাল। বিমুগ্ধ হেসে হেসে তাকাল। দু’ টি অবাস্তব অনুভূতির অক্ষিযুগল একত্রিত হয়ে অন্যরকম কথা বলছে।
‘ তোমাকে অন্যরকম লাগছে।’
‘ কেমন?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল নীহারিকা।
‘ রাগেশ্বরী তুমি ঘামছ।’
‘ মোটেও না।’
‘ তোমার হৃৎপিণ্ড তীব্র শব্দ করছে।’
‘ কিছুতেই না।’
‘ তোমার কায়া দুলছে।’
‘ অসম্ভব। ফালতু কথা বলবেন না।’
‘ তোমার ঠোঁট কাঁপছে। আমি কন্ট্রোল লেস হয়ে পড়ছি। আমার মনে হয় তোমার যাওয়া উচিৎ। আউট। গেট আউট।’ নীহারিকা লজ্জা পেয়ে গেল। অবাকও হলো। কিন্তু দু’টিই প্রকাশ করতে চাইল না। অথচ বিমুগ্ধকে পাগল করে দিল। সে চোখ বুজে বলল,’ তুমি যাচ্ছ না কেন?’
‘ যাচ্ছি।’
‘ আমি জানি তুমি দাড়িয়ে আছো।’
‘ একটু থাকি?’ নীহারিকার কণ্ঠ অন্যরমক। নেশালো। বিমুগ্ধ ভয়াবহ রকমের অবাক হয়ে গেল। নীহারিকার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকাল। হেসে ফেলল নীহারিকা। মুচকি সেই হাসিতে ডুবে গেল বিমুগ্ধ। মেয়েটি সুন্দর নয়। একদম সুন্দর নয়। অথচ ভালোবাসাময়। অসুন্দর মেয়েগুলোকে বেশি ভালোবাসা সম্ভব। সুন্দর মেয়েদের ভালোবাসা সুন্দর হয় না।
‘ তুমি সুন্দর করে হাসতে পারো না? খিলখিল করে? আমি দেখতে চাই। তুমি খুব কাঁদবে। আমার জন্য। আমি চাই।’
‘ মেয়েদের কাঁদানো উচিৎ নয়।’ নীহারিকা দোলনায় বসলো। বিমুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে নিলো। নীহারিকা তা দেখে বলল,’ এটা আমার দোলনা। বসতেই পারি।’
‘ তোমার ভয় করছে না? আমি ভালো মানুষ নই। তুমিও আমার জন্য সাধারণ কেউ নও।’ বিমুগ্ধ আরও ঘেঁষে দাড়াল গ্রিলে। যেন নিজেকে আটকে রাখছে। নীহারিকা হাসছে। এই মুহূর্তে সে শুধু হাসবে। কিছু সময় হাসা উচিৎ। শুধু হাসা।
‘ না করছে না। করা কি উচিৎ?’
‘ অবশ্যয় উচিৎ।’ বিমুগ্ধ চোখ কান লাল। মুখ থমথমে। ঘামছে সে। তার কপাল বেয়ে পড়ছে সে ঘাম। নীহারিকার সাথে সে কখনো আর বারান্দায় আসবে না। কখনো একা দেখা করবে না। নিজের কপালের ঘাম মুছে নিলো হাতের উল্টো পিঠে। নীহারিকার হাসি একটু বাড়ল। বিমুগ্ধকে এমন অবস্থায় দেখে তার দারুন অনুভব হচ্ছে। চোখ ছোট করে ঠোঁটে হাসি রেখে বলল,’ তাহলে পাচ্ছি। অনেক ভয় পাচ্ছি আমি। এই যে হৃদয়পিঞ্জিরা কাঁপছে। হাত কাঁপছে। চোখ কাঁপছে। সমস্ত শরীর কাঁপছে।’ বিমুগ্ধ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। সে সত্যি অবাক হচ্ছে। তা একদম লুকিয়ে রাখছে না। প্রকাশ করছে।
‘ তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? মাতাল মাতাল লাগছে। ড্রিংক করেছো? রেড ওয়াইন না কি হুইস্কি?’ বিমুগ্ধ অবাকের আকাশে আরোহণ করে কথা বলছে। যেন সত্যি নীহারিকা মাতাল। এসব খেয়েই মাতাল হয়েছে। নীহারিকা এবার বেশ গম্ভীর হয়ে বলল,’ আমাকে মাতাল মনে হচ্ছে?’
‘ হুম হচ্ছে।’
‘ ভালো আমি মাতাল। এবার পরের পরিকল্পনা বলুন। আপনার আব্বি এসে কি করবে? মানে তিনি কেমন রিয়েক্ট করবেন। আপনাকে কি চড় থাপ্পড় দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসাবে?’ নীহারিকা বেশ চিন্তিত একটা লুক দিল। বিমুগ্ধ গম্ভীর গলায় উত্তর দিল,’ এসেই তিনি নিজের রুমে ঢুকে পড়বেন। কারো সাথে কথা বলবেন না। এমন কি আমার সাথেও না। টানা তিনদিন বাহির থেকে খাবার কিনে খাবেন। কথা নেই, বের হওয়াও নেই। তাকে নিয়ে ভেবে লাভ নেই। তুমি তাকে চোখের সামনেও দেখবে না।’
‘ আপনারা পুরো পরিবার কি পাগল? মানে মাথায় সমস্যা আছে ধরনের রোগ আছে?’
‘ সবাই না। আমি আর আব্বি একটু এমন। কারণ পাগলদের সাথে থাকি তো।’
‘ তাহলে তো আপনার মা আর বোনও পাগল হয়ে যাওয়ার কথা।’
‘ রোগীদের সাথে থেকে ডাক্তার পাগল হয়ে যায়। কিন্তু ডাক্তারের সাথে থাকলে রোগী, সাধারণ মানুষ পাগল হয় না।’
‘ আপনি হসপিটালে যাচ্ছেন না কেন? আজকে সারা দিনে ও গেলেন না। কাহিনী কি?’
‘ আমি লিভ নিয়েছি কিছু দিন। তুমি এমন প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছো কেন? তোমাকে আমার এখন বউ বউ লাগছে। যাদের কাজ প্রশ্ন করা। চিৎকার চেঁচামেচি করা। সবচেয়ে বড় কাজ স্বামীর মাথা খাওয়া।’
নীহারিকা এবার রেগে আগুন হয়ে গেল। অগ্নীশর্মা রূপে তাকে দারুন লাগছে। মনে হচ্ছে আগুন কুন্ডলী। ওই যে দূরের সূর্যের আলো এসে মুখের উপরে পড়ছে। রং পাল্টে দিচ্ছে। বিমুগ্ধের এখন আর কন্ট্রোল হারানো হারানো অনুভূতি হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সামনের মেয়েটিকে দেখতে ভালো লাগছে। সুন্দর লাগছে। রূপবতী লাগছে। এসব মেয়েদের ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে জাগে না। দূর থেকে দেখতে ইচ্ছে করে। ঠিক পাহাড়ের মত। আকাশের মত। নীহারিকার মাথায় সোনালী ওড়না। গায়ে সোনালী রোদ। জামা সাদা। বিশাল উড়না তার মাথা ছাড়িয়ে কোমড় পর্যন্ত। এক প্যাঁচে ডান থেকে বামে। বিমুগ্ধ হাসল। বেশ অনেক্ষণ পরে। এবার সে নীহারিকার পাশে চেয়ার টেনে বসল। নীহারিকা একটু একটু অবাক হচ্ছে। বিমুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,’ ভয় করছে এবার?’
‘ করছে।’
বিমুগ্ধ সরে বসল। ঠোঁটে হেসে চুলে হাত বুলিয়ে বলল,’ তুমি শব্দ করে হাসবে। তোমাকে খিলখিল হাসিতে অদ্ভুৎ সুন্দর লাগবে। রূপকথার রাজনন্দিনীর মত। স্বপ্ন স্বপ্ন। অবাস্তব। অথচ বাস্তব। যাদের দেখে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করলেও ছুঁয়ে দেওয়া হয় না। আমি কি বেশি রোমান্টিক কথা বলছি?’
‘ হ্যাঁ বলছেন।’
‘ প্রেমিক প্রেমিক লাগছে?’ বিমুগ্ধ আগ্রহের সাথে জানতে চাইছে। গভীর দৃষ্টি। নীহারিকা বড়দের মত মুখ ভার করে বলল,’ ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘ পারবে না। কারণ তুমি কখনো প্রেমিক দেখনি। এসবে তোমার অভিজ্ঞতা নেই। তোমার প্রেমিক দেখা উচিৎ। কোন এক ভোরে আমি তোমাকে প্রেমিক দেখাতে নিয়ে যাব।’
‘ ভোরে প্রেমিক কোথায় পাবেন?’ নীহারিকার চোখে মুখে অবিশ্বাস্য ছাপ।
‘ ভোরেই প্রেমিক পাওয়া যায়। দেখবে কি না বলো?’
‘ আচ্ছা। দেখব। এখন আপনি আমাকে বলুন কিভাবে তাদের মিল করাবেন?’
‘ আমাদের মিল হলেই মিল হয়ে যাবে।’
নীহারিকা উঠে দাড়াল। বিমুগ্ধ উলটোপালটা কথা বলছে। মানে সে আর একটি প্রশ্নেরও উত্তর দিবে না। নীহারিকাকে যেতে দেখে বিমুগ্ধ বলল,’ আমি কিন্তু সিরিয়াস।’
‘ আমিও সিরিয়াস হয়েই উঠে যাচ্ছি।’
‘ তুমি হাসলেই মিল হয়ে যাবে। কবে হাসবে বলো?’
নীহারিকা অবাক হয়ে থেমে গেল। হাসি কি দিন তারিখ ঠিক করে হাসা যায় নাকি? বিমুগ্ধের অকম্মৎ কথায় সে থ। বিমুগ্ধ অপরাজিতা গাছের একটি ফুল ছিড়ে ফেলল। চেঁচিয়ে উঠল নীহারিকা। রাগে গজগজ করছে নিঃশ্বাস। অগ্নী গলায় বলল,’ ফুল ছিড়লেন কেন?’ বিমুগ্ধ উত্তর দিল না। আরও একটি ছিড়ে ফেলল। নীহারিকার কঠর চক্ষু। বিমুগ্ধ উপেক্ষা করে আরও একটি ছিড়লো। তারপর সেগুলো নিয়ে নীহারিকার সামনে এসে দাঁড়ালো। দু’টি ফুল সে খাঁচার ভিতরে ঢুকিয়ে পাখিদের দিয়ে দিলো। আর একটি ফুল নীহারিকার দিকে এগিয়ে দিলো। নীহারিকা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বিমুগ্ধ সেই ফুল তার হাতের জামার উপরে রেখে দিল। তারপর বলল,’ আমার সামনে লজ্জা পাবে না। তোমাকে তাহলে আমি খু/ন করে দিব। তোমারই মত।’
নীহারিকা মুচকি হাসল। কেন সে জানে না। জানে শুধু এই মুহূর্তে তার হাসার প্রয়োজন। যেতে যেতে সে পিছনে ফিরে বলল,’ আমি কোন এক দিন আপনার জন্য হাসব। শব্দ করে খিলখিল করে। পাগলের মত।’ বিমুগ্ধর চোখে খেলে গেল এক প্রেমময় কণ্ঠ। একটি প্রেমের বসন্তদূত ডাকছে। ভয়াল কণ্ঠে। এটাই কি প্রেম? অবাধ্যতাইতো প্রেম। বিমুগ্ধ সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। টানা এক ঘন্টা।
নীহারিকার মন আজ অনেক দিন পরে অবাধ্য উশৃঙ্খল হয়েছে। বিমুগ্ধের সাথে অনেক দিন পরে কথা বলে তার অন্য রকম লেগেছে। বিমুগ্ধের সেই কেমন কেমন নজর তার হৃদয়কে কেমন কেমন করে দিয়েছে। প্রিয় একটি কেমন কেমনে ভেসে গেলো সে। একটি লম্বা সিঁথি করলো নীহারিকা। এক পাশের চুল সামনে নিয়ে আসল। সেই চুলের মাঝে নীলকণ্ঠের ডাটা ডুবিয়ে দিল। সরু রেশম চুলে অর্ধ ডুবা নীলকন্ঠ। আয়নার সামনে নীহারিকা। সত্যি তো কেমন কেমন লাগছে। অনুভূতিগুলো কেমন কেমন। রাগটাও কেমন কেমন। নীহারিকা ফুলের দিকে তাকিয়ে একটু রেগে গেল। পরক্ষণে হাসল। ফুল সত্যি অন্যের জন্য ফুঁটে। নীলকণ্ঠময় নীহারিকা আজ কেমন কেমন সাজে।
______________
চলবে………….
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি সুন্দর গুন।
@হাফসা_আলম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here