#তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি
#লেখিকা_রিয়া_খান
#পর্ব_৩৪
আই সি ইউ তে দীপ্তির যেনো প্রতিটা সেকেন্ড যাচ্ছে মৃত্যুর সাথে কড় গণনা করে।
এতোটা বাজে ভাবে এক্সিডেন্ট করেছে যে ওর বেঁচে উঠার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারছে না।আই সি ইউ থেকে বের হওয়ার আগে তীব্রর মাথায় টনক ঘুরলো এতো রাতে দীপ্তি কেনোই বা বাইরে বের হয়েছিলো,আর যে রাস্তায় ওর এক্সিডেন্ট এর কথা টা শুনেছে সেখানে এরকম এক্সিডেন্ট হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক। ব্যাপারটা মাথায় নিয়ে তীব্র হসপিটাল থেকে বের হবে এমন সময় মিশানের সামনে পড়তে হলো,মিশানকে খুব ক্লান্ত লাগছিলো, গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে,বুঝা যাচ্ছে ও অনেক দূর থেকে হাঁটা পায়ে এসেছে।
-তুমি এখানে কি করছো?
-স্যার আপনার ফোন টা কি সাথেই আছে?
– কেনো?
-যদি সাথেই থাকে তাহলে ফোনটা চেক দিন, আমি আপনাকে কতবার কল করেছি।
আপনাকে কল করতে করতে আমার ফোনের চার্জ ই শেষ হয়ে গেছে। একটা বার রিসিভ তো করবেন!
-তোমার ফোন রিসিভ করা মানেই তো পকেটের টাকা খসানো।এতো রাতে তোমার কল মানেই মদের বিল ভরার ডাক।
-স্যার আমি মদ খেয়ে যমরাজকে কল দিতে পারি কিন্তু আপনাকে না,মদের দোকানদাররা আমি চাইলে মাগনাও দিতে রাজি হবে।
আমি আপনাকে কল করেছিলাম আপনার প্রয়োজনে।
তীব্র চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
-আমার কি প্রয়োজন?
স্যার আমি তো রাতে রাস্তাঘাটে হাঁটাহাঁটি করি জানেন ই।আজকে আমি টোটালি মদ খাই নি,শুধু কয়েকটা সিগারেটে টান বসিয়েছি, আজকে ইচ্ছে করছিলো পুরো শহর হাঁটবো।আমি আন্দাজি এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে দেখি একটা। বিল্ডিংয়ের চার তলার ছাদ কমপ্লিট অই বিল্ডিংয়ের কোনো একটা ফ্লোর থেকে ভারী কিছু একটা পড়লো, কৌতুহল নিয়ে আমি কাছাকাছি যেতেই বুঝতে পারি এটা কোনো মানুষ আর সে ছটফট করছে বাঁচার জন্য,আমি তাঁর দিকে দৌড় দিয়ে একদম নিকটে যাওয়ার আগেই আমার চোখের সামনে একটা গাড়ি হাই স্পিডে বডিটার উপর দিয়ে ক্রস করে গেলো।স্বাভাবিক অবস্থায় আমি তো এসব দেখে ভয় পাই আপনি জানেন ই। তবুও আমি হন্তদন্ত হয়ে বডিটার কাছে গিয়ে দেখি ওটা দীপ্তি ম্যাডাম, এটা দেখে আমি আর আমার মাঝে নেই।ম্যাডামকে কোলে তোলে আমি এগিয়ে একটা সিএনজি নিয়ে হসপিটালে আসি, আর আপনাকে অনবরত কল করতে থাকি, আপনি তো রিসিভ ই করছিলেন না, আমার মাথাও কাজ করছিলো না, এখন কি করবো?,এরপর খেয়ালে আসলো আপনি বলেছিলেন দীপ্তি ম্যাডাম হলিক্রসের শিক্ষিকা, আমি স্কুলের নাম্বারটা কালেক্ট করে প্রিন্সিপালকে ইনফরম করি, উনিই ম্যাডামের বাড়িতে জানায় ব্যাপারটা।
ম্যাডামের বাড়ির লোক আসার পর আমি সেই জায়গাটাতে আবার যাই,এবং ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করে আসি,এখন এখানে এলাম যদি ম্যাডামের জ্ঞান ফিরে তাহলে কিছু ইনফরমেশন পেলে হয়তো ক্রিমিনালকে শনাক্ত করতে পারবো।
মিশানের কথাগুলো শুনে তীব্র চিন্তিতো হয়ে গেলো,ওর ই কোনো শত্রু দীপ্তিকে মারার প্রচেষ্টা করছে। আর সেদিন অভিজিৎ ও বলছিলো ওদের টার্গেটে দীপ্তিও ছিলো।
তীব্র মিশানকে নিয়ে আবার সেই ঘটনা স্থানে গেলো।
মিশান যা যা দেখেছিলো তার সবটা এক্সপ্লেইন করে দেখালো তীব্রকে। তীব্র চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখলো,পকেট থেকে একটা মারকার বের করে রোডের সেই স্থানে দাগ কাটলো যেখানে দীপ্তি উপর থেকে পড়ে গিয়েছিলো,এটা তো কনফার্ম কেউ একজন দীপ্তিকে উপর থেকে ফেলে দিয়েছে, আর প্ল্যানিংয়ের সাথে দীপ্তির উপর গাড়ি চালিয়ে দিয়েছে।
-মিশান
-জি স্যার?
– গাড়িটার নাম্বার দেখে রেখেছো?
– না স্যার, আমি গাড়ির নাম্বার কিভাবে দেখবো স্যার, গাড়িটা বাম পাশ থেকে এসে ডান পাশের রাস্তা দিয়ে চলে গেছে, আমি তো সামনের দিকে ছিলাম।
তীব্র ভাবুক দৃষ্টিতে উত্তর দিলো,
-হুম তাও কথা!
-কিন্তু স্যার গাড়ির কালার টা মেবি হোয়াইট ছিলো।
-শিউর?
-হতে পারে,অই সময় এতো কিছু খেয়াল করার মতো সিচুয়েশন ছিলো না, আমার একটু একটু মনে পড়ছে সাদা ছিলো হয়তো।
তীব্র ঘাড় ঘুরিয়ে এদিকে ওদিক দেখলো আশেপাশে কোনো সিসিক্যামেরা আছে কিনা,কিন্তু কোথাও ক্যামেরা নেই।
-স্যার আপনি কি সিসিক্যামেরা খুঁজছেন?
এদিকে সিসিক্যামেরা নেই,আমি কিছুক্ষণ আগে এসে খুঁজে গেছি। আর এই খান থেকে ডান দিকে দশমিনিট পথেও কোনো ক্যামেরা নেই,দশমিনিট রাস্তার পর রাস্তা তিন দিকে গেছে, অই রাস্তা দিয়ে বেশ গাড়ি চলে, এখন ধরতে হবে গাড়িটা কোন দিকে গিয়েছে,দুর্ভাগ্যবশত স্যার অই মোড়ে বা তার আশে পাশে কোনো ফ্ল্যাটে কোনো ক্যামেরা লাগানো নেই। এরপর থেকে প্রতিটা মোড়ে সিসিক্যামেরা আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গাড়িটা কোন মোড়ে এগিয়েছে?অইটুকু সময়ে সাদা রঙের প্রাইভেট কার অই রাস্তা দিয়ে অনেক গুলোই গিছে নিশ্চয়, কারণ ওদিকটা এই রাস্তার মতো এতোটা জনশুন্য না।
-বাহ!তুমি তো বেশ কাজ এগিয়ে দিয়েছো, এতো বিচক্ষণতা নিশ্চয় আমার থেকেই পেয়েছো তাই না?
-এখন কি আপনি ঝগড়া করতে চাচ্ছেন?
-কথা বাঁকা করে নিচ্ছো কেনো?আমি ঝগড়া করার পরিস্থিতিতে নেই। মাথা ঠান্ডা করার প্রচেষ্টায় আছি,তোমার সাথে একটু কথা কাটাকাটি হলে আমার ব্রেইন খুলে যায়, আর যখন তাতলামো করো আমি অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই।
-স্যার দয়া করে মজা নিবেন না । দীপ্তি ম্যাডাম না আপনার ছোটো বেলার বন্ধু,তাঁর করুণ অবস্থা দেখে মায়া হচ্ছে না?
-মায়া হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে,ভেতরে যন্ত্রণা হচ্ছে আবার খুশিও লাগছে।
-খুশি লাগছে মানে?
-দীপ্তি যদি মরে যায় তাহলে এটা একটা খুশির সংবাদ আমার জন্য। দীপ্তি তীব্ররও হয় নি,অন্য কারোরও হয় নি।
-আপনার কথার প্যাঁচ অণুবীক্ষণ দিয়েও ছুটানো সম্ভব নয়।মানুষ যে কতটা নির্মম হতে পারে সেটা আপনাকে দেখলে বুঝা যায়।
তীব্র বাঁকা হাসি দিলো।মিশান তীব্রর দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে বললো,
-কোনো ভাবে আপনিই দীপ্তিকে মারার চেষ্টা করেন নি তো?এরকম মার্ডার প্ল্যান তো আপনার ই হয় বেশিরভাগ সময়।
তীব্র মিশানের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো,
-এটা বাড়াবাড়ি বলে ফেললে মিশান।মুখে লাগাম দাও,না হলে আমার হাতের লাগাম ছেড়ে যাবে।
মিশান রাগ চেপে চুপ করে রইলো।
-আচ্ছা মিশান, এখান থেকে হসপিটালে নেয়া অব্ধি দীপ্তিকে কে কে স্পর্শ করেছে?
-এখান থেকে হসপিটাল অব্ধি আমিই নিয়ে যাই, তারপর উনাকে বেডে আমিই রাখি আরেকজন নার্স আমাকে হেল্প করেছিলো,এরপর ডক্টররা স্পর্শ করেছে।
-চলো হসপিটালে যাওয়া যাক আবার।
তীব্র মিশানকে সাথে নিয়ে হসপিটালে গেলো,আর এসবিতে কল করে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে কয়েকজন অফিসারকে পাঠিয়ে দিতে বলে।
হসপিটালে গিয়ে দেখে তীব্রর মা আর তৃপ্তি এখনো হসপিটালেই আছে, আর দীপ্তির ফ্যামিলির লোক তো আছেই শুধু দীপ্তির ভাই আদিব বাদ দিয়ে।ভোর চারটার আগে আদিবকে জানানো যাবে না কিছু,কেনোনা আদিব ডিউটিতে গেছে শহর থেকে অনেকটা দূরে, এখন দীপ্তির কথা ওকে জানালে আদিব ভেঙে পড়বে, আর তাড়াহুড়ো করে ফিরতে গিয়ে অপকলঙ্ক ঘটে যাবে।
তীব্র মিশানকে নিয়ে সবার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো,মিশান দীপ্তির মায়ের দিকে তাকাতেই দীপ্তির মা মিশানের হাত জড়িয়ে কান্নাভেজা কন্ঠে বলে উঠে,
-তুমি কোথায় ছিলে মা এতোক্ষণ? বাড়ি ফিরে যাও নি?
-না আন্টি, আমি তো থানায় ডায়েরি করতে গিয়েছিলাম,আর হসপিটালে আসার সময় স্যারের সাথে দেখা হয়ে গেলো,আমি স্যারকে নিয়ে স্পটে গিয়েছিলাম।
-এসব করে কি হবে গো মা।বসে বসে দোয়া করো মেয়েটার জন্য,যেনো বেঁচে ফিরে। আল্লাহ তোমাকে ফেরেশতা বানিয়ে পাঠিয়েছিলো আমার মেয়েটাকে উদ্ধার করার জন্য, না হলে এতোক্ষণে হয়তো দীপ্তির মরা লাশটাই দেখতে হতো!
-আন্টি কাঁদবেন না প্লিজ!দীপ্তি ম্যাডাম ঠিক হয়ে যাবে, আপনি এভাবে ভেঙে না পড়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করুন যেনো উনি ঠিক হয়ে যায়।
-আল্লাহ তোমার অনেক মঙ্গল করুক মা!
মিশান অন্যদিকে ঘুরে হতাশাময় নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
-আন্টি স্যারের সাথে আমার কাজ আছে, একটু পর আপনার কাছে আসছি।
মিশান দীপ্তির মায়ের সামনে থেকে চলে যায়। এদিকে তীব্রর মা মিশানকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো, বেশ কিছুদিন আগে এই মেয়েটাই তাঁর দরজার সামনে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় দাঁড়িয়েছিলো, আর সেই মেয়েই কিনা আজ রাতে এমন একটা ভাল কাজ করেছে , তীব্রর মা শুধু মিশানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো, তীব্রর পিছু পিছু যাচ্ছে মিশান। আজ তীব্রর মা সামনাসামনি থাকা সত্ত্বেও মিশানের নজরে আটকাইনি এখনো, খেয়াল করবে তো দূর, তাঁর দিকে তাকায়ও নি।তীব্রর মা যতোটা আগ্রহ নিয়ে মিশানকে দেখছে, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তৃপ্তি।মিশানকে দেখার পর থেকে খুব চেনা চেনা লাগছে তৃপ্তির কাছে,মনে হচ্ছে মিশানকে এর আগেও কোথাও দেখেছে, কিন্তু কোথায় দেখেছে সেটা মনে করতে পারছে না।
মিশানকে নিয়ে তীব্র ডাক্তারের কাছে গিয়ে কিছু ইনফরমেশন নিলো,আবার আইসিইউ এর ভেতর গিয়ে দীপ্তির বডি পর্যবেক্ষণ করলো।
-স্যার দেখুন ম্যাডামের হাতের কব্জির এইখানটাতে কেমন একটা দাগ।
-অই হাতটাও চেক করো তো।
মিশান অপরপাশে গিয়েও চেক করলো অপর হাতেও একই রকম দাগ।
-স্যার সরু কিছু দিয়ে বাঁধলে এরকম দাগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।ম্যাডামের দুই হাতেই যেহেতু এই দাগ, ধারণা করা যায় কিছু একটা দিয়ে হাত বেঁধে রেখেছিলো অনেক্ষণ এরপর হয়তো উনি হাত ছুটানোর প্রচেষ্টা করে আর এরকম দাগ হয়,যেহেতু উনি অনেক ফর্শা তাই এটা প্রথমে লালচে রূপ নিয়ে এখন নীলচে রঙয়ের দাগ হয়েছে।
তীব্র দীপ্তির হাত ধরতে গিয়েও হাত সরিয়ে পকেটে ভরে নিলো,এরপর ওর হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো,আবার মুখের দিকে তাকালো।দীপ্তির অবস্থা খুবই করুণ, হার্টবিটও যেনো চলছে না, ওর চেহারার দিকে তাকালে মনে হচ্ছে না বেঁচে ফিরবে।
-আচ্ছা স্যার, ম্যাডাম এতো রাতে বের হয়েছিলো কেনো?উনার ফ্যামিলির লোক কি বলে?
-দীপ্তি রাতে বের হয় নি, সেই যে সকালে বের হয়েছে এরপর আর ফিরে নি,সন্ধ্যায় ওর ফোন থেকে ওর বাবার ফোনে এসএমএস যায় বাড়ি ফিরতে দেরি হবে।
-সব কিছুই রহস্যময় লাগছে স্যার।
-হুম,সেটা আমিও বুঝতে পারছি।
বেশ কিছুক্ষণ পর আবার দুজনেই বের হলো।মিশানের ফোনে বাড়ি থেকে কল আসার কারণে আই সি ইই থেকে বের হয়ে ফোন কানে নিয়ে অন্য দিকে যায়,তীব্র দীপ্তির বাবা মায়ের সামনে গিয়ে বলে,
-আংকেল আন্টি আপনারা বাড়ি চলে যান, আর রেস্ট নিন।ভোর হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আমি হসপিটালেই আছি।আর আদিব বাড়ি ফিরলে ওকে কিছু জানাবেন না,দীপ্তির কথা জিজ্ঞেস করলে বলবেন ও তৃপ্তির সাথে আছে, সারা রাত ডিউটি করে ওর রেস্টের প্রয়োজন আছে।আপনারা দীপ্তিকে নিয়ে টেনশন করবেন না, ও ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
-কেনো জানি মনটা খুব কু গায়ছে তীব্র!মেয়েটা এমন ভাবে আহত হয়েছে!
-কিচ্ছু হবে না দোয়া করুন ওর জন্য।
আর মা, তৃপ্তি তোমরাও বাড়ি চলে যাও, মন না মানলে আবার দিনের বেলা এসো,এখন বাড়ি যাও।
-তুই যাবি না বাবু?
-নাহ,আমার এখানে কাজ আছে,একাবের দিনের বেলাই যাবো।তোমরা এখন যাও।
মিশান কথা শেষ করে দীপ্তির মায়ের কাছে আসতেই দীপ্তির মা মিশানের কাঁধে হাত রেখে বলে,
-মা তুমি বাড়ি ফিরবে না? রাত তো শেষের দিকেই, বাড়িতে বকবে না?
-না আন্টি কোনো প্রবলেম নেই।আমি সারারাত বাড়ি না ফিরলেও কেউ কিছু বলবে না। আর আপনারা এখন বাড়ি যান, আমি এখনি বাড়ি যেতে পারবো না, ম্যাডামের জ্ঞান না ফেরা অব্ধি।
-তোমার নাম ছাড়া তো কিছুই জানা হলো না মা, কিছু মনে নিও না মা। মাথায় তো আমার কিছুই আসছে না,কি রেখে কি জিজ্ঞেস করবো। দীপ্তি ঠিক না হওয়া অব্ধি আমার ভেতর শান্ত হচ্ছে না।
-ম্যাডাম ঠিক হয়ে যাবে,ডোন্ট ওরি!
দীপ্তির বাবা মাকে বলে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠানো হলো,সাথে তীব্রর মা আর তৃপ্তিকেও। তৃপ্তি আর তীব্রর মা একদিকে শোকাহত দীপ্তির অবস্থার কারণে আরেক দিকে মিশানকে নিয়ে তাদের মাথায় আলাদা আলাদা চিন্তা।একজন চেহারা মনে করতে পারছে না,আরেকজন হিসেব মেলাতে পারছে না।
তৃপ্তির সাথে এমনটা হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে,কারণ বেশ কিছুদিন আগে যে তীব্রর কাছে মিশানের মোবাইল ছিলো, আর তৃপ্তি সেটাতে ওয়াল পেপারে নিশানের ছবি দেখেছিলো।নিশান মিশানের চেহারার কাটিং, গঠন প্রায় একই।মিশান শুধু নিশানের থেকে একটু বেশি লম্বা আর হ্যাংলা। নিশান সব সময় হাসিখুশি থাকতো বলে ওর চেহারা দেখতে একরম লাগতো আর মিশান সব সময় চিন্তিতো থাকতো বলে ওর চেহারা আরেক রকম লাগতো।
কিন্তু ওদের চেহারা ৯০% ই মিল ছিলো।
সেজন্য তৃপ্তির সামনে মিশানকে দেখে মনে হচ্ছে ওকে কোথাও দেখে আগে কখনো।
সবাই চলে যাওয়ার পর মিশান আর তীব্র দীপ্তির আই সি ইউ এর সামনে বসে থাকে।সবাই জানে দীপ্তি কেবলই এক্সিডেন্ট করেছে,কিন্তু আসল রহস্য মিশান আর তীব্রই জানে।ওদের ধারণা কেউ জেনে বুঝে দীপ্তিকে মারার প্রচেষ্টা চালিয়েছে,যদি জানতে পারে দীপ্তি ডেঞ্জার মুক্ত তবে আবার এট্যাক করবে ওর উপর। সেজন্য ওরা বাইরেই বসে রইলো,একজন হসপিটাল কর্তৃপক্ষ এসে তীব্রকে রিকুয়েস্ট করলো ওদের জন্য কেবিন ঠিক করা হয়েছে সেখানে রেস্ট করতে,কিন্তু তীব্র সেটা মাথায় নেয় না। একজন এসপি এভাবে আই সি ইউ এর বাইরে বসে থাকবে সেটা হসপিটাল কর্তৃপক্ষের খুব লাগছে। কিন্তু তীব্রকে হ্যাঁ থেকে না,আর না থেকে হ্যাঁ করানোর সাধ্যি ক্ষমতা কারো হয়নি আজ অব্ধি।
এসবি থেকে যেসব অফিসারদের পাঠানো হয় তাদের নির্দেশ দেয়া হয় যেনো সাধারণ মানুষের সাথে মিশে থেকে এদিকটা পর্যবেক্ষণ করে।
মিশান এক জায়গায় চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে ওর চোখে ঘুম চেপে আসে কিন্তু চোখ এক করলেই একটু পর পর ছিটকে যাচ্ছে। তীব্র এক হাতে চা আরেক হাতে সিগারেট নিয়ে চালাচ্ছে।
মিশানের চোখে যখনি ঘুম ভর করছে আস্তে আস্তে ওর মাথা তীব্রর কাঁধে চলে যাচ্ছে আবার ছিটকে উঠতেই সোজা হয়ে বসে, আবার কিছুক্ষণ পর পুনরায় একই ঘটনা ঘটছে।
মিশানের চোখে ঘুম থাকলেও তীব্রর চোখে নেই।কারণ তীব্র চিন্তা করছে শুধু, কে দীপ্তিকে মারার চেষ্টা করেছে, আর কেনো? যদি তীব্রর শত্রুদের মাঝের কেউ হয় তাহলে তাঁরা তো দু বছর আগেই দীপ্তিকে মারতো,দু বছর পর কেনো?! যারা ওর শত্রু তাঁদের মাঝে একমাত্র জাফর ই বাংলাদেশে আছে আর কেউ এদেশে নেই, আর জাফর জানেও না তীব্র আছে কি নেই, যদি জানতো তাহলে অনেক আগেই তীব্রকে মারার চেষ্টা চালাতো ।
খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করে নি, যারা
খোঁজ দিবে তাদের দুনিয়া থেকে অনেক আগেই উচ্ছেদ করে দিয়েছে তীব্র।
সকাল সাতটার দিকে দিকে দীপ্তির জ্ঞান ফিরে, একটু একটু করে কথা বলতে পারছে লম্বা শ্বাস টেনে টেনে।
নার্সের থেকে যখন জানতে পারলো বাইরে তীব্র বসে আছে, তখন দীপ্তি নার্সকে বলে তীব্রকে ভেতরে যেতে।নার্স বাইরে বেরিয়ে তীব্রকে জানানোর পরপরই তীব্র আই সি ইউতে প্রবেশ করে।
চিন্তিতো চেহারা নিয়ে তীব্র দীপ্তিকে প্রশ্ন করলো,
-দীপ্তি এখন কেমন ফিল করছো?
দীপ্তি মলিন হেসে লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে একটু একটু করে উত্তর দিলো,
-যখন কারো সময় ফুরিয়ে আসে পৃথিবীর স্থায়িত্বে,তখন সেই মানুষ টা বুঝতে পারে,সময় হাতে নেই,শুধু এক্সাক্ট টাইমটা ধরতে পারে না কখন চলে যাবে।চোখ বন্ধ করলে মৃত্যুর ফেরেশতাকে দেখতে পায়।
ঠিক আমি যেমনটা বুঝতে পারছি!তুমিও বুঝতে পারছো দীপ্তি আর বাঁচবে না কিন্তু তবুও শান্ত্বনা দিবে এখন আমাকে।
দীপ্তিকে দেখে তীব্র স্পষ্ট বুঝতে পারছে ,মেয়েটা সত্যিই বাঁচবে না । তীব্র একটা চেয়ার টেনে দীপ্তির বেডের পাশে বসে পকেট থেকে মোবাইল বের করে রেকর্ডার অন করে পাশে রাখলো,
-দীপ্তি কাল রাতে কি কি হয়েছে, প্লিজ সবটা খুলে বলো আমাকে,কষ্ট হলেও বলো আমাকে সবটা!
-যা হওয়ার তাই ই হয়েছে, তবে যা হয়েছে তাতে আমার একটুও ক্ষোভ হচ্ছে না। মৃত্যুর বিনিময়ে হলেও আমি আমার প্রশ্নদের উত্তর খুঁজে পেয়েছি।কাল রাতে আমি সব জেনেছি, যা আমার জানা প্রয়োজন ছিলো,কিন্তু দুঃখ একটা জায়গায় বেশি লেগেছে, এসবটা যদি তোমার নিজের মুখ থেকে শুনতাম। তুমি একটাবার বলেই দেখতে, আমি সত্যি তোমায় ভুল বুঝতাম না।তোমার তো কোনো দোষ নেই,তুমি কেবল পরিস্থিতির স্বীকার! জন্ম মৃত্যু এগুলো তো প্রাণীজগৎ এর একটা নিয়ম ধারা,এটা অস্বাভাবিক কিছু না। তুমি কেনো নিজেকে অপরাধী মনে করো?তুমি তো অপরাধী নও। তবে তুমি আমার থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে অনেক ভালো একটা কাজ করেছো,তুমি যেটা করে যাচ্ছো সেটা একদম ঠিকঠাক করে যাচ্ছো। আমার কোনো আফসোস নেই,আমি তো সব জানতে পেরেছি!
তীব্র খানিকটা ঘাবড়ে গেলো,দীপ্তির দিকে তাকিয়ে বিভ্রান্তিকর ভাবে বললো,
-কি ক্কি জানতে পেরেছো তুমি?আর জানাজানির সাথে তোমার এই অবস্থার কি সম্পর্ক?
দীপ্তির কথা বলতে কষ্ট হলেও নিজের সাথে যুদ্ধ করে যেনো গলার আওয়াজ তুলে কথা বলছে,তীব্রকে আস্তে আস্তে সবটা খুলে বলতে লাগলো,তীব্র সবটা শুনছে মন দিয়ে।
এদিকে বাইরে মিশান বসে বসে ঝিমাচ্ছে, এমন সময় কেউ একজন মিশানকে ডাকতে লাগলো,
-হ্যালো ম্যাডাম!হ্যালো!
মিশান ছিটকে তাকায় তাঁর দিকে।
-জি জ্জি স্যার ব বলুন?
-আপনি কি পেশেন্টের লোক?
-জি হ্যাঁ।
-কি হন আপনি উনার?
-আমার বড় বোন।
-ও আচ্ছা,তীব্র স্যার কি আছেন নাকি চলে গেছেন?
-তীব্র স্যার?
-জি হ্যাঁ
মিশান এদিকে ওদিক তাকাতাকি করে বললো,
-স্যার তো এখানেই বসে ছিলো,কোথায় গেলো!
এরপর মিশান উঠে দাঁড়ালো, তীব্রকে এদিক ওদিক খুঁজাখুঁজি করতে করতে একজন নার্সের থেকে জানতে পারে তীব্র আই সি ইউ এর ভেতর । এরপর অফিসার মিশানকে বলে তীব্রকে ডেকে দিতে, মিশান আই সি ইউ এর দিকে যায়।
-তীব্র!
-হুম!
-শুনেছি মৃত্যু যাত্রীদের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে হয়, তুমি কি আমার একটা ইচ্ছে পূরণ করবে?
-কি ইচ্ছে?
-আমি জানি এটা চাওয়া অন্যায়।সবটা জেনে বুঝেও মনকে মানাতে পারছি না, আমি যে তীব্রকে ভালোবাসি সে তুমি নও, তুমি তো মিশানের তীব্র, তুমি মিশানকে অনেক ভালোবাসো বলে ওকে বিয়ে করে নিজের সাথে জোড় বেঁধেছো। আমার সেই তীব্রর মুখ থেকে কখনো শোনা হয় নি সে আমাকে ভালোবাসে কিনা, তুমি বলো না একটা বার সেই তীব্র আমাকে ভালোবাসতো?
-…………………
-চুপ করে আছো কেনো?বলো না! মিথ্যে হলেও আমার ইচ্ছে টা পূরণ করো না, মিথ্যেটাকেই আমি সত্যি ভেবে আমার শেষ নিশ্বাসটা ফেলবো, প্লিজ বলোনা!
তীব্রর ভেতর থেকে আটকে আসছে কথাটা বলতে, কিন্তু দীপ্তির শেষ ইচ্ছে পূরণের জন্য এটা বলতে হবে, তীব্রর চোখের কোণে যেনো পানিও জমে আসছে। মিশান কেবলি আই সি ইউ এর ভেতর প্রবেশ করে পেছন থেকে ডাক দিবে সেই সময় অনেক কষ্ট করে তীব্র দীপ্তিকে বললো,
-তীব্র দীপ্তিকে অনেক ভালোবাসে, এতোটা ভালোবাসে যে এপারে ওদের মিল হয়নি ঠিকি কিন্তু ওপারে ওদের ঠিক মিল হয়ে যাবে, তীব্র দীপ্তির কাছে প্রকাশ করেনি ঠিক, কিন্তু ভালোবেসেছে অবিরাম ,খুব ভালোবাসে তীব্র দীপ্তিকে।
দীপ্তি মলিন হাসি দিয়ে বললো,
-থ্যাংকস! মিশানকে নিয়ে ভালো থেকো এই প্রার্থনাই করি। আমার খুব শান্তি লাগছে জানো তো? আমার এখন শান্তিময় ঘুম পাচ্ছে!
তীব্রর চোখের কোণা বেয়ে জলের বিন্দুটা গড়িয়েই পড়লো।
চলবে…………