#ময়ূখ
#পর্ব-৩১
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৯১.
মৌন আর কিছু বলেনি। খেয়ে নিয়েছে নিভৃতের হাতেই। সেই কখন থেকে নিভৃত একা একাই বকবক করে চলেছে। আর মৌন অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। মৌনর মতে নিভৃত অতিশয় বাঁচাল হয়ে গিয়েছে!
সুমি মৌনর সাথে দেখা করে বাড়ি ফিরে গিয়েছে। সুমি নামক মেয়েটার কাছে মৌন অনেক কৃতজ্ঞ।
_____________________
মৌন ‘একগুচ্ছ সুখ’ নামক বাড়িতে আবার এলো। ভাগ্যের জুড়ে একদিন বউ হয়ে এসেছিলো। তবে আজ স্বামীর হৃদয়ের প্রেয়সী হয়ে এসেছে। নাজমুল অসুস্থ, মিরাও চিন্তায় বিভিন্ন রোগের বাসা বাঁধিয়েছেন শরীরে। মৌন মিরার অসহায় চেহারা দেখে আর মানা করতে পারেনি। যদিও নিভৃতের সাথে কথা বলবেনা বলেই ঠিক করেছে সে।
একসপ্তাহ কেটে গেলো দেখতে দেখতে। মিটিকে নিয়ে মৌন বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে। গোলাপের বাগান থেকে সুন্দর একটা সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। মন প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে যেনো।
‘আপা?’
হঠাৎ করেই রথির ডাকে পিছনে ফিরে মৌন। রথি, মর্জিনা দাঁড়িয়ে আছেন। রথি কেঁদে জড়িয়ে ধরলো মৌনকে। মৌন স্থির হয়ে বসে রইলো কেবল। রথি মৌনকে ছেড়ে মৌনর পায়ে ধরলো। ভেজা গলায় বললো,
‘আমাকে ক্ষমা করে দাও আপা। আমার অনেক বড় ভুল হইছে। আপাগো আমি দোষী। তুমি আমারে মারো, কাটো তবুও রাগ কইরা থাইকোনা।’
মৌন রথিকে টেনে তুলে। পাশে দাঁড় করিয়ে বলে,
‘আমি এতটা স্বার্থপর নই রথি। আগেই বলেছি এখনো বলছি তোদের আমি ভালোবাসি। তাই হয়তো কখনো রাগ করে থাকতে পারবোনা। তবে কি জানিস রথি? বুকটায় না একটা ক্ষত হয়েছে। যা হয়তো কোনোদিন মুছতে পারবোনা।’
‘আপা! আল্লাহর দোহায় লাগে আপা এমন বইলোনা।’
‘এমন নারে রথি। বিপদের সময় প্রিয়জনের খারাপ ব্যবহার বুকে ভিষণ লাগে। তুই কাঁদিস না। আমি তো তোর উপর রাগ করে নেই বোকা মেয়ে।’
মর্জিনা এগিয়ে এলেন মৌনর দিকে। নরম গলায় ডাকলেন,
‘আম্মা। আমারে মাফ কইরা দিও।’
‘ছিঃ, মা। এসব বইলোনা। আমি কারো উপরেই রেগে নেই।’
মৌন বেশি হাঁটতে পারেনা। নিচতলায় একটা ঘরেই নিভৃত কিছুদিন থাকবে বলে মনস্থির করেছে। মৌন আস্তে আস্তে সোফার ঘরে এসে দাঁড়ালো। সোফায় রিপ্ত বসে। মৌনকে দেখে থমকে গেলো সে। পর স্ত্রীর দিকে তাকানো হারাম জেনেও বেহায়া চোখ বারবার আটকে যায় তার মাঝে। মিরা মৌনকে ধরে সোফায় বসালেন। মর্জিনাও এসে বসেছেন পাশে। রথি দাঁড়িয়ে আছে। রিপ্ত মাথা নিচু করে বসে আছে। মৌন ডাকলো,
‘রিপু ভাই?’
রিপ্ত মাথা তুলে তাকালো। মৌন হেসে বললো,
‘কেমন আছো রিপু ভাই?’
রিপ্ত জবাব না দিয়ে আবার মাথা নিচু করলো। আসলেই তো সে কেমন আছে? মিরা রান্নাঘরের দিকে গেলেন। মৌন আস্তে করে বললো,
‘রাগলে তোমার মাথা ঠিক থাকেনা আমি জানি রিপু ভাই। এবারের মতো ওকে মাফ করে দাও। ছোট মানুষ বুঝেনি। তোমাকে ভিষণ ভালোবাসে রিপু ভাই।’
‘এতটা ছোটও না।’
‘আমি ভালো আছি তো। আমার কিছু হয়নি। তুমি ওকে ক্ষমা করে দাও রিপু ভাই। নয়তো পুঁচকো রাগ করবে কিন্তু!’
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠে মৌন। রিপ্ত তাকিয়ে থাকে। কি অপূর্ব সে হাসি। রথিকে হয়তো সে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবেনা। সংসার করে যাবে সারাজীবন। একসময় হয়তো হৃদয়ের কোণে রথিও জায়গা করে নিবে।
৯২.
মৌনর সাতমাস চলছে। শরীরটা বড়ই দুর্বল তার। নিভৃত অযথাই পাগলামি করে। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। সারাটা সময় মৌনর সাথে আঠার মতো লেগে থাকে। মৌন এতো কথা শোনায় তবুও কিছু মনে করেনা নিভৃত। হাসি মুখে সব সয়ে যায়। এই তো সেদিন,
‘বাবুর আম্মু। ও বাবুর আম্মু।’
‘একদম এসব আহ্লাদ করবেন না নিভৃত। আমার এসব পছন্দ না।’
‘আচ্ছা, তুমি আমাকে এটা বলো একটা বাচ্চার পরিবারে সবচেয়ে আপন কে থাকে?’
‘তার বাবা-মা।’
‘তুমি মানো এটা?’
‘কেন, মানবোনা কেন?’
‘তাহলে এটাও মানো বাবুর উপর বাবা-মা দুজনেরই অধিকার আছে?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই আছে।’
‘তাহলে আমার বাবুর উপরও আমার আছে?’
‘হ্যাঁ, এই না, না।’
‘উঁহু, এখন তো না করলে হবেনা জান। একবার বলে ফেলেছো। দেখি হাতটা সরাও আমার বেবি আমার সাথে কথা বলবে।’
বলেই মৌনর পেটে কান পাতলো নিভৃত। মৌন শুধু অবাক হচ্ছে। এই লোক তো মহা চালাক!
‘এই সরেন তো আপনি। খালি ছুঁয়ার ধান্দা। সরেন।’
নিভৃত সরেনা। ভালোবাসার পরশে ভরিয়ে দেয় মৌনকে।
_________________
সন্ধ্যায় একটু শুয়েছিলো মৌন। হঠাৎ পায়ে চিনচিন ব্যথায় ঘুম ভেঙে যায় তার। পায়ে পানি নামার দরুন পা ভারী হয়ে গিয়েছে তার। মনে হচ্ছে দুপায়ে কেউ লোহার বস্তু রেখেছে। এপাশ ওপাশ করছে মৌন। পেটটা অনেক উঁচু হয়েছে আগের তুলনায়। পুঁচকোটা তো মনে হয় ফুটবল খেলে ভিতরে। এতো দুরন্ত! অবশ্য যার বাবা এতো দুষ্টু তার সন্তান তো এমন হবেই! মিরার মুখে নিভৃতের ছেলেবেলার সব শুনেছে মৌন। এতো কষ্টের মাঝেও হাসি পায় মৌনের। নিভৃত পাশে শুয়ে আছে। মৌন তাকিয়ে থাকে সেদিকে। তবে পায়ের ব্যথা আরো বাড়ায় চিৎকার করে উঠে সে। নিভৃত হকচকিয়ে উঠে বসে।
‘কি হয়েছে? কোথায় ব্যথা হচ্ছে? পেটে ব্যথা হচ্ছে? বাবু লাথি দিয়েছে? এই বলো। আরে বলোনা মেয়ে।’
মৌন বিছানায় হেলান দিয়ে উঠে বসে কটমট করে তাকায় নিভৃতের পানে। দাঁত কিড়িমিড়িয়ে বলে,
‘আমাকে বলতে দিবেন?’
‘সরি, সরি জান। কোথায় ব্যথা হচ্ছে?’
‘পায়ে।’
নিভৃত পায়ের দিকে হাত বাড়ায়। মৌন পা গুটিয়ে নিতে চাইলেও পারেনা।
‘এই কি করছেন আপনি?’
‘হুস্, কথা বলেনা।’
নিভৃত আস্তে আস্তে মৌনর পা টিপে দিচ্ছে। মৌন অবাক হয়ে দেখছে কেবল। এই নিভৃত বড়ই অচেনা। একসময় ঘুমিয়ে পড়ে মৌন।
৯৩.
দিন এভাবেই কাটছে। আর কিছুদিন পরেই মৌনের ডেলিভারি ডেট। মৌন হাই রিস্ক পেসেন্ট। তাই তার প্রতি ডাক্তার একটু বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সেই সাথে নিভৃতের পাগলামিতে মৌন অনেকটা সুস্থ।
রাত প্রায় ২ টা বেজে ২৫ মিনিট। মৌন উঠে বসে আছে। তার প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। নিভৃত কিছুক্ষণ আগেই মাত্র ঘুমিয়েছিলো। তবে নিভৃতকে এতোটা শান্তিতে ঘুমাতে দেখে গা জ্বলছে মৌনর। উঁহু, একে এতো শান্তিতে ঘুমুতে দেওয়া যাবেনা। প্রচুর জ্বালিয়েছে তাকে। এবার নিজে জ্বলুক। মৌন আস্তে করে পেটে হাত রাখে। ফিসফিসিয়ে বলে,
‘তোমার বাবাকে এতো শান্তিতে ঘুমাতে দিতে পারি আমরা! একদম না। একদম না।’
মৌন নিভৃতকে ডাকে,
‘এই যে শুনছেন? এই?’
নিভৃত হকচকিয়ে উঠে বসে। কিছু বলবে তার আগেই মৌন বলে,
‘আপনার বাবু নাকি পিজ্জা আর কেক খাবে। যান নিয়ে আসেন।’
নিভৃত অসহায় ভঙ্গিতে ঘড়ির দিকে তাকালো। এতো রাতে পিজ্জা বেচারা কোথায় পাবে। নিভৃত অসহায় গলায় মৌনর পেটের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘বাপ, সকালে পিজ্জা খাওয়াই। এখন শুধু কেক খাও।’
‘না, আপনার বাপ আপনার কথা মানেনি। সে এই মুহূর্তে পিজ্জা খাবে।’
নিভৃত বেশ বুঝতে পারছে। বাবু না বাবুর আম্মু খেতে চায়। তাই আস্তে করে মৌনর হাতটা ধরে বললো,
‘জান, সকালে একবস্তা পিজ্জা এনে দিবো। এখন শুধু ফ্রিজে কেক আছে। এনে দেই?’
মৌন এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দিলো। গম্ভীর গলায় বললো,
‘খাবোনা কেক। সারাদিন আমার বাবু আমার বাচ্চা করেন। অথচ কাজের বেলায় নাই। আপনি ঘুমান তো নিভৃত। আপনি শান্তিমতো ঘুমান। যত্তসব।’
নিভৃতকে বড্ড অসহায় দেখালো। বেচারা কি করবে এখন! ফ্রিজ থেকে দুই পিস কেক মৌনকে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিভৃত। মৌন মিটিমিটি হাসছে। বেশ হয়েছে! আহারে বেচারা!
(চলবে)….