আধ পোড়া হাতে পোড়া লাল মরিচ ডলে ডলে ভাতের দলা পাকাচ্ছে রাত,যন্ত্রণায় চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ঠোঁট কামড়ে ধরে যন্ত্রণা টা সহ্য করলো রাত। লাল টকটকে হয়ে যাওয়া ভাতগুলো দেখে শরীর কেঁপে উঠলো রাতের,বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর ঝাল হবে।বা হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে কাঁপা কাঁপা হাতে এক দলা ভাত নিজের মুখে তুলে নিলো।ঝালে চোখের পানি নাকের পানি সব একাকার,দ্রুত গতিতে একের পর এক ভাতের দলা মুখে নিতে লাগল রাত।যতো দ্রুত সম্ভব ভাতগুলো শেষ করতে পারলে বাঁচে, রাতের এহেন অবস্থা দেখে অদূরে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁপে উঠলো আসমা রহমান।যে মেয়েটা একটু ও ঝাল সহ্য করতে পারে না সে এভাবে শুধু মরিচ ডলে ভাত খাচ্ছে এটা আসমা রহমানের পক্ষে সহ্য করতে পারছে না।
‘রা’ক্ষ’সে’র মতো ভাত গিলছিস কেন রাত?ভাত যেভাবে খেতে হয় সেভাবেই খা,কেউ তোকে পিটাচ্ছে না।’
রাত কে দ্রুত গতিতে ভাত মুখে তুলতে দেখে হুংকার ছাড়লেন নাসিমা রহমান। রাতের সামনেই বসে আছেন তিনি, তদারকি করছেন রাতের খাওয়ার। চড়ুই পাখির মতো ভাত গিলতে গিলতে দ্রুত আরেক দলা ভাত মুখে তুলতে যাচ্ছিল রাত, এসময় খালামনির হুংকারে হাত থেকে ভাতগুলো পড়ে গেল।একে তো ঝাল সহ্য করতে পারছে না তার উপর ভাত গুলোও পড়েছে খালামনির সামনে,এক হাত মুখে নিয়ে ভয়ে বেশ জোরেই কেঁদে উঠলো রাত।
আজ সকালে কলেজে যাওয়ার সময় রাতের দশ বছরের ছোট বোন আওরাত অনেক ঝামেলা করছিল।খুব কাছের একটা ফ্রেন্ডের এক্সি’ডে’ন্ট হওয়ার কারণে রাতের মন মেজাজ ভালো ছিল না তার উপর আওরাতের দুষ্টামি, সর্বশক্তি দিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিল আওরাতের গালে।চড় খেয়ে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে আওরাত চুপ করে গেল, কান্না শুনে আসমা রহমান ও এসে রাত কে বকে গেলেন। এরপর থেকে দুপুর পর্যন্ত সবকিছু ঠিকই ছিল কিন্তু বিপত্তি ঘটলো খালামনি বাসায় ফেরার পর। নাসিমা রহমান দুই দিন বাসায় ছিলেন না,বড় মেয়ের শশুর অসুস্থ তাকে দেখতে গিয়েছিলেন মেয়ের শশুর বাড়িতে। দুপুরের দিকে নাসিমা রহমান বাসায় ফিরতেই আওরাত কাঁদতে কাঁদতে খালামনির কাছে রাতের নামে বিচার দিলো,রাত ওকে যেই গালে মে’রে’ছে সেটুকুও দেখালো।সব শুনে নাসিমা রহমানের যেন মাথায় রাগ চেপে গেল,আওরাত উনার কলিজার টুকরা বলতে গেলে।তার গায়ে হাত তুলেছে রাত,আর যায় কোথায়?রাত কে রুম থেকে টেনে বের করে রান্নাঘরে নিয়ে এসে চুলায় গরম পানি ফুটছিল সেখানে ওর ডান হাত টা ডুবিয়ে দিলো।রাত জোরে চিৎকার করে উঠল খালামনির এমন রুপ দেখে, কিন্তু নাসিমা রহমান এতেও শান্তি পাচ্ছেন না।আর কি করা যায় রাতের, হঠাৎ মাথায় এলো মরিচ দিয়ে ভাত খাওয়ার কথা।রাত ঝাল একদম সহ্য করতে পারে না, তার জন্য এই শাস্তি টাই ঠিক। ফুটন্ত গরম পানিতে হাত ডোবানোর কারণে হাত পুড়ে গেছে অনেকটা, সেই হাত নিয়ে মরিচ ডলে ভাত খেতে লাগিয়ে দিলেন রাত কে।
রাতের কান্না দেখে আসমা রহমান এগিয়ে এসে ভয়ে ভয়ে বললেন,,
‘আপা এবার ছেড়ে দিন না মেয়ে টা কে, একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে না কি?’
নাসিমা রহমান চোখ রাঙিয়ে ছোট বোনের দিকে তাকালেন, মুখে কিছু বললেন না। চোখ রাঙানো দেখেই আসমা রহমান শেষ, চুপ করে দাঁড়িয়ে মেয়ের কান্না দেখতে লাগলেন। বাসার আর সবাই মজা নিতে ড্রইং রুমে এসে উপস্থিত হলো, অবাক চোখে তিন জনের কান্ডকারখানা দেখছে সবাই। কিছুক্ষণ পর নাসিমা রহমান রাত কে উনার সামনে থেকে চলে যেতে বললেন,নাকে বিরক্তিকর কান্না সহ্য হচ্ছে না।রাত উঠে চলে যাওয়ার সময় পিছন থেকে ডাকলেন,
‘আর কখনো যদি কোন বাচ্চার গায়ে হাত তুলেছিস রাত, সেদিন কিন্তু আমি ভুলে যাবো যে তুই আমার বোন আসমার মেয়ে।বল আর কখনো কাউকে মা’র’বি?’
রাত উল্টো দিকে ঘুরেই কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়িয়ে না বলে দৌড়ে রুমে চলে গেল।আসমা রহমান রাত কে দৌড়ে চলে যেতে তপ্তশ্বাস ছাড়লেন একটা।একবার বোনের দিকে তাকিয়ে আরেক বার শান্ত চোখে ছোট মেয়ের দিকে তাকালেন,আওরাত মায়ের চাহনিতে ভয়ে কাঁপা কাঁপি শুরু করলো। বুঝতে পারছে, আজকে ওর কপালে শনি, রবি মঙ্গল সবকিছু আছে।
________________________________________
‘তোর খুব কষ্ট হচ্ছে না রে আপুই, আমার উপর খুব রাগ করেছিস তুই?প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দে তুই, আমি আর কখনো তোর নামে খালামনির কাছে বিচার দেবো না প্রমিস ‘
দুই হাতে রাতের চোখ মুছে দিয়ে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কাচুমাচু মুখ করে কথাটা বললো আওরাত। বিকেল তিনটার মতো বাজছে, জানালার পাশে বসে পোড়া হাতটা দেখছিল আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল রাত, তখনই আওরাতের আগমন। মুখে একটুখানি মেকি হাসি দিয়ে আওরাত কে বললো,
‘না আমার কষ্ট হবে কেন,হাত টা একটু জলছিল সেজন্যই কাঁদছিলাম। তুই মন খারাপ করিস না আমি তোর উপর রাগ করিনি।এটা তো আমার কপাল যে খালামনি আমাকে পছন্দ করেন না।’
রাতের কথা শুনে আওরাত কিয়ৎক্ষণ ভাবুক চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।ওর জন্য খালামনি ওকে এতো বড় শাস্তি দিল তারপরও ও ওর উপর রাগ করেনি এটা মানতে বড় কষ্ট হচ্ছে আওরাতের। ছোট মাথায় কি একটা ভেবে হঠাৎ করেই খুব খুশি হয়ে বললো,,,,,
‘জানিস আপুই, আজকে সাকিব ভাইয়া দেশে ফিরছে। একটু আগে খালুজান আর আব্বু ভাইয়া কে আনতেই তো এয়ারপোর্টে গেছেন।’
আওরাতের কথা শুনে রাত চমকে উঠলো, মনে হলো যেন কানে ভুল কিছু শুনেছে।ওর সাকিব ভাই দেশে ফিরছে, না এটা হতেই পারে না।চাপা উচ্ছাস বুকের মাঝে আটকে রেখে রাত জিজ্ঞেস করল,
‘কি বললি তুই, আবার বল। আমি শুনতে পাই নি ভালো করে।’
‘সাকিব ভাইয়া আজকে লন্ডন থেকে একেবারে চলে আসছে, খালামনি একটু আগে আমাকে তাই বললো। জানিস আপুই, আজকে সাকিব ভাইয়া আসবে বলে তানহা আপু,নিদ্রা আপু আর সিমরান আপুও আসছে আমাদের বাসায়। খালামনি আমাকে খুব সুন্দর করে সাজুগুজু করে থাকতে বলেছে এখন থেকে আর বলেছে তুই যেন কোন সাজগোজ না করিস। তুই তো এখন বড় হয়ে গেছিস তাই খালামনি তোকে সাজতে বারণ করেছে।আপুই তুই আমাকে এখন সুন্দর করে সাজিয়ে দে না!’
আওরাতের কথা শুনে অমাবস্যা রাতের মতো অন্ধকার হয়ে গেল রাতের মুখশ্রী খানা।আওরাত ওর হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে ওকে সাজিয়ে দিতে বলছে কিন্তু ওর কোনো হেলদোল নেই, ওর কানে আওরাতের বলা কথা গুলো বাজছে।
_______________________________________
নাসিমা রহমানের মেজো ছেলে সাকিব রহমান সাদ। বাংলাদেশের মেডিক্যাল এ পড়াশোনা শেষ করে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য লন্ডনে গিয়েছিল বছর চারেক আগে। সেই যে গেল, আজ দেশে ফিরছে পুরো চার বছর পর।এয়ারপোর্টে ফ্লাইট ল্যান্ড করার পর ফ্লাইট থেকে নেমে লাগেস টা নিয়ে বহিরাগমন বিভাগে চলে এলো।ব্যস্ত চোখে কাউকে খুঁজছে সাকিব, ওকে দেখে আনিস রায়হান আহমেদ আর আফতাব রহমান প্রায় দৌড়ে ওর কাছে এলেন। কতদিন পর নিজের ছেলেকে সামনাসামনি দেখছেন আফতাব রহমান, চোখে পানি নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন সাকিব কে। কুশল বিনিময় করে সাকিব ইতিউতি করে আবার কাউকে খুঁজতে শুরু করলো। এভাবে এদিকে ওদিকে তাকাতে দেখে আফতাব রহমান বললেন,
‘ এভাবে কাকে খুঁজছিস সাকিব?’
‘না মানে আব্বু আজকে তো আমাকে রিসিভ করতে তোমাদের সাথে সিমরানের আসার কথা ছিল, ওকেই খুঁজছি।ও কোথায়, আসেনি তোমাদের সাথে?’
‘না তো, সিমরান আমাদের সাথে আসবে বলে তো আমরা কিছু জানতাম না।’
মুখ টা অন্ধকার হয়ে গেল সাকিবের, ভেবেছিল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে প্রথমেই প্রেয়সীর মুখখানি দেখবে অথচ তার আসার কোনো নাম গন্ধই নেই।মনমরা হয়ে বাবা আর খালুর সাথে বাসার দিকে রওনা দিলো।সিমরানের সাথে একবার দেখা হোক শুধু, কথা বলবে না ওর সাথে।যাওয়ার আগে এমনকি ফ্লাইটে উঠার আগেও বারবার বলেছিল আব্বুর সাথে যেন সিমরান ওকে রিসিভ করতে আসে, তারপরও ও শুনলো না কেন?
চলবে………………………..
#তোর_শহরে_মেঘের_আনাগোনা (১)
#Rawnaf_Anan_Tahiyat