#গর্ভধারিণী
পর্ব—০৪
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
—একি,আম্মা তুমি?তুমি কোথা থেকে এলে?
আম্মা শুধু আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে,কোনো কথা বলছে না।ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম আমি।
—একি আম্মা,তুমি কোনো কথা বলতেছো না কেনো?কি হইছে তোমার।
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়লো আমার।আম্মা তো মারা গেছে,তাহলে আবার ফিরে এলো কিকরে।যতোদূর জানি কোনো মৃত মানুষ ফিরে আসতে পারে না।কিন্তু আম্মা ফিরে আসলো কিকরে।এ কি সত্যিই আমার আম্মা,নাকি অন্য কেউ।এটা ভেবে আমার ভয়ের মাত্রা আরোও বাড়তে লাগলো।মনের ভেতরে সাহস সঞ্চয় করে আয়াতুল কুরসী পড়া শুরু করলাম।
—আল্লা-হু লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল ক্বাইয়্যুম। লা তা’খুযুহু সিনাতুঁ ওয়ালা নাঊম। লাহূ মা ফিস্ সামা-ওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্বি। মান যাল্লাযী ইয়াশফাউ’ ই’ন্দাহূ ইল্লা বিইজনিহি..
আয়াতুল কুরসী শুনে আম্মা উঠে দাঁড়ায় ।তারপর সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো।আমি সূরা পাঠ থামিয়ে আম্মাকে পেছন থেকে ডাক দেই।
—আম্মা,তুমি এভাবে কিছু না বলে কোথায় চলে যাচ্ছো,আমাকে কিছু বলতেছো না কেনো তুমি?
আমার কোনপ্রকার আকুতি মিনতি আম্মার কানে পৌঁছালো না,ধীরে ধীরে এগোতে এগোতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।আমি আম্মার পেছনে দৌড় দেবার জন্য উদ্যত হলাম অমনি ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো।বিছানা থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসলাম।বুকটা বড্ড শুকিয়ে গেছে।তার মানে এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম আমি।তাই তো, আম্মা তো আর বেঁচে নেই সে ফিরেই বা আসবে কিকরে?যদিও এই স্বপ্নের মতো বাস্তবে কিছু ঘটলে আমার থেকে বেশী খুশি কেউ হতো না।আমি ভালো করেই জানি সেটা হয়তো কখনো সম্ভব না।আম্মা আগে ঘুমানোর সময় খাটের পাশের টেবিলটায় পানিভর্তি জগ রেখে দিতো।এখন পানির জন্য রান্নাঘরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।বিছানা থেকে উঠে ঘরের দরজাটা খুললাম।হাতে ছোটো টর্চটা নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে পড়ি,তারপর রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াই।আব্বার শোবার ঘর পেরিয়ে রান্নাঘরে যেতে হয়।তার ঘরের দরজার সামনে আসতেই ভেতর থেকে অদ্ভুত আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসলো।ঠিক সেই মুহূর্তে আমার চলার গতি থেমে যায়।ব্যপারটা কি হলো বুঝতে পারছি না,ভেতর থেকে কিসের শব্দ আসছে?আমি চুপি চুপি আব্বার দরজার সামনে এগোতে থাকি তারপর কান পেতে ভেতরে কি ঘটছে বোঝার চেষ্টা করলাম।
—এতো কোনো মহিলার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে!সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছে।কিন্তু এতো রাতে আব্বার ঘরে কোন মহিলা এসে কান্না করবে,
একবার ভাবলাম আব্বাকে ডাক দেবো,কিন্তু পরক্ষণেই থেমে গেলাম।ঘরের জানালার পাশে একটা ছোটো ছিদ্রের দিকে চোখ গেলো আমার। আমি সেই ছিদ্র দিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করি।
ঘরের ভেতরে আব্বার মোবাইলের জ্বলছে। আলোতে দেখতে পাচ্ছি আব্বা কোনো একটা মহিলার ওপরে উঠে আছে।তাদের দু’জনের গায়ের ওপরে একটা চাদর বেছানো।তবে এইটুক বুঝলাম আব্বার গায়ে কোনো জামা নেই।সে মহিলাটার ওপরে উঠে কিছু একটা করছে,হয়তো খুব ব্যথা দিচ্ছে।যার জন্য সে সমানে কান্না করে চলছে।
—দূরুত ভাই,ছাড়ো এবার।যাইতে হবে আমায়।
—আরেকটু সময় থেকে যা।এই সময়ে ছাড়া যায় তুই বল।
—তাড়াতাড়ি শেষ করো,ভাইজান দেখে ফেললে মাইরা ফালাইবো আমারে,
—কেনো রে,এসব প্রথম বার নাকি,এতো ভয় পাচ্ছিস কেনো?
—আমার খুব ভয় করেছে,তাড়াতাড়ি যাইতে দাও আমায়,
—এইতো হয়ে এসেছে…
একটু পরে দেখলাম আব্বা মহিলাটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে,অমনি ঘরের লাইট বন্ধ হয়ে যায়।তাদের গলার আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শুনতে পাচ্ছি না আমি।
—উফফফ,ওড়নাটা কোথায় আমার,
—এইতো আমার বালিশের পাশে,নে ধর
—হুম দাও,
–হইলো তোর জামা কাপড় পড়া?
—হইছে,এবার গেলাম আমি।
—শোন,আবার কবে আসবি?তুই আগের মতো একদম ভালোবাসিস না আমায়,
—কি যে বলো না তুমি,আসবো আসবো।আবার আসবো।
এই বলে মহিলাটা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।মোবাইলের টর্চের আলোতে এগোতে থাকে।আমিও তার পিছু নিলাম।দরজার কাছে গিয়েই চারপাশটা ঘুরে তাকাতে লাগলো কেউ আছে কিনা এটা দেখার জন্য।তার মুখমন্ডল আমার সামনে আসতেই চমকে উঠলাম।
—এটা তো মর্জিনা ফুপু!তার মানে আব্বা এতোক্ষণ মর্জিনা ফুপুকে কষ্ট দিচ্ছিলো।কই মর্জিনা ফুপু তো কিছুই বলো না আব্বাকে।উল্টো আবারো আসার কথা বললো,এ আবার কেমন কষ্ট,যা কেউ নিজে থেকেই পেতে চায়?আমার মাথায় ঢুকছে না কিছুই।
মর্জিনা ফুপু চলে যেতেই আমি আমিও পেছনে ঘুরে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।তারপর আবারো আব্বার ঘরের সামনে যাই।দরজাটা খোলাই আছে,কিছু না বলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।আব্বা বিছানায় বসে একটা সিগারেট ধরালো।তার পুরো শরীর ঘেমে একাকার।এখনো দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।মনে হয় এই মাত্র কোনো পরিশ্রমের কাজ করে এলো।আব্বা আমাকে নিজের ঘরে দেখে যেনো আকাশ থেকে পড়লো।
—একি তুই এখানে?
—হ,আমি
—কখন এসেছিস?
—অনেক আগেই,
—অনেক আগেই এসেছিস, কতক্ষণ আগে? কিছু দেখিসনি তো?
—দেখেছি।
—কি দেখেছিস!(আব্বার চোখেমুখে ভয় আর আতংকের ছাপ স্পষ্ট)
—তুমি মর্জিনা ফুপুকে মা র ছো,তাই দেখলাম।মর্জিনা ফুপু খুব কান্না করতেছিলো, আব্বা মর্জিনা ফুপু তো কতো ভালো, তুমি তারে এইভাবে কষ্ট দিলা কেনো?
–বলিস কি,আচ্ছা কোথা থেকে এসব দেখলি তুই?
—ঐ যে টিনের ফাঁক দিয়ে,
—যা দেখেছিস ভালো করেছিস,বাইরের কাউকে বলিস না ভুলেও।মনে করবি স্বপ্ন দেখছোস,
—ক্যান আব্বা সবাইরে কইলে কি হইবো?
–কি হইবো,এদিকে আয়,বুঝাইতেছি তোরে কি হইবো(দাঁত কটমট করে আব্বা বললো)
আমি তার দিকে এগিয়ে যাই।আব্বা আমায় তার পাশে বসালো।তারপর জলন্ত সিগারেটটা আমার হাতের কাছাকাছি এনে বলতে লাগলো।
—এই আগুনটা তোর হাতের ওপর চেপে ধরলে কি হবে বল তো?
আমি ভয় পেয়ে কোনো কথা বললাম না।
–কি ভয় পেয়েছিস তাই না?এটা তোর হাতে ছোয়ালে হাত তো পুড়ে যাবে।যদি কাউকে কিছু বলেছিস তোর হাতে এটা আমি সত্যি সত্যি চেপে ধররো।তখন বুঝবি বাপের ঘরে আড়ি পাতার কি মজা!
আব্বার এই রুপ কখনো দেখিনি আমি,প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম।একটা ঝটকা দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দেই।আমার শুকনো গলা এখন পর্যন্ত পানির ছোঁয়া পায়নি,যদিও এখন আর তেষ্টা নেই।কখন যে মিটে গিয়েছে নিজেও জানি না।কেনো জানি না একা একা শুয়ে থাকতে ভীষণ ভয় করছে,আব্বার কাছে যাবো সেই সাহস টুকুও নেই।বিছানা থেকে নেমে আলনা থেকে আম্মার একটা শাড়ি নিলাম।তারপর সেই শাড়িটা বুকের ভেতরে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ি।আম্মার গায়ের গন্ধ তার উপস্থিতির জানান দিচ্ছে,অনুভব করতে পারছি সে আমার সাথেই আছে।ভয়ের মাত্রা ধীরে ধীরে কাটতে লাগলো।এরপর মনের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
–
–
–
–
–
পরের দিন সকাল বেলা।ঘুম থেকে উঠে দেখি আব্বা তার ঘরে নেই।চারদিকে খোঁজাখুজি করেও কোথাও পেলাম না।এদিকে প্রচন্ড খিদেও পেয়েছে।রান্নাঘরে গিয়ে হাড়ি থেকে পান্তা ভাত আর গতকালকের ভেজে রাখা কচুরি ফুলের বড়া নিয়ে বসে পড়লাম।ঠিক তখন বাড়ির বাইরে লোকজনের গলার আওয়াজ শুনতে পাই।কেউ একজন আমায় ডেকে বললো
—কইরে আকাইদ,কোথায় গেলি?দেইখা যা তোর আব্বা নতুন বৌ নিয়া আইছে!
কথাগুলো শুনে আমার হাত পা রীতিমতো থরথর করে কাঁপতে লাগলো!
চলবে……