#গর্ভধারিণী
পর্ব—০৩
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ
আম্মার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লাম আমি।
—নাহ,এইটা আমার আম্মা না।আব্বা এইটা আমার আম্মা না।কারে নিয়া আইছো তুমি?
—আহারে,মায়ের শোকে বেচারার মাথাটাই গেছে মনে হয়।দেখো নিজের মায়েরেই চিনতে পারতেছে না।
গ্রামবাসী আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো।কিন্তু আমি ভালো করেই জানি এটা আমার আম্মা না।আব্বার হয়তো কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।আমাকে যেকরেই হোক আব্বার ভুল ভাঙ্গতেই হবে।
—আব্বা দেখো সবাই আমারে পাগল বলতেছে,তুমি আম্মার মুখখানা দেখাও সবাইরে।এইটা আমার আম্মা না।
—বাপ আমার।এইটা তোর আম্মা না তো কে, আমি নিজে সদর হাসপাতাল থেকে নিয়া আসছি তোর আম্মারে।
—আমি আম্মার মুখ দেখতে চাই।আম্মার মুখ দেখতে চাই আমি।
এই অরে কেউ ঘরের ভেতরে নিয়া যা।এইখানে আর বেশিক্ষণ রাখা যাবে না অরে।পুরোপুরি পাগল হইয়া যাইবো।
মর্জিনা ফুপু আমায় ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়।আমি কিছুতেই যেতে চাচ্ছিলাম না।একপ্রকার জোর করেই নিয়ে গেলো।এরপর লাশটাকে গোসল করানো হলো।বাড়ির সামনে কবর খোড়া হচ্ছে,সেখানেই দাফন করা হবে।একটা বিষয় সত্যি বুঝতে পারছি না,লাশটা তো আমার আম্মা নয়।তাহলে কেউ চিনতে পারছে না কেনো।কই কেউ তো অস্বাভাবিক আচরণ করছে না।তবে কি আমিই ভুল।কিন্তু এতো বড়ো ভুল হয় কিকরে আমার।নিজের মাকেই চিনতে পারবো না আমি।না,আর ঘরের ভেতরে আটকে থাকা চলবে না।যেকরেই হোক আমায় এখান থেকে বের হতে হবে।অনেক চেষ্টা করে কোনমতে জানলার ফাঁক দিকে নিজের ছোট্ট শরীরটা বের করি।তারপর এক দৌড়ে কবরস্থানের কাছে গেলাম।আম্মাকে কবরে নামানো হবে ঠিক সেই মুহূর্ত।আমাকে দেখে উপস্থিত সবাই হতবাক।
—একি,এ ঘর থেকে বাইর হইলো কেমনে,তোরা কি ওরে মাইরা ফেলতে চাস ওরে?
—সরো তোমরা,আমি আমার আম্মারে দেখমু।আম্মারে দেখমু আমি।
এই বলে লোকজনের বাঁধ ভেঙে সাদা কাপড়ে মোড়ানো লাশের ওপরে হামলে পড়লাম।লাশের চেহারার দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম আমি।মুখমন্ডল অস্বাভাবিক ভাবে থেতলে গিয়েছে।কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।এই কারণে হয়তো কেউ লাশটাকে চিনতে পারে নি।কিন্তু আমি ঠিকই চিনতে পেরেছি।
—-আমি কইছিলাম এইটা আমার আম্মা না,দেখলে তো তোমরা।
—আকাইদ,বাবা এইটা তোরই আম্মা।তুই কি বলতেছিস আমি তোর আম্মারে চিনতে পারবো না।দেখ যা হইছে মেনে নে বাবা।
—তোমরা সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখো।তাড়াতাড়ি জানাজার কাজ শেষ করতে হইবো।
গল্পের পর্বগুলো নিয়মিত এবং সবার আগে পেতে আমার পেইজ ‘প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ’ ভিজিট করুন।ধন্যবাদ।আব্বা সবাইকে তাড়া দিয়ে আম্মার লাশের দাফন কার্য শেষ করলো।আমার ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় রইলো না।বারবার এটাই মনে হচ্ছিলো যদি আম্মার সাথে কবরের ভেতরে শুয়ে থাকতে পারতাম আর কোনো কষ্ট থাকতো না আমার।
দাফন শেষে সবাই আমায় ধরে ঘরে নিয়ে গেলো।সবার সাথে সাথে আমিও এখন বিশ্বাস করি আম্মা আর এই পৃথিবীতে নেই।আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে সে,এমন জায়গায় যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না।কিন্তু আম্মা আমার সাথে কি এমন অন্যায় করেছে,কোন অপরাধবোধে স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণ দিয়ে দিলো সেই প্রশ্নের উত্তর আজোও অজানা।জানি না কোনোদিন এই অজানা রহস্যের সমাধান হবে কিনা।
–
–
–
–
কয়েকদিন পরে।আম্মা মারা যাবার পরে আব্বা এখন বাড়িতেই থাকে।আগে কাজের তাগিদে বেশীরভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকতো।রাতেবেলা আমি আর আব্বা ভাত খাচ্ছি।আব্বা বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে,বুঝতে পারছি সে হয়তো কিছু বলতে চাইছে আমায়।একটু পরে নিজের সংকোচ কাটিয়ে আব্বা আমায় বললো।
—তোর সাথে একটা কথা ছিলো আকাইদ।
—কি কথা আব্বা?
—তোর আম্মা তো চলে গেছে অনেকদিন হইলো।তুই একলা একলা থাকতে পারোস না ঘরে,যদি তোর জন্য….
—আমার জন্য কি আব্বা?
—তোর জন্য যদি আরেকটা নতুন মা আনি,তুই রাগ করবি না তো।
আব্বার কথা শুনে ভাতের গ্রাসটা মুখ পর্যন্ত তুলে আবার থালায় রেখে দিলাম।
—নতুন মা ক্যান আনবা,সে তো আমার আম্মা না,তুমি পারলে আমার নিজের আম্মারে আইনা দাও আব্বা।
—সেইটা আর সম্ভব না বাবা।দেখ নতুন আম্মা তোরে তোর আম্মার মতোই ভালোবাসবে, দেইখবি দুইদিনের তুই নিজের আম্মার কথা ভুইলা গেছো।
—আমি নতুন মা চাই না,আর আমার আম্মারেও ভুলতে চাই না।
এই বলে আমি ভাতের থালায় পানি ঢেলে উঠে গেলাম।যেতে যেতে শুনতে পাই আব্বা পেছন থেকে বলছে।
—ভালো কথা কইলাম বুঝলি না,আমি কিন্তু তোর ভালোর জন্যই কইছিলাম।
আব্বার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে আমি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাই।তারপর নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম।এই ঘরে আমি আর আম্মা থাকতাম।তার বালিশখানা এখনো সেইভভাবে বিছানায় পড়ে।মায়ের গায়ের গন্ধ এখনো আলনায় ঝুলিয়ে রাখা তার শাড়িতে লেগে আছে।শুধু মানুষটাই নেই।কেনো জানি না এই ঘরে আসলেই বুকটা হুহু করে কেঁদে ওঠে।এই বিছানায় শুয়ে শুয়ে আম্মা কতো গল্প শুনিয়েছে আমায়।রূপকথার রাজা রানির গল্প, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর গল্প,আরোও কতো কিছু।কতো বায়না করেছি তাঁর কাছে,আমার শত আবদার এই ঘরেই আম্মার কাছে পূরণ হয়েছে।আবার মারও খেয়েছি।কেঁদেছি,আম্মা চোখের পানি মুছে দিয়েছে।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই।
হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো আমার।শব্দটা ঘরের বাহির থেকেই আসছে।দরজাটা খুলে ঘরের বাইরে গেলাম।
দরজার সামনে একটা মহিলা মুখে ঘোমটা দিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে।আমি বলে উঠলাম।
—কে,কে আপনে?
সে আমার কথার কোনো উত্তর দিলো না।আমি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে যাই।তারপর ঘোমটাটা মাথার ওপর থেকে সরিয়ে দিলাম।মূহুর্তের এক অদ্ভুত অনুভূতি ঘিরে ধরলো আমায়।মনে হচ্ছে চোখের সামনে যেনো স্বপ্ন দেখছি।
—একি,আম্মা তুমি?তুমি কোথা থেকে এলে?
চলবে….