আমার অবেলায় তুমি পর্ব ১৬

0
1336

#আমার_অবেলায়_তুমি
#সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
#পর্ব_ ১৬

আজ দুই দিন হলো লামিয়া মেহরাবের রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। মেহরাব তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। লামিয়ার কষ্ট হলেও সয়ে নিচ্ছে। দোষ তার হয়েছে।মেহরাবের সাথে সরাসরি কথা বললে আজ এই সমস্যা হতো না। আজও সকালে মেহরাব হসপিটালে যাওয়ার সময় তাকে বলে যায়নি। গত দুইদিনে মেহরাব তার সাথে একটা কথাও বলেনি। রাতে বারান্দায় শুয়েছে। লামিয়া হাজার অনুরোধ করেও তাকে রুমে আনতে পারেনি। তাই আজ ঠিক করেছে আজ থেকে সে নিজেই বারান্দায় থাকবে। লোকটা সারাদিন পরিশ্রম করে এসে বারান্দায় শোয় তা তার একদম ভালো লাগে না। তাই আগে ভাগেই বারান্দা দখল করে রেখেছে সে। অবহেলা যা করার বিছানায় শুয়ে বসে করুক। সে নাহয় বারান্দায় মশার কামড় খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করবে।

মেহরাব বাসায় আসতে আসতে নয়টা বেজে গেছে। ড্রয়িং রুমে সবাই আড্ডা দিলেও লামিয়া কে না দেখে তার কপাল কুচকে গেল। আবার কোথায় গিয়ে ঘাপটি মেরে রয়েছে কে জানে! এই মেয়ে বাড়ি ছাড়া মানে তার চরিত্রের রফাদফা।

— ভাবি, লামিয়া কোথায়?
মেহরাবের বলতে দেড়ি হলেও ময়না বেগমের খপ করে ধরতে দেড়ি হয়নি। সে চায়ের কাপ নাড়তে নাড়তে হতাশ হওয়ার ভান করে বলল,

— আমরাও আছি ভাই। আমাদের খবরাখবর ও একটু জানতে চা। বউ তো তোর একার নেই,সব বিবাহিত ছেলেদের ই বউ থাকে।তারা এসেই এভাবে বউয়ের খোঁজ করে না।

— আমি করি আপা। একটা মাত্র বউ আমার। খোঁজ খবর না রাখলে আমাদের কাছে থাকবে কেন?আর তোমাদের আদরের বউ বাড়ি ছাড়লে তো তোমরা সেই আমার ঘাড় ই মটকাতে আসবে। তাই একটু খোজ খবর রাখতে হয়।

মেহরাব আর কিছু বলতে না দিয়ে হনহন করে নিজের রুমে চলে গেলো। কুলসুম বেগম বিরক্ত হয়ে বলল,

— মাত্র বাইরে থেকে এসেছে ময়না। সবসময় পিছনে লাগো কেন? বউয়ের খবর রাখবে না তো কি পাশের বাসার মানুষের খবর রাখবে?অদ্ভূত!

ময়না বেগম পাত্তা দিলেন না। সে নিজের মতো চা খাওয়ায় মন দিলো। আজ সারাদিন তার গুণধর ছেলে কল করেনি।কোন বিদেশি নিয়ে ঘুরছে কে জানে? বংশের মতো হয়েছে নিশ্চিত। অসভ্য ছেলেপেলে যত্তসব।

মাহট্যাব নিজের রুমেই অফিসের কাজ করছিল। কুলসুম বেগমের রাগী গলা শুনে দরজার সামনে এসে দাড়িয়েছে। দাঁড়ানোর কারণ যদিও ভিন্ন। তার পরিবারের সবার ব্যবহার সম্পর্কে সে অবগত। এসব তার কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু আজকাল একটা বিষয় খুব নতুন আর উপভোগ্য। তা হলো,মধুর ভ্যাবাচেকা খাওয়া অসহায় মুখ। তাদের পরিবারের এই হালকা পাতলা সংঘর্ষ দেখে মধুর শুকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে মাহতাবের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। মেয়েটা যে বড্ড সরল।

মধু মুখ কালো করে কিচেনে চলে গেলো। রহিমা সেফ কে সাহায্য করছে রান্নার জোগাড় করতে। সেদিকে তাকিয়ে কি মনে করে মধু নিজের রুমে চলে গেলো। মাহতাব বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেলি ফুলের বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে। সাদা সাদা ফুলে বাগান ভরে গেছে। ফুলের সুভাসে চারিদিক মো মো করছে। মাহতাব চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস নিলো। এই বেলিফুলের বাগান তার অসম্ভব প্রিয়। সে নিজের হাতে পরিচর্যা করে। কিন্তু গত একমাস যাবত সে বাগানে সময় দিতে পারছে না। ব্যবসার কাজে ইদানীং একটু বেশিই ব্যস্ত থাকে সে।
মধু ধীর পায়ে এসে মাহতাবের পাশে দাড়ালো। মাহতাব তখন চোখ বন্ধ করে বেলীফুলের সুভাস নিতে ব্যস্ত। মধুর আসার আভাস পেয়ে সে চোখ খুললো। মধুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

— কি ব্যাপার? শ্বাশুড়ি আর আপাকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে হলো? তুমি তো আমাকে পাত্তাই দিচ্ছো না মধু! এটা কি মেনে নেয়া যায় বলো? নাকি বুড়ো বলে আমার সামনে আসতে ইচ্ছে হয় না?

মধু অবাক চোখে তাকালো মাহতাবের দিকে। তার মনে মাহতাব কে নিয়ে কখনো কোন হীনমন্যতা আসেনি।মাহতাবের সামনে কম আসে এটা ঠিক। কারণ মাহতাবের হুটহাট রোমান্টিকতায় সে খুব লজ্জা পায়। ভয় ও পায় খানিকটা। এতো বড় একজন মানুষের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনা সে। সারাক্ষণ চিন্তায় গলা শুকিয়ে আসে। কখন কোন ভুল করে ফেলবে সেই চিন্তায় সে রাতে ঠিক মতো ঘুমাতেও পারে না। আর তার দূরে থাকাকে মাহতাব এমন কিছু ভাববে তা মধু কল্পনা ও করেনি।

মাহতাব মধুর মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো। মধুর আদুরে গাল দুটো টেনে দিয়ে আস্বস্ত গলায় বলল,

— মজা করছিলাম। ভয় পাচ্ছো কেন মধু? আমি ই তো। আমাকে ভয় নয়,ভরসা করবে। ঠিক আছে?

মধু আটকে রাখা শ্বাস টা ছাড়লো। লোকটার হুটহাট মজায় তার জান বেড়িয়ে যাওয়া জোগাড় হয়ে যায়। এভাবে কেউ মজা করে! মধু মুখ কালো করে দাড়িয়ে রইলো।

মাহতাব মধুকে এক হাতে টেনে তার কাছাকাছি দাড় করালো। হালকা অগোছালো চুল গুলো ঠিক করে দিতে দিতে শান্ত গলায় বলল,

— কিছু বলতে এসেছিলে?

— হুম।

— আচ্ছা বলো?

— এখন থেকে সবার জন্য আমি রান্না করতে চাই। আমরা মাত্র এই কয়জন মানুষ। এর জন্য একজন সেফ রাখার কি দরকার? আমার এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। সময় কাটতে চায় না। প্লিজ না করবেন না।

মধুর আবদারে মলিন হাসলো মাহতাব। একহাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বলল,

— ঠিক আছে। তবে সেফ ও থাকুক। ও আমার পরিচিত কাছের একজন। বাবা মারা যাওয়ার পর আমি বেশির ভাগ সময় ক্যাম্পাসে নাস্তা করতাম। আমাদের ভার্সিটির ক্যাম্পাসে রান্না করতো ময়িন। বয়সে আমার থেকে বছর পাচেক ছোট হবে। তখন ই ময়িনের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। পড়াশোনা শেষ করে আমি যখন বিজনেস শুরু করি তখন আর ময়িনের। খোঁজ খবর রাখা হয়নি।
কিছু বছর আগে নিউমার্কেটের ফুটপাতে হকারি করতে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করতেই বলল,চাকরি টা চলে গেছে। তাই উপায় না পেয়ে হকারি করছে। সংসারে খুব টানাটানি অবস্থা। বউ বাচ্চা নিয়ে কোন রকম জীবন কাটাচ্ছে। আমার অফিসে চাকরি দিতে চেয়েছিলাম। ও রাজি হয়নি। সারা জীবন রান্নার কাজ করেছে। ফ্যাক্টরির কাজ নাকি ওর মাথায় ঢুকবে না।তাই বাসায় নিয়ে আসি। তখন থেকে আমাদের বাসায় ই আছে। এখান থেকে চলে গেলে ও মাঝ দরিয়ায় পরবে মধু। ও কোন সার্টিফাইড সেফ নয়। তাই ভালো কোথাও চাকরি পাবে না। তুমি রান্না করতে চাইলে করবে। তবে ময়িন ও থাকুক। ঠিক আছে।

মধু টলমলে চোখে মাথা নাড়ালো। মাহতাব মধুর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে গম্ভীর গলায় বলল,

— অল্পতেই চোখে পানি আসে কেন তোমার? ইব্রাহিম বাড়ির বড় বউ তুমি। পাহাড়ের মতো শক্ত না হলে সবাইকে সামলাবে কি করে? এখন থেকে শক্ত করবে নিজেকে।

মধু নাট টানতে টানতে বলল,

— আচ্ছা।

মাহতাব মধুর মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা শব্দ করে হেসে ফেললো। বউটা তার বড্ড বোকা।

মেহরাব রুমে এসে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে লামিয়া কে কোথাও পেলো না। কপাল কুচকে এপ্রোন টা টেবিলের উপর রেখে ওয়াশরুম চেক করলো। খালি ওয়াশরুম দেখে কপালের ভাজ গাড় হলো মেহরাবের। বারান্দার দরজায় কাছে গিয়েই মুখ থেকে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ বেরিয়ে এলো। লামিয়া বারান্দায় উল্টো হয়ে শুয়ে আছে। মোটা একটা বইয়ের উপর মাথা দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহরাব লামিয়াকে না ডেকে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। দশ মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেলো। লামিয়া কে কোলে তুলে রুমে শুয়িয়ে দিয়ে আবার বারান্দায় গেলো। সমরেশ মজুমদারের বিখ্যাত উপন্যাস “সাতকাহন” ফ্লোর থেকে হাতে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই উপন্যাস পড়েই তার বউয়ের মাথায় তাকে ছেড়ে একা থাকার কু মতলব এসেছে। সে কি সাতকাহনের দীপাবলির বরদের মতো নাকি?আশ্চর্য!!
এসব উপন্যাস আর বাসায় রাখা যাবে না। কি সাংঘাতিক ব্যপার স্যাপার।

রাতের খাওয়ার সময় মেহরাব আর লামিয়া কে ডাকেনি। লামিয়ার মেন্টাল কন্ডিশনের জন্য এখন প্রোপার ঘুম প্রয়োজন। জেগে থাকলেই উল্টো পালটা চিন্তা করে নিজের মাথা খারাপ করবে সাথে তার টাও করবে। রহিমা কে দিয়ে লামিয়ার খাবার রুমে নিয়ে রাখলো মেহরাব। রাতে জেগে গেলে খেয়ে নিবে।
লামিয়ার ঘুম ভাঙ্গলো মাঝরাতে। নিজেকে বিছানায় দেখে বুঝতে বাকি রইলো না মেহরাব তাকে এখানে রেখে গিয়েছে। বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে বারান্দায় গেলো সে। মেহরাব এক হাত কপালে দিয়ে শুয়ে আছে। লামিয়া গিয়ে সোজা মেহরাবের পায়ের কাছে বসে পরলো। মেহরাব হুড়মুড় করে উঠে বসে লামিয়ার হাত দুটো চেপে ধরে হতভম্ব গলায় বলল,

— এসব কি করছো তুমি? পায়ে হাত দিচ্ছো কেন!

— আমাকে ক্ষমা করে দাও।আমি আর কখনো এমন ভুল করবো না। প্লিজ এবারের মতো মাফ করে দাও। তুমি এভাবে রাগ করে থাকলে আমার খুব কষ্ট হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে। প্লিজ শেষবারের মতো ক্ষমা করে দাও।

লামিয়া ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। মেহরাব লামিয়াকে বুকে টেনে নিলো। এক হাতে চোখের পানি মুছে অস্থির হয়ে বলল,

— আরে কাদছো কেন? আমি রাগ করে নেই আর।কান্না বন্ধ করো প্লিজ। আর কখনো আমার পায়ে হাত দিবে না লামিয়া। আমি পছন্দ করি না।

শেষের কথাটা গম্ভীর গলায় বলল মেহরাব।লামিয়া তার হাতদুটো ধরে তড়িঘড়ি করে বলল,

— করবো না।আর কোন ভুল করবো না। এবারের মতো মাফ করে দাও।

— শোন লামিয়া, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসা বোঝো? যা মনের অন্তস্তল থেকে আসে। যেখানে ভালোবাসা আছে সেখানে কখনো ধোকা,প্রতারণা থাকবে না। কেউ যদি ধোকা দিয়ে বলে, তার সাথে সম্পর্ক থাকলেও ভালো আমি শুধু তোমাকেই বাসি। তাহলে বুঝে নিতে হবে সে কখনো ভালোবাসেনি। আমি তোমাকে আমার সহধর্মিণী হিসেবে ভালোবেসেছি। আমার বাচ্চার মা হিসেবে নয়। কতো মানুষের হাত থাকে না,পা থাকে না। অপূর্ণতা নিয়ে তারা কি বেচে থাকছে না? আমাদের তো সব আছে। একটা সন্তান নাহয় নাই থাকলো। আল্লাহ হয়তো এতেই আমাদের কল্যাণ রেখেছে। কারণ সন্তান দেয়ার মালিক একমাত্র সে। আমরা কপাল কুটে ম*রে গেলেও সন্তান পাবো না যদি না সে চায়। তাই প্লিজ,আর কখনো এমন বোকামি করবে না।আমি কষ্ট পাই খুব। ভালোবাসি বলে কষ্ট দিয়ো না বউ।

চলবে,,
(রিচেক করা হয়নি। ভুল গুলো ক্ষমার চোখে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here