প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
(তৃতীয় অধ্যায়)
|৩০|
গরম চায়ের কাপে বাষ্প উড়ছে। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ আর দুধ চায়ের মিষ্টি সুবাসে ম ম করছে অফিস ঘর। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা টেনে নিতেই প্রচন্ড শব্দ তুলে বিভীষকাময় অন্ধকারে তলিয়ে গেল গোটা কোতোয়ালি থানা। ধ্রুবর কপাল কুঁচকে গেল। সামনের চেয়ারে বসে থাকা ডিউটি অফিসার ভরাট পুরুষালি হাঁক ছাড়তেই ছুটে এলো এক কনস্টেবল। অফিস ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকলো। একহাতে মোমবাতি ধরে রেখে অপরাধী কন্ঠে বলল,
‘ ঝড়বৃষ্টির তান্ডবে এলাকার ট্রান্সমিটারটা অকেজো হয়ে গেছে স্যার। থানার জেনারেটরটাও কাজ করছে না।’
মোমবাতির হালকা বাদামি আলোয় চায়ের কাপে চুমুক দিলো ধ্রুব। ডিউটি অফিসার ধমকে উঠে বলল,
‘ কাজ করছে না মানে কী?জেনারেটর কাজ করছে না সেটা তোমরা এখন দেখছো? জেনারেটর ঠিক করার ব্যবস্থা করো, দ্রুত।’
কনস্টেবল মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যরাতে জেনারেটর ঠিক করার মিস্ত্রি কোথায় পাওয়া যাবে, জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। ধ্রুবর টেবিলের উপর দুটো মোমবাতি রেখে ম্লান কন্ঠে বলল,
‘ ইয়েস, স্যার।’
কনস্টেবল সেলাম ঠুকে বেরিয়ে যেতেই চোখ ফিরিয়ে ধ্রুবর দিকে চাইলেন অফিসার। মোমের কমলা আলোয় ধ্রুবর শক্ত বাদামি চিবুক, গভীর চোখ, সুস্বাস্থ্য যেন ঈর্ষা জাগালো বুকে। ধ্রুব চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে হাত বাড়িয়ে সিগারেট ধরালো। সিগারেট পোড়া পাতলা ঠোঁটের মাঝে সিগারেটটা চেপে ধরে দেশলাই জ্বালালো। দেশলাইয়ের আচমকা আগুনে পেটানো মূর্তির মতো দেখালো ধ্রুবর মুখ। কুঁচকে থাকা সুচালো ভ্রু জোড়ার নিচে গভীর চোখদুটো কি ধূর্ত! সেই সাথে মিশে আছে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা। ধ্রুব সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিলো ডিউটি অফিসারের দিকে। ডিউটি অফিসার হাত বাড়িয়ে নিলো ঠিক কিন্তু স্যারের সামনে অভদ্রতা হয়ে যাওয়ার ভয়ে জ্বালানোর সাহস করে উঠতে পারলো না। ধ্রুব দুই ঠোঁটের মাঝে সিগারেটটা চেপে রেখে ফাইলে চোখ নিবন্ধ করলো। কুঁচকানো কপাল নিয়ে বার দুয়েক ঘড়ি দেখলো। কখন বৃষ্টি থামবে কে জানে? ডিউটি অফিসার কিছুক্ষণ কাঁচুমাঁচু করে আগের কথার খেঁই ধরলো,
‘ আপনার ভাই তো ডাক্তার স্যার?’
ধ্রুব চোখ তুলে পূর্ণদৃষ্টিতে চাইলো। যার অর্থ, ‘তো?’ ডিউটি অফিসার বিব্রত হাসলো,
‘ আসলে স্যার, আমার মেয়েটাকে ডাক্তার দেখাবো ভাবছিলাম। এই শহরে নতুন এসেছি তো, কোন ডাক্তার দেখাবো বুঝে উঠতে পারছি না। পরিচিত ডাক্তার হলে ভরসা করা যেতো। উনি কী মেডিসিন ডাক্তার?
ধ্রুব মাথাটা আলতো হেলিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো। শীতল কন্ঠে বলল,
‘ ঠিক তা নয়। আবির অর্থোপেডিক ডাক্তার। আপনার মেয়ের জন্য মেডিসিন ডাক্তার প্রয়োজন?’
‘ বুঝতে পারছি না স্যার। মেয়েটা ছোটবেলা খেলতে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছিলো। পা ঠিক হয়ে গিয়েছে অনেক বছর হলো। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ সেই পায়ের জয়েন্টে নাকি ব্যথা করে। ব্যথার কারনে রাতে ঘুমুতে পারে না।’
ধ্রুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ তাহলে দেখাতে পারেন। আবির ভালো এডভাইস দিতে পারবে এই ব্যাপারে।’
‘ উনি কোথায় বসেন? ময়মনসিংহ মেডিকেলে? নাকি নিজস্ব চেম্বারে? ঠিকানাটা যদি….’
‘ হ্যাঁ, মেডিকেলে বসে। একটা প্রাইভেট হসপিটালেও বসে। চেম্বারও আছে। আমি ওকে বলে রাখবো। আপনি যেকোনো জায়গায় দেখাতে পারেন। সমস্যা নেই।’
ডিউটি অফিসার আপ্লুত চোখে চাইলো। এই স্যারকে বিনা কারণেই ভীষণ শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে তার। চাল-চলনে গাম্ভীর্যের সাথে সাথে কেমন স্পষ্ট বিনয়। চোখের দৃষ্টিতেই মোহাচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব। ডিউটি অফিসার আর ধ্রুবর আলাপের মাঝেই দরজায় এসে দাঁড়াল সেই পুরনো কনস্টেবল। ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে বলল,
‘ একটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছে স্যার।’
ডিউটি অফিসার বিরক্ত চোখে চাইলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে শুধাল,
‘ কী ঝামেলা?’
কনস্টেবল মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,
‘ একটা মহিলা এসেছেন জিডি করতে। ছিনতাই কেস।’
অফিসারের ভ্রু কুঁচকে এলো। চিন্তিতমুখে একবার ঘড়ির দিকে চাইলেন, বারোটা বিশ। বিস্মিত কন্ঠে বললেন,
‘ এতোরাতে মহিলা? এই ঝড়বৃষ্টিতে?’
‘ জি, স্যার।’
অফিসার উঠে দাঁড়ালেন। চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
‘ চলো তো দেখি।’
অফিসার বেরিয়ে যেতেই আরেকটা সিগারেট ধরালো ধ্রুব। রিভলভিং চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করতেই মাথায় খেলে গেল একটাই চিন্তা, দেরী হয়ে যাচ্ছে! মিনিট দশকের মাঝেই ফিরে এলো অফিসার। ধ্রুবর অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ধ্রুব টোকা দিয়ে সিগারেটের ছাই ঝাড়ল,
‘ কী ব্যাপার?’
অফিসার বেকায়দায় পড়া কন্ঠে বলল,
‘ আচ্ছা একটা বিপদে পড়ে গেলাম স্যার! এক ভদ্রমহিলা এসেছেন কমপ্লেইন নিয়ে অথচ জিডি করতে রাজি নন। তিনি কোনো কথায় শুনছেন না। ডিরেক্ট এ্যাকশন চাইছেন। একে তো মহিলা মানুষ তারওপর এতোরাত, ধমক-টমক যে দেব সেই উপায়ও নেই। কী করব স্যার?’
ধ্রুব কৌতূহলী চোখে চাইল। সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে বলল,
‘ এখানে আসতে বলুন। আপনিও বসুন। শুনি কী ব্যাপার।’
অফিসার মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কনস্টেবলকে ডেকে ভদ্রমহিলাকে খবর পাঠাল। মিনিট দশেক বাদে শাড়ি পরিহিত চমৎকার দেখতে এক ভদ্রমহিলা ভেতরে প্রবেশ করলেন। ধ্রুব সিগারেট নিভিয়ে আঁশ ট্রে তে ফেলে সোজা হয়ে বসলো। বুদ্ধিদীপ্ত চোখে ভদ্রমহিলার আগাগোড়া নিরক্ষণ করলো। সেকেন্ডের ব্যবধানে চোখে চোখে নোট করে ফেলল ভদ্রমহিলার ভাবগতি। শাড়ির আঁচলে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। দৃষ্টি অস্থির। পিঠ বেয়ে নেমে গেছে লম্বা এক বিনুনি। মোমের বাদামি আলোয় ক্লান্ত, মোলায়েম দেখাচ্ছে মুখ। ধ্রুব গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ বসুন।’
ভদ্রমহিলা চেয়ার টেনে বসেই চমকে উঠলেন। ধ্রুব! মোমের আলোতে ধ্রুব তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। কোথাও কোনো আবেগ নেই। পরিচিতের ছাপ নেই। কী আত্মবিশ্বাসী দৃষ্টি! নিশিতা ভেতর ভেতর থমকে গেলেও বাইরে প্রকাশ করলো না। ধ্রুব যদি তাকে না চিনে থাকে তবে নিশিতার আগ বাড়িয়ে চিনতে পারার প্রশ্নই উঠে না। ধ্রুব প্রশ্ন করলো,
‘ আপনার নাম?’
নিশিতা চোখ তুলে চাইলো। ভেতর ভেতর নড়বড়ে ঠেকলেও সমান প্রতাপে ধ্রুবর অন্তর্ভেদী চোখে চোখ রাখলো। নম্র কন্ঠে বলল,
‘ নিশিতা হক।’
‘ একা এসেছেন?’
‘ জি।’
‘ আপনার ঠিকানা? ময়মনসিংহের স্থায়ী বাসিন্দা?’
‘ আমি ঢাকায় থাকি।’
মৃদু মাথা ঝাঁকাল ধ্রুব,
‘ ময়মনসিংহে আসার কারণ?’
‘ এখানে একটা সেমিনার এটেন্ট করতে এসেছিলাম। জয়নুল আবেদীনে নবীন-প্রবীণ লেখকদের নিয়ে একটা সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। আমি লেখালেখি করি। আই হ্যাড টু এটেন্ট দ্যাট সেমিনার। তাছাড়া, ব্যক্তিগত কিছু কাজ ছিলো।’
ডিউটি অফিসার খাতা, কলম হাতে লিখছিলেন। এবার চোখ তুলে শুধালেন,
‘ এতোরাতে ফিরছিলেন কেন?’
নিশিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
‘ ঢাকায় কিছু দরকার ছিলো। তাছাড়া এখানে থাকার মতো তেমন কোনো জায়গা নেই। একা একা হোটেলে থাকা সেইফ মনে হয়নি।’
ধ্রুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। বরাবরের মতোই ভ্রু’জোড়া কুঁচকে রইলো তার। শুধাল,
‘ ঘটনাটা বলুন। কী ঘটেছে আপনার সাথে?’
কিয়ৎক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঘটনাটা মনে পড়তেই শিউরে উঠলো নিশিতা। বুকের শক্ত বেড়িটা আগলা হয়ে যেতে লাগল ধীরে ধীরে। ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে বলল,
‘ আমি ঢাকা ফিরছিলাম।’
‘ বাসে করে?’
নিশিতা মাথা নাড়লো,
‘ না। ভাড়া গাড়ি করে। শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ থেকে ড্রাইভারের ত্রিশাল রোড ধরার কথা ছিলো। কিন্তু ব্রিজেই হঠাৎ কোথা থেকে কয়েকটা ছেলে এসে গাড়ি থামাতে বললো। ড্রাইভার গাড়ি থামাতেই ওরা খুব উগ্র আচরণ করতে লাগল। ড্রাইভারকে মারধোর করে আমাদের সকল জিনিসপত্র নিয়ে নিলো।’
‘ গাড়িতে শুধু ড্রাইভার আর আপনিই ছিলেন?’
নিশিতা মাথা দোলালো। ডিউটি অফিসার বিস্মিত চোখে চাইলেন। অতঃপর কটাক্ষ করে বললেন,
‘ মহিলা মানুষ ইজ মহিলা মানুষ স্যার। এই মাঝরাতে ভাড়া গাড়ির অপরিচিত ড্রাইভারের সাথে কেউ এতোদূরের পথ পাড়ি দেয়? তারওপর ঝড় বৃষ্টির রাত। ড্রাইভারই যদি উলটাপালটা কিছু করে রাস্তায় ফেলে যেতো তাও তো কারো কিছু করার ছিলো না। এমন বোকামো কাজ এনারা করবে আর নিউজে ছাপবে আমাদের দুর্নাম। যত্তসব।’
অফিসারের মন্তব্যে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো নিশিতার। ধ্রুব কোনো মন্তব্য করলো না। সাবলীল কন্ঠে শুধাল,
‘ ড্রাইভারকে মারধোর করলো, আপনাকে কিছু করেনি? কোনো রকম শারিরীক ক্ষয়ক্ষতি?’
নিশিতার মনের আগল ভেঙে যাচ্ছে। জীবনের প্রথম সে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়েছে। তার সাথে এমন কিছু ঘটে যেতে পারে তা যেন তার নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছে না। হাত-পায়ের কাঁপনটা বেড়ে যাচ্ছে। ধ্রুব কী তাকে সত্যিই চিনতে পারছে না? প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো। দু’জনই আলাদা দুটো পৃথিবীর মানুষ এখন। ভুলে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তবু, এভাবেও ভুলে যাওয়া যায়? কই, নিশিতা তো ভুলে যায়নি? হঠাৎ করেই যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল নিশিতা। চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ল। অন্যমনস্ক কন্ঠে বলল,
‘ না।’
‘ আপনার আঁচলে রক্তের দাগ। এই রক্ত কার?’
এমন এক পরিস্থিতির পর এতো এতো জেরায় বিরক্ত হয়ে উঠল নিশিতা। রূঢ় কন্ঠে বলল,
‘ সেটা আপনাদের দেখার বিষয় নয়। গাড়িতে আমার ব্যাগ ছিলো। ব্যাগে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজ ছিলো। আমার ওগুলো চাই। ওগুলো ফিরিয়ে আনার একটা ব্যবস্থা করে দিন প্লিজ!’
ধ্রুব স্থির চোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। টেবিলের উপর খোলা ফাইলটা বন্ধ করে পাশে রাখতে রাখতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শীতল কন্ঠে বলল,
‘ আচ্ছা, বেশ! আপনি অফিসারের কাছে একটা জিডি করে রেখে যান। উই উইল টেক কেয়ার অফ ইট। আপনি এখন আসতে পারেন।’
নিশিতা অধৈর্য হয়ে বলল,
‘ আপনি এভাবে দায়সারা উত্তর দিতে পারেন না। আমার ব্যাগে আমার সকল প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট ছিলো। পরশু আমার বিসিএসের ভাইভা। কাগজগুলো না পেলে কত বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে আপনি বুঝতেই পারছেন না!’
ধ্রুবর মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে আগের মতোই শীতল কন্ঠে বললো,
‘ আমাদের কাজ করার নিজস্ব একটা নিয়ম আছে ম্যাডাম। সেই সকল প্রসিডিওর মেইনটেইন করেই কাজটা করতে হবে আমাদের। আপনি জিডি করুন। আপনার লিখিত অভিযোগ মোতাবেক আমরা ব্যবস্থা নিব। জিডি ছাড়া আমরা কোনো এ্যাকশন নিতে পারব না।’
নিশিতার বুকের ভেতর হুহু করে উঠল। আতঙ্কে তার মাথা কাজ করছে না। এতোক্ষণ একটা ঘোরের মাঝে থাকলেও সময়ের সাথে সাথে দুর্বল লাগছে শরীর। চোরা বালির মতো ঝুরঝুর করে ঝড়ে পড়তে চাইছে দেহ। নিচের ঠোঁটটা দাঁতের সাথে চেপে ধরে ভেতরের অস্থিরতা কমানোর চেষ্টা করলো নিশিতা। চেয়ারের হাতলে কনুই ঠেকিয়ে ডান হাতের তালুতে কপাল চেপে ধরলো। উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে। যদি কাগজগুলো না পাওয়া যায় তবে কী হবে? নিশিতার এতোদিনের পরিশ্রম চোখের পলকে শেষ হয়ে যাবে। মুখ উঠিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ জিডি করলেই যে আপনারা ব্যাপারটা সিরিয়ালি নিবেন তার কী নিশ্চয়তা আছে? প্রতিদিন অসংখ্য জিডি করা হয় থানায়। আপনারা…’
ধ্রুব ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
‘ আপনি জিডি না করে বসে থাকলে যে আমরা ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিব তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই ম্যাডাম। পুলিশের সাহায্য চাইলে পুলিশের প্রতি বিশ্বাস রাখতে শিখুন। পুলিশ আপনাকে গ্যারেন্টি কার্ড দেবে না।’
ঠান্ডা গলায় শীতল অপমানের পর আর কোনো প্রত্যুত্তর করা চলে না। নিশিতা আর কথা বাড়ালো না। টেনশনে তার পৃথিবী ঘুরছে। এই মাঝরাতে একা একা কী করবে মাথায় আসছে না। কিছু উপরি টাকা পয়সা দিলে বোধহয় কাজটা এগুতো। কিন্তু নিশিতার কাছে এই মুহূর্তে টাকা তো দূর মুঠোফোনটা পর্যন্ত নেই। এমন বিপদে সে জীবনে পড়েনি। এই পঁচিশ বছরের জীবনে এই প্রথম তার থানায় আসা। কারো সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। থানা সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে এমন পরিচিত কেউ কী তার আছে? নিশিতার মনে পড়ছে না। নিশিতার ভাবনার মাঝেই উঠে দাঁড়ালেন ডিউটি অফিসার,
‘ আসুন, ম্যাডাম।’
নিশিতা চিন্তিত মুখেই উঠে গেল। জিডির কাজ শেষ হতেই মুখ তুলে চাইলো অফিসার। সাধারণ কন্ঠে বলল,
‘ আপাতত আপনার কোনো কাজ নেই ম্যাডাম। আপনি এখন আসতে পারেন। কোনো খোঁজ পেলে আমরা আপনাকে জানাবো।’
অফিসারের মুখে বাড়ি ফেরার কথা শুনে অস্থিরতার সাথে সাথে নতুন চিন্তা যুক্ত হলো। এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে কোথায় যাবে নিশিতা? ময়মনসিংহে রাত কাটাবার মতো নির্ভরশীল জায়গা তার নেই। গ্রাজুয়েশন চলাকালীনই ঢাকা শিফট হয়ে গিয়েছে সে। পরীক্ষা ব্যতিরেকে ক্যাম্পাসে খুব একটা আসা হয়নি। দুই একটা বন্ধু তবু পাওয়া যেতে পারে কিন্তু তাদের নাম্বার মুখস্থ নেই। চিন্তায় চিন্তায় গলা শুকিয়ে গেল নিশিতার। সে উঠে গিয়ে বারান্দায় রাখা একটা বেঞ্চিতে বসলো। বৃষ্টির দাপটটা এখন একটু কমে এসেছে। থেকে থেকে প্রচন্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। গাছের মাথায় পাগলা হাওয়ার নৃত্য হচ্ছে। নিশিতা অন্যমনস্ক হয়ে অন্ধকারে ডুবে থাকা রাস্তার দিকে চেয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে উঠে গিয়ে ডিউটি অফিসারকে শুধাল,
‘ একটা ফোন করা যাবে অফিসার?’
অফিসার মোমের আলোয় পুরাতন এক ফাইল ঘাঁটছিল।মুখ তুলে অবাক হয়ে বলল,
‘ আপনি এখনও যাননি?’
এতোরাতে পুলিশ স্টেশনে সে কতটা সুরক্ষিত তাই নিয়েও সন্দেহ জাগলো নিশিতার। সেকেন্ডের মাঝে অসংখ্য চিন্তা খেলে গেল মাথায়। বলল,
‘ একটা ফোন করা যাবে?’
অফিসার কিয়ৎক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে নিঃশব্দে টেলিফোন সেট এগিয়ে দিলো। নিশিতা টেলিফোনের রিসিভারটা হাতে নিয়েই উপলব্ধি করলো উত্তেজনা আর অস্থিরতায় কারো নাম্বারই মাথায় আসছে না তার। নিশিতা চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিলো। নিজেকে শান্ত করে মস্তিষ্কে জোর দিলো। কাকে ফোন দিবে সে এতোরাতে? তূর্য? নাকি বড়ো ভাইয়া? তূর্য বড়ো অস্থির মানব। নিশিতা বড়ো ভাইয়াকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিলো। ভাইয়া ঠান্ডা মাথার মানুষ। কিছু একটা সমাধান দিতে পারবেন। কয়েক বারের চেষ্টায় বড়ো ভাইয়ের নাম্বার মনে করলো নিশিতা। দুই বারের মাথায় ফোন রিসিভ হলো। ভাইকে শান্ত গলায় পরিস্থিতি জানাতেই ডিউটি অফিসারের সাথে কথা বলতে চাইলো তিশান। নিশিতা ফোনটা অফিসারের দিকে বাড়িয়ে দিতেই বিনাবাক্যে রিসিভার উঠাল অফিসার। যেন এমন একটা সিচুয়েশন আসবে সে ব্যাপারে তিনি অবগত। অফিসার রিসিভার উঠাতেই ওপাশ থেকে বলল,
‘ হ্যালো অফিসার। আমি নিশিতা হকের বড়ো ভাই বলছিলাম।’
‘ জি, বলুন।’
‘ আপনাদের থানায় এএসপি ধ্রুব নামে একজন কর্মরত ছিলেন। উনি কী ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছেন?’
অফিসার খানিক অবাক হলো। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ না। উনি এখনও এখানেই কর্মরত আছেন।’
ওপাশ থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। ব্যস্ত হয়ে বলল,
‘ উনি আমার মামার বন্ধু। আমার পরিচিত। উনি কী থানায় আছেন? থেকে থাকলে উনাকে একটু লাইনটা দিবেন? আপনি তার আগে যাচাই করে নিতে পারেন। উনাকে বললে, উনি আমাকে চিনবেন।’
জনৈক যুবকের কথা খুব একটা বিশ্বাস হলো না অফিসারের। ধ্রুবর মতো সৌম্যকান্ত যুবক এতো বড়ো পুরুষের মামার বন্ধু হয় কী করে? বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দো-চলা নিয়েও উঠে দাঁড়াল অফিসার। বিরস কন্ঠে বলল,
‘ আপনার ভাগ্য ভালো স্যার আজ থানাতেই আছেন। অপেক্ষা করুন। আমি জিজ্ঞেস করছি।’
ধ্রুব তখন বেরিয়ে যাওয়ার উদযোগ করছিলো। এহেন সময়ে ডিউটি অফিসারের আগমনে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। ডিউটি অফিসার মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,
‘ স্যার, একটা সমস্যা।’
ধ্রুব জবাব না দিয়ে ভ্রু কুঁচকে নিশ্চুপ চেয়ে রইলো। যার অর্থ, বাকিটা বলুন। অফিসার তার দৃষ্টি বুঝতে পেরেই কথা এগুলো,
‘ নিশিতা হক মানে সেই ভদ্রমহিলার ভাই লাইনে আছেন। তিনি বলছেন, সে নাকি আপনার পরিচিত। আপনার বন্ধুর ভাগ্নে। আপনার সাথে কথা বলতে চায়। লাইন কী দেব স্যার?’
ধ্রুব কয়েক সেকেন্ড ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল,
‘ দিন।’
লাইন দেওয়া হলো। ধ্রুব রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে শান্ত কন্ঠ ভেসে এলো। খানিক অস্বস্তি নিয়ে বলল,
‘ মামা আমি তিশান বলছিলাম। একবার আপনার সাথে দেখা হয়েছিলো ময়মনসিংহে। তরু মামার সাথে গিয়েছিলাম। চিনতে পারছেন কিনা…’
ধ্রুব আন্তরিক কন্ঠে বলল,
‘ আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি তিশান। পরিচয় দিতে হবে না।’
ধ্রুবর আন্তরিক কন্ঠে ভারমুক্ত হলে তিশান। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ মামা আসলে একটু বিপদে পড়েই মনে করেছি। আমার ছোটবোন নিশিতা ময়মনসিংহে গিয়ে একটু বিপদে পড়ে গিয়েছে। আপনাদের থানাতেই জিডি করেছে ঘন্টাখানেক আগে। মাঝরাতে এমন একটা দুর্ঘটনায় কী করবো বুঝতে পারছি না। ময়মনসিংহে আমাদের তেমন কোনো আত্মীয়ও নেই। আপনি যদি ডাকবাংলোতে আজকের রাতটা থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন। তাহলে খুব উপকার হতো। মেয়েটার হাতে আপাতত টাকাপয়সা, মোবাইল কিছুই নেই।’
ধ্রুব বলল,
‘ আচ্ছা, আমি দেখছি।’
রিসিভার নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো ধ্রুব। অতঃপর ডিউটি অফিসারকে ডেকে বলল,
‘ ডাকবাংলোতে খবর নিয়ে দেখুন তো কোনো ঘর ফাঁকা আছে কিনা। আর সেই ভদ্রমহিলাকে আমার ঘরে এসে বসতে বলুন। কাউকে বলে উনাকে চা দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। তার আগে একজন মহিলা কনস্টেবলকে পাঠান উনার কাছে। উনার বোধহয় ফার্স্ট এইড এর প্রয়োজন হবে। শী ইজ ইঞ্জুরড্।’
ডিউটি অফিসার সম্মত হয়ে বেরিয়ে যেতে নিতেই পিছু ডাকলো ধ্রুব। একটু চুপ থেকে বলল,
‘ ভদ্রমহিলার কেসটা একটু সিরিয়াসলি হ্যান্ডেল করবেন। ব্রীজের কাছে যারা রেগুলার এসব কান্ড ঘটায় তাদের পাঁকড়াও করে খোঁজ নিন। কাল সকালের মাঝে ম্যাডামের কাগজপত্র, ব্যাগ উদ্ধার হওয়া চাই।’
অফিসার ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেল। ধ্রুবর ঘরে তখন পুরাতন মোম পাল্টে নতুন মোম দেওয়া হয়েছে। পুরো ঘর জুড়ে ঠান্ডা নরম আলো ছড়াচ্ছে। নিশিতাকে ভেতরে আসতে দেখে চোখ তুলে চাইলো ধ্রুব। স্বাভাবিক ভদ্রতা নিয়ে বলল,
‘ বসুন।’
নিশিতা একটা চেয়ার টেনে বসলো। চেয়ারে বসা মাত্রই চোখ গেলো টেবিলের মাঝ বরাবর রাখা একটি ফটো ফ্রেমে। মোমের মৃদু হলদে আলোয় দেখতে পেলো উচ্ছল এক যুবতীর মুখ। মেয়েটি একটি শিশু কোলে হাসছে। শিশুটিও দন্তহীন হাসি নিয়ে চেয়ে আছে মায়ের মুখে। এক ঝলক মাত্র! তার পরপরই ফটোফ্রেমটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ঠিক করে রাখলো ধ্রুব। গম্ভীর, শান্ত মুখে ব্যস্ত হয়ে রইলো কোনো এক ফাইলে। নিশিতার মনে মিলি সেকেন্ডে খেলে গেল প্রাসঙ্গিক এক প্রশ্ন, ‘ধ্রুব তবে ছেলের বাবা হয়েছে?’ যদিও মামার কাছে ধ্রুবর বিয়ে নিয়ে হালকা পাতলা কিছু শুনেছিল একসময়। তখন ততটা গা করেনি নিশিতা। কিন্তু আজ, এতোদিন পর, সেই বাস্তবটা চোখের সামনে দেখে বুকের ভেতরটা অযথা চিনচিন করে উঠল। অথচ সেও এখন আলাদা পৃথিবীর বাসিন্দা। এই এতোগুলো বছরে ভুল করেও সে ধ্রুবর পৃথিবীতে পা মাড়াতে চায়নি। ধ্রুবকে পেতে ইচ্ছে হয়নি। অথচ আজ মনে হচ্ছে, কোথাও একটা গভীর ক্ষত। সেই ক্ষত ধীরে ধীরে আরও নতুন হচ্ছে। বিশ্রী হচ্ছে। মনটা থেকে থেকেই বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে। তীব্র অভিমান হচ্ছে। নিশিতা ভেবে পায় না, নারী মন এতো আশ্চর্য কেন? তারা ভালোবাসুক বা না বাসুক প্রতিপক্ষের চোখে সারাটি জীবন নিরবিচ্ছিন্ন ভালোবাসা দেখতে চায় কেন? এইযে ধ্রুবর চোখে কোনো আবেগ নেই। নিশিতার প্রতি কোনো মুগ্ধতা নেই। জড়তাহীন অপরিচিত ব্যবহার। এই স্বাভাবিক ঘটনায় নিশিতার এতো ক্রোধ হচ্ছে কেন? অথচ ধ্রুব কখনো তার প্রেমিক ছিলো না। কখনো তাদের ভালোবাসাবাসির শর্ত ছিলো না। ছিলো না আজীবন ভালোবেসে যাওয়ার কোনো দায়। তবুও কেন এতো দুঃখ হচ্ছে? নিজে সুখে থেকেও অ-প্রেমিক ধ্রুবর সুখ দেখে কেন এতো ঈর্ষা হচ্ছে? তবে কী তার নারী মন চেয়েছিলো ধ্রুব চির অসুখী হোক? সব দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে বেঁচে থাকুক দুঃখী হয়ে? খুব একলা হয়ে?
#চলবে…
[ আর একটা পর্বই বাকি আছে। ]