প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|২৩|
সকালবেলা ঘুম ভেঙেই পুরোদস্তুর এক অঘটন ঘটিয়ে ফেলল কল্প। বাবার ওয়ালেট থেকে পনেরো-বিশটা এক হাজার টাকার নোট নিয়ে মনের সুখে কেটে টুকরো করল। কল্পের এই অঘটনের খবরটা সকালের গরম চায়ের সাথে খুব রমরমা করে ছড়িয়ে দিল কাজের মেয়ে সুরাইয়া। মুহূর্তের মাঝে থমথমে মেঘে ঢেকে গেল বাড়ির অন্দরমহল। বাবা গম্ভীর শ্বাস ফেললেন। ধ্রুবর মা কঠিন মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। আবির দাঁত বের করে হাসতে লাগল। একমাত্র কল্পর কোনো হেলদোল হলো না। সে খুব ভালো মানুষটির মতো মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে এক হাজার টাকার সাইজগুলো দশ টাকা সমান হয়েছে কি-না তার মাপঝোঁক করতে লাগল। চোখ-মুখে ফুটে উঠল গম্ভীর্য। দুই ভ্রুর মাঝে সুচিন্ত ভাঁজ। ধ্রুব মাত্রই অফিসের জন্য বেরুচ্ছিল। আবির তাকে বেরুতে দেখেই অঘটনের খবরটা দিয়ে দাঁত বের করে হাসলো। ধ্রুব সেই খবরে খুব একটা গা করলো না। চেয়ার টেনে বসতে বসতে ভাইয়ের দিকে কঠিন চোখে চাইল। ধ্রুবর যতটুকু মনে পড়ে, ছেলেবেলায় খুব শান্ত বাচ্চা ছিলো সে। তার দুই ভাইয়ের মতো হাড় জ্বালানো দুষ্টুমি করেনি কোনোকালে। বাবা-মা দুজনেই খুব গম্ভীর বিধায় ছেলেবেলা থেকেই সহজাত এক গাম্ভীর্যে মোড়ানো তার আচার-ব্যবহার। অথচ তার দুই ভাইকে দেখো? চেহারা ছবি একরকম হলেও কার্যকলাপ স্বয়ং ইবলিশকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতোই চমৎকার। দুজনেই দূরন্ত। কারোরই এক দন্ড স্বস্তি নেই। এইতো দুদিন আগের কথা। ঘুম ভেঙেই আবির আর কল্পর ভয়াবহ ঝগড়া লেগে গেল। কল্প আবিরের এসাইনমেন্টের পাতা ছিঁড়ে সুন্দর বানিয়েছে। অথচ আবির তার ‘সুন্দর বানানো’ টা না বুঝেই খপ করে তার ঘাড় চেপে ধরে ঘ্যাঁচ করে এক মুঠো চুল কেটে দিলো। বলতে এক মুঠো, আদতে কাটা চুলের সংখ্যা ছিলো মোটে দুই। সেই কাটা চুলের দুঃখেই আকাশ-বাতাস আলোড়িত করে কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল কল্পর। কিছুতেই থামবে না। আবির বলেছে, সে টাক্কু হয়ে গিয়েছে। তাকে কেউ বউ দেবে না। সুতরাং, কান্নাকাটিও থামবে না। এই কল্পকে শান্ত করানো নিয়েও ভীষণ ফ্যাসাদে পড়ে গেল আবির। বাবা গোটা দুই গরম চোখে তাকিয়েছেন। ভেবেচিন্তে কোনো কূলকিনারা না পেয়ে ধ্রুবর থেকে সুপার গ্লো নিয়ে খুব ধৈর্য সহকারো কাঁটা চুলগুলো লাগিয়ে দিলো কল্পের মাথায়। নিজের চুল ফেরত পেয়ে কল্প মহাখুশি। দু’জনের মাঝে আবারও গলায় গলায় ভাব। ধ্রুব মাঝে মাঝে হতভম্ব হয়ে ভাবে, চব্বিশ বছরের এক ছেলের পক্ষে আদৌ এমন বাঁদরামো সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। তার দুই ভাইয়ের পক্ষে দুনিয়ার সব রকম বাঁদরামিই সম্ভব। ধ্রুব হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। যাদের বাবা, মা, ভাই একাধারে মুখে কুলুপ এঁটে থাকে তারা এতো মুক্ত প্রাণ হলো কী করে তা ভেবে একটু দুশ্চিন্তা হলো। পরমুহূর্তেই মায়ের কথা মনে পড়ে গেল তার। টেবিলের অপর পাশে চোখ-মুখ গম্ভীর করে বসে থাকা কঠিন মহিলাটি তার মা। সবার মতো ধ্রুব নিজেও যেন অবাক হয়। মনে মনে শুধায়, এই বাচ্চা দেখতে কঠিন মহিলাটি সত্যিই তার মা? ধ্রুবর মাঝে মাঝে মনে হয়, উত্তরাধিকারসূত্রে মায়ের গাম্ভীর্যতাটুকু সে পেলেও। আবির আর কল্প পেয়েছে মায়ের হারিয়ে যাওয়া কৈশোর আর চঞ্চলতা।
মায়ের যখন বিয়ে হয় তখন ১৯৯৩ সাল। অবাধ চঞ্চলতা নিয়ে বেড়ে উঠা এক কিশোরীর হঠাৎ ছন্দপতন। ধ্রুব শুনেছে, মায়ের অনেকদূর পড়ার ইচ্ছে ছিলো৷ বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে মা। নানুভাই যে কী মনে করে আদরের কন্যাকে এই বয়সে সম্প্রদান করেছিলেন তা ধ্রুব জানে না। তবে তার মায়ের অভিমানের জায়গাটুকু বুঝে। প্রিয় বাবার প্রতি কতটুকু অভিমান নিয়ে ছোট্ট একটা মেয়ে জীবনযুদ্ধের নতুন খেলায় পা দিয়েছিল তা ভেবে তার বুক কাঁপে। কষ্ট হয়। সংসারের প্যাঁচমোচর না বুঝা তার মা বিস্তর বয়সের পার্থক্যের স্বামীকে তখনও মেনে নিতে পারেননি। নিজের শখের বই, বন্ধু, বিশাল স্বপ্ন ফেলে আসা বাচ্চা মেয়েটিকে মানিয়ে নেওয়ার ন্যূনতম সুযোগ দেওয়া হয়নি ভেবে, নিজের বাবার প্রতিই খুব অভিমান হয় ধ্রুবর। তাকে একটু সুযোগ দিলে নিশ্চয় গল্পটা অন্যরকম হতো? তার চঞ্চলা মা একরাতেই ঝুপ করে শান্ত হয়ে যেতো না? ছোট্ট বুকে পৃথিবী সমান অভিমান জমতো না? ধ্রুবর খুব আফসোস হয়, কেন সে সেই সময়টায় পৃথিবীতে জন্মাল না? মাকে খুব শক্ত করে আগলে রাখতে পারল না?
মা-বাবার বিয়ের পাঁচ দিনের মাথায় কাজে ফিরে গেলেন বাবা। বাবা ছিলেন তৎকালীন দূর্ধর্ষ সেনা কর্মকর্তা। ঘরে বসে বাচ্চা বউ সামলানোর ধৈর্য তার নেই। তাছাড়া, এতো অল্প বয়স্কা বধূ তার পছন্দ হয়নি। এদিকে মধ্যবিত্ত ছোট্ট পরিবার থেকে বিশাল বনেদী পরিবারে এসে একরকম দিশেহারা হয়ে পড়লেন মা। বনেদী পরিবারের শতকথা, কূটকচালি, অতিথি অপ্যায়ন, সংসার সামলাতে না পারার খোঁটা, টুকরো স্বপ্নের বোঝা সব মিলিয়ে ক্লান্ত মা বিয়ের তিন মাসের মাথাতেই বুঝতে পারলেন তার শরীরের সূক্ষ্ম পরিবর্তন। ভয় পেলেন। বাবা-মার আদর আর বইয়ের পাতায় আবদ্ধ থেকে শৈশব পেরুনো মা বুঝতে পারলেন না তার শরীরে নতুন প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে। তিনি ভাবলেন, তার বুঝি কঠিন অসুখ হয়েছে। নয়তো কেন এতো মাথা ঘুরে? বমি পায়? খেতে পারে না? কিন্তু কাকে বলবে সে এই অসুখের কথা? বাবা-মা তো কাছে নেই। কোনো বন্ধু নেই। এ বাড়ির কাউকেই সে ভালো মতোন চেনে না। এমনকি তার স্বামীকেও না। চেহারাটাও কেমন অস্পষ্ট। খেয়াল করে দেখা হয়নি পর্যন্ত! এই দুর্বল, দিশেহারা মা’ই একসময় দুঃসাহসিক এক কাজ করে বসলেন। নিজের অবস্থাটা মেনে নিয়ে, সকল নিয়ম ভেঙে দুই ক্রোশ দূরের এক হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে গেলেন। সে তো আজকের কথা নয়। সেই তিরানব্বইয়ের যুগে গর্ভবতী এক নারীর যেখানে বাড়ির সীমানা পেরুনোই ছিলো গুরুতর অপরাধ। সেখানে এতটুকুন একটা মেয়ে কতটা সাহস নিয়ে সকল নিয়ম ভেঙে একদম একা গিয়ে স্কুলে ভর্তি হয় ভাবলেই আশ্চর্য হয় ধ্রুব। গর্ব হয়। উনিশো তিরানব্বই সালে গ্রামীণ সমাজের রূপটা আরও করুণ বই সরস নিশ্চয় ছিল না? চারদিকে কুসংস্কার আর প্রতিরোধের মাঝে বনেদি ঘরের গর্ভবতী বধূ স্কুলে ভর্তি হয়েছে তা যেন চড়াও হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। ধিক ধিক শুধু একই কথা। একই খবর। ধ্রুবর বাবার বাড়ির লোকেরা খুব রাগারাগি করলেন। একসময় হিংস্র হয়ে উঠলেন। তাদের মানসিক অত্যাচারটা ধীরে ধীরে শারীরিক হয়ে উঠল। ধ্রুবর নানা-নানি এসে মেয়েকে বোঝালেন। কান্নাকাটি করলেন। কিন্তু অভিমানী মেয়ে শক্ত হয়ে বসে রইলো। হয়তো সে বুঝে গিয়েছিল, নিজের জন্য দাঁড়াতে না শিখলে। সত্যিকারের দাঁড়াতে শেখা হয় না কখনো। দাঁড়াতে হয় কেবল নিজের জন্য। নয়তো হাঁটু মুড়েই থাকতে হয় চিরজীবন। ধ্রুবর দাদিমা খুব হম্বিতম্বি করলেন। ছেলেকে চিঠি পাঠিয়ে তার বউয়ের কৃতকর্ম জানিয়ে এই ছন্নছাড়া বউকে তালাকের দড়ি দেখাতে আদেশ বললেন। বাবা এই নিয়ে কোনো হৈ-চৈ করলেন না। সবাইকে আশ্চর্য করে এক সপ্তাহ পর একটা চিঠি পাঠালেন। সেখানে সোজাসাপ্টা জবানবন্দি,
‘ আমি আমার স্ত্রী অথবা বাচ্চা কাউকেই ছাড়বো না আম্মা। আমার স্ত্রী যদি পড়াশোনা করতে চায়, করবে। তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। পড়াশোনা করা কোনো পাপ নয়। এতে তোমাদের মানসম্মান জলাঞ্জলি কেন যাচ্ছে বুঝতে পারছি না।’
ছেলের চিঠি পেয়ে দাদিমা এবার রণমূর্তি ধারন করলেন। বিয়ের পাঁচ দিনের মাথায় ফেলে যাওয়া বউয়ের প্রতি ছেলের এতো দরদে বিস্মিত হলেন। এই এতটুকুন মেয়ে কী জাদু করে তার ছেলেকে আঁচলে বেঁধেছে সে নিয়েও শুরু হলো নতুন মানসিক অত্যাচার। অথচ মা নির্বিকার। যেন অনুভূতিগুলো বেঁধে রেখে এসেছেন দূরবর্তী কোনো রূপকথায়। মানসিক অত্যাচারের এক পর্যায়ে, ধ্রুবর সেই ছোট্ট গর্ভবতী মাকে খাবার দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় এক সপ্তাহ শুধু পানি আর বাগানের এক দুটো পেয়ারা খেয়ে বেঁচে গেলেন মা। কিন্তু হার মানলেন না। পড়াশোনা চলতে লাগল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো বোর্ড পরীক্ষায়। তখন মায়ের আট মাস চলছে। দাদাভাই গম্ভীর কন্ঠে জানালেন, “এসব পরীক্ষা টরীক্ষার ভূত ঝেড়ে ফেলো। এই বাড়ির বউ হয়ে এই পাপ কাজ করার কথা চিন্তাও করবে না। তোমার বাবার মানসম্মানের ভয় না থাকলেও আমাদের আছে। এই অবস্থায় পরীক্ষায় বসবে, মানুষ কী ভাববে?” মা উত্তর দিলেন না। দাদিমার মুখ ছুটলো গুলির বেগে। মা যে আসলে মা হওয়ার যোগ্য না। নিজের পেটের বাচ্চা খাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগা রাক্ষসী। তা খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন। মা কোনো কথার জবাব দিলেন না। চোখ বন্ধ করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলেন এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে সকালবেলা পরীক্ষার জন্য তৈরি হয়ে গেলেন। তারপর শুরু হলো আরেক কুরুক্ষেত্র। এই কুরুক্ষেত্র ভেদ করে মা যে কী করে পরীক্ষা দিতে সদর পর্যন্ত পৌঁছেছিল, তা ভেবে এখনও আশ্চর্য হয় ধ্রুব। পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পর মাকে কিছুতেই ঘরে ঢুকতে দেওয়া হলো না। এই অস্পৃশ্যা মেয়েটিকে ঘরে তারা তুলবে না। ছেলেকে প্রয়োজনে নতুন করে বিয়ে করাবে। তবুও এই অস্পৃশ্যাকে বংশ কলঙ্কিত করতে দেওয়া হবে না। আট মাসের গর্ভবতী ক্লান্ত ছোট মেয়েটা আরও একবার তলোয়ারের মতো জ্বলে উঠলো। গম্ভীর, শান্ত কন্ঠে বললেন,
‘ এই বাড়িতে আমি আপনাদের অনুগ্রহে থাকছি না। আমার স্বামীর উপার্জিত টাকার দাপটে থাকছি। আপনাদের ছেলেকে এসে তালাক দিয়ে যেতে বলেন। তালাক না হওয়া পর্যন্ত আমি এ বাড়ি ছাড়বো না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে সদরে গিয়ে মামলা করব। বনেদী মানসম্মানের কতটা বাকি থাকে সেটাই দেখবেন।’
এই ছোট্ট, আপাত দুর্বল মেয়েটির এমন ছুঁড়ির মতো কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই। সেই তিরানব্বইয়ের সনে গ্রামীণ নারীর মামলা করার হুমকি হাস্যকর শুনালেও তার ব্যক্তিত্বের ধারে সেবারের মতো চুপ করলেন দাদাভাই। মা কে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হলো। একে একে সবগুলো পরীক্ষা দেওয়ার পর শেষ পরীক্ষার দিন মায়ের প্রসব যন্ত্রণা শুরু হলো। এমন খারাপ রাস্তা ধরে রিক্সা করে সদরে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার ধকলেরই বোধহয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দিল এই ব্যথা। মা সেই প্রসব যন্ত্রণা নিয়েই সদরে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এলেন। কিন্তু তার লড়াইটা রাত পর্যন্ত টিকলো না। বয়স আর কত হবে তখন? পনেরো? পনেরো বছর বয়সে গর্ভে সন্তান নিয়ে একদম একা জীবনযুদ্ধে নেমে আসা মা রাতের বেলা হয়ে পড়লেন অসহায়। এমন হাড় ভাঙা ব্যথা তার ছোট্ট জীবনে কখনো উপলব্ধি করেছেন বলে মনে পড়ল না। বনেদী বাড়ির দেয়াল কাঁপতে লাগল কিশোরী মায়ের তীব্র চিৎকার আর যন্ত্রণায়। শুধুমাত্র বনেদী পরিবারের মানুষগুলোর মন কেঁপে উঠল না। দাদিমা বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। কাজের লোকদের আশেপাশে যেতে নিষেধ করলেন। কতটা অমানবিক হলে সারারাতেও পশুর মতো ছটফট করতে থাকা মেয়েটির ধারেকাছে কেউ এলেন না। এই বিশাল পৃথিবীতে পনেরো বছরের ছোট্ট কিশোরীটি নিজেকে একদম একা বলে আবিষ্কার করল। মা নেই, বাবা নেই, স্বামী নেই, একটু স্নেহের ছায়া নেই, ভরসা নেই। কেবল আছে ফুলেফেঁপে উঠা পেটটিতে সাড়ে আটমাসের বাচ্চা। তার শরীরের অংশ। মাঝে মাঝে নড়েচড়ে জানান দেয় এই পৃথিবীতে সেই তার একমাত্র আপন কেউ। পুরো রাত ছটফট করতে করতে ভোরের দিকে জ্ঞান হারালেন মা। ঘন্টাখানেক পর জ্ঞান ফিরলে আবারও শুরু হলো অমানসিক কষ্ট। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই কোথা থেকে খবর পেয়ে ছুটে এলেন ধ্রুবর নানা-নানি। আদরের মেয়ের এই অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে পড়লেন। সারাদিন মাকে অমানবিক কষ্ট দিয়ে বিকেলের দিকে জন্ম নিল ধ্রুব। মায়ের ধ্রুব। ধ্রুব জন্মানোর সাথে সাথেই আবারও জ্ঞান হারালেন মা। অপ্রাপ্ত বয়সে সন্তান প্রসব আর এতো অত্যাচারের পর রক্তপাত শুরু হলো। নানা-নানি দিশেহারা হয়ে পড়লেন। মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলেছেন বলে কপাল চাপড়াতে লাগলেন। সেই সন্ধ্যেতেই বাড়ি ফিরলেন বাবা। মায়ের এই অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। বিয়ের সময় দেখা ছোট্ট নববধূকে এবার ঠিক চিনতে পারলেন না। এক মুহূর্ত দেরী না করে যে মোটরগাড়ি করে এসেছেন সেই মোটরগাড়িতে চেপেই স্ত্রীকে নিয়ে গেলেন সদরে। তারপর খুব ঝক্কিঝামেলা পুহিয়ে ঢাকায় আনলেন। বাবার পরিচিত ডাক্তারের নিরন্তর ছুটোছুটির পর তিনদিন বাদে সত্যিকার অর্থে বেঁচে গেলেন মা। চোখ মেলে সুঠাম, বিশালদেহী এক পুরুষকে দেখলেন। বিয়ের পর এটাই ছিলো বাবার সাথে মায়ের দ্বিতীয় দেখা। মা প্রথমে বাবাকে ঠিক চিনতে পারলেন না। আর যখন চিনলেন তখন বুকে ফুলেফেঁপে উঠল আকাশ সমান ব্যথা, অভিমান। কিন্তু বাবার ভুল, বাবা সেই কিশোরী মেয়েটির অভিমানটা ঠিক ধরতে পারলেন না। আর না ধরতে পারলেন তার বাবা-মা। কেউ একটু স্নেহ দিয়ে জিগ্যেস করল না, ‘তুমি কেমন আছ দোলা?’ পৃথিবীর প্রতি পৃথিবী সমান অভিমান নিয়েই জন্মের আটদিন পর নিজের সন্তানকে প্রথম চোখে দেখলেন মা। শ্যামবর্ণ শান্ত, চুপচাপ একটা শিশু। তারদিকেই চেয়ে আছে অপলক। হাত দিয়ে ছুঁতে চাইছে তার গাল, চুল। বড় বড় চোখে দূর্নিবার কৌতূহল। যেন শুধাচ্ছে, ‘তুমি ভালো আছ তো মা?’ মা দীর্ঘক্ষণ ভ্রু কুঁচকে ছেলের শান্ত মুখের দিকে চেয়ে থেকে তার নাম দিলেন, ধ্রুব। এতো যুদ্ধের পর যার বেঁচে থাকা তার নাম নিশ্চয় ধ্রুবই হবে? ধ্রুবতারার মতোই জ্বলজ্বলে প্রাণ। মা বোধহয় সেদিন বিশ্বাস করেছিলেন, এই ছেলেটিই তার দুঃসময়ের একমাত্র অবলম্বন। তার কষ্টের, অভিমানের প্রতিটি রন্ধ্র রন্ধ্র উপলব্ধি করেছে এই ছেলে। এই গোটা পৃথিবীতে তার এই নাড়ি ছেঁড়া অংশটিই কেবল বুঝবে তাকে। ধ্রুব সত্যিই বুঝেছিল। আর বুঝেছিল বলেই হয়তো মায়ের গাম্ভীর্যটুকু উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করেছিল মাথা পেতে। ছোট থেকেই মায়ের আঙুল ধরেছিল ছায়া হয়ে। বুঝে গিয়েছিল, তার মায়ের অনেক কষ্ট। এই কষ্ট বোঝার দায় একমাত্র তার।
ধ্রুব জন্মানোর কয়েক মাস পর মায়ের মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। মা চার বিষয়ে লেটার পেয়ে পাশ করেছেন। বাবা খবরের কাগজে রেজাল্ট দেখে গম্ভীর কন্ঠে শুধালেন,
‘ তুমি হোস্টেলে থেকে পড়বে দোলা? ধ্রুবকে আব্বা-আম্মার কাছে রেখে ময়মনসিংহে ভালো কলেজে ভর্তি হও।’
মা কঠিন কন্ঠে জানালেন,
‘ আপনার আব্বা-আম্মা বা আমার বাবা-মা কারো কাছেই ধ্রুবকে আমি রাখব না। ধ্রুব খুব মা পাগল হবে। আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। যে ধ্রুবকে পেটে নিয়ে আমি পড়াশোনা করতে পেরেছি তার আঙুল ধরেও আমি পড়াশোনা করতে পারব। আপনি ময়মনসিংহে আমায় বাসা দেখে দেন। আমি একা থাকতে পারব।’
ধ্রুব সত্যিই মা পাগল হলো। গম্ভীর হলো। দু’বছর বয়স থেকেই নিজের আগে মাকে নিয়ে ভাবতে শিখে গেল। ময়মনসিংহ শহরে একাকিত্বের জীবনযুদ্ধে। হাজারও কটুক্তির মাঝে ধ্রুব তার মায়ের একমাত্র সঙ্গী হয়ে গেল। ধ্রুবর চার বছর বয়সের সময় আবিরের জন্ম হলো। মা তখন মুমিনুন্নেসা কলেজে বিএ পড়ছেন। ধ্রুব যেন সেই ছোট্ট বয়সেই বুঝে গেল আবিরের দায়িত্বও তার। তাদের মা অন্যরকম। আবির মাকে পাবে না। সত্যিই আবির মাকে পায়নি। ততদিনে নীরব অভিমান জমিয়ে রাখতে রাখতে মা হয়ে গিয়েছেন মূর্তির মতো কঠিন। আবিরের জীবনটা মূলত সেজন্যই বড় ভাইয়াকে কেন্দ্র করেই ঘোরে। তার সকল আবদার, অভিযোগ, অভিমান ভাইয়াকে কেন্দ্র করেই। মায়ের সাথে তার সম্পর্কটা কেমন ছাড়া ছাড়া অস্পষ্ট। মা কেন এতো দূরের মানুষ তা নিয়ে আবিরের অবশ্য কোনো মাথাব্যথাও নেই। বাবাকেও বছরে এক দুইবার দেখা ছাড়া কাছে পায়নি। ছেলেবেলায় বাবাকে সে অন্য লোক ভাবতো। খুব একটা কাছে ঘেঁষতো না। ছোট থেকেই সে বুঝে এসেছে ভাইয়া থাকা মানেই সব থাকা। ভাইয়া মানেই পৃথিবী। ধ্রুবর পিছু পিছু ঘুরে বাবা-মার অভাবটাও বোধহয় সে খুব একটা উপলব্ধি করতে পারেনি। তার মনোভাব মতে, ভাইয়ের কথা বেদবাক্য। মা-বাবার কথা না শুনলেও চলে। শুধুমাত্র ভাইয়া রাগ না হলেই হলো। আবিরকে দেখে দেখে কল্পও হয়েছে ওই একইরকম। বড় ভাইয়া আর আবির ছাড়া তার আর কারো প্রতি তেমন ঝোঁক নেই। তবে বউ হলে অন্য হিসেব। আজকাল তার বউয়ের প্রতি ঝোঁক হয়েছে। আবির তাকে বলেছে, বউ মানে পরি। পরিদের কাছে জাদু থাকে। কল্পের ঝোঁকটা তাই পরির থেকে পরির জাদু দণ্ডের প্রতিই বেশি। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখ তুলে কঠিন মুখে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া মায়ের দিকে চাইল। পনেরো বছরের সেই সাহসী কিশোরীটা এখন বোধহয় চুয়াল্লিশ হলো। মেয়ে, স্ত্রী, পুত্রবধূ, মা সব সম্পর্কের উর্ধে গিয়ে সে এখন সরকারি কলেজের অধ্যাপিকা। আজ বনেদী শ্বশুর বাড়িতে তার মতামতের দাম আছে। তার ধারালো ব্যক্তিত্বে বনেদী পরিবার কেঁপে উঠার শক্তি আছে। কী কঠিন, কী শক্ত তার মুখাবয়ব। অথচ এই মুখটিতে লুকিয়ে আছে দীর্ঘ ঊনত্রিশ বছরের ব্যথা। সেই ব্যাথাটা বুঝি কেবল ধ্রুবর কাছেই দৃশ্যমান? মায়ের অভিমান বুঝার দায় নিয়ে জন্মানো ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বুকের ভেতর খুব বুঝে, মায়ের ধ্রুব ছাড়া মাকে বুঝার কেউ নেই!
ধ্রুব এ-ও জানে নিশুকে নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে মায়ের কোনো সমস্যা নেই। নিশুকে তিনি ভালো যেমন বাসেন না। তেমন ঘৃণাও করেননি কখনো। মায়ের সাথে নিশুকে নিয়ে ধ্রুবর আকারে ইঙ্গিতেও কোনো কথা হয়নি। মা ধ্রুবকে মনের ভুলেও নিশু সম্পর্কিত কিছু জিগ্যেস করেননি। ধ্রুব যদি এখনও বলে, সে একমাত্র নিশুকেই বিয়ে করতে চায়। তবুও কোনোরূপ প্রতিবাদ করবেন না মা। মেনে নিবেন। কিন্তু ধ্রুব জানে, আপাতদৃষ্টিতে কঠিন থাকলেও মনে মনে নিষ্ঠুরভাবে হেরে যাবেন মা। বাবা-মা, স্বামী সবার কাছে হেরে গিয়ে তার এক টুকরো আশা কেবল ধ্রুবকে নিয়ে। অথচ সেই ধ্রুবর জীবনের এতবড় খবরটা তাকে পেতে হয়েছে বাড়ির কাজের মেয়ে আর পাশের বাড়ির ভাবির কাছে। মা বড় অভিমানী। এই দুঃখটা তিনি মেনে নিতে পারবেন না। এখন যদি ধ্রুব নিশুকে বিয়ে করার দাবী তুলে তবে কী এতোদিনের সকল মিথ্যে গুজব সত্যি হয়ে যাবে না? ধ্রুব কী বুঝাতে পারবে, তখন নয় তার বহু পরে নিশুকে ভালোবেসেছে সে? তার দুঃসাহসিক মা হারতে হারতে কী ফুরিয়ে যাবে না? এই ঊনত্রিশ বছরের দীর্ঘ জীবনযুদ্ধে মুখ থুবড়ে পড়বে না? তার সকল আস্থা, বিশ্বাস টলে যাবে না? ধ্রুব কী করে পারবে মাকে এতোবড় আঘাত করতে? মায়ের সেই পরাজিত মুখশ্রী দেখার থেকে ধ্রুবর মৃত্যুই কী শ্রেয় নয়? হে বিধাতা? তবে ধ্রুবর মৃত্যুই হোক। ভাগ্য বিধাতা বুঝি ধ্রুবর মৃত্যুর আকাঙ্খাটা ঠিক শুনলেন না। তাই বলে তাকে পুরোপুরি ছেড়েও দিলেন না। মৃত্যুর পরবর্তীতে তার উপর বর্ষণ করলেন ভীষণ প্রাচীন এক যন্ত্রণা। আদিম প্রণয়ের শ্বাসরুদ্ধকর যাতনা।
ধ্রুবর ছন্দহীন জীবন লিপি যখন কিছুটা গুছিয়ে এলো। নিশুর নিতান্তই অদর্শনে প্রেমের ঝড়টা যখন নামমাত্র চাপা দেওয়ার মতো মনের জোর এলো ঠিক তখনই আবারও কালবৈশাখীর বাতাসে ফুলেফেঁপে উঠল প্রণয় সাগর। বুকের ভেতর সুড়সুড়ি দিয়ে উঠল প্রিয় অনুভূতিরা। সেদিন শুক্রবার। ধ্রুবর ডিউটি শেষ হলো গোধূলির শেষ বেলায়। বাসায় ফেরার পথে ঠিক বাসার গেইটের সামনেই চোখে পড়ে গেল চির পরিচিত এক মুখ। ধ্রুব প্রথমটায় অবাক হলেও সামলে নিলো। অকৃত্রিম খুশিতে জাপটে ধরল আগুন্তকঃ এর সুঠাম দেহ। হেসে বলল,
‘ তুই এখানে? আমি তো ভেবেছিলাম ময়মনসিংহকে মন থেকে পত্রপাঠ বিদায় দিয়ে দিয়েছিস। এদিকে আর ফিরছিস না।’
আগুন্তকঃ মিটিমিটি হাসলো। ধ্রুবর পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,
‘ প্রিয়তমার শহর কী চাইলেও ভুলে যাওয়া যায়?’
ধ্রুবর মুখটা চোখের পলকে গরম হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই হেসে ফেলে বলল,
‘ তুই একটুও বদলাসনি তরু। তা কাঁধে ঝুলা যে? সাহিত্যিক হয়ে গেলি নাকি হঠাৎ?’
গমরঙা পেটানো শরীরের ছেলেটি এবার মাথা দুলিয়ে হাসল। তার হাসির সাথে দুলে উঠল এক মাথা কুঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল।
‘ তুই সব রেখে পুলিশই হতে গেলি কেন বল তো? বন্দুক দেখিয়ে আমার প্রেম আটকাবি বলে?’
ধ্রুব রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
‘ বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছিস যে? ভেতরে গিয়ে বসলেও পারতি।’
তরু অবাক হয়ে বলল,
‘ এটা তোদের বাসা? এজন্যই চেনা চেনা লাগছিল। কয়েক বছরে আশপাশটা কেমন পাল্টে পাল্টে গিয়েছে। বিল্ডিংয়ের রঙটাও পাল্টেছিস মনে হচ্ছে?’
ধ্রুব উত্তরে হাসল। তরু হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ একা আসিনি বুঝলি? আপদ সঙ্গে করে এনেছি। আপদ গিয়েছে চা খেতে। আমার উপর হুকুম জারি করেছে আপদ ফিরে না আসা পর্যন্ত ভেতরে ঢুকা যাবে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মশা মারতে হবে। তুইও দাঁড়িয়ে থাক। দুজনে মিলে মশা মারি।’
ধ্রুব প্রত্যুত্তরে কিছু বলার আগেই গলির মোড় থেকে আবিরকে আসতে দেখা গেল। ধ্রুব প্রথমে আনমনে চাইল। পরমুহূর্তেই চমকে গিয়ে পাশের রমণীটির দিকে চাইল। রমণীটি তার দিকে ফিরেও তাকাল না। আবিরের সাথে সহাস্য বাক্য বিনিময় করতে করতেই তাদের পাশে এসে দাঁড়াল। তরু মানবীটিকে দেখেই গম্ভীর প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘ কী রে টুনটুনি? আপদের এখনও চা খাওয়া শেষ হয়নি? চা কী মানুষ পেট ভরার জন্য খায়? এই আপদ সবসময় এমন আবলামো করে কেন বল তো?’
বিষণ্ন চেহারার মানবী কৃত্রিম রাগ নিয়ে চাইল। চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ বাবাকে একদম আপদ বলবে না ছোট মামা।’
নিশুর সম্বোধনটা শুনেই চমকে উঠল ধ্রুব। মামা? তরু নিশুর মামা? ধ্রুবর প্রথম চমকটা কাটার আগেই দ্বিতীয় চমক দিলো তরু। ধ্রুবকে দেখিয়ে বলল,
‘ এই হলো আমার বন্ধু ধ্রুব। যার মাকে দেখে আমরা দশজন বন্ধু একসাথে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। পুরো পাঁচ বছর প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছি এবং এখনও খাচ্ছি।’
তরুর কথায় ধ্রুব চোখ রাঙিয়ে তাকালেও আবির শব্দ করে হেসে ফেলল। তরু সেদিকে পাত্তা নিয়ে দিয়ে খুব গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ হা করে তাকিয়ে আছিস কেন টুনটুনি? যদিও সে আমার আর আমার প্রিয়তমার প্রেমে এক নাম্বার শত্রু। তবুও সে আমার বন্ধু। প্রাণের বন্ধু। তোর প্রাণের মামা। মামাকে সালাম দে। সুন্দর করে বল, আসসালামু আলাইকুম ধ্রুব মামা।’
তরুর কথাটা শুনেই ফ্যাকাশে হয়ে আসা মুখটা ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে গেল ধ্রুবর। চোখের পলকে অজস্রবার প্রার্থনা করে ফেলল, আর যায় হোক। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাক। তবুও নিশুর মুখ থেকে যেন মামা ডাকটা শুনতে না হয় বিধাতা! প্রেমিক হতে হতে শেষে কি-না মামা! উফ! এ-ও বুঝি মেনে নেওয়া যায়?
#চলবে…..
[ বিঃদ্রঃ পর্বটা যথেষ্ট বড় হয়েছে। এবং পর্বের বেশির ভাগ জুড়েই রয়েছে ধ্রুবর মা সম্পর্কিত কাহিনি। অনেকেই এতে বিরক্ত হতে পারেন। তবে প্রসঙ্গটা আমি গল্প বাড়ানোর জন্য টেনে আনিনি। ধ্রুবর মানসিকতা, পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা বুঝানোর জন্য এই বর্ণণাটুকু প্রয়োজন ছিলো বলেই আমার মনে হয়েছে। তবুও আমি সেই কাহিনিটুকু যথেষ্ট কম শব্দে ছোট করে লেখার চেষ্টা করেছি।