প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|১৫|
‘ এমন একটা মুহূর্তে জেদ ধরাটা কী খুব গুরুত্বপূর্ণ?’
ভীষণ অন্ধকারে ঢাকা মেঘাবৃত আকাশ। আলোহীন, রুদ্ধ শহরটিতে ঝমঝমে বর্ষা। মাথার উপর স্বল্প আলো ব্যতিত চারপাশটা ধরণি বিচ্ছন্ন লোমহর্ষক উপত্যকা। পায়ের কাছে ঝমঝমিয়ে জল পড়ছে। স্তব্ধ আকাশটা থেকে থেকেই ঝিলিক দিয়ে উঠছে নিষ্ঠুর আর্তনাদে। ঠিক তখনই চোখে পড়ছে হাতখানেক দূরের নির্বিক গাছগাছালি আর খুব নির্জন পথটা। গায়ের জামাটা ভিজে একাকার। শরীরটা কাঁপছে থরথর। বুঝতে পারছি, মাত্র সেড়ে উঠা জ্বরটা আবার ফোঁড়ন কাটছে গায়ে। চেপে বসতে চাইছে মাথায়। কন্ঠনালিতে। ধ্রুবর গায়ের শার্টটা ভিজে গিয়েছে আরও আগে। বৃষ্টির ছাঁটে বিন্দু বিন্দু জল জমেছে শ্যামবর্ণ মুখে। পুরু ভ্রু জোড়ায় ঢেউ খেলানো ভাঁজ ফেলে আমার দিকে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। কাঙ্ক্ষিত জবাব না পেয়ে একবিন্দু রাগ করলো না। বিরক্ত হলো না। হাতে থাকা মুঠোফোনটা সচল করে সেকেন্ড কয়েক অপেক্ষা করল। ওপাশে ফোন রিসিভ হতেই ভূমিকাহীনভাবে বলল,
‘ তোর ভাবীকে নিয়ে যা।’
আমি চমকে চাইলাম। অবাক চোখে চেয়ে থেকে নিজের অজান্তেই ফোনটা ছিনিয়ে নিলাম হাতে। কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম। নিজের অভদ্রতায় অবাক হলাম। তবুও বেশ তেজ নিয়ে বললাম,
‘ ভাবী বলতে কাকে বুঝাচ্ছেন?’
ধ্রুব তার ভাসা, ভাসা গম্ভীর চোখদুটো ফিরিয়ে আমার হাতের দিকে চাইল। তারপর চোখ তুলে চাইল আমার চোখে। তার সেই চাহনিতেই কালবৈশাখীর ঝড়ের থেকেও ভয়াবহ ঝড় বয়ে গেল মনে। থরথর করে কাঁপতে লাগল প্রেমে ডুবন্ত হৃদয়। সব ছেড়ে ছুঁড়ে জানতে ইচ্ছে হলো, ‘এমন ঘোর ধরানো দৃষ্টি আপনি কোথায় পান?’ কিন্তু জানা হলো না। চোখের দৃষ্টিটাও শিথিল হলো না বিন্দুমাত্র। চোয়াল শক্ত করে নির্বিকার চেয়ে রইলাম। ধ্রুব বলল,
‘ তোমাকেই বুঝাচ্ছি।’
‘ আমাকে বুঝাচ্ছেন? আশ্চর্য! আমি কারো ভাবী হতে যাব কেন?’
ধ্রুবর তেমন ভাবান্তর হলো না। সহজ কন্ঠে বলল,
‘ আবির তো তোমায় তাই বলে।’
আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। কঠিন কন্ঠে বললাম,
‘ আবির বলে! আবির বললেই আপনি মেনে নিবেন?’
ধ্রুব এবার পূর্ণদৃষ্টিতে চাইল। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘ আবির তোমাকে ভাবী ডাকছে, আমাকে নয়। তাহলে আমার মেনে নেওয়া না নেওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন?’
আমি চোখ বড় বড় করে চাইলাম। থতমত খেয়ে বললাম,
‘ আপনার মেনে নেওয়া না নেওয়ার প্রশ্ন আসবে না?’
ধ্রুব কঠিন কন্ঠে বলল,
‘ না। আসবে না।’
এরপর কী বলা যায় বুঝে না পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। আমার স্তব্ধতা কাটাতেই বুঝি সচল হয়ে উঠল মুঠোফোন। অধৈর্য হয়ে বলল,
‘ ভাইয়া-ভাবী, তোমরা ঝগড়াটা একটু বন্ধ করবে, প্লীজ? কোথায় আছো?’
আমি উত্তর দিলাম না। ধ্রুব আবারও সহজ রূপে ফিরে এলো। সহজ কন্ঠে বলল,
‘ পার্কের পেছনে ব্যাটমিন্টন ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাসা থেকে বেরিয়ে চট করে একটা রিকশা নিয়ে চলে আয়। তোর ভাবীকে উদ্ধার কর।’
আমি তপ্ত চোখে চাইলাম। আবির অবাক হয়ে বলল,
‘ মানে কী? এই বৃষ্টিতে ওখানে কেন? আর তুমি তো আছোই। তুমি থাকতে আমাকে আসতে হবে কেন?’
ধ্রুব বুঝি একটু ফোড়ন কাটল। বলল,
‘ ভাবী তো তোর, আমার না। আমার সাথে যেতে তার দুনিয়ার অসুবিধা।’
আমি রাগী চোখে চাইলাম। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
‘ আমি বলেছি কাউকে আসতে? আবির? তোমার আসার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমার ভাইয়াকেও বলো চলে যেতে। আই ক্যান হ্যান্ডেল মাইসেল্ফ।’
আবির হতাশ হয়ে বলল,
‘ তোমরা কী দয়া করে ঝগড়াটা বন্ধ করবে?’
ধ্রুব বা আমি কেউই প্রত্যুত্তর করলাম না। আবির কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে অসহায় কন্ঠে বিড়বিড় করল,
‘ মা কী এই ঝড় বৃষ্টিতে বেরুতে দিবে? কী বলে বেরুবো? আচ্ছা, আমি আসছি।’
অপরিচিত এক মেয়ের জন্য আবিরের এই আত্মোৎসর্গে বিস্মিত হলাম আমি। স্তম্ভিত হয়ে কিছু বলার আগেই কল ডিসকানেক্ট হলো। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে পকেটে পুড়ল। রোমশ হাতের উপর পড়ে থাকা ঝকঝকে ঘড়িটিতে সময় দেখল। তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল,
‘ এখানে আমার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। থাকো তবে। আমার বাসায় ফেরা প্রয়োজন।’
আমি সরু চোখে চাইলাম। শক্ত কন্ঠে বললাম,
‘ যান। কেউ মানা করেছে আপনাকে?’
ধ্রুব মৃদু হাসল। আমি বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দেখলাম আমাকে একা ফেলে সেই রিকশাটিতে চেপে ধ্রুব সত্যি সত্যিই চলে গেল। এই অন্ধকার আষাঢ়িয়া রাতে, একদম একা দাঁড়িয়ে থেকে, ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ধ্রুবর চলে যাওয়া দেখলাম। কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ধ্রুব চলে গেল? সত্যিই চলে গেল? একবারও ফিরে এলো না? মানুষের মন কী এতোটা নিষ্ঠুর না হলে চলে না? ‘ধ্রুব চলে গেছে’ — এই ঘোর থেকে বেরিয়ে আশেপাশে চাইতেই ঝুপ করে বাস্তবতায় নেমে এলাম আমি। চারদিকে নির্জন, নিস্তব্ধতা। নির্বিক দৈত্যের মতো অন্ধকার মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা। জনমানবহীন দীর্ঘ পথ। ঝমঝমে বৃষ্টির ফোঁটা ব্যতিত কোথাও কোনো নেড়ি কুকুরের আর্তনাদও নেই। আমি এই প্রথম নিজের দুরবস্থাটা গভীরভাবে উপলব্ধি করলাম। ভয়ে সিঁটিয়ে গেল মন। প্রিয়তাকে আরও একবার ফোন করার কথা মনে রইলো না। গলা শুকিয়ে এলো। মস্তিষ্কটা বাবার কথা মনে করিয়ে দিতেই আহ্লাদে ভিজে এলো চোখ। ধ্রুব আমায় এতোটা গুরুত্বহীন ভাবে ভাবতেই কোমল মনটা রক্তে রক্তে ভেসে গেল। এই পৃথিবীতে এই মুহূর্তে নিজেকে পথের মোড়ের ওই নেড়ি কুকুরটির থেকেও অসহায় মনে হলো। মনে হলো, এই পৃথিবীতে আদতে আমার কেউ নেই। কেউ না৷ নয়তো এতোক্ষণের বিপদ সময়ে কেউ তো একটিবারও মনে করলো না আমায়। একটু আদর দিয়ে আগলে নিলো না। উদ্বিগ্ন হলো না। নিজেকে আমার আবারও খুব অযথা মনে হলো। ভুল জন্মের পাপে পাপিষ্ঠা মনে হলো। ভেতরের অবুঝ মনটা খুব অবুঝ হয়ে বলল, মা থাকলে নিশ্চয় মনে করতো আমার কথা? আমি কোথায় আছি ভেবে উদ্বিগ্ন হতো? আকাশে মেঘ করেছে দেখেই চিন্তায় অস্থির হতো? আমার চোখ উপচে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। প্রায় মিনিট দশেক পর, যখন আমার মনে হলো এই পৃথিবীতে আমি বড়ই প্রয়োজনহীন। আমার হারিয়ে যাওয়া কাউকে ভাবায় না ঠিক তখনই টং টং ঘন্টি বাজিয়ে একটা রিকশা এসে থামল আমার সামনে। প্রথম দফায় ধ্রুব ভেবে খুব চমকালাম। কিন্তু পরমুহূর্তেই ওই সরল মুখে সহজ হাসি দেখে চমকটা কেটে গেল। আবির অর্ধসিক্ত শরীরে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। ডানহাত দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে নির্মল হাসল,
‘ খুব দেরী হয়ে গেল? রাস্তায় একটা রিকশাও নেই, জানো? এই রিকশাটা পেয়েছি খুব যুদ্ধ করে। জলদি চলো তো, ভাবী। ভিজে গেছো।’
আমি অপলক চেয়ে রইলাম। এই সহজ-সরল ছেলেটির সহজ আন্তরিকতায় হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। আমি যেন তার খুব কাছের এমনভাবেই উদ্বিগ্ন হলো আবির। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ ফেলে তাড়া দিলো। একই চেহারার দুটো মানুষের চারিত্রিক ভিন্নতায় কিছুটা স্তব্ধ হয়েই রিকশায় উঠলাম। প্রতিবাদ করলাম না। রিকশায় উঠেই হুটটা ফেলে দিয়ে মাথার উপর ছাতা মেলে ধরল আবির। হাজারও কথায় নিরন্তর ছুটে চলল তার ঠোঁট। আমি আবিরের দিকে চাইলাম। বিষণ্ন কন্ঠে বললাম,
‘ তুমি এতো মিষ্টি তবে তোমার ভাইয়া এতো অসভ্য কেন?’
আবির থমকাল। অবাক চোখে চেয়ে বলল,
‘ ভাইয়া আবার কী করল?’
‘ কী করল! আমাকে এখানে একা ফেলে চলে যাওয়াটা অভদ্রতা নয়? বিন্দুমাত্র মানবিকতা নেই। আমি জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না।’
আবির হেসে ফেলল। একটুও না চমকে সহজ কন্ঠে বলল,
‘ ভাইয়া আরও অনেক কিছু করতে পারে যা তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না।’
আমি প্রশ্নবোধক চাহনিতে চাইলাম। আবির খুব উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ তোমাকে একটা উদাহরণ দিই। আমি যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি তখন ভাইয়া হাই স্কুলের ছাত্র। আমাদের গ্রামের বাড়ি মুক্তাগাছা। তো, ঈদের ছুটিতে সবাই গ্রামের বাড়ি ঘুরতে গেলাম। আমার দাদুবাড়িতে সেই সময়ই দু’তলা বিশাল এক বাড়ি ছিলো। ছোট রেলিঙের ছড়ানো ছাদ। তখন বর্ষাকাল। ছাদে শ্যাওলা জমে একাকার অবস্থা। আমি ছাদের রেলিঙ ধরে হাঁটছি। বাবা-মা অনেকবার নিষেধ করেছেন। পা পিছলে গেলে সর্বনাশ। ছাদে হাঁটাহাঁটি করো না। কিন্তু কে শুনে কার কথা? আমার তখন সেটাই সবচেয়ে মজার খেলা। বাবা-মা সবাই যখন বলতে বলতে অতিষ্ঠ তখন এলো ভাইয়া। একদম সহজ কন্ঠে বলল, ‘ রেলিঙের কাছে যাস না। পড়ে যাবি।’ আমি ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম, ‘পড়ব না।’ ভাইয়া আরও একবার নিষেধ করল। কান দিলাম না। তারপর কী হতে পারে ভাবতে পারছ?’
আমি বিভ্রান্ত চোখে চাইলাম। অনিশ্চিত কন্ঠে বললাম,
‘ তারপর কী? মেরেছে তোমায়?’
আবির হেসে ফেলল। মাথা নেড়ে বলল,
‘ উঁহু। আমাকে তোলে ডিরেক্ট ছাদ থেকে নিচে ফেলে দিয়েছে।’
আমি চমকে উঠলাম। স্তব্ধ চোখে চেয়ে থেকে বললাম,
‘ মানে! সত্যি! তুমি ব্যথা পাওনি?’
আবির হাসল,
‘ গোটা দুইমাস বেড রেস্টে থাকতে হয়েছিল। স্কুলে যেতে পারিনি।’
আমি হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলাম,
‘ তোমার মা-বাবা উনাকে কিছু বলেনি?’
‘ না। বাবা একটু বকেছিল। তবে মা কিছু বলেনি। মা-ও ভাইয়ার মতোই। ভাইয়া মার মতো হয়েছে। খুব কঠিন। আর আমি হয়েছি বাবার মতো। কল্প কারো মতোই হয়নি। ও হয়েছে চূড়ান্ত বেয়াদবের মতো। আমার জীবনটা নাশ নাশ করার জন্যই ওর জন্ম।’
আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। বড় ভাইকে এরা কেন এতো ভয় পায় বুঝতে পেরে স্তব্ধ হয়ে গেল বুক। আবির একটু হেসে বলল,
‘ ভাইয়া যে তোমায় ফেলে গিয়েছে এটা তার খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। নিশ্চয় জেদ ধরেছিলে খুব?’
আমি উত্তর দিলাম না। এমন একটা ভয়ঙ্কর মানুষের প্রেমে পড়েছি ভেবেই তওবা পড়লাম। কী সাংঘাতিক কান্ড!
#চলবে….
[ বিঃদ্র-১ঃ পর্বটা ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত। চেষ্টা করেও যথেষ্ট সময় দিতে পারছি না।
বিঃদ্র-২ঃ আমায় একজন জিজ্ঞেস করেছে, আপনি যে বিনামূল্যে এই লেখাগুলো ছাড়ছেন। আপনার কী লাভ হচ্ছে? আপনার সময়ের মূল্য নেই? আপনার লেখা দিয়েই মানুষ হাজার টাকা রোজগার করছে। একজন কপিবাজ হয়েও কথাটা তিনি আমায় খুব ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন। আমি সেই মুহূর্তে খুব বিরক্ত হলেও প্রশ্নটা এড়িয়ে যাইনি। আপনাদের কী মনে হয় প্রিয় পাঠক? আমার সময়ের মূল্য নেই? এইযে আপনারা কেউ কেউ এডমিশনের পড়াশোনায় ব্যস্ত এখন। কলেজ, ভার্সিটি, স্কুলের পরীক্ষায় নাস্তানাবুদ অবস্থা? রাত-ভোর করে পড়াশোনা করছেন। মাঝরাতে একটু ক্লান্তি মেটাতে, স্বস্তি পেতে জাস্ট দশ মিনিটের জন্য আমার টাইমলাইনে আসছেন। লেখা পড়ছেন। কেউ টুক করে একটা রিয়েক্ট দিচ্ছেন। কেউবা একটা কমেন্ট। কেউ মান-অভিমান ঝাড়ছেন। কেউবা রিয়েক্ট কমেন্টের ধার না ধেরে ফুরফুরে মনে আবারও নিজের কাজে মন দিচ্ছেন। সমালোচনার গ্রুপে আক্রমনাত্মক সমালোচনা হচ্ছে। বিষাক্ত সব, মন খারাপ করে দেওয়ার মতো মন্তব্য পাচ্ছি। গালি শুনছি নিরন্তর। তবু লিখে চলেছি। আপনাদের থেকে প্রাপ্য সাড়া না পেয়েও লিখছি। আপনাদের কী মনে হয়, আমার সময়ের মূল্য নেই? অবশ্যই আছে। প্রত্যেকেরই সময়ের মূল্য থাকে।
আমার এই লেখালেখির জন্য জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছি আমি। তবে কখনো আফসোস করিনি। আপনাদের মতো আমারও খুব পড়াশোনা আছে। ক্যারিয়ার নিয়ে ভীষণ টেনশন আছে৷ পরিবারের এক্সপেকটেশন আছে। হেরে যাওয়ায় ডিপ্রেশন আছে। সারাদিনের বিশাল এক ক্লান্তি আছে। রাত জাগার কারণ আছে। বাজে মন্তব্য, সমালোচনা, পাঠকদের উদাসীনতা এসব নিয়ে মানসিক ক্লান্তিও আছে। আপনারা যখন ক্লান্ত শরীরের ক্লান্তি কাটাতে দশ মিনিট সময় নিয়ে লেখা পড়তে আসেন। কেউ ছোট্ট করে ‘নেক্সট’ মন্তব্য করে। আবার কেউ রিয়েক্ট, কমেন্টকে অযথা ভেবে এড়িয়ে গিয়ে আবারও ফুরফুরে মনে পড়তে বসেন? তখন আমি ক্লান্ত শরীর নিয়ে, ঘুম বাদ দিয়ে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে লিখতে বসি। বইয়ের পান্ডুলিপি না লিখে ফেসবুকের লেখা লিখি। বইয়ের কাজ পিছিয়ে দিই বারবার। কিন্তু এমনটা কেন করি? আমার কী লাভ? সত্যি বলতে আমার কোনো লাভ নেই। তবুও আমি লিখি। এই পৃথিবীর কোনো এক কোণে কেউ একজন খুব বিষণ্ণ সময়টাতে আমার লেখা পড়ে মৃদু হাসলো। কান্না থেমে গেল। আমি তাকে চিনি না, জানি না তবুও একটুখানি আমায় ভাবলো। শুধুমাত্র এইজন্য লিখি। আমি তাকে যে নিঃস্বার্থ খুশি দিতে পারলাম এইজন্য লিখি। তার এই হাসিটা আমার নিঃস্বার্থ প্রাপ্তি হবে। বিধাতা দেখছেন, এই প্রাপ্তিতে কোনো খাদ নেই। এজন্য লিখি। এতে আমার কোনো আফসোস নেই। আমি চাই পৃথিবীর কেউ একজন আপাতত আমার লেখা পড়ে বাঁচতে শিখুক। হাসতে শিখুক। একটু কাঁদতে শিখুক। মানসিক শান্তি পাক। বন্ধন বুঝতে শিখুক। আমি শুধুমাত্র এজন্যই লিখি। এটাই আমার শান্তি। প্রাপ্তি। অনেক কিছু হারিয়ে ফেলার পরও এক চিলতে সুখ।
পাঠকরা যে তাড়াতাড়ি লেখা না দেওয়ায় রাগ হয়? লেখকের লেখা পড়ে খুব দয়া করে ফেলেছেন এমন ভঙ্গি নিয়ে বলেন, ‘নেক্সট’। তাতে আমার রাগ হওয়ার কথা হলেও রাগ হই না। তাদের অভিমানে আমি হাসি। সাড়া না দেওয়ায় কখনো-বা একটু মন খারাপ নিয়ে ভাবি, তারা এমন কেন হয়? তবু লিখি। লিখে যাই। পাঠকদেরও উচিত লেখকের সেই লিখে যাওয়ার কারণ বুঝা। তাদের একটি রিয়েক্ট, একটি মন্তব্য, একটি সাড়া যে একজন লেখককে কতোটা আন্দোলিত করে। উৎসাহিত করে তাদের উচিত তা বুঝা।
পরিশেষে, গল্পশেষে এতো কথা লিখে ফেলার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। লেখালেখিটা আমি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছি। সুতরাং সেখানে আপনাদের কোনো দায়ভার নেই। আপনারা কেউ আমায় জোর করেননি। কাল হঠাৎ লেখা বন্ধ করে দিলেও জোর করবেন না। আমার নামটা হয়তো আপনাদের মনেও থাকবে না। তবুও বললাম। বলার প্রয়োজন ছিল না বলেও বললাম। বিশ্রী এক ঘটনার পর ভার মন হালকা করার জন্য বললাম। কথাগুলো পার্সোনালি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রিয় পাঠককে ভালোবাসা ❤️]





