প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|১২|
ফেব্রুয়ারীর ঝড়ো বাদলায়, এক মাথা ভিজে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন আমার হুহু জ্বর। থার্মোমিটারের পারদ উর্ধ্বগতিতে ছুটছে। চোখদুটো জ্বলন্ত আঙ্গার। মাথার চিন্তাগুলো অপরিষ্কার, ঝাপসা। বারান্দার দরজাটা ঠা করে খোলা। গোলাপি রঙের পর্দাটা উন্মুখ হয়ে উড়ছে। হাওয়ায় উড়ে আসা জলে থৈ থৈ করছে বসার ঘরের মেঝে। আমি ভেজা ছাতাটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে সোফায় গা এলিয়ে বসলাম। ভেজা জবজবে চুলগুলো মুক্ত করে দিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রিয়তাকে ডেকে বললাম,
‘ আমার মনে হচ্ছে ধ্রুব একটা মানসিক রোগী। ম্যান্টালি আনস্টেবল। আমাকে মানসিকভাবে অস্থির হতে দেখে তার ভয়াবহ আনন্দ হয়। সে চায় আমি অতি শীঘ্রই পাগল ছাগল কিছু হয়ে যাই।’
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলেই কাঁথা টেনে ঘুমিয়ে পড়া নিয়ম। প্রিয়তা এতোক্ষণ মনপ্রাণ দিয়ে নিয়ম রক্ষার চেষ্টা করছিল। তবে চেষ্টা সফল হলো না। আমার অত্যাচারে আড়মোড়া ভেঙে নড়েচড়ে বসলো। ঘুমে ঢুলুঢুলু, অনুভূতিশূন্য চোখে চেয়ে থেকে বলল,
‘ সে চাইলেই যে তোকে পাগল হয়ে যেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই নিশু। তুই জেনেশুনে কেন পাগল হচ্ছিস?’
আমি ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললাম,
‘ আমি জেনেশুনে পাগল হচ্ছি?’
‘ অবশ্যই হচ্ছিস।’
আমি ঝুপ করে নিভে গেলাম। প্রিয়তার অতিশয় সত্যকথনে আচমকায় এক অদৃশ্য চপটেঘাত এসে পড়ল আমার গালের উপর। কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে বিড়বিড় করে বললাম,
‘ ধ্রুবর চাওয়াটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না, প্রিয়। হোয়াট ডাজ হি ওয়ান্ট?’
প্রিয়তা অলস হাই তুলল। আমার দিকে চেয়ে থেকে একভাবে বলল,
‘ হি ডাজে’ন্ট ওয়ান্ট এনিথিং। আমি আগাগোড়া কোথাও তার কোনো দোষ দেখতে পাচ্ছি না। সে আগ বাড়িয়ে কখনো তোর সাথে কথা বলেনি। প্রশ্ন করেনি। যা করার তুইই করেছিস। হি জাস্ট বিহেভড নরমাল।’
আমি অবাক চোখে চাইলাম,
‘ বিহেভড নরমাল? ওর ব্যবহারগুলো তোর কাছে নরমাল মনে হচ্ছে ?’
‘ অবশ্যই মনে হচ্ছে। তোর অ-প্রেমিকের অবজারভেশন পাওয়ার দূর্দান্ত। আমার ধারণা, সে প্রথম দিনই ধরে ফেলেছে তুই তার জন্য মরে যাচ্ছিস। প্রেমে পা পিছলে চিৎ কাৎ হয়ে পড়ে আছিস। সে তোকে দুঃখ দিতে চাইছে না। আবার দুঃখ না দিয়েও পারছে না। তবে একদমই যে মজা নিচ্ছে না তাও নয়। তোর মতো রূপবতী একটা মেয়ে তাকে ভেবে এলেমেলো হয়ে যাচ্ছে। উলোটপালোট হয়ে চোখের জলে মন ভাসাচ্ছে। তা যেকোনো পুরুষকে নাড়িয়ে দিতে বাধ্য। সে হয়তো এই নাড়িয়ে দেওয়ার মজাটুকু লুফে নিতে চাচ্ছে।’
আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। প্রিয়তার বিশ্লেষিত গল্পটিতে নিজেকে মজার খোরাক ব্যতিত অন্যকোনো বিশেষণে বিশেষায়িত করতে পারলাম না। অপমানে থমথমে হয়ে গেল মন। ভীষণ অবুঝ মনটা খুব অবিশ্বাস নিয়ে শুধাল, ধ্রুব জেনেশুনেও আমার অনুভূতি নিয়ে এমন নিষ্ঠুর অপমান করতে পারল? একটুও মায়া হলো না? বুক কাঁপলো না? অবুঝ মনটাকে বুঝ দেওয়ার মতো স্বচ্ছ কোনো উত্তর না পেয়ে নিরুত্তর বসে রইলাম আমি। ধ্রুবর প্রতি হিমালয় সমান অভিমান নিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। ঠান্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকা শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আঙ্গারের মতো জ্বলতে থাকা চোখদুটোতে তীব্র কষ্ট হলো। জ্বালা করলো। নিজের প্রতি তীব্র ঘৃণাটা সুচের মতো বিঁধতে লাগল মস্তিষ্কে। সূক্ষ্ম অনুভূতির বশবর্তী হয়ে নিজের প্রতি এই ভয়াবহ আত্মপ্রবঞ্চনায় শিউরে উঠলাম আমি। চোখ দুটো বোজে রেখেই বললাম,
‘ আমার বাবাকে ছেড়ে আসা উচিত হয়নি, প্রিয়। আমার ঢাকা ছেড়ে আসা উচিত হয়নি। বড়ো ভুল হয়েছে। আমার জীবনে এতো ভুল কেন প্রিয়? আমার গোটা জন্মটাই কী ভীষণ ভুল!’
প্রিয়তাকে প্রত্যুত্তরের সুযোগ না দিয়েই চোখ মেলে চেয়ে মৃদু হাসলাম আমি। ফ্যাকাশে হাসি। অতঃপর বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলাম। সহজ হেসে বললাম,
‘ মাকে খুব মনে পড়ছে বুঝলি? আমার একটা মা থাকা উচিত ছিলো। আমার ভুল জন্মটা ভুল না হয়ে আরও একটু সঠিক হওয়া উচিত ছিল। এতোকিছু উচিত হয়েও কেন যে উচিত হলো না!’
তারপর একটু থেমে, অন্যমনস্ক হয়ে, একরকম মনের ভুলেই বলে ফেললাম,
‘ ধ্রুবরও বোধহয় আমার অনুভূতিটাকে একটু সম্মান করা উচিত ছিল। তোরা সবাই আমায় এতো দয়া করিস কেন, বল তো? আমাকে সারাটা জীবন এমন দয়ায় দয়ায় বাঁচতে হচ্ছে কেন? কেউ কী আমায় দয়া ছাড়া ভালোবাসতে পারে না? এতো জঘন্য আমি!’
প্রিয়তা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। প্রত্যুত্তরের চেষ্টা করল না। আমি সহজাত হাসলাম। জ্বরে এলোমেলো হয়ে আসা শরীরটা হিঁচড়েপাঁচড়ে তুলে নিয়ে শোবার ঘরে গেলাম। এ মাসের বাড়ি ভাড়াটা প্রিয়তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,
‘ ধ্রুবর কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার। ওইযে বললাম না? ভুল জন্ম? এজন্য ভুল করে ফেলি বারবার। আর অপমান করিস না প্লিজ। অল্প একটু আত্মসম্মান বোধহয় আমারও আছে। সত্য বললেও কোথায় যেন খুব খারাপ লাগে।’
প্রিয়তা হতবিহ্বল চোখে চেয়ে থেকে করুণ কন্ঠে বলল,
‘ সরি সোনা। আমি তোকে ….. ‘
আমি হেসে ফেললাম। প্রিয়তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
‘ ধুর! সরি টরি কিছু না। বাড়ি ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে এক মাস পর যে বাড়ি ছেড়ে দেব তার নোটিশটা জানিয়ে দিয়ে আয়। এই বাড়িতে আর থাকতে পারব না আমি। দমবন্ধ লাগবে। তোর যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে বরং আমি বাবার কাছে চলে যাই। বাকি পড়াশোনাটুকু ওখানেই কোনোভাবে…. ময়মনসিংহ শহরটা আমার জন্য নয়, প্রিয়। আমার জন্য নয়।’
প্রিয়তা উত্তর দিল না। আমি ঘরে এসে পোশাক বদলালাম। ভেজা চুলগুলো হাত খোঁপা করতে গিয়ে বুঝলাম জ্বরটা বেড়ে যাচ্ছে। জোর করেও চোখ মেলে রাখা যাচ্ছে না। হাত-পা মৃদু কাঁপছে। বল পাওয়া যাচ্ছে না। আমি শারিরীক কষ্টটুকুকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে বসার ঘরে এসে বসলাম। শরীরটা একটু কষ্ট পাক। অনেক অনেক কষ্টে ছটফট করুক। আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। প্রিয়তাকে আগের মতোই ঠাঁই বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বললাম,
‘ কী রে? এখনও যাসনি?’
প্রিয়তা হঠাৎ ধ্যান ভাঙার মতো চমকাল। সুন্দর, হরিণী চোখজোড়া তুলে অপ্রস্তুত হাসল। ঝুপ করে আগের প্রিয়তা বনে গিয়ে বলল,
‘ একা যাব নাকি? তোর শ্বশুর বাড়ির মানুষগুলো কেমন মাথা পাগল জানিস না? যদি আমায় একা পেয়ে ফট করে পাঁচ তলা থেকে ফেলে দেয়? তখন? তুই আমার সাথে চল। দু’জন একসাথে লালা লা করে চলে যাব। লেটস্ গো।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে বললাম,
‘ জমিলা আপাকে নিয়ে যা। আমি ও বাড়িতে যাব না।’
‘ জমিলা আপা নিজেই তো ওই বাসায়। প্লিজ জান, চল না। টুপ করে গিয়ে টুপ করে ভাড়াটা দিয়ে চলে আসবো। কী হবে?’
আমি প্রিয়তার দিকে চাইলাম। তেতো জিহ্বাটা আলতো নেড়ে বললাম,
‘ আমি আমার জীবন থেকে ধ্রুব নামক চ্যাপ্টারটা ক্লোজ করে ফেলেছি। এখন তার অস্তিত্বের বাতাসটাও আমার অসহ্য লাগবে। আমি ওকে ভুল করেও আর দেখতে চাইছি না প্রিয়। বিরক্ত লাগছে৷’
প্রিয়তা ফাঁকা বাতাস গিললো। একটু ভেবে বলল,
‘ এজন্য তো আরও বেশি করে যাওয়া উচিত, সোনা। তুই যে ধ্রুব নামক চ্যাপ্টার ক্লোজ করেছিস তা আসলেই ক্লোজ হয়েছে কিনা দেখতে হবে না? ধ্রুবর সামনে তুই কতটুকু সেল্ফ কন্ট্রোল রাখতে পারিস, লেটস্ চেইক।’
আমি বিরক্ত চোখে চাইলাম। প্রিয়তা লাফিয়ে এসে আমার হাত ধরতে নিতেই কড়া কন্ঠে বললাম,
‘ খবরদার! ছুঁবি না। সেল্ফ কন্ট্রোল আবার কী? আমার কী ধ্রুবকে দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে যে কন্ট্রোল করতে হবে? গোটা ব্যাপারটাকে ভয়াবহ বিরক্ত লাগছে আমার। আমি এই বিরক্তিটা এড়িয়ে যেতে চাইছি।’
প্রিয়তা আমার কোনো কথা শুনলো না। বাচ্চাদের মতো ঝুলা ঝুলি করে পাকিয়ে ফেলল কান। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজি হলাম। ভেজা চুলগুলো পিঠের উপর ছড়িয়ে দিয়ে ওড়না সামলালাম। চারতলা থেকে পাঁচতলার মাত্র কয়েকটা সিঁড়িই আমার কাছে হিমালয় সমান উঁচু মনে হলো। জিহ্বার তেতো ভাবটা ধীরে ধীরে তেতো করে তুললো মস্তিষ্ক। কলিংবেল চেপে মিনিট কয়েক দাঁড়িয়ে থাকাটাও ভীষণ ধৈর্যের কাজ বলে বোধ হলো। মিনিট কয়েক দরজা খোলার অপেক্ষা করে হাত বাড়িয়ে কলিংবেলে দ্বিতীয়বার চাপ দেওয়ার আগেই খুট করে খুলে গেল কাঠের ভারি দরজা। আমার হাতটা মাঝ পথেই থেমে গেল। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠলো মোহনীয় এক মুখ। গভীর চোখের বিস্মিত দৃষ্টি। আমি চোখ সরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইলাম। চোখে-মুখে স্পষ্ট উপেক্ষা। দরজার দিকে না চেয়েও বুঝতে পারলাম, দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আমাকেই দেখছে। তার দৃষ্টি বুঝতে পেরেই শক্ত হয়ে গেল দেহ। বিদ্যুৎস্পন্দনের মতো ঝিলিক দিয়ে গেল তীক্ষ্ণ বিরক্তির রেখা। ধ্রুব আমার থেকে চোখ সরিয়ে এক পলক প্রিয়তার দিকে চাইল। বিস্মিত চোখদুটো ঘুরেফিরে আবারও আমার উপর স্থির করেই প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ কী ব্যাপার?’
প্রিয়তা আহ্লাদে গলে গিয়ে বলল,
‘ আমরা তো পরের মাসে বাসাটা ছেড়ে দিচ্ছি তাই জানাতে এসেছি আন্টিকে। সাথে এই মাসের ভাড়াটা। বাসা ছাড়ার ব্যাপারটা তো এক মাস আগেই জানিয়ে দিতে হয়, তাই।’
আমি বিরক্ত হলাম। কড়া চোখে চাইলাম। প্রিয়তা সবটা সময় বেশি কথা বলে। নিজে নিজেই রামায়ণ, মহাভারত, পুঁথি আওড়ে ফেলায় তার জন্মগত স্বভাব। কী দরকার আগ বাড়িয়ে এতো কথা বলার? কেউ কী একবারও জিজ্ঞেস করেছে তোমরা কবে যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ? আশ্চর্য! ধ্রুব প্রত্যুত্তর না করে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। আমাদের ভেতরে আসতে বলে উত্তর-দক্ষিণ না তাকিয়ে নিজের রুমের বাঁকে হারিয়ে গেল। যেতে যেতেই মাকে জানাল,
‘ মা? ভাড়া দিতে এসেছে।’
ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। তার মা ব্যাপারটা আমলে আনলো কিনা বুঝা গেল না। তবে অন্য কেউ বেশ আগ্রহ দেখাল। দক্ষিণের ঘরের ভেতর থেকে ছোট্ট, গোলগাল একটা মুখ উঁকি দিলো বাইরে। বড় বড় চোখদুটোতে এক সমুদ্দুর বিস্ময়। ঘন, লম্বা চোখের পাপড়িগুলোতে মোহনীয় কম্পন। গলায় ঝুলছে প্রায় অর্ধ-দেহ সমান লম্বা স্টেথোস্কোপ। চিওমিও ঘন ঘন পলক ফেলে আমাদেরকে দেখে নিয়ে ধীর পায়ে সামনে এসে দাঁড়াল। ধ্রুবর চেহারার আদলে ছোট্ট একটা চেহারা ঠিক তার মতোই গম্ভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করে গেল কিছুটা সময়। তারপর লম্বা পাপড়ি কাঁপিয়ে, ঘন ঘন পলক ফেলে খুব আদর কন্ঠে বলল,
‘ আমি ডাত্তার।’
আমার ঠোঁটের কোণে প্রশ্রয়ের হাসি ফুটলো। চিওমিওয়ের গায়ের রঙটা তার বাবার মতোই ধবধবে ফর্সা। ভাইদের মতো শ্যামলা নয়। হলদে ফর্সা ঢুলঢুলে মুখটিতে আদর আদর মায়া। বড় বড় চোখদুটোতে সর্বদা বিস্ময়। আমি হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলাম। সে তার ভাইয়ের মতোই এটিটিউট দেখাল। কাছে এলো না। গম্ভীর চোখে চেয়ে বলল,
‘ তুমি অসুখ?’
প্রিয়তা চাপা হিসহিসিয়ে বলল,
‘ ও অসুখ হবে কেন? ওর নাম নিশু। তুমি নায়ক থেকে ফট করে ডাক্তার হয়ে গেলে কেন চুচু?’
চিওমিও মহাবিরক্ত চোখে চাইল। ঠিক তখনই কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো আবির। আর্তনাদ করে উঠে বলল,
‘ কল্প! তুই আবার আমার স্টেথোস্কোপে হাত দিয়েছিস। এটা কোনো খেলনা না বাপ। দে, এই এক্ষণ আমার স্টেথোস্কোপ ফেরত দে।’
ভাইয়ের আর্তনাদ, আহাজারিতে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না চিওমিও। আগের জায়গাটাতেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে ড্যাবড্যাবে চোখে চেয়ে রইলো। মুখ গুঁজ করে বলল,
‘ আমি ডাত্তার।’
আবিরের এবার কেঁদে ফেলার জোগার। হাঁটুর সমান ভাইকে ভাগে আনতে না পেরে চূড়ান্ত হতাশ৷
‘ আমি কিন্তু ভাইয়াকে ডাকবো কল্প। ভাইয়া? ভাইয়া?’
মুহূর্তের মাঝে দুই ভাইয়ের মাঝে গলা চালাচালি শুরু হয়ে গেল। কেউ কারো থেকে কম নয়। ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়৷ এদের দুই ভাইয়ের চেঁচামেচিতে মাথা ধরে গেল আমার। ভেতর ঘর থেকে ছুটে এলেন একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রমহিলা। চোখে-মুখে সুপ্ত আভিজাত্যের ছাপ। গায়ের রঙটা ধ্রুবর মতো উজ্জ্বল শ্যামা। একহারা, লতানো লম্বা শরীর। হঠাৎ দেখলে বয়স আঁচ করা মুশকিল। ভদ্রমহিলা এক নজর আমাদের দিকে চাইলেন। চোখ ফিরিয়ে ছেলেদেরকে চাপা শাসানি দিলেন। শাসানি কাজে এলো না। ছেলেদের চেঁচামেচি মাকে দেখে কিছুমাত্র কমল না। জ্বর গায়ে এদের পারিবারিক কলহ দেখতে দেখতে একরকম হাঁফ উঠে গেল আমার। ঠিক তখনই বসার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল ধ্রুব। পুরু ভ্রু জোড়ায় ম্লান ভাঁজ ফেলে ধীর অথচ কঠিন কন্ঠে ডাকল,
‘ কল্প? আবির?’
ধ্রুবর কন্ঠটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়তেই ঝুপ করে শান্ত হয়ে গেল চারপাশ। দুই ভাইয়ের কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করল না। আমি মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ধ্রুবর মা, যাকে আমি কিছুতেই ধ্রুবর মা বলে বিশ্বাস করতে পারলাম না, তিনি এসে বসলেন আমাদের পাশের এক সোফায়। ধ্রুব গমগমে কন্ঠে আদেশ করল,
‘ আবিরকে স্টেথোস্কোপ দিয়ে ভাইয়ার কাছে আসো কল্প।’
চিওমিও কিছুক্ষণ মুখ গুঁজ করে দাঁড়িয়ে রইলো। বড় ভাইয়ার কঠিন দৃষ্টির সামনে এক রকম বাধ্য হয়েই আবিরের দিকে এগিয়ে দিলো ওটা। আবির হাত বাড়িয়ে স্টেথোস্কোপটা কেড়ে নিয়ে চিওমিওয়ের দিকে কড়া চোখে চাইল। ভাবখানা এই, আরেকবার ছুঁয়ে দেখিস। একদম হাত গেলে দেব। ধ্রুব কঠিন চোখে আবিরের দিকে চাইল। তার থেকেও কঠিন স্বরে বলল,
‘ রুমে আয়।’
আবিরের মুখ আচমকা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ আমি কী করলাম?’
ধ্রুব উত্তর না দিয়ে কঠিন চোখে চেয়ে রইল। আমি এতোক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলাম। এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভদ্রমহিলার দিকে চাইলাম। ভদ্রমহিলা আমাকেই লক্ষ্য করছিলেন। আমি চাইতেই কঠিন কন্ঠে শুধালেন,
‘ আপনার নাম নিশিতা?’
জীবনের কিছু কিছু মুহূর্তে আমাকে খুব শক্ত দেখায়। সর্বদা অস্থির সত্তাটা স্থির হয়ে যায় অদ্ভুত ব্যক্তিত্ববোধে। আজ বোধহয় তেমনই এক বিকেল। আমি চোখ তুলে চাইলাম। স্পষ্ট কন্ঠে বললাম,
‘ জি।’
ভদ্রমহিলা আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। দু’চোখে তাঁর অদ্ভুত দ্যুতি। নিদারুণ তেজ আর ব্যক্তিত্ববোধ। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘদেহী পুরুষটা এই তেজী অল্পবয়স্কা মহিলাকে মৃদু করুণ কন্ঠে ডাকল,
‘ মা!’
ভদ্রমহিলা আমার থেকে চোখ সরালেন না। আবির আর চিওমিওকে ভেতরে যেতে বলে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো ধ্রুব। মা-ছেলের নিজস্ব মানসিক দ্বন্দ্বকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি প্রসঙ্গ টানলাম আমি,
‘ পার্সোনাল কিছু সমস্যার জন্য সামনের মাসে বাসাটা ছেড়ে দিতে হচ্ছে আমাদের। আপনারা চাইলে বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপ্তি দিতে পারেন। আমরা মাসের প্রথম সপ্তাহেই বাসাটা ছেড়ে দেব।’
ভদ্রমহিলা এবার ঘাড় ফিরিয়ে ছেলের দিকে চাইলেন। ধ্রুব তৎক্ষনাৎ মাথা নিচু করল। ভদ্রমহিলা কড়া কন্ঠে বললেন,
‘ তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এখানে কোনো প্রয়োজন আছে?’
ধ্রুব উত্তর না দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখ তুলে একদম আমার চোখের দিকে চাইল। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। সেকেন্ডের দৃষ্টি বিনিময়ের পর চুপচাপ সরে গেল দরজার আড়ালে। ভদ্রমহিলা এবার আমার দিকে চাইলেন। তাঁর চোখে তখন অদ্ভুত স্পষ্ট ক্ষোভ। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ আমরা তাহলে আসি?’
ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে শুষ্ক কন্ঠে বলল,
‘ আসুন।’
বয়সে বড়ো একজন মহিলার মুখে ‘আপনি’ সম্বোধন শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম আমি। অপ্রস্তুত হলাম তাঁর গোটা ব্যবহারে। প্রিয়তাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে আসতেই জ্বরের তান্ডবে কেঁপে উঠলো শরীর। তেতো হয়ে উঠল জিহ্বা থেকে কন্ঠ নালি পর্যন্ত। প্রিয়তা আমার দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ এই মহিলা তোর শ্বাশুড়ি? আই কান্ট বিলিভ। একে তো বড়জোর বড়বোন মনে হয় রে।’
আমি উত্তর দিলাম না। ধ্রুব নামক মানুষটির প্রতি বিরক্তিটা এতোটাই বেড়ে গিয়েছে যে তার সম্পর্কে কোনো শব্দও আর মনঃ পূত হলো না। এই মুহূর্তে সব ছেড়েছুড়ে বাবার কাছে যেতে ইচ্ছে হলো। অথবা বড় ভাইয়ার কাছে। আমার চোখের দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। সিঁড়ির রেলিঙটা শক্ত করে চেপে ধরে থমকে দাঁড়ালাম। একটু নড়লেই গড়িয়ে পড়ব। নিজেকে আটকে রাখা যাচ্ছে না। আমাকে হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে দেখে চোখ ফিরিয়ে চাইল প্রিয়তা। আমার ফ্যাকাশে হয়ে আসা মুখের দিকে চেয়ে আর্তনাদ করে বলল,
‘ কী হয়েছে নিশু? ঠিক আছিস তুই?’
আমি যে ঠিক নেই এই ছোট্ট কথাটুকু প্রিয়তাকে বলা হয়ে উঠল না। দেহের ওজনটা এতোই ভারি লাগছিলো যে আমি আর বহন করতে পারলাম না। শরীরটাকে হাওয়ায় ছেড়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তারপর কী হয়েছিল তা আর মনে করতে পারি না। প্রিয়তার ভাসা ভাসা আর্তনাদ। জমিলা আপার হৈচৈ। কয়েকজন অস্থির মানুষের ছুটোছুটি। হাওয়ায় ভাসতে থেকেও আমার কী নিদারুণ বিরক্তি। ওরা কেন আসছে কাছে? বাবাকে ডাকুক। বড় ভাইয়া কোথায়? কেউ কাছে আসবে না। আমার মা নেই কেন?
#চলবে…..