প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|৩|
ভীষণ বর্ষায় যেমন ঝুপ করেই বৃষ্টি নামে ঠিক তেমনই আচমকা সন্ধ্যা নামে এই শহরে। রাস্তার কোণের ওই প্রেমীযুগলরা ভালোবাসার ঘোর কাটিয়ে হাতে-মুখে লাজুক লাজুক সন্ধ্যা মাখে। আকাশের রঙ পাল্টায়। রঙ পাল্টায় ছোট্ট এই শহরের রূপ। আনন্দমোহনের সামনে জমজমাট আড্ডা বসে। টং দোকানে ফাঁকা হতে থাকে একে একে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ। কেউ-বা সুর তুলে গিটারে। কারো আড্ডায় রমরমা হাসি-গল্পের চাপ। শাড়ি পরা কোনো রূপসীর কোমল হাতটা আচমকাই চেপে ধরে কেউ। দু’জন দু’দিকে মুখ ঘুরিয়ে ধুরুধুরু বুকে হাসে মৃদু মৃদু। তাদের হাসিতে কেটে যায় বিষণ্ণতা। সন্ধ্যা নামক উদাসীনতা! আমি আর প্রিয়তা রেলিং-এ ঠেস দিয়ে সন্ধ্যা দেখি। পোষা কবুতরের ঘরে ফেরা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। মস্তিষ্কে অনবরত চলতে থাকে ধ্রুব-আবিরের জল্পনা! রূপকথার গল্পের মতোই লাগে মস্তিষ্ক ধাঁধানো গল্পটা। গলির মোড়ের ল্যাম্পপোস্টটা জ্বলে উঠে। নিয়ন আলোটা ঝাপটে পড়ে প্রিয়তার ভীষণ ক্লান্ত মুখটিতে। প্রিয়তা ঠোঁট উল্টে বলে,
‘ এই ধ্রুব-আবিরের কেচ্চাটা তো কিছু বুঝতে পারছি না রে নিশু? ব্যাটা আমাদের সাথে কোনো মাইন্ড গেইম টেইম খেলছে না তো?’
আমি ক্লান্ত চোখে চাইলাম। উদাস কন্ঠে বললাম,
‘ বুঝতে পারছি না। লোকটা অদ্ভুত। তার বলা গল্পটাও অদ্ভুত। একই রকম দেখতে দুটো লোক আদৌ সম্ভব?’
প্রিয়তা কিছুক্ষণ তেজি পায়ে পায়চারী করল। ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করল। তারপর ধপ করে বিছানার কোণায় বসে পড়ে বলল,
‘ আমার মনে হয় দু’জনেই এক। নয়তো আমাদের উপর তলায় থাকে তবু কখনো চোখে পড়ল না কেন?’
কথাটা শেষ করেই জ্বলজ্বল করে উঠল প্রিয়তার ভীষণ আদুরে দুটো চোখ। আমার দিকে চেয়ে দুষ্টু দুষ্টু হাসল। আমি ভ্রু বাঁকালাম। ওর এই বিদঘুটে হাসির দিকে চেয়েই সন্দিহান কন্ঠে বললাম,
‘ কী ব্যাপার?’
প্রিয়তা এক লাফে আমার পাশ ঘেঁষে বসল। ঠোঁট টিপে হাসল। টেনে টেনে ডাকল,
‘ নিশু…. ‘
আমার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। ভ্রু বাঁকিয়ে ওর এই হাসির অর্থ বোঝার চেষ্টা করলাম। সতর্ক কন্ঠে বললাম,
‘ দেখ প্রিয়! খবরদার কোনো উল্টাপাল্টা প্ল্যানে আমায় টানবি না। আই অ্যাম নট এবেলএবল।’
প্রিয়তার হাসি চওড়া হলো। চোখে-মুখে তেলতেলে ভাব নিয়ে আরও একটু কাছে সরে এলো। ওর এমন ব্যবহারে হকচকিয়ে গেলাম আমি। কিছুটা সরে বসে চোখ ছোট ছোট করে চাইলাম। প্রিয়তা দাঁত বের করে হেসে বলল,
‘ এমন করছিস কেন সোনা? আমি কী তোর খারাপ চাই? দূর্দান্ত এক প্ল্যান পেয়েছি। তুই শুধু আমার সাথে চল। এই মুহূর্তে রহস্যের উত্থান আর দুধকা দুধ, পানিকা পানি হয়ে যাবে। ট্রাস্ট মি!’
আমি আরও একটু সরে বসলাম। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে শক্ত কন্ঠে বললাম,
‘ অসম্ভব! তোকে বিশ্বাস করার থেকে দুই মিনিট হেঁটে রেললাইনে মাথা দেওয়া উত্তম। তোর দুধকা দুধ আর পানিকা পানি নিয়ে দূর হ। আমার রহস্য উদ্ধারের প্রয়োজন নেই।’
আমার কথায় কাজ হলো না। প্রিয়তা সটান উঠে দাঁড়িয়ে পাড়ার গুন্ডাদের মতো তাকাল। জামার হাতে গোটাতে গোটাতে একটা পা তুলে দিল আমার উরুর পাশে। ওড়নার কোণা টেনে ধরে বলল,
‘ সবসময় ধমক দিয়ে আমায় চুপ রাখতে পারবে না সুন্দরী। রহস্যে রহস্যে মাথাটা ফেঁটে যাচ্ছে আমার। ভাত হজম হচ্ছে না। প্রেমিকের প্রেমময় কথা অসহ্য লাগছে। আকাশকে মাটি আর মাটিকে আকাশ লাগছে। দুনিয়ার সব কিছু কেমন ধ্রুব-আবির, ধ্রুব-আবির দেখছি। তুই যদি আমাকে সাহায্য না করিস তবে তুই শেষ। ডিপজলের মতো এক্কেরে মলম লাগিয়ে ছেড়ে দিব। উপরতলায় গিয়ে ডিরেক্ট দুলাভাই দুলাভাই বলে চিল্লাচিল্লি জুড়ে দিব। মাইন্ড ইট!’
আমি হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলাম। প্রিয়তা আমার মুখের উপর ঝুঁকে এসে বলল,
‘ যাবি কি-না বল!’
আমি একরকম বাধ্য হয়েই মাথা নাড়লাম। প্রিয়তা আমার অনুমতি পেয়েই আনন্দে ভেসে গেল। আমাকে ঝাপটে ধরে গালে জোরে একটা চুমু দিয়ে বলল,
‘ উফ! তুই কত্তো ভালো রে নিশু! গুড গার্ল।’
আমি ডানহাতের উল্টো পিঠে গাল মুছে চোখ-মুখ কুঁচকে চাইলাম। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললাম,
‘ মহিলা ডিপজল।’
আমার কথায় প্রিয়তার মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে আমাকে বগলদাবা করে মনের সুখে পাঁচ তলায় উঠে গেল। কিন্তু পাঁচতলার দরজার সামনে আসতেই সব কনফিডেন্স ফুঁস হয়ে গেল তার। ফট করে কলিং বেলটা চেপে দিয়েই আমার দিকে চাইল। অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ নিশু রে? বাড়িওয়ালী যে দজ্জালী! কেন এসেছি জিগ্যেস করলে কী বলব? আমাদের যদি পাঁচ তলা থেকে পটাক করে ফেলে দেয়? হায় আল্লাহ! আমার হার্ট এমন ধুরুধুরু করছে কেন? আমি বোধহয় আর বাঁচব না। হে আল্লাহ! হে খোদা! আমি এখনই মরতে চাই না। আমি সদ্য শিশু। অবলা নারী। বিয়েশাদী কিছু করি নাই। আমি এখনই মরে গেলে আমার বাচ্চাদের কী হবে? নিশু? দরজা খুললে সব দোষ তোর। আমি কিছু জানি না।’
প্রিয়তার আকস্মিক নাটকে তাজ্জব বনে গেলাম আমি। চোখ কটমট করে তাকালাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। মুখের সামনের দরজাটা হঠাৎ খুলে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল থমথমে লম্বাটে এক মুখ। প্রিয়তা চট করে আমার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। আমি কী করব ভেবে না পেয়ে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রিয়তা! পৃথিবীর সবচেয়ে অসভ্য মেয়েটা পেছন থেকে আলতো করে সালাম দিয়ে বাকি কাজটুকুও সেরে ফেলল। ভীষণ লক্ষ্মীটি হয়ে বলল,
‘ আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। কেমন আছেন? নিশু আপনাকে কিছু বলতে চায়।’
আমি এবার অকূল পাথারে পড়লাম। ভদ্রলোকের ভীষণ রাগী, গম্ভীর মুখটা দেখে আমার বাবার নামটা পর্যন্ত ভুলে গেলাম। মনে মনে প্রিয়তাকে অজস্র চড় দিয়ে আমতা আমতা করে বললাম,
‘ আঙ্কেল ছাদের চাবিটা দেওয়া যাবে? চাবিটা দরকার।’
এতটুকু বলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। জীবনীশক্তির অর্ধেকটা ধ্বংস করে বাকিটুকুকে সম্বল করে চুপচাপ চেয়ে রইলাম। ভদ্রলোকের মুখখানা রাগী রাগী হলেও মোলায়েম কন্ঠে বললেন,
‘ রাতের বেলায় ছাদে যাওয়া ঠিক নয়। আর কখনো যাবে না। দাঁড়াও আনছি।’
আমি মাথা হেলিয়ে ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করলাম। ভদ্রলোক সামনে থেকে সরে যেতেই প্রিয়তা আফসোস নিয়ে বলল,
‘ আহহা! কাহিনী তো উল্টে গেল রে নিশু? আমি তো ভেবেছিলাম বাংলা সিনেমার মতোই নায়ক এসে দরজা খুলবে। নায়িকাকে দেখে চুল উড়বে। কল্পনায় ঘুরবে। আমি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দেওয়ার বাহানায় নায়ককে চেপে ধরে বলব, আরেক নায়ক কই? বের করবি নাকি খতম?’
প্রিয়তার কথায় চোখ মুখ লাল করে চাইলাম আমি। পুরস্কার স্বরূপ তার পিঠে চমৎকার এক চড় বসিয়ে দিয়ে বললাম,
‘ শাট আপ!’
প্রিয়তা ‘শাট আপ’ হলো। কিন্তু পরিস্থিতি ‘শাট আপ’ হলো না। আমার হাঁটুর সাইজের এক বাচ্চা কৌতূহলী চোখে চেয়ে বলল,
‘ আমি নায়ক। নায়ক চিওমিও।’
প্রিয়তা আর আমি ভ্রু বাঁকিয়ে চাইলাম। প্রিয়তা চোখ-মুখ কুঁচকে হাঁটুতে হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়াল। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘ চুচু?এটা আবার কেমন নাম?’
ছেলেটি গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ চুচু না। চিওমিও।’
প্রিয়তা চিওমিওকে খুব একটা পাত্তা দিল না। তার বাহু ধরে হেঁচকা টানে তাকে কাছে এনে বলল,
‘ এই চুচু, এই বাসায় ধ্রুব থাকে?’
বাচ্চাটা এবার আরও গম্ভীর হলো। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ভ্রু কুঁচকাল,
‘ তোমায় কেন বলব?’
প্রিয়তা বাচ্চাটার ডান গালটা শক্ত করে টেনে দিয়ে বলল,
‘ কারণ তুমি নায়ক। নায়কদের সব বলে দিতে হয়। বলো তো চিওচিও সোনা? ধ্রুব তোমার কী হয়?’
বাচ্চাটা প্রিয়তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। ধমক দিয়ে বলল,
‘ আমাকে চিওচিও বলবে না।’
প্রিয়তা মুখ ভেঙিয়ে বলল,
‘ একশো বার বলব। ধ্রুব কে, বলো? নয়তো শুধু চিওচিও না চিওপিও বলেও ডাকব।’
বাচ্চাটা উত্তর দিল না। সেই ভদ্রলোককে চাবি হাতে দরজার কাছে আসতে দেখেই গগনবিদারী চিৎকার করে উঠল। ধপ করে ফ্লোরে বসে একরকম গড়াগড়ি জুড়ে দিল। আমি আর প্রিয়তা চমকে উঠলাম। এই বাচ্চা যে প্রিয়তার থেকেও নাটকবাজ তা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক হতভম্ব হলেন তার থেকেও বেশি। বাচ্চাটা গগনবিদারী চিৎকারে সেকেন্ড কয়েক বিরতি দিয়ে কান্নার কারণ জানাল। বলল, ‘আমায় মেরেছে’। তারপর আবারও জুড়ে দিলো সেই চিৎকার। ভদ্রলোক অবাক হয়ে আমাদের দিকে চাইলেন। প্রিয়তার তখন কাঁদো কাঁদো অবস্থা। অসহায় চোখে ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করল। বলল,
‘ চাবি লাগবে না আঙ্কেল। আপনার কাছেই থাক। ও একা একা পড়ে গেছে। আমরা কিছু করিনি। কসম!’
কথাটা বলে এক সেকেন্ড দেরী না করেই ‘আসি’ বলে ফিরতি পথ ধরল প্রিয়তা। আমি কয়েক সেকেন্ড হ্যাবলাকান্তের মতো চেয়ে থেকে দ্রুত সিঁড়ি পেরুলাম। নিজেদের ঘরে এসে এক রকম কানে ধরে ফেললাম,
‘ যায় হয়ে যাক না কেন? এই ধ্রুব-আবির সংক্রান্ত কোনো ঝামেলায় আর জড়াব না। পৃথিবী উল্টে গেলেও না।’
কিন্তু আমাদের প্রতিজ্ঞা বেশিক্ষণ টিকল না। পরের দিন ক্লাসে যেতেই ভয়াবহ এক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। সবাই কেমন অদ্ভুত চোখে চেয়ে আছে। এদিকওদিক ফিসফাস আলোচনা চালাচ্ছে। তার থেকেও অদ্ভুত বিষয় বিভিন্ন ক্লাস থেকে সিনিয়ররা এসে এসে জানতে চাইছে, ‘নিশু নামের মেয়েটা কে?’ ক্লাসের ছেলেপুলে হাত উঁচিয়ে আমায় দেখিয়ে দিচ্ছে। সিনিয়ররা আমায় আগাগোড়া দেখে নিয়ে হৃষ্টচিত্তে আলোচনা করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আমি আর প্রিয়তা কিচ্ছু বুঝতে না পেরে ভ্যাবলাকান্তের মতো বসে আছি!
#চলবে…..
( তপোবনে যখন সন্ধ্যা নামে হাফ লিখে রেখে দিয়েছি। প্রেমকথনও অর্ধেক লিখা। সব গল্প একসাথে লিখে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আলসেমির জন্য পারছি না। কিন্তু আপনারা তো মশাই আমার থেকেও অলস। রিয়েক্ট, কমেন্ট করতেও আলসেমি! এসব মানা যায়? মন খারাপ হয় না? এসব দেখলে আরও অলসতা বাড়ে না?)