#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৮
ঘোড়ার গাড়িটা হঠাৎ বড় একটা পুরনো বাড়ির সামনে এসে থামলো। পারিজা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজায় কড়াঘাত করতেই দরজা খুলে বাড়ির ঝি বেরিয়ে এলো। পারিজা ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
— আম্মা কোথায়?”
ঝি আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে উত্তর দিলো,
— বড় আম্মা মুর্শিপাড়ার ওখানে গেছেন।”
পারিজা বাড়ির ভেতরে ঢুকে বললো,
— কবে আসবে আম্মা? ”
ঝি উত্তর দিলো,
— কালই তো গেল। দিন দুয়েকের মতো থাকবেন।”
পারিজা কথার প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
— আচ্ছা, তুমি রান্নাবান্না করে রেখে চলে যেও। আমি আজ এখানে থাকবো।”
ঝি মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। পারিজা ধীর পায়ে ওপরে উঠলো। আম্মাকে দেখার সাধটুকু আর পূরণ হলো না!মুর্শিপাড়ায় বেনী মাসীর বাড়ি। বেনী মাসী পারিজার আম্মা তৃণ মালার সহকর্মী ছিলেন। তিনিও একটা সময়ে পতিতাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবশ্য তিনি সেই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন৷ এখন মানুষের বাড়িতে ঝি এর কাজ করে জীবন চালান। বড্ড ভালো মানুষ তিনি। পারিজাকে ছোটবেলায় খুব আদর করতেন।
পারিজা দোতলার সামনের ঘরটায় গিয়ে বসলো। এই ঘরে পারিজার আম্মা তৃণ মালা থাকেন। পারিজা পালঙ্কে হেলান দিয়ে বসতেই পারিজার সামনে পুরনো স্মৃতি ভেসে উঠলো। পারিজা অশ্রুমাখা দৃষ্টিতে বেলকনির দিকে তাকালো। বাতাসে বারবার বেলকনির সামনের দরজাগুলো বারি খাচ্ছে। থমথমে আকাশ আর তীব্র বাতাসে চারপাশ তছনছ হয়ে যাচ্ছে। পারিজা বেলকনির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আকাশের অবস্থা বেশি সুবিধার নয়। বৃষ্টি হবে যেকোনো মুহূর্তে। রাস্তায় লোকজনেরা দৌড়াদৌড়ি করে বাড়ি ফিরছে। বৃষ্টির আশংকায় রাস্তার পাশে বসা সন্দেশ ওয়ালাও দোকান মুড়িয়ে পালাচ্ছেন। পারিজা প্রগাঢ় হাসলো। ছোটবেলায় সে সন্দেশের জন্য কতই বায়না করেছে নিজের মায়ের কাছে! সন্দেশ না দিলে দুপুরে কিছুই খাবে না সে। আম্মার সঙ্গে কোনো কথাও বলবে না। পারিজার খুব ইচ্ছে হলো আম্মার সঙ্গে দুটো গল্প করার। আম্মা যে আজ বাড়ি নেই। কেন যে আর একটা দিন আগে ওয়াহেদের সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হলো না! একটা দিন আগে আসলেই আম্মাকে এক নজর দেখা যেতো। ওয়াহেদের কথা মনে আসতেই পারিজা কষ্টে চোখ বুজলো। ওয়াহেদ কখনোই এখানে তাঁকে নিতে আসবে না। হয়তোবা বাড়িতে একবার খুঁজবে তাঁকে। তারপর মায়ের কথায় রাজি হয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে। কখনোই তাঁর আর ওয়াহেদের সঙ্গে দেখা হবে না ভেবে পারিজার খুব দুঃখ হলো। নতুন একটা মানুষের সঙ্গে সংসার সাজানোর একটা সুন্দর স্বপ্ন ছিল তাঁর। সেই স্বপ্নটা এভাবে ভেঙে গেল কেন? সংসারের সঙ্গে মিষ্টি সম্পর্কের বদলে যন্ত্রণার সম্পর্ক গড়ে উঠলো কেন? বাড়ির মানুষগুলোর কথায় বুকে পাথর ঠেকেছিল পারিজার।কোথাও একটু শান্তি নেই। ওয়াহেদ সান্ত্বনার বদলে কষ্ট দিয়েছিল শুধু। কোথাও তিল পরিমাণ খুশি নেই! সৃষ্টিকর্তা এমন দিন দেখালো কেন?
বাইরে ঝড় হাওয়ার বৃষ্টি নেমে এলো। পারিজা ছাঁদের দরজা খুলে চিলেকোঠার ঘর পেরিয়ে ছাঁদে ঢুকলো। ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভিজে পারিজার সেকি জ্বর!আম্মা পারিজার মাথায় জলপট্টি দিয়েছিলেন। আদর করে ভাত মেখে খাইয়ে ছিলেন। পারিজা তৃণলতার খুব আদরের সন্তান। বড় হওয়ার পরও জীবনে ভাত মেখে খেয়েছে কিনা সন্দেহ। এই সংসার জীবনে প্রবেশের পরপরই পারিজা এতকিছু শিখেছে। নাহলে,পারিজা কখনো গরমে পুঁড়ে রান্না করেছে? তৃণলতা নিজের শেষ অবলম্বন নিজের মেয়েকে অতি আদরে মানুষ করেছেন। মার তো দূরে থাক জীবনে একটা কটুকথাও বলেননি। চাওয়ার আগেই সব জিনিস হাজির করেছেন।
পারিজার চক্ষুজল আর বৃষ্টির জল একত্রিত হয়ে আজ নতুন জলের সৃষ্টি করলো। পারিজার চোখেমুখে কষ্টের ছাঁপ।একাকিত্ব, মনে কষ্টের আঘাত তাঁর ছোট্ট হৃদয়ে ছিন্ন বিছিন্ন করে দিলো। পারিজা ভেজা শরীরে এক এক ধাপ করে সিঁড়িতে পা দিলো। আর বৃষ্টিতে ভিজবে না সে। বৃষ্টির প্রতিটি ফোটা তাঁকে দ্বিধাহীন ভাবে কষ্ট দিচ্ছে। এত কষ্ট সহ্য করার মতো ক্ষমতা নেই তাঁর। পারিজা ভেজা শরীরেই পালঙ্কে গিয়ে চোখ বুজলো। বহুদিন পরে একটা শান্তির ঘুম দিলো।
পারিজা যখন চোখ খুললো দেখলো তাঁর সারা শরীর আগুনের মতো দাউদাউ করে জ্বলছে। পারিজা ধীরে ধীরে উঠে বসলো। গায়ের ভেজা কাপড়টা শরীরের উত্তাপে খানিকটা শুকিয়ে গেছে। পারিজা মাথা ওঠাতে পারলো না। পুরো ঘর যেন গোল গোল হয়ে ঘুরছে। পারিজা বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ালো। একটু একটু করে সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করলো। হঠাৎ শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পরলো। ঘাড়ের নরম অংশটা সিঁড়ির কোনার সঙ্গে লেগে কিছুটা র/ক্তপাত হলো।পারিজার চোখ একটু একটু করে বন্ধ হয়ে আসছে। পারিজা অসুস্থ শরীরে কল্পনা করলো। ওয়াহেদের ধুমধাম করে বিয়ে হচ্ছে। অচেনা একটা মেয়ের সঙ্গে ওয়াহেদ মুচকি মুচকি হাসছে। পারিজার চোখ এবার অনেকটাই বন্ধ হয়ে এলো। এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো চোখ থেকে। ঝাপসা চোখে পারিজা শুধু দেখলো ওয়াহেদ নতুন একটা মেয়ের হাত ধরে হাঁটছে। পারিজা তীব্র আক্ষেপে চোখ বন্ধ করলো।একবার তাঁর মনে হলো ওয়াহেদ তাঁকে নিতে এসেছে। পরক্ষনেই পারিজার ওয়াহেদের বলা কাল রাতের কথাগুলো মনে পরলো। ওয়াহেদ তাঁকে কখনোই নিতে আসবে না।এক পতিতা কন্যার জন্য ওয়াহেদের কোনো ভালোবাসা নেই। আছে শুধু কটু কথা আর কষ্ট। ওয়াহেদ তাঁকে ভালোবাসে না!
চলবে….