শ্রেয়সী
লেখাঃখাইরুন নেছা রিপা
পর্বঃ৩৫
সোহেল মহিলার কণ্ঠস্বর শুনেই সিঁড়িতে এসে দাঁড়ালো। ঠোঁটে একটা ঝুলন্ত হাসি নিয়ে বললো,
–আসসালামু আলাইকুম চাচি।”
–ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো বাবা?”
–এই তো চাচি আপনাদের দোয়ায় ভালোই।”
–তা কখন আইছো? ”
–গতকাল রাতে আসছি।”
–এখন কই যাও?”
–একটু বের হবো।”
–ওহ্। তা ঘরে কেউ আছেনি? রিদি, বউ ওরা কই?”
–ওরা ঘরেই আছে। তবে আম্মা বাড়িতে নেই। ঘরে আসেন।”
–হুঁ একটু দরকার ছিলো।”
সোহেল স্পষ্ট বুঝতে পারলো মহিলা ঘরে ঢুকবে। সোহেল তাড়াহুড়ো দেখিয়ে বললো,
–চাচি আপনি ঘরে যান আমি গেলাম।”
কথাটা শেষ করেই লম্বা লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি থেকে উঠানে পা রাখলো। মহিলা ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে দৌড়ে এসে বিন্দুকে ধরলো।
–এই বউ কী হইছে তোমার?”
পরক্ষণেই ঘরের বাহিরে গেল সোহেলকে ডাকার জন্য কিন্তু সোহেলের চিহ্ন মাত্রও দেখা যাচ্ছে না আবারও দৌড়ে তিনি ঘরে আসলেন রিদিকে বার কয়েক জোরে জোরে ডাকলেন তবুও কোনো সাড়া মিললো না। শেষমেশ কোনো উপায় না দেখে উনি জগ থেকে পানি এনে বিন্দুর মাথায় দিলেন তবুও কোনো সাড়াশব্দ নেই বিন্দুর। উনি যে বিন্দুকে উঠিয়ে বিছানায় শোয়াবেন তাও সম্ভব হচ্ছে না। মহিলা একরকম দুশ্চিন্তায় হাঁসফাঁস করতে লাগলেন। এই অবস্থায় বিন্দুকে ফেলেও যেতে পারছেন না। শিশির বেশ ফুরফুরে মেজাজে বাড়ির উঠোন অব্দি বাইক নিয়ে প্রবেশ করলো। দরজাটা হাট করে খোলা। দরজা খোলা দেখেই মুখটা চুপসে গেল শিশিরের। সচারচর শিরিনা বেগম দরজা খোলা রাখেন না। কারণ আজকাল এমনিতেই চোর-ডাকাতি অহরহ হয়ে থাকে। আর তাছাড়া শিশিরদের একলা বাড়ি। শিশির দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকলো। কে জানতো এত বড় একটা দুঃসংবাদ ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো। শিশিরের হাত থেকে ফুসকার প্যাকেটটা নিচে পড়ে গেল। দৌড়ে এসে বিন্দুকে কোলে তুলে নিলো। খাটে শোয়াতে শোয়াতে বললো,
–আন্টি কী হয়েছে ওর? এভাবে ঠোঁট -কপাল ফাঁটলো কী করে? ”
–আমি কিছু জানি না বাবা। আমি এসেছি একটু হলুদ নিতে। আর তখনি দেখা হয় রিদির জামাইয়ের সাথে। ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম কেউ বাড়িতে আছে নাকি। উনি বললো রিদি বউ দু’জনেই আছে। তোমার মা নাকি ঘরে নাই। আর ঘরে ঢুকে দেখি এই অবস্থা। অথচ রিদি কোথাও নেই।”
শিশিরের আর কিছু বুঝতে অসুবিধা হলো না। তাড়াতাড়ি ফোন করলো পাশের বাড়ির আটো ড্রাইভারকে। এখন এ্যাম্বুলেন্সলের জন্য অপেক্ষা করা যাবে না। শিশিরের পাগলের মতো করছে একরকম। রাস্তা অব্দি বিন্দুকে কোলে করে নিয়ে গেল। তখনও অচেতন অবস্থায় রয়েছে বিন্দু। যাওয়ার আগে ওই মহিলাকে বলে গেল,
–আন্টি পারলে কাউকে দিয়ে একটু মাকে তাড়াতাড়ি ডেকে আনার ব্যবস্থা করেন।”
–আচ্ছা বাবা চিন্তা করো না। তুমি আগে বউমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়া যাও। এমনিতেই বউর এই অবস্থা আল্লাহ না করুক কিছু যেন না হয়।”
কথাটা শুনেই ভয়টা আরও জেঁকে বসলো। এমনিতেই গতকাল রাতে ভয়ানক এক স্বপ্নে ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো বিন্দুর যদি কোনোভাবে সেই ভয়ংকর স্বপ্ন ফলে যায় তখন কী হবে আর ভাবতে পারছে না শিশির। শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে। হাঁটু ভেঙে আসছে এক কদমও সামনে এগুতে পারছে না। শিশির রাস্তায় পৌঁছতেই ড্রাইভার চলে এল।
–কাকা তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে চলুন।”
ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছে শিশির। একবার কেবিনের কাছে এগিয়ে যাচ্ছে তো পরক্ষণে আবার একটা চেয়ারে এসে বসছে। কিছুতেই যেন শান্তি লাগছে না। অন্যদিকে আজ স্কুলে পরীক্ষা অথচ প্রশ্নগুলোও বাড়িতে। বিপদ আসলে সব দিক থেকেই আসে। সবসময় কাজের প্রতি শিশিরের দায়িত্বের ত্রুটি থাকে না। আর তাছাড়া তার জন্য তো পরীক্ষা বন্ধ হয়ে থাকতে পারে না। সেই মুহূর্তেই শিশিরের ফোনে কল করলো প্রিন্সিপাল স্যার।”
–আসসালামু আলাইকুম।”
–ওয়ালাইকুম সালাম। শিশির আর কতদূর তোমার।”
–স্যার আমি দুঃখিত। একটা অঘটন ঘটে গেছে।”
–কী হয়েছে?”
সংক্ষেপে শিশির পুরো ঘটনাটা বললো।
–তোমাদের আরও কেয়ারফুল থাকা উচিত ছিলো। যাই হোক টাকা-পয়সা লাগলে আমাকে জানিও।”
–স্যার আমি প্রশ্নগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
–আসলে শিশির আমিও দুঃখিত। পরীক্ষা না থাকলে সমস্যাই ছিলো না।”
–স্যার আমি বুঝতে পারছি। আমি একজন অটো ড্রাইভারকে দিয়ে প্রশ্নগুলো পাঠাচ্ছি আপনি প্লিজ একটু কষ্ট করে গেটের কাছে থাকবেন।”
–ওকে। তুমি চিন্তা করো না।”
শিশির ফোন রেখেই অটো ড্রাইভারকে বললো,
–চাচা কষ্ট করে আপনাকে একটু বাড়িতে যেতে হবে। মাকে গিয়ে বলবেন আমার ল্যাপটপের টেবিলের ড্রয়ারে কতগুলো প্রশ্ন আছে ওগুলো আপনাকে দিতে।সেগুলো নিয়ে আপনি আমারস্কুল তো চিনেন? সেখানে চলে যাবেন। দরজার সামনে একজন স্যার থাকবেন। ওনাকে প্রশ্নগুলো দিয়ে দেবেন।”
–আচ্ছা তুমি চিন্তা কইরো না।”
ডাক্তার বিন্দুর কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,
–কীভাবে হলো এসব? মনে হয় তো ওনাকে কেউ মেরেছে।”
–কে হন আপনি ওনার?”
–হাজবেন্ড!”
–এই অবস্থায় এসব কাজ কীভাবে করলেন? এই অবস্থায়ও বউয়ের গায়ে হাত তুলতে হয়? তাহলে কেন নিয়ে এসেছেন এখানে মরে গেলে যেত।”
শিশির লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। ডাক্তার কী ভুলটাই না বুঝলো। শিশির আমতা আমতা করে বললো,
–ডক্টর সব ঠিকাছে তো?”
–আলট্রাসনো করাতে হবে এখন কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। এভাবে বউয়ের গায়ে হাত তুলতে লজ্জা করে না আপনাদের? কেমন পুরুষ আপনারা? নিজেদের পুরুষত্ব দেখানোর জন্য মেয়েদের গায়ে হাত তুলেন।”
শিশির চুপচাপ অপরাধীর মতো সব কথা হজম করে নিলো। কিছুই যে তার বলার নেই। ঘরের কথা বাহিরে বললে হাসির পাত্র ছাড়া আর কিছুই হবে না। আলট্রাসনো করানোর আগেই জ্ঞান ফিরলো বিন্দুর। শিশির বিন্দুর কাছে যেতেই বিন্দুর চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। শিশিরের কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। শুকনো মুখে গিয়ে দাঁড়ালো বিন্দুর সামনে। তখনও বিন্দু অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। শিশিরের ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে। শুধু বিন্দুর পাশে বসে মাথায় হাতের পরশ বুলিয়ে দিলো। আলট্রাসনো করানোর পর শিশির রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললেন,
–ইমার্জেন্সি সিজার করাতে হবে। বাচ্চার পজেশন ঠিক লাগছে না।”
কথাটা শুনে আরও ভয় গেড়ে বসলো মনে।
একজন নার্স এসে ব্লাড টেস্ট করে জানালো ‘ ও নেগেটিভ’ রক্ত লাগবে। এই মুহূর্তে শিশিরের শরীরটা শুধু কাঁপছে। কী হবে না হবে ভেবে ভেতরে ভেতরে দুমরে-মুছরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। একজন মানুষও নেই পাশে এসে সাহস দেওয়ার মতো। তখনই মনে হলো সাজেদা বেগমের কথা। তখনই ফোন করলো।
–মা আপনি প্লিজ হসপিটালে চলে আসুন ২০৩ নাম্বার কেবিনে আছি আমরা।”
–কী হয়েছে শিশির? বিন্দুর ডেলিভারি তো এত তাড়াতাড়ি হওয়ার কথা না।”
শিশির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
–মা আমি এখন কিচ্ছু বলার মতো অবস্থায় নেই। পারলে একটু তাড়াতাড়ি আসুন।”
শিশিরের উদ্ভট কথাবার্তায় ভয় পেয়ে গেলেন সাজেদা বেগম। সঙ্গে সঙ্গে বিধুকে ফোন করলেন,
–হ্যাঁ মা বলো?”
–বিন্দুর অবস্থা মনে হয় ভালো না। শিশির ফোন করেছে। তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আয়। স্যারের থেকে ছুটি নিয়ে আসিস। বুয়াও বাসায় আছে আমি এক্ষুণি বের হবো। ”
বিধুকে আর কিছু না বলেই ফোন কেটে দিলেন সাজেদা বেগম এরপর ফোন করলেন সাহেদ আলীকে।
–হ্যাঁ বলো?”
–আপনি পারলে একটু হসপিটালে আসুন। বিন্দুকে ওখানে নেওয়া হয়েছে।”
–আচ্ছা আমি আসছি।”
শিশির উদ্ভান্তের মতো করছে। এখানে -ওখানে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইছে ‘ও নেগেটিভ ‘রক্ত আছে কি না। তখনই হাসপাতালে পৌঁছলেন শিরিনা বেগম। মাকে দেখেই শিশির কাঁদো কাঁদো মুখে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শিরিনা বেগম উত্তেজিত হয়ে বললেন,
–বিন্দু কোথায়? কী অবস্থা ওর?”
–ভালো নেই মা। ডাক্তার বলেছেন ইমার্জেন্সি সিজার করাতে হবে। ওর ব্লাড গ্রুপ ও নেগেটিভ। কয়েক জায়গায় খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না।”
–আমারই তো ও নেগেটিভ। ভুলে গেলি তুই?”
শিশির যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। পরক্ষণেই মুখটা কালো করে বললো,
–মা তোমার স্বাস্থ্যই তো ভালো না। এই অবস্থায় তুমি কী করে রক্ত দেবে?”
শিরিনা বেগম ধমক দিয়ে বললেন,
–আমার অবস্থা অতটাও খারাপ না। তুই আগে ওনাদের জানা।”
শিশির সঙ্গে সঙ্গে নার্সকে গিয়ে জানালো। ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই বিন্দুকে ওটিতে নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে বিন্দু শুধু অসহায়ের মতো শিশিরের দিকো তাকিয়ে রইলো। শিশিরের তখন দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এগিয়ে গিয়ে শুধু একটু বিন্দুর হাতটা ধরলো। চোখের ঈশারায় ভরসা দিলো।
“ভয় পেও না পাগলী,আমি আছি তো তোমার পাশে!”
আমি অসুস্থ তাই লিখতে পারিনি। না হলে আরও বড় করে দিতাম?।
চলবে,,,