শ্রেয়সী
লেখাঃKhayrun Nessa Ripa
পর্বঃ৩১
শিশির ঠিক দেড়টায় বাড়ি পৌঁছালো। তাড়াতাড়ি দরজার লক খুলে ঘরে প্রবেশ করলো। ডাইনিংয়ে খাবারগুলো রেখেই দ্রুত পায়ে নিজের বেডরুমে ঢুকলো। পুরো ঘেমে নাজেহাল অবস্থা বিন্দুর। বিদ্যুৎ নেই। এই গরমের মধ্যে কিভাবে যে শুয়ে আছে মেয়েটা। শাড়িও সব এলোমেলো। পুরো মুখ, গলা সব ঘামে ভিজে গেছে। শিশির তাড়াতাড়ি হাত পাখাটা খুঁজে অনেকক্ষণ বাতাস করলো৷ বেশ খানিকক্ষণ পর বিদ্যুৎ আসলো৷ শিশির হাত পাখাটা রেখে পরনের শার্ট আর প্যান্ট পাল্টে একটা লুঙ্গি আর টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে আসলো। টাওয়ালে হাত-মুখ মুছে লম্বা হয়ে বিন্দুর পাশে শুয়ে পরলো। শিশিরেরও খুব ঘুম ঘুম পাচ্ছে। গতকাল রাতে এতটা টেনশনের ভেতর ছিলো যে তেমন একটা ঘুমাতেই পারেনি। বিন্দুকে এক টানে নিজের বুকের মাঝে নিয়ে আসলো। বিন্দুও গুটিশুটি হয়ে শিশিরের বুকের মাঝে ঢুকে পরলো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো,
–এই বুঝি আপনার আসার সময় হয়েছে? আমি সেই কখন থেকে আপনার জন্য ওয়েট করছিলাম।”
শিশির বিন্দুর চুলের ভাঁজে মুখ ঢুকিয়ে বললো,
–সত্যিই! ”
–হুঁ।”
–আচ্ছা এখনও কী ঘুমাবে?”
–হুঁ।”
–কিন্তু আমার যে খিদে পেয়েছে তার কী হবে?”
–আপনি খেয়ে আসুন।”
–তুমি খাবে না?”
–উঁহু, আজ শুধু ঘুমাবো। নো খাওয়া-খাওয়ি।”
শিশির টেনে তুললো বিন্দুকে। চোখে-মুখে অনেকগুলো চুমু এঁকে দিলো।
–এখন নো ঘুমা-ঘুমি। আগে খাওয়া-খাওয়ি৷ তারপর ঘুমা-ঘুমি।”
বিন্দু শিশিরের গায়ের ওপর ঢুলুঢুলু করে পরছে। শিশির কোলে করে বিন্দুকে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল। বেসিনের সামনে বিন্দুকে দাঁড় করিয়ে দিলো।
–উফ এখানে কেন নিয়ে আসলেন?”
–হাত-মুখ ধুয়ে নাও৷ আগে খাবে তারপর ঘুমাবে৷ সকালেও তো শুধু একটা পরটা খেয়েছো। এত কম খেলে কী করে হয় বলো তো?”
বেশ চলছে দিনগুলো। বিন্দুর শক্ত মন বোধহয় একটু একটু করে নরম হচ্ছে। শিশিরের দৈনিক অভিযান তার বউয়ের শক্ত হৃদয়ে একটুখানি জায়গা করে নেওয়া৷ অবশ্য এতে শিশিরের কোনো তাড়া নেই৷ কারো ভালোবাসা অর্জন করতে হলে একটু পরিশ্রম তো করতেই হয়। না চাইতেই যে ভালোবাসা পাওয়া যায় তার মধ্যে আলাদা কোনো অনুভূতি থাকে না। থাকে না কোনো জয়। একটু একটু করে কারো সান্নিধ্যে আসা, তার পুরোটা বুঝতে পারা, তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া। এভাবেই তো একটা মানুষের কাছে যাওয়া যায়। তার হৃদয়ে একটু ঠাঁই পাওয়া যায়। হুঁট করে কোনো কিছু পাওয়ার মধ্যে কোনো স্বার্থকতা নেই। জীবনে কোনো কিছু পেতে গিয়ে যদি অনেকটা কষ্ট করতে হয়, অনেক ত্যাগ করতে হয় তবেই তো তার মধ্যে স্বার্থকতা লুকিয়ে থাকে। যা তার জীবনে আশির্বাদ স্বরুপ ধরা দেয়। শিশিরও সেই স্বার্থকতা অর্জন করতে চায়৷ জোর করে বিন্দুর ভালোবাসা কখনোই সে আশা করে না। তবে মনে-প্রাণে যেটা আশা করে সেটা হলো বিন্দু যেন এবারে সত্যি মা হতে পারে। এটা শুধুমাত্র শিশিরের একার জন্য না সবার জন্যই হবে সবচেয়ে বড় সুখের খবর হবে। এখন শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা তার আগে কিছুই বোঝার উপায় নেই।
এভাবেই কেটে গেল দেড়টা মাস। এর মধ্যে রিদিরও বিয়ে হয়ে গেছে। কোরবানির ঈদও শেষ। সব মিলিয়ে বেশ ভালোই যাচ্ছে বিন্দুর দিনগুলো। কিন্তু এখনো সেইভাবে বিন্দুর শিশিরকে ধরা দেয় না। অবশ্য এতে শিশিরেরও কোনো আফসোস নেই। বিন্দু যেদিন নিজে থেকে শিশিরের প্রাপ্যটা শিশিরকে দেবে সেদিনই শিশির গ্রহণ করবে। তবে ওই রাতে বিন্দুর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার একটাই কারণ আর সেটা হলো শুধু মাত্র বিন্দুকে ভালো রাখা। যাতে এবারে সত্যি সত্যিই বিন্দু মা হতে পারে। যাতে বিন্দু ভেঙে না পরে। বিন্দুকে ভালো রাখা, এমনকি নিজের সবটা দিয়ে ভালো রাখতে সর্বদা প্রস্তুত থাকবে শিশির।
বিয়ের আগে কথা ছিলো রিদি এইচএসসি পরীক্ষা না দেওয়া অব্দি নিজেদের বাড়িতেই থাকবে। আর সেই কথা অনুযায়ী রিদি নিজের বাড়িতেই থাকছে। তবে বড় অনুষ্ঠান সব হয়ে গেছে। রিদি দু’বার শ্বশুর বাড়িও গিয়েছে। মাঝে মাঝে রিদির হাজবেন্ড এসে বউকে দেখে যায়। দু’একদিন থাকে আবার চলে যায় নিজের কাজে। নতুন বিয়ে উপলক্ষ্যে একটু ঘন ঘনই ছুটি কাটাচ্ছে।
বিন্দুর শরীরটা ইদানিং খুব খারাপ যাচ্ছে। মাছ-মাংসের আঁশটে গন্ধ নাকে আসতেই খালি বমি পায়। একদম খেতে পারে না। শিরিনা বেগম ব্যাপারটা লক্ষ্য করেই শিশিরকে নিজের রুমে ডাকলেন। শিশির সবে স্কুল থেকে এসেছে। বিন্দু নিজের রুমেই শুয়ে ছিলো।
–হ্যাঁ মা বলো? কী বলবে? রাত তো অনেক হয়েছে আর খুব ক্ষুধাও লেগেছে। যা বলবা তাড়াতাড়ি বলো।”
–তুই একাই খাবি? বিন্দুও তো এখনো খায়নি।”
–সে কী? ও এখনো খায়নি কেন?”
–ওর নাকি খেতে ইচ্ছে করছে না। বললো, তুই আসলে নাকি খাবে। আচ্ছা চল দু’জনে আগে খেয়ে নে। পরে কথা হবে।”
–হুঁ।”
শিশির রুমে এসে বিন্দুর পাশে বসলো। মাথায় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–খুব খারাপ লাগছে?”
বিন্দু শুধু ডানে-বামে মাথা দুলিয়ে না বললো।
–এখন ওঠো কিছু খেয়ে নাও।”
–আমার একটুও খেতে ভালো লাগছে না। আপনি খেয়ে নিন।”
–উঁহু, আমি একা খাব না৷ তুমিও খাবে আমার সাথে।”
বিন্দুকে টেনেটুনে নিয়ে গেল শিশির খাওয়ার টেবিলে৷ তেমন কিছুই খেতে পারলো না৷ শিশির খাওয়া শেষ করে এগুলো মায়ের রুমের দিকে।
–হ্যাঁ, মা। যা বলবে বলছিলে?”
–বিন্দুর শরীরটা কেমন খারাপ যাচ্ছে তোর কী চোখে পরে না? কয়েকটা দিন মেয়েটা না খেয়ে-দেয়ে নিজের কী হাল করেছে। খাবেই বা কী সব তো বমি করেই ফেলে দিচ্ছে । কালই ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি।”
–আসলে মা হাত একদম ফাঁকা ছিলো তাই ডাক্তার দেখাতে পারিনি৷ আজ বেতন পাইছি কালই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। সকালের টাইমে স্যারের থেকে ছুটি নিয়ে আসবো।”
–হুঁ। আচ্ছা শোন না?”
–বলো?”
–রিদির জামাই আসবো বলছে। ফ্রিজ একদম খালি। তাই বলছিলাম আরকি…
–আরেহ মা চিন্তা করো না। সব হবে।”
পরেরদিন শিশির বিন্দুকে এক গাইনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। বিন্দু যখন বললো ওর বমি হয় খেতে পারে না তখন কিছু টেস্ট আর আলট্রাসনোগ্রাফি করানোর পরামর্শ দিলো। শিশির রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। বিন্দুর শরীরটা বেশিই খারাপ লাগছে তাই ওয়েটিং রুমে বসে রইলো। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললো,
–উনি কনসিভ করেছেন। বেবীর দু’মাস চলছে। প্রেসারটা বেড়েছে। বোধহয় খুব টেনশন করে।”
ডাক্তার নিজের মতো ঔষধ লিখে দিয়ে বললো,
–আবার এক মাস পরে আসবেন আপনার ওয়াইফকে নিয়ে।”
শিশির খবরটা শোনার পর থেকেই যেন সুখের আকাশে ভাসছে। বাবা হওয়ার অনুভূতি সম্পর্কে কোনো আইডিয়া ছিলো না তার। আজ ডাক্তারের কথাটা শোনার পর থেকেই কেমন যেন অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছে। সেটা শিশিরের পক্ষেও কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব না। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বরে হয়ে ঔষধের দোকানে গিয়ে ডাক্তারের লিখে দেওয়া ঔষধগুলো কিনে নিলো। শিশির বারবার বিন্দুর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কিন্তু বিন্দু সেটা খেয়াল করলো না। শিশিরের ইচ্ছে করছে বিন্দুকে জরিয়ে দরে চিৎকার করে বলতে যে সে বাবা হবে। কিন্তু সেটাও বলার উপায় নেই। রিক্সায় দু’জন পাশাপাশি বসে আছে। বিন্দুকে খুব ক্লান্ত লাগছে। ডাক্তারের কাছে এত ভীর যে আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে পরেছে বসে থাকতে থাকতে। শিশির হাত বাড়িয়ে বিন্দুর কোমড়ে হাত দিয়ে কাছে টেনে আনলো। বিন্দু ক্লান্ত গলায় বললো,
–উফ কী করছেন পথের মাঝে?”
–কিচ্ছু না।”
–আচ্ছা বাবুর কয় মাস হয়েছে?”
শিশিরের মুখটা মুহূর্তেই ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বললো,
–কয় মাস যেন বলছে ভুলে গেছি।”
–এটা কোনো কথা হলো? আমারই ডাক্তারের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো। মনে হয় চার-পাঁচ মাস চলছে। আমারও ঠিক তারিখগুলো মনে পরছে না।”
শিশির চাপা গলায় বললো,
–হুম। হবে হয়তো।”
–জানেন?”
–কী।”
–আমি না বাবুর নাম রেখেছি।”
শিশির কৌতূহল হয়ে জিজ্ঞেস করলো কী নাম?”
–মেয়ে হলে রাখবো ‘ বিহা ‘। মানে বিন্দুর ব-ই কার আর শিহাবের হ-া কার। তাহলে হবে বিহা!”
বিন্দুর কথা শুনেই শিশির স্ব-শব্দে হেসে উঠলো। হাসি কোনো থামছেই না শিশিরের। মনে হয় রিক্সা থেকে পরেই যাবে। বিন্দু বিরক্তিকর ভাঙিতে বললো,
–উফ হাসার মতো কী বললাম?”
শিশির হাসতে হাসতেই বললো,
–আর কোনো নাম খুঁজে পেলে না। শেষমেশ বিহা! ফিহা হলে হয় তাই বলে বিহা। নো ওয়ে আমি আমার মেয়ের এই নাম জীবনেও রাখবো না।”
বিন্দু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বললো,
–ও তো আপনার কেউই হয় না।”
শিশির মনে মনে বললো,
–তুমি তো জানোই না বিন্দু। ও আমার রক্ত। আমার অস্তিত্ব! ও আমার অনেক অনেক অনেক কাছের!”
শিশিরকে চুপ থাকতে দেখে বিন্দু বললো,
–মন খারাপ করবেন না৷ যেটা সত্যি সেটা সত্যিই তাই না?”
শিশির এক গলা হেসে বললো,
–উঁহু সত্যি এটাই ছেলে বা মেয়ে যাই হোক সে শুধু আমারই সন্তান। আর সবাই এটাই বিশ্বাস করবে। আড়ালের ব্যাপরটা বারবার এভাবে সামনে না আনাই ভালো। সেটা তোমার জন্য ভালো, আমার জন্যও ভালো আর আমাদের অনাগত সন্তানের জন্যও ভালো।”
বিন্দু ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর একটু দম নিয়ে বললো,
–হুঁ।”
–তা ছেলে হলে কী নাম রাখবে?”
–বলবো না। আবারও হাসবেন তাহলে।”
–না আর হাসবো না। বলেই ফেলো।”
–উঁহু আর বলছি না।”
শিশির শুধু মনে মনে বললো, আমার মেয়ে হলে নাম রাখবো ‘কণা’!
“শিশিরের বিন্দু কণা”! আমাদের ভালোবাসার পবিত্র কলি হবে কণা। যেটা ফুল হয়ে পুরো পৃথিবীতে তার সুবাস ছড়াবে। যার মধ্যে থাকবে না কোনো অবৈধের ছোঁয়া। কেউ তাকে বলতে পারবে না তার বেজন্মা!
চলবে,,,,,,,