#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ১৮
বাড়ি থেকে তো বেরিয়ে এসেছে ঠিকই কিন্তু যাবেটা কোথায় বিন্দু? এই ভেবে ভেবেই অস্থির এখন। কেমন যেন নিজের মধ্যে ভয় লাগা শুরু করে দিয়েছে। নাকি বাড়ি ফিরে যাবে? পরক্ষণেই নিজের মনকে বুঝিয়ে নিলো কিছুতেই বাড়ি যাবে না। যা হওয়ার হবে আজই ঢাকার লন্সে উঠবে। দরকার হলে গার্মেন্টসে কাজ করবে তবুও কারো গলগ্রহ হয়ে থাকবে না। কিন্তু এখন তো লন্স ছাড়বেও না। তাই সিদ্ধান্ত নিলো আজ পুরো বিকেলটা পাশের একটা পার্কে কাটিয়ে দেবে। হঠাৎই মনে হলো টাকা – পয়সাও তো আনতে মনে নেই এখন কী হবে? পরক্ষণেই মনে হলো কানে একজোড়া ছোট্ট কানের দুল আছে চার আনার মতো হবে। ওটা বিক্রি করলেই মোটামুটি ছয়-সাত হাজার টাকা পাওয়া যাবে আর এতেই অনেকগুলো দিন কেটে যাবে। ভাবতেই একটু খুশি মনে হাসলে বিন্দু। কিন্তু জুয়েলারির দোকানও তো এত সকাল সকাল খুলবে না। নয়টা-দশটার আগে তো কোনো দোকানই খোলে না তার চেয়ে বরং পার্কে কাটানোই বেটার।
পার্কে একা বসে থাকতে থাকতে বোর হচ্ছে বিন্দু। এমনিতেই রমজান মাস তাই তেমন লোকের সমাগমও নেই। একদম অসহ্য লাগছে। একবার ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ঘড়িতে সারে নয়টা বাজে। ফোনটা নিয়ে এবারে বন্ধ করে দিলো যদি কেউ কল দিয়ে বসে তখন। এবারে পা চালালো জুয়েলারির দোকানের উদ্দেশ্যে। তার আগেই কানের দুলগুলো কান থেকে খুলে ভ্যানিটি ব্যাগের সাইডে রেখলো। দশ-পনের মিনিট পর কাঙ্খিত জুয়েলারির দোকানে গিয়ে উঠলো। এই দুলগুলো বিন্দুর মা বিন্দুকে সাথে নিয়ে এসে এই দোকানেই বানিয়ে ছিল। সেই সূত্রে ভালোই চেনা – জানা। এছাড়া বিন্দুর মায়ের যাবতীয় সব গয়না এই দোকানেই তৈরী। বিন্দু দোকানে এসে দশ মিনিটের মতো বসেছে। হঠাৎই দেখলো শিশির এসে সেই দোকানে ঢুকেছে। বিন্দু তাড়াতাড়ি মুখটা ঘুরিয়ে বসলো। ভাগ্যিস হিজাব দিয়ে মুখ ঢাকা নয়তো এক্ষুণি শিশির চিনে ফেলতো। তবুও ভয় লাগছে বিন্দুর যদি কোনোভাবে শিশির চিনে ফেলে তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে। শিশির এসেই দোকানের মালিকের সাথে বেশ হাসেরসে কথা বলতে লাগলো। দোকানের মালিক সোহেল শিশিরকে জিজ্ঞেস করলেন,
–তা আজ হঠাৎ করে কী ব্যাপার শিশির সাহেব?”
শিশির একটু লাজুক হেসে বললো,
–কিছু গয়না বানবো।”
–কেন? বিয়েসাদী আছে নাকি সামনে?”
–হ্যাঁ। ”
–আপনার নাকি বোনের?”
–দু’জনেরই। ”
বলেই একটু শব্দ করে হেসে ফেললো শিশির।
–তা কী বানাবেন?”
–একজোড়া কানের দুল। আর একটা গলার চেইন।”
–বউয়ের জন্য বুঝি?”
শিশির লাজুক হেসে বললো,
–হু।”
–কানের দুল কত আনার মধ্যে বানাবেন?”
–দশ আনা আর চেইনটা একভরীর।”
–আচ্ছা তাহলে ডিজাইন দেখুন।”
বিন্দুর পাশাপাশিই শিশির সিটের ওপর বসে ছিল। তার সামনেই গ্লাসের ভেতর রাখা সব তৈরী গয়নাগুলো। সেখান থেকেই শিশির পছন্দ মতো একজোড়া কানের দুল দেখিয়ে দিলো।”
–দেখুন ভাই গয়নাগুলো আমাকে পাঁচ-ছ দিনের মধ্যেই দিতে হবে।”
–এত তাড়াতাড়ি কীভাবে দেব বলুন? এমনিতেই ঈদের মার্কেট চলতাছে প্রচুর গয়নার অর্ডার পরে আছে।”
–এত কথা বুঝি না। বিয়ে এই অল্প কয়েকদিন পরেই তাই গয়নাগুলো আমার তাড়াতাড়িই চাই। কাথাগুলো বলেই চল্লিশ হাজার টাকা দোকানের মালিকের হাতে ধরিয়ে দিলো শিশির। বিন্দু সবটাই খেয়াল করলো। খুব খারাপও লাগছে শিশির কত কী করছে। আরও এভাবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। ওদিকে হয়তো ওর বাবা মাও কত কিছুর আয়োজন করে চলেছে। ভাবতে ভাবতেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো বিন্দুর। শিশির দোকানে ঢুকার পর থেকেই তার পাশে বসে থাকা মেয়েটার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। মেয়েটার ভাব-সাব কেমন যেন সন্দেহের ঠেকছে শিশিরের কাছে। মুখটা ওইদিক করে ঘুরে বসে আছে তাই বুঝতেও পারছে না। দোকানে বসে থাকতেই শিশিরের কল আসলো। বিন্দু কান খাড়া করে বুঝতে চাইছে কে ফোনকল করেছে। শিশির শুধু হু হা করে ফোন রেখে দিলো। এরপর দোকান ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বিন্দু এবারে যেন একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। একবার দোকানের বাহিরে মাথা দিয়ে দেখলো শিশির ধারে কাছে আছে কিনা। এরপর দোকানদারকে বললো,
–কাকা তাড়াতাড়ি আমার টাকাটা দেন।”
–দিচ্ছি একটু বসুন।”
দোকানদার টাকাগুলো গুণে।যা দাম হয়েছে তা বিন্দুর দিকে এগিয়ে দিলো। বিন্দুও টাকা নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো। তখনি কেউ একজন ডাকলো,
–বিন্দু!
আর ওমনি বিন্দু পাশ ফিরে জবাব দিলো,
–হু।”
কিন্তু শিশিরকে দেখেই বুকের মধ্যে কামড় দিলো। ইশরে বড় রকমের ভুল হয়ে গেছে। শিশিরকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেশ রেগে গেছে। বিন্দু ভয়ে ভয়ে টাকাগুলো নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। শিশির দোকানের মধ্যে ঢুকেই কিছু না বলেই বিন্দুর থেকে টাকাগুলো নিয়ে বললো,
–সোহেল ভাই এগুলো কিসের টাকা?”
–ওই একজোড়া ছোট কানের দুল বিক্রি করেছেন সেই টাকা।”
–আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ। দুলগুলো দেন টাকাটা রাখেন। আমি আপনার সাথে পরে কথা বলবো।”
দোকানদারের সাথে বেশ ভালোই পরিচয় শিশিরের তাই আর কিছুই বললেন না দোকানদার। টাকাগুলো রেখে দুলগুলো ফিরিয়ে দিলো। শিশির বিন্দুর হাত ধরে টেনে দ্রুত দোকান ছেড়ে বেরিয়ে আসলো। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে শিশিরের ইচ্ছে করছে থাপ্পড় দিয়ে সব কয়টা দাঁত ফেলে দিতে বিন্দুর।
রাস্তার একটা নিরিবিলি জায়গায় এসে দাঁড়ালো শিশির। বিন্দুও তৈরী শিশিরের বকা খাওয়ার জন্য।
–এই মেয়ে, এই ,সমস্যা কী তোমার? নাক টিপলে দুধ বের হবে সেই মেয়ে এত চালাকি করো কিভাবে? খুব বড় হয়ে গেছো তাই না? খুব বুঝতে শিখে গেছো? একেবারে থাপ্পড় দিয়া সব কয়টা দাঁত ফেলে দিব।”
হঠাৎ করেই বিন্দুর খুব হাসি পেল ওমনি পিক করে হেসে দিলো। আর তখনি শিশির ধমক দিয়ে বললো,
–চুপ, আবার অভদ্রের মতো হাসে। এক তো বাড়ি থেকে পা দিয়ে বড় অন্যায় করেছে তার ওপর এসেছে গয়না বেচতে। কত বড় সাহস! আন্টিকে বলবো একেবারে ঠ্যাং ভেঙে রেখে দিতে। এহ্ উড়তে শিখে গেছে এখন আর বাবা-মাকে প্রয়োজন নেই। ওই অসুস্থ মহিলাটা ওনাকে না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছেন আর উনি আসছেন গয়না বেচে পালানোর ধান্দা করতে।”
এবারে বিন্দু একদম মিইয়ে গেল। মুখটা শুকনো হয়ে গেছে। সত্যিই খুব ভুল হয়ে গেছে এভাবে মাকে কষ্ট দেওয়া মোটেও ঠিক হয়নি। ওর এই ভাবনার মাঝেই শিশির বিন্দুর মাথায় আঙুল দিয়ে খোঁচা দিয়ে বললো,
–এই মাথাটার মধ্যে কী কোনো গিলু নাই? এত আজেবাজে ভাবনা কেন আসে এই মাথায় ভালো কোনো চিন্তা, পজিটিভ কোনো চিন্তা মাথায় আসে না কেন? খালি যত উল্টাপাল্টা চিন্তা।”
কথাগুলো বলেই শিশির একটা রিক্সা নিয়ে এসে বিন্দুকে সহ নিজেও উঠে বসলো। শিশিরকেও একই রিক্সায় উঠতে দেখে মেজাজ খারাপ হলো বিন্দুর। বেশ দূরে গিয়ে সরে বসলো। শিশির ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বলোো,
–এভাবে বসলে তো রিক্সার বাহিরে গিয়ে পরবে। মরার খুব শখ হয়েছে নাকি?”
–তাহলে আপনি এই রিক্সায় কেন উঠেছেন?”
–কয়দিন পর তো একসাথেই চলবো-ঘুরবো। তাই এখন থেকেই প্রেকটিস করতাছি। কথাটা বলেই শিশির বিধুর নাম্বারে কল করে জানিয়ে দিলো বিন্দুকে পাওয়া গেছে। শিশির কল কেটে দেখলো তখনও বিন্দু আগের মতোই বসে আছে। শিশির বিন্দুর কোমরে হাত দিয়ে একদম শিশিরের অনেকটা কাছে নিয়ে এলো।বিন্দু রাগান্বিত চোখে তাকাতেই শিশির রাগ দেখিয়ে বললো,
–যদি আবার দূরে গিয়ে বসো পুরো রাস্তা কোমর জড়িয়ে বসে থাকবো তখন নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না। তার চেয়ে চুপচাপ ভালো মেয়ের মতো বসে থাকো সেটাই ভালো।”
–আপনি এত উল্লুক কেন? দেখলে তো মনে হয় ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানেন না শয়তানী তো ভালোই জানেন।”
–সবই জানি৷ সাথে ভাজা মাছটাও উল্টেপাল্টে খেতে জানি৷”
বিন্দু ভেংচি কেটে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। খুব মনে পরছে শিহাবকে। এমনিভাবে শিহাবের সাথে একই রিক্সায় করে কত যে ঘুরেছিল তারও হিসেব নেই৷ সহসাই চোখ জোড়া ভিজে উঠলো। শিশির লক্ষ্য করে বললো,
–বিন্দু জানো তো জীবনটা বড়ই অদ্ভুত। কাছের মানুষগুলো না বলেই হঠাৎ করে চলে যায় তবুও তো আমাদের বাঁচতে হয়। হয়তো কখনো নিজের জন্য বা অন্যের জন্য। জানো তো যখন আমি সবেমাত্র ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছি রিদি তখন ক্লাস সেভেন না যেন এইটে পড়ে তখনই বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যান। মা পুরো বাবার শোকে পাগল পাগল অবস্থা। আমিও তখন আহামরী খুব বুঝদার না। যেমন তুমি এখন কত ভুল করতেছো। তখন আমি তোমার বয়সী ছিলাম। মাকে সান্ত্বনাও দিতাম না নিজেও যেন কেমন উদাস উদাস ছিলাম। তখনো গ্রাজুয়েশন কম্পলিট করা বাকি। বাবা মারা যাওয়ার পাঁচ-ছ মাস পর একদিন মা আমার কাছে এসে বললেন,
–শিশির আর পড়া লাগবে না। এবার কিছু একটা কর আমি আর চালাতে পারছি না।”
মায়ের কথাটার মানে আমি বুঝে গিয়েছি। চাকরির জন্য অস্থির হয়ে পরেছিলাম। এইসেই কম্পানিতে চাকরি করে কাটিয়ে কোনরকম গ্রাজুয়েশন কম্পলিট করেছি। রেজাল্ট তেমন ভালো হয়নি। সারাদিন ডিউটি করে রাতে দশটা-এগারোটায় বাড়ি ফিরতাম। তখন আর পড়ার মুড থাকতো না। তখন সাকালে কোনরকম বইটা দেখেই পরীক্ষা দিতে দৌড়। বাবাকে হারিয়ে বুঝেছি একটা সংসার সামলানো ঠিক কতোটা কষ্টের। মাস শেষে রিদির প্রইভেটের টাকা। স্কুলের বেতন। খাতা,কলম। ভাইয়া একটা ড্রেস কিনে দে। এটাসেটা আবদার ওর। মা মাঝে মাঝে খুব করে বকতো রিদিকে। আসলে ও তখন ছোট ছিল তাই বুঝতো না। মা কিছুই চাইতেন না এমনকি ঔষধ শেষ হয়ে গেলেও আমাকে বলতো না আমার কষ্ট হবে ভেবে। তাও তো প্রিয় মানুষটাকে ছাড়া আমরা এতগুলো মানুষ বেঁচে আছি এখনো। ”
বিন্দু শিশিরের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিটা কথা শুনলো৷ কেন যেন খুব খারাপ লাগছে শিশিরের কষ্টে ঘেরা সেই অতীতের কথাগুলো শুনে। শিশির আবারও বলতে লাগলো,
–দেখ বিন্দু আবেগের বশে তুমি এখন একটা সিদ্ধান্ত নিবে ঠিকই কিন্তু এই সিদ্ধান্তটা তো তোমার জীবনের কাল হয়েও দাঁড়াতে পারে। সবসময় একা নিজেকে নিয়ে ভেবো না একটু তোমার আশেপাশে যারা আছে তাদের কথাও ভেবে দেখো। এই যে তোমার মা তোমাকে মারে, বকে যাই করে ভালোও তো বাসে তাই না? হয়তো তোমার বাবাও রেগে আছেন তাই বলে যে তোমায় ভালোবাসেন না এমন তো না৷ আর বিধুর কথাটাও তো ভাবা উচিত মেয়েটা তোমায় কত ভালোবাসে। আর সবশেষে যে আসছে তার কথাও তো সবার আগে ভাবা উচিত তোমার। তুমি বাচ্চাটা জন্ম দিলে অথচ তার বাবার কথাই কাউকে বলতে পারলে না এটা তোমার বাচ্চার জন্য ভবিষ্যতে কতবড় ইফেক্ট হয়ে দাঁড়াবে একবারও কী এসব ভেবেছো? আমি বিয়ে করতে চাইছি এটা হয়তো আমার অপরাধ। তোমার ধারণা হয়তো আমি তোমাদের সম্পত্তির লোভে বিয়েটা করতে চাইছি। তবুও বলছি এটা ভেবেও প্লিজ বিয়েটা করে নাও। কখনো তোমাকে জোর করবো না কোন বিষয়ে। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে তুমি আমার থেকে।”
বিন্দু গম্ভীর গলায় জবাব দিলো,
–আমার পাপের দ্বায়ভার আপনি কেন নেবেন?”
শিশির ম্লান হাসলো একটু। তারপর মনে মনে বললো,
–এত কিছু বোঝো অথচ আমার ভালোবাসাটাই বোঝো না। থাক বুঝতে হবে না তোমায়!”
–কী হলো বলছেন না কেন?”
–নাই বা শুনলে। সব কথা শুনতে হবে এমনতো মানে নেই। যদি কখনো সময় হয় তাহলে নয়তো কারণটা বলবো।”
এর মধ্যেই রিক্সা এসে দাঁড়িয়েছে বিন্দুদের দরজার সামনে। এবারে ভয়ে কাঁপছে বিন্দু। বাড়ি যাবে কী করে? সাজেদা বেগম তো নিশ্চয়ই রেগে আগুন হয়ে আছে।
–আমি বাড়ি যাব না।”
–কেন?”
–আমার ভয় করছে।”
–কিচ্ছু হবে না আন্টি কিচ্ছু বলবে না। আমার সাথে এসো।”
বিন্দু শিশিরের পিছু পিছু গিয়ে ঘরে পা রাখলো।
চলবে,,,,,,,