#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ১০
প্রেয়সী,
জানি একটু বেশিই অবাক হচ্ছো। প্রতিদিন এত ঘণ্টা কথা বলার পরেও কেন তোমাকে চিঠি লিখালাম। সবাটাই জানবে। একটু ওয়েট করো। তার আগে বলে নেই, বড্ড বেশি ভালোবাসি তোমাকে। তোমাকে ছাড়া সত্যিই নিজেকে অনেক শূন্য লাগে। তবুও কখনো কখনো পরিস্থিতি এমনভাবে সামনে এসে দাঁড়ায় যা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। হয়তো তুমি মনে মনে ভাবছো কী এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। কী করে বলবো তোমায়। না বলেও উপায় নেই। তোমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলার শক্তি বা সাহস কোনোটাই আমার নেই। বিশ্বাস করো নিজের অজান্তেই খবরটা শোনার পর থেকে অনেক কেঁদেছি। বড় হওয়ার পর কখনো এভাবে কাঁদিনি আমি। নিজেও অনেকটা অবাক হয়েছি ছেলেরা এভাবে কী করে কাঁদে?
বাবাকে কত করে বললাম তবুও বাবা রাজী হচ্ছে না। আমাকে এক মাসের মধ্যেই বাবার কাছে বিদেশ চলে যেতে হবে। বাবার বন্ধু খুব অসুস্থ, তাই বাবা ব্যবসা সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। এখন আমাকে বলেছে আমি যেন পাঁচ বছরের জন্য সেখানে চলে যাই। বিশ্বাস করো তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে চাই না। কিন্তু এখন মা – বাবা দু’জনেই এমনভাবে আমাকে পেয়ে বসেছেন যে না যেয়েও উপায় নেই। দেখো বিন্দু এসব শুনে তুমি একদম কাঁদবে না বলে দিলাম। আমার চিঠটা লেখতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা বিন্দু তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করবে? আমি কিন্তু চির জীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারবো। তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম আর কিছু লিখতে পারছি না। ভালো থেকো আমার প্রেয়সী।
ইতি
তোমার শিহাব।
হাতে থাকা চিরকুটটার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিন্দু। বারবার চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে উঠছে। বুকের ভেতরটা কেমন ভয়ংকরভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে। অজানা এক আশংকা এসে কুড়ে কুড়ে ভেতরটাকে খেয়ে যাচ্ছে। কী করে প্রিয় মানুষটাকে ছাড়া এতগুলো বছর পার করবে বিন্দু? এত অল্প সময়তেই যাকে এতটা ভালোবেসে ফেলেছে তাকে ছাড়া পাঁচটা বছর কী করে কাটাবে? আর বাবা-মাকেই কী বলে রাখবে সে। এমনিতেই বিভিন্ন দিক থেকে সম্বন্ধ আসে সাজেদা বেগম মেয়ের এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবেন না বললেও কখন আবার মত ঘুরে যায় বলা তো যায় না। ভালো সম্বন্ধ পেলে তারা কী আর মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখবেন নাকি! যত ভাবছে তত বেশিই কান্না পাচ্ছে বিন্দুর। ওদিকে শিহাব একের পর এক ফোন করে চলেছে বিন্দুর ফোনে। আজ যেন কোনো তাড়া নেই ফোন রিসিভ করার৷ প্রিয় মানুষটাকে বোধহয় সে হারিয়েই ফেলেছে। সত্যিই কী পাঁচটা বছর শিহাবের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারবে বিন্দু?
–আচ্ছা মা শিশির ভাইয়াকে তোমার কেমন লাগে?”
সবজি কাটতে কাটতে সাজেদা বেগম এক পলক বিধুর দিকে তাকালে। তাপর সবজি কাটার দিকে নজর দিয়ে বললেন,
–খারাপ না।”
–তার মানে বেশি ভালোও লাগেনি?”
–সেটা কখন বললাম? দেখতে শুনতেও খারাপ না। তাছাড়া স্কুলের মাষ্টার। বেতনও মোটামুটি ভালোই পায়৷ ভালোই লেগেছে ছেলেটাকে আমার। বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলতে পারে কিন্তি। আমার সাথে যে প্রথম কথা বলেছে, প্রতিটা কথাই খুব সাবলীলভাবে বলেছে। একটা কথাতেও জড়তা কাজ করেনি। অনেক স্পষ্টভাষী মনে হয়েছে।”
মায়ের মুখে শিশিরের প্রশংসা শুনে খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে বিধুর তবুও সেটা এখন মায়ের সামনে না প্রকাশ করাই ভালো।
–তাহলে বাবাকে একবার বলে দেখো বাবা কী বলে।”
–তোর বাবা ইদানিং খুব বিজি। রোজা আসছে এখন কেনাকাটাও বেশি চলছে। ঢাকা যাচ্ছে মাল আনতে। এখন এসব বলে চিন্তা বাড়াতে চাই না।”
–কবে যাবে?
–কালই যাবে। ঈদটা শেষ হোক তারপরই না হয় তোর বাবার সাথে এ নিয়ে আলাপ করবো।”
–তাড়াতাড়ি করো কিন্তু বেশি দেরী যেন না হয়।”
–সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ যেখানে চাইবেন সেখানে হাজার ঝামেলা থাকলেও সেই কাজ সফলভাবে সম্পূর্ণ হয়। আর না চাইলে কারো পক্ষেই সেটা সম্পূর্ণ করা সম্ভব না। এখন শোন পেঁয়াজুর ডালটা একটু বেটে দে তো। বিন্দু কিছুদিন হলো জ্বর থেকে উঠেছে। তুই একটু আমাকে সাহায্য কর। ওকে কাজের কথা বলতে ভালো লাগে না।”
–আপুকে এমনিতেও বলার দরকার নাই। এই অল্পস্বল্প কাজ আমি নিজেই পারবো। মা একটা ব্যপার খেয়াল করেছো?”
–কী?”
–শিশির ভাইয়া ওইদিন সরিষা ইলিশ দিয়েই অনেকগুলো ভাত খেয়েছে।”
–হয়তো ওর কাছে ভালো লাগছে তাই খাইছে।”
–আমার মনে হয় ভাইয়ার সরিষা ইলিশ খুব পছন্দ।”
–হবে হয়তো।”
অনেক্ষণ ফোন করার পর এট লাস্ট ফোনের ওপাশ থেকে কারো কান্নাভেজা কণ্ঠ স্বর কানে ভেসে আসলো শিহাবের। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে এই মুহূর্তে শিহাবের। কী করে থাকবে সে তার প্রিয় মানুষটাকে ছাড়া। সুক্ষ্ম গলায় শিহাব ডাকলো,
–বিন্দু!”
–হু।”
–প্লিজ কেঁদো না। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। তুমি এভবাে কাঁদলে আমি সেখানে গিয়ে থাকবো কী করে?”
এ পর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো বিন্দু।
–শিহাব আমি তোমাকে ছাড়া কী করে থাকবো? মনে হচ্ছে তুমি আমার থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাচ্ছো। প্লিজ শিহাব আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি মরেই যাব তোমাকে ছাড়া। পাঁচটা বছর তোমাকে ছাড়া থাকা অসম্ভব। যেখানে তোমার একটুখানি দূরুত্বই সহ্য করতে পারছি না সেখানে পাঁচটা বছর কী করে থাকবো আমি?”
বিন্দুকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না শিহাব। ফোনের দুই প্রান্তের দু’জনেই নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। অনেক্ষণ এভাবে থাকার পর বিন্দু মুখ খুললো,
–শিহাব একটা কথা রাখবে?”
–বলো?’
–আগে বলো রাখবে?”
–আচ্ছা রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।”
–প্লিজ তুমি আমাকে বিয়ে করে রেখে যাও। তাহলেও আমি নিজেকে একটু এটা ভেবে শান্তি দিতে পারবো। তুমি দূরে গিয়েও আমার কাছেই আছো। ”
–বিন্দু সেটা আমিও চাই। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা কোনোভাবেই পসিবল না। বাবা- মা কেউই এখন চাইবে না আমাদের বিয়ে হোক।”
–প্লিজ তবুও একবার আন্টিকে বলে দেখ। আন্টি যদি রাজি হয়। তাহলে শুধু আমাদের বিয়েটা হয়ে থাকবে৷ তুমি আসলে না হয় বিয়ের সব আয়োজন হবে। ”
–তুমি যেহেতু বলছো আমি মাকে আজই বলে দখবো মা কী বলে। তোমাকে নিজের বউ করে পেতে তো আমার কোনো অনীহা নেই। আমি তো নিজেই চাই তোমাকে একেবারে আমার কাছে নিয়ে আসতে৷ যাই হোক এমনিতেই রোজা রেখেছো একদম মন খারাপ করো না। আল্লাহ যা করবে দেখবে ভালোই হবে। ডোন্ট ওয়ারি। ওকে?”
–হু।”
ফোন কাটতেই দেখলে বিধু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
–কিরে কখন এলি?”
–এইতো কিছুক্ষণ। তা চোখ দুইটা এমন আন্ডার মতো করছোস কেন?”
বিন্দু কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
–কিচ্ছু না।”
–আমি সবই জানি তুই ওই শিহাব ছেলেটার সাথে রিলেশন করোস। তোর কী মনে হয় আমি কিছুই জানি না?”
বিন্দু কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বললো,
–তোকে এসব কে বলেছে?”
–কেউ না।”
–আমার তে মনে হয় শিশির ভাই বলেছে।”
–ওনাকে এসবের মধ্যে টানবি না।”
–বাব্বাহ এত লাগছে কেন? সামথিং সামথিং নাকি?”
–নাথিং। আমার এখনো সেই বয়স আসেনি।”
–ওরে আমার কঁচি খুকিরে। যতসব নেকামো। বাব্বাহ ওইদিন আসছে মতো যা ভাব দেখলাম।”
বিধু কোনোরকম উত্তেজিত না হয়েই বললো,
–ভালো করছোস দেখছোস। এখন একটু লেবুর শরবত বানিয়ে ফেল৷ আমি মাকে হাতে হাতে সাহায্য করছি।”
–আচ্ছা চল।”
নামজ সেরে মসজিদ থেকে এসেই শিশির নিজের ঘরে ডাকলো রিদিকে।
–হ্যাঁ ভাইয়া বল?”
–আমার কাছে এসে বোস। মা কোথায়?”
–মা একটু শুয়েছে। শরীরটা নাকি খারাপ লাগছে।”
–আবার প্রেসার লো হয়ে গেল নাকি?”
–জানি না। আমি মাথায় তেল-পানি দিয়ে এসেছি।”
–মাকে দেখেশুনে ঠিক মতো ঔষধগুলো খাইয়ে দিস। আমাদের আপন বলতে শুধু মা’ই আছে। যেদিন চোখজোড়া চিরদিনের জন্য বুঝে যাবে সেদিন বুঝবি মা কী ছিল।”
বলতে বলতে বেশ জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললো শিশির। তারপর আবারও রিদির উদ্দেশ্যে বললো,
–এইবার ঈদে তোর কী চাই?”
রিদি হাসতে হাসতেই বললো,
–একটা মিষ্টি ভাবি চাই।”
–বেশি পাকনামো না করে যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে।”
–কী পাকনামি করলাম? তুই দেখিস না মায়ের কত কষ্ট হয় কাজ করতে। একজন ভাবি থাকলে তো এতটা কষ্ট করা লাগতো না মায়ের।”
–তাহলে তুই আছিস কী করতে? এত বড় একটা মেয়ে হয়ে যদি মা’কে সাহায্য না করতে পারিস তাহলে তোকে রেখে কী লাভ। এই বছরই পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেব।”
–দেখ ভাইয়া বেশি বাজে কথা বলবি না। আমার রাগ উঠবে কিন্তু।”
–আচ্ছা আর রাগ দেখাতে হবে না। এখন বল কী চাই?”
–তোর যা ভালো লাগে তাই এনে দিস। আমার কোনো চাওয়া নেই।”
–সত্যিই তো? পরে আবার মন খারাপ করবি না তো?”
–নাহ্!”
–আচ্ছা তাহলে গিয়ে এখন পড়তে বোস।”
রিদি চলে যেতেই শিশির ফোন করলো বিধুর মায়ের ফোন নাম্বারে। গত দুইদিন হয়ে গেল বিধুর সাথে কথা হয় না। যদিও বিধু কয়েকবার কল করেছিল কিন্তু ব্যস্ততার জন্য ফোনটাই তুলতে পারেনি।
চলবে,,,,,,