স্বর্ণলতা part 45

0
463

#স্বর্ণলতা
পর্বঃ৪৫
____________
দুপুরে জাফর বাসায় এসে পৌঁছালো।
এসেই পুরো বাড়ি মাথায় তুলে দিলো।রণক রণক বলে চিৎকার জুড়ে দিলো।
নীরব আর শোভা তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
—”বাড়িত কি মানুষ নাই!কতক্ষণ থিকা চিল্লাইতাছি?মরছে সবাই?”
সৈকত স্নেহা দ্রুত বেড়িয়ে আসলো।
স্নেহা বললো-
—”মামা! তাহলে আসতে পারলে!”
স্নেহার কথাও বোধহয় কাটার মতো বিঁধলো জাফরের গায়ে।খুবই বিরক্তি নিয়ে বললো-
—”কি পরিমান রিস্ক লইয়া যে আইছি আমরা জানি।তোগো এইহানে খাওয়া আর ঘুম ছাড়া আছিলো কি?আর তুই বেশি বোঝোস?তোরে কইছিলাম না রণক হারামজাদারে থামা।তুই ওরে যাইতি দিলি ক্যান?”

—”মামা ঠান্ডা হও।ভালো বুদ্ধি করেছি।নিশ্চয়ই তোমার পছন্দ হবে।”

—”আমি কারও বুদ্ধিতে চলি না।তোগোর জন্য আইজকা আশু সর্দারের কাছে কতগুলা কথা শোনা লাগলো।ছিঃ ছিঃ কি একচোট ঝগড়া ডা না হইলো!দোষ না কইরাও দোষী!”

সৈকত জাফরকে ভীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
—”কি বলেছেন উনি?”

—”আমারে দেইখা নিবো,আমারে পুলিশে দিবো,মিথ্যা মামলায় ফাসাইয়া দিবো আরও কত রকম কাহিনী। এইগুলা কি শুনমু আমি?আমি তারে কত সাহায্য করছি আর এখন হে আমারে কি সব কয়!”

স্নেহা একপ্রকার জোর জবরদস্তি করেই জাফর কে তার ঘরে নিয়ে গেলো।
ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো।স্নেহার মা, সৈকত এবং জাফর ছাড়া ঘরে আর কেউ নেই।
স্নেহা ফিসফিসিয়ে বললো-
—”মামা অনেক তো হলো,এবার নিজের কথা ভাবো!”

—”মানে!”

খানিকটা বিম্মিত দৃষ্টিতে স্নেহাকে দেখে নিয়ে স্নেহার মা বললো-
—”স্নেহা তুই জাফরকে কি বলছিস?”

—”হ্যাঁ মা।কতদিন আর অন্যদের ভাগ দিবো আমরা?সব কাজ আমরা করি তাহলে ভাগের বেলায় অন্যরা বেশি পাবে কেনো?তোমরা কি কেউ জানতে মরা সাধন করার পর লাশ গুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আশু সর্দার বিক্রি করে দিতো।”

মামা আস্বস্ত গলায় বললো-
—”স্নেহা, আমি একটু আন্দাজ করবার পারছিলাম তয় হে চরম মিথ্যাবাদী।আবার হাজার হইলেও আমার গুরু।কি করতাম আমি!”

—”এখন আর দূর্বলতা না।ঝগড়া হয়েছে হতে দাও।যদি এক ঢিলে ৩ পাখি মারা যায় তাতে মন্দ কি!”

এবার ঘরে থাকা প্রত্যেক টা মানুষের দৃষ্টি স্নেহার চোখ মুখে আটকে গিয়েছে।মনে মনে সবাই ভাবতে লাগলো-
‘কি বলে এই মেয়ে! এক ঢিলে ৩ পাখি কিভাবে মারবে!আগাগোড়া কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা।’
জাফরের চোয়াল শক্ত হলো।
—”স্নেহা ঝেড়ে কাশ তো।কি বলবি একটু পরিষ্কার করে বল।এক ঢিলে ৩ পাখি মারবো মানে!”

—”মামা শোনো,মন্টুকে মেরে ফেলেছো তাইনা?লাশ কি করেছো?এখনো নিশ্চয়ই পাতালঘরে রেখে দিয়েছো।”

—”ওরে মারিনাই।তয় হ অনেক পিটাইছিলাম আর আইয়া পড়ছিলাম।এরপর তো কত কান্ড হইলো।পাতাল ঘরে আর যাইনাই।ওরে তো খাওন পানি কিছুই দেওয়া হয়নাই।এতোদিনে মনে হয় মইরা গেছে।”

—”নীরব থেকে শুরু করে সবাই কিন্তু জানে যে স্বর্ণলতার সাথে সেদিন মন্টু গিয়েছিলো এরপর আর ফেরেনি।আমি নিজেও দেখেছি।এমন কি মন্টুর মা ও মন্টুকে খুঁজছে।এখন আমি যদি স্বর্ণলতা কে ফাসিয়ে পাতাল ঘরে নিয়ে যাই এবং সেখান থেকে মন্টুর মৃত্যুর দায়ে ওকে হাতেনাতে ধরা যায় তাহলে কেমন হবে?”

—”কি কস উল্টাপাল্টা!!”

—”মন্টুর মা মন্টুর জন্য পাগল হয়ে আছে।এর আগেও একটা সন্তান উনি হারিয়েছেন।সে চাইবে যেকোন উপায়ে মন্টুকে ফিরে পেতে।তুমি একটু উস্কাও।মন্টুর মা ঠিকি তালে তাল মেলাবে।আমি সাহায্য করবো।”

জাফর প্রত্যেকটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো।এরপর বললো-
—”এসব করে আমাদের কি লাভ?”

—”আহা! মামা! তোমাকে আমি বুদ্ধিমান ভাবি আর এই তোমার বুদ্ধি!!!”

—”আরে বল তো।এতো কাহিনী না কইরা।এমনি মেজাজ বিগরাইয়া আছে।”

—”রণক এখনো বাড়িতে আসেনি।কাল রাতে আশু সর্দারের বাড়ি থেকে ও কোথায় যেনো চলে যায়।এর মধ্যে যদি স্বর্ণলতাকে ফাঁসানো যায় আর যদি কৌশলে পুলিশ কে খবর দেওয়া যায় তাহলে রণক স্বর্ণলতাকে বাঁচানোর জন্য খু*নের ভার নিজের কাধেঁ নিবে কিনা বলো?”
স্নেহার মা পাশ থেকে বলে উঠলো-
—“১০০% নিবে।আমার ছেলের দু চোখ ভরা ভালোবাসার এক ভয়ংকর নেশা।ও ডুবুরির মতো সাতরে বেড়াচ্ছে।স্বর্ণতার জন্য যদি নিজের কলিজা কেটে দিতে হয় ও আসক্ত ব্যক্তিদের মতো সেটাও দিতে দ্বিধাবোধ করবে না।”

কথা শেষ না হতে হতেই সৈকত বলে উঠলো-
—”জ্বি মা,আর প্রানের চেয়ে প্রিয় প্রেয়সি এভাবে বিপদে পড়বে আর প্রেমিক বাঁচাবে না এ হতেই পারেনা।”

—”কিন্তু এতে আমার ছেলে ফেসে যাবে।ওর সমস্যা হবে।”

—”পুলিশের লোক কে থাকবে জানো?সৈকতের ছোট বেলার বন্ধু।ওকে সব শেখানো থাকবে।ও শুধু রণক কে কিছুদিনের জন্য আটকে রাখবে।সাথে আশু সর্দার কেও।এখন আশু সর্দারের বাড়িতে লাশ দিয়ে ভরা।লাশ চুরির অপরাধে ও জেলে গেলো এরপর থেকে যা অর্জন করবে সব তোমার।এদিকে স্বর্ণলতা কে ফাসিয়ে মন্টুর খু*ন ধামাচাপা দিতে পারবে অন্যদিকে স্বর্ণলতাকে বাঁচানোর জন্য রণক দূরে সরে যাবে।এই সুযোগে নীরব কে স্বর্ণলতার ঘরে ঢুকিয়ে দিলে বাচ্চার কাজ হয়ে যাবে।
এরপর কি খেলা আমাদের হাতে থাকবে না?কি বলো শেয়ানা মামা?হলো না এক ঢিলে তিন পাখি মারা?”

জাফর চিন্তামগ্ন হয়ে গেলো।স্নেহার প্রস্তাবিত পরিকল্পনা নেহাত মন্দ না।লোভনীয় এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার আগে জাফর অবশ্যই মাথা খাটাবে।কিন্তু এখন রণক কে সরানোর দ্বিতীয় রাস্তা আর দেখা যাচ্ছেনা।ও যে ভয়ানক কাজ করেছে এখন ও সবকিছু করতে পারবে।আগের পরিকল্পনা মাফিক স্বর্ণলতা কে যদি রণকের কথা বলেও দেয়া হতো তাতেও রণক দমে যেতোনা।উল্টো হিতে বিপরীত হতো।এরচেয়ে পরিচিত আইনের লোক দিয়ে স্বর্ণলতা আর রণক কে আলাদা করার দ্বিতীয় সুযোগ কি পাওয়া যাবে!জাফর ভেবে যাচ্ছে।শুধুই ভাবছে।সে এখন তার পুরো মস্তিষ্কের চিন্তার বীজ ছিটিয়ে দিয়েছে।এখন শুধু ফলাফল আসা বাকী।
একদিকে স্বর্ণলতা অন্যদিকে রণক ও আশু সর্দার।তিনজনকে যদি বাগে আনা যায় তাহলেই তো খেলা তাদের হাতে।

জাফর এবার একটু শক্ত কন্ঠ বললো-
—”বুদ্ধি ভালোই দিছোস।দেখি কি করা যায়।নীরব আর শোভা কই?”

—”তারা ঘুমাচ্ছে।তাদের কালকে ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছিলো।”

—”কেডা খাওয়াইলো!রণক হারামজাদা নাকি?”

—”হুম ও ছাড়া আর কে!”

মামা কিছুই বললো না।বিলাপ করতে করতে স্থান ত্যাগ করলো।

দুপুরের মধ্যে রণক ফিরে আসলো।রণক কে দেখে মারতে উঠলো জাফর।চোখ রক্তবর্ণ করে বললো-
—”বাড়িত ঢুকবি না।এইখানে আয়।তোর সাথে আমার কথা আছে।”
রণক কে টানতে টানতে বাড়ির পেছনে নিয়ে গেলো জাফর।
—”কিরে! তুই এগুলা কি শুরু করছোস?শান্তি দিবিনা?তোর কথা মতো স্বর্ণলতারে তোরে দিছি এখন এইসব করলে ফল ভালো হইবো?”

—”মামা ঠান্ডা হও।আমি কালকে কোথায় গিয়েছিলাম শোনো।”

—”তা তুমি কই গেছিলা শুনি?”

—”আমি কালকে দেওয়ান মিয়াজি সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম।দেওয়ান মিয়াজি বাংলাদেশের কুখ্যাত সন্ত্রাসী।আমি ওকে চিনি নীরবের মাধ্যমে।এক রাতে নীরবের পিছু নিয়ে এটার সন্ধান পাই আমি।আমরা যেসব লাশ কবর থেকে উঠাই এগুলো সাধন করার পর আশু সর্দার আর নীরব বিক্রি করে দেয়।স্বাভাবিক মৃত্যুর লাশগুলোতে নিয়ে লাভ নাই।ওদের বড় গ্যাং আছে।সুইসাইড/খুন করা লাশগুলোকে ওরা একাজে লাগায়।কতদিন ধরে যে কত টাকা উর্পার্জন করেছে তা তুমি ধারনাও করতে পারবে না।নীরবের ব্যাংক একাউন্টে এখন ৮ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা আছে।ভাবা যায়!!”

—”কি কস এগুলা!!!৮ কোটি!!!!!”

—”এই দেখো আমি রিসিট এনেছি।কালকে ওকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ওর ফোন নিয়ে গিয়েছিলাম।আর তোমাকে সরানোর কারন শুধু স্বর্ণলতা ছিলো না নীরব ও ছিলো।তোমার দূরে যাওয়াতে নীরবের উত্থান টা আমি দেখতে চেয়েছিলাম।
নীরবের পিছু পিছু করতে করতে আমি তার সন্ধান পাই।এরপর নীরবের ভাই পরিচয়ে এবং নীরবের ফোনের মাধ্যমেই তারা নিশ্চিত হয় আমি নীরবের পরিচিত।
আজকে রাতে প্রায় ১৪ টা লাশ ওরা সাপ্লাই দিবে।ওদের আর কিছু কাজ বাকী।ওগুলো শেষ হলে নীরব আর সাড়ে তিন কোটি টাকা পাবে।আশু পাবে ৫ কোটি।এরপর
ওরা তার কিছুদিনের মধ্যে আমাদের সবাইকে শেষ করে দিবে।টাকা নিয়ে পালাবে।”
মামা রণকের হাতে রিসিট টা ভালো করে লক্ষ্য করলো।সত্যি সত্যি নীরব এর একাউন্টে এতোগুলো টাকা।কিন্তু এতো টাকা আসবে কিভাবে।তাহলে কি রণকের কথা সত্যি!

জাফর এবার গম্ভীর হয়ে গেলো।এরপর রণক কে জিজ্ঞেস করলো-
—”আর কি কি জানতে পারছোস?”

—”তুমি আর আমি বাদে এখানে সবাই আমাদের শত্রু।আমাদের মিত্র হওয়ার নাটক করছে সবাই।”

—”যদি তোর কথা সত্যি হয় তাহলে স্বর্ণলতারে তোর সাথে বিয়া দিমু।এরপর যখন তোদের বাচ্চা হবে তখন বাচ্চা নিয়ে আমাদের কাজ হাসিল কইরা একে একে সবাইরে খু*ন করমু।স্নেহা,শোভা,তোর মা,নীরব কেউ ই বাঁচবে না।সবাই রে নির্মম মৃত্যু দিমু আমি।এরপর তোর আর আমার রাজত্ব!
কিন্তু যদি মিথ্যা হয় তাহলে তোরে নির্মম মৃত্যু দিমু আমি।আমারে বোকা বানানো এতো সহজ না।আমি কয়েকদিনের মধ্যেই সব বের করে ফেলমু।কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা। ”

জাফর চলে গেলো।তার মাথা বড্ড গোলমেলে লাগছে।স্নেহা রনকের দোষ দিচ্ছে আর রনক দিচ্ছে সবার।আসলে কে প্রকৃত দোষী!জাফরের শত্রু কে! আবার মিত্র টাই বা কে! তার কার কথা শোনা উচিত।আবার নীরবের একাউন্টে এতো টাকা আসবে কিভাবে! রণকের কথায় প্রমান আছে।তবুও স্নেহার পরিকল্পনা মন্দ না।সে কোন দিকে যাবে!!
মাথা ফেটে যাচ্ছে চিন্তা করতে করতে।
সারারাত জার্নি করার পর দু চোখ ভরে ঘুম এসেছে।স্নেহা সকালের নাস্তা করালো।জাফর ঠিক মতো কিছুই খেতে পারলো না।শরীর টা বড্ড ক্লান্ত লাগছে।
ভাবতে লাগলো-
‘একটু ঘুমিয়ে নেই।দুপুরে উঠে সবকিছু শেষ করে কাজে নেমে পড়তে হবে।এখন একটু বিশ্রাম দরকার।’
চলবে………..
sharmin Sumi-শারমিন সুমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here