#স্বর্ণলতা
পর্বঃ৪৩
_____________
আকাশে মস্ত বড় রূপালী চাঁদ হেলে আছে।রূপালী চাঁদ পুরো ধরনী কে আলোকিত করছে।
প্রেমিকযুগল এর মধুর রাত চাঁদনি রাত।সদ্য বিবাহিত নবদম্পতি চাঁদ কে উপভোগ করে।
চাঁদ পুরো বিশ্বের।পুরো বিশ্বজুড়ে চাঁদের সৌন্দর্যে মানুষ মোহিত হয়।
এ চাঁদনি রাত কে নিয়ে অনেক বিখ্যাত কবিগণ নানারকম কাব্য রচনা করেছেন।
হুমায়ুন আহমেদ স্যারের চাঁদ নিয়ে একটা উক্তি-
“চাঁদের বিশালতা মানুষের মাঝেও আছে, চাঁদ এক জীবনে বারবার ফিরে আসে। ঠিক তেমন মানুষ প্রিয় বা অপ্রিয় যেই হোক, একবার চলে গেলে আবার ফিরে আসে।”
রূপক ও তার জীবনে আবার ফিরে আসবে।রূপকের সাথে আরও চাঁদনি রাতের সৌন্দর্যের স্বাক্ষী হবে।
রূপক এবং স্বর্ণলতা এভাবেই অনেক চাঁদনি রাত কাটিয়েছিলো।চাঁদ তাদের দাম্পত্য জীবন কে প্রেমময় করে তুলেছিলো।
আর আজ অন্য এক পুরুষের সাথে স্বর্ণলতা চাঁদ দেখতে বের হয়েছে।
সে মানুষটি তার অপরিচিত।অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার সাথে পা মেলাতে হচ্ছে।কিছুদিন পর হয়তো তার সবকিছুর অবসান ঘটবে।নতুন এক জীবনের নতুন করে আবার সূচনা ঘটবে।এ জীবনে হয়তো আর দুঃখের ছন্দপতন হবে না।
রূপক আর স্বর্ণলতা হয়তো খুব ভালো থাকবে।
রণক আর স্বর্ণলতা পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে।প্রকৃতি নিস্তব্ধ। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো প্রকৃতি।ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে।গ্রামের বেশ দূরে তাদের বাসা।মাটির সরু রাস্তা।উঁচু নিচু রাস্তা।মাঝে মাঝে নুড়ি পাথরে ঠাসা।ছোট ছোট ইটের টুকরা,নুড়ি পাথরের সাথে স্বর্ণলতা হোঁচট খাচ্ছে আর রণক সাথে সাথে ধরে ফেলছে।
বড্ড অস্বস্তি লাগছে স্বর্ণলতার।এ মানুষটার ছোঁয়া অপবিত্র। তবে এখন তার কিছু করার নেই।
—”স্বর্ণলতা,শাড়ি পড়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?”
—“আমি সবসময় শাড়ি পড়ি।আমার অভ্যাস আছে।”
—”বারবার হোঁচট খাচ্ছো যে!”
—”আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা তাই।আমি শহরে বড় হয়েছি।কোনদিন ও কোথাও বের হওয়ার সুযোগ হয়নি।তাই হয়তো হোঁচট খাচ্ছি।”
—”দেখো সামনে চায়ের দোকানের একটা ব্রেন্ঞ্চ।আবার তার সাথেই পদ্মপুকুর।এ গ্রামের মানুষ বেশ শৌখিন তাইনা?সবজায়গায় পদ্মফুলের চাষ।”
—”আপনার কাছে শৌখিন ফুল কি পদ্মফুল?”
—”ফুল বলতেই আমার কাছে শৌখিন।”
—”আচ্ছা! ফুল ভালোবাসেন!”
—”তোমাকেও ভালোবাসি।”
—”কি!!”(ভ্রু কুঁচকে স্বর্ণলতা বললো)
—”নাহ্ কিছু না কিছুনা।”
দুজন ব্রেন্ঞ্চে বসলো।প্রকৃতি নিশ্চুপ।স্বর্ণলতা এবং রণক ও নিশ্চুপ।নিরবতা ভেঙে রণক বলে উঠলো-
—”কেমন লাগছে শিউলিফুল?”
—”কেমন নাম শিউলিফুল! আর কোন নাম নেই?”
—”পছন্দ না?আচ্ছা যাও নীলপদ্ম।”
স্বর্ণলতা কোন জবাব দিলো না।ঘাড় ঘুরিয়ে দিঘির পদ্মফুল দেখছে।চাঁদের আলো পদ্মফুলের সাথে মিষ্টি খেলায় মেতেছে।
রণক বলে উঠলো-
—”কেমন লাগছে স্বর্ণলতা?”
–”ভালো।”
—”শুধু ভালো?”
—”আর কি?”
—”আচ্ছা চোখ বন্ধ করো।”
—”কেনো????”
—”করোনা প্লিজ।”
স্বর্ণলতা চোখ বন্ধ করলো।রণক এক গুচ্ছ পদ্মফুল নিয়ে হাটু গেড়ে বসে পড়লো।আর একগুচ্ছ পদ্মফুল হাত বাড়িয়ে স্বর্ণলতার সম্মুখে তুলে ধরলো।আর বললো-
”আকাশের ঐ চাঁদ আর ধরনী তে আরেক টি চাঁদ।যেই চাঁদকে আমি উপহার দিচ্ছি নীলপদ্ম।”
স্বর্ণলতা চোখ খুললো।পদ্মফুল গুলো হাতে নিলো।এরপর বললো কিন্তু এটা তো নীলপদ্ম না।”
—”মনে করে নাও নীল।”
—”কেনো মনে করবো?যখন এটা নীল-ই না।”
—”ভালোবাসার রং কি?”
—”সবাই বলে লাল।”
—”তারা কি আদৌ দেখেছে ভালোবাসার রং লাল?”
—”না দেখে নি।কল্পনা করে বলেছে।”
—”ঠিক।তুমি যদি কল্পনা করো এটা নীলপদ্ম তাহলে এটা নীল পদ্মই।তুমি যদি কল্পনা করো এটা সবুজ পদ্ম তাহলে এটা সবুজ পদ্মই।”
ফুলগুলোর দিকে তাকালো স্বর্ণলতা।ফুলগুলোতে হাত বুলালো।নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রান নেওয়ার চেষ্টা করলো।ফুলগুলোর পাতাগুলো নুইয়ে গেছে।
—”স্বর্ণলতা,গান শুনবে?”
—”আপনি গাইবেন?”
—”আমি ছাড়া আছে কে?”
—”আপনি বলেছিলেন আপনি গান গাইতে পারেন না।”
—”বলেছিলাম বুঝি! যাক,বেসুরে গলায় একটু গাই।এতো সুন্দর পরিবেশ গান না হলে জমে নাকি?”
অনিচ্ছাসত্বেও মাথা নেড়ে সম্মতি জানলো স্বর্ণলতা।
রণক হালকা কেশে গলা পরিস্কার করে নিলো এরপর গাইতে শুরু করলো-
কারণে অকারণে
নিষেধে বা বারণে
তোমার নামেই যত
জোছনা নিলাম
ভেতরে বাহিরে
দহনে বা ধারোণে
আমায় নিখোঁজ ভাবো
বাঁ পাশেই ছিলাম
চোখে জল নোনা কী?
নিয়ে গেলো জোনাকি
কেনো আমি পথে একা দাঁড়িয়ে?
আলোদের পিয়নে
সোডিয়াম নিয়নে যেনো
সবই কোথায় হারিয়ে
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি
তোমার দ্বিধায় পুড়ে যাই
এমন দ্বিধার পৃথিবীতে
তোমায় চেয়েছি পুরোটাই
আমি তোমার স্বপ্নে বাঁচি
তোমার স্বপ্নে পুড়ে যাই
এমন সাধের পৃথিবীতে
তোমায় চেয়েছি পুরোটাই
পুরোটাই
জলেতে আগুনে
বর্ষা বা ফাগুনে
তোমার নামেই যত
মেঘেদের গান
জাগরণে মিছিলে
কোথায় যে কি ছিলে
আমায় নিখোঁজ ভাবো
নিয়ে অভিমান
চোখে জল নোনা কী?
নিয়ে গেলো জোনাকি
কেনো আমি পথে একা দাঁড়িয়ে?
আলোদের পিয়নে
সোডিয়াম নিয়নে যেনো
সবই কোথায় হারিয়ে
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি
তোমার দ্বিধায় পুড়ে যাই
এমন দ্বিধার পৃথিবীতে
তোমায় চেয়েছি পুরোটাই
আমি তোমার স্বপ্নে বাঁচি
তোমার স্বপ্নে পুড়ে যাই
এমন সাধের পৃথিবীতে
তোমায় চেয়েছি পুরোটাই
পুরোটাই।……
গান শেষে রণক কিছুটা থামলো।তাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছিলো সে গানটা স্বর্ণলতাকে উদ্দেশ্য করে গেয়েছে।এবং তার সত্যিকারের অনুভূতি দিয়েই গেয়েছে।
খানিকবাদে স্বর্ণলতা বললো-
—”বাহ্ আপনার কন্ঠস্বর সুন্দর।খুব ভালো লাগলো।”
—”তোমাকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া যে তাই।”
খাপছাড়া ভাবে স্বর্ণলতা উত্তর দিলো-
—”ওহ্ আচ্ছা।”
কয়েকসেকেন্ড পর রূপক স্বর্ণলতাকে প্রশ্ন করলো-
—”চা খাবে?”
—”এখন চা কোথায় পাবেন?সব দোকান বন্ধ।”
—”তুমি যদি চা খেতে চাও তবে আমি পৃথিবীর বাইরে গিয়ে হলেও চা নিয়ে আসবো।”
—”ওহ্! তাই?”হুম খাবো নিয়ে আসুন।”
—”চলো আমার সাথে।”
—”দোকানের চা খাওয়াতে হবে।বাসায় বানিয়ে দিলে হবে না।”
,—”তোমাকে দোকানের চা-ই খাওয়াবো।আসো আমার সাথে।
ঐ যে চারটা বাড়ি দেখতে পাচ্ছো?ওখানে দুই নম্বর বাড়িটা মকবুল চাচার।আমরা যেখানে এতোক্ষন বসে আছি এটা তার ই দোকান।”
—”ওনাদের বাসায় গিয়ে চা খাবো?তাহলে তো বাসার চা-ই হলো।”
—”ওনাকে দোকানে নিয়ে এসে চা বানিয়ে নিবো।”
—”কিহ?ওনারা সবাই নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে।এখন আসবে না।”
—”আমি র-ন….মানে রূপক।আমি ডাকলে ঠিকি আসবে।”
স্বর্ণলতা নিচের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো।মুখ ফসকে নিজের নাম বের হয়ে যাচ্ছিলো রণকের।
এরপর আবার স্বাভাবিক হয়ে বললো-
–”কেনো?”
—”আমি তার রেগুলার কাস্টমার।আমাকে খুব ভালো করে চেনে।”
—”এই দুই দিনে রেগুলার কাস্টমার হয়ে গেলেন কিভাবে? নাকি বহুবছর থেকে এখানেই থাকেন?”
স্বর্ণলতার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে রণক কিছুটা বিচলিত হলো।এরপর স্বাভাবিক ভাবে আবার উত্তর দিলো-
–”যে সম্পর্ক গভীর হওয়ার,তা একদিনেই হয়।”
এবার চলো তো।কোন প্রশ্ন করো না।তুমি কথা কম প্রশ্ন বেশি করো।
ফসলের জমির আইল বেয়ে দুজন বাড়ি গুলোর দিকে পৌঁছে গেলো।এরপর মকবুল চাচা বলে রণক ডাকতে শুরু করলো।
স্বর্ণলতা হঠাৎ খেয়াল করলো পাশের বাড়ি থেকে হু হু করে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।এদিকে রণক ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভেতরের উঠানে চলে গিয়েছিলো।আর স্বর্ণলতা কান্নার আওয়াজ অনুসরন করে পরের বাড়িটার দিকে অগ্রসর হতে লাগলো।স্বর্ণলতা কোথায় যাচ্ছে তা রণক খেয়াল করলো না।সে মকবুল চাচার ঘুম ভাঙাতে ব্যস্ত
যত বাড়িটির দিকে এগুচ্ছো ততই কান্নার আওয়াজ বেড়ে যাচ্ছে।স্বর্ণলতা বুঝে নিলো এ বাড়ির ভেতর থেকেই কান্নার আওয়াজ আসছে।
বাড়িটা ছিলো মাটির।বাড়িটার চাল ছনের তৈরী। জানালা গুলো বেতের।জানালার ফাঁকা দিয়ে হারিকেন আলোতে এক মধ্যবয়স্কা নারী কে কান্নারত অবস্থায় দেখতে পেলো।
এক দেখাতেই চিনে ফেললো।
‘এতো মন্টুর মা!তাহলে এটা মন্টুদের বাসা!কিন্তু মন্টুর মা কাঁদছে কেনো!!”
বাড়িতে ঢুকে স্বর্ণলতা দরজায় টোকা দিলো।আর ফিসফিসিয়ে বললো-
—”খালাম্মা!!দরজা খোলেন আমি স্বর্ণলতা।”
দরজায় টোকার শব্দ পেয়ে কান্না থেমে গেলো।
ওপাশ থেকে ভেসে আসলো-
—”কেডা?স্বর্ণলতা?মন্টুর বুবুজান?”
—“হ্যাঁ খালাম্মা।আমি মন্টুর বুবুজান দরজা খোলেন খালাম্মা।”
চলবে………
Sharmin Sumi-শারমিন সুমি