স্বর্ণলতা part 41

0
398

#স্বর্ণলতা
পর্বঃ৪১
____________
নিশি রাত্রির দ্বি প্রহরে,
তোমায় নিয়ে বাহুডোরে,
তোমার সঙ্গে জোসনা স্নানে,
দিবো আমি গা ভাসিয়ে।
দুজনের নিঃশব্দে হবে কথা,
চাঁদ দেখার নিমন্ত্রণ-
‘ও আমার স্বর্ণলতা।’

রণক চিরকুট টি ভাঁজ করে দরজার নিচে দিয়ে ঢুকিয়ে দিলো।এরপর দরজায় ঠকঠক করে তিনবার শব্দ করলো।
স্বর্ণলতা দেখতে পেয়ে চিরকুট টি তুলে নিলো।এরপর ওপরের লেখা গুলো দেখতে পেলো।
স্বর্ণলতা পড়ে কিচ্ছুক্ষণ চুপ থাকলো।এরপর দরজা খুলে দেখলো দরজার সামনে কেউ নেই।

সে এপাশ ওপাশ রণক কে খুঁজতে লাগলো।
রণক দেয়ালের পেছনে উঁকি মেরে স্বর্ণলতা কে দেখছিলো।
স্বর্ণলতার নজরে নজর পড়লো।আর রণক পিছিয়ে গেলো।
স্বর্ণলতার একটু হাসি পেলো।সে চুপি চুপি দেওয়ালে অন্য কোনে একদম মিশিয়ে গেলো।যেখান থেকে রণক উকিঁ দিলেই স্বর্ণলতার চোখাচোখি হবে।কিছু সময় পর রণক আবার উঁকি দিলো।এবং স্বর্ণলতা কে দেখে ছিটকে দু-কদম পিছিয়ে গেলো।

রণক মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।লজ্বায় লাল হয়ে গেছে।মনে হচ্ছে মাটি খুঁড়ে ভেতরে ঢুকে যেতে।তার তো কোনদিন ও এমন অনুভূতি কারও জন্য হয়নি।
শুধু স্বর্ণলতার জন্য তার মনে ভালোবাসার জোয়ার বয়।পৃথিবীতে বোধহয় সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি-
ভালোবাসার অনুভূতি।

স্বর্ণলতা এবার রাঙা চোখে বললো-
–”কে আপনি বলুন তো!”
রণক স্বর্ণলতার প্রশ্নে চোখ বড়বড় করে ফেললো।কি উত্তর দিবে সে!আসলেই তো কে সে?রণক নামের কাউকে তো স্বর্ণলতার চেনার কথা নয়।সে তার অস্তিত্ব কে কবর দিয়ে দিয়েছে।এখন রণক চাচ্ছে স্বর্ণলতা বুঝুক তাকে।অন্যের পরিচয়ে না।আত্মপরিচয়ে স্বর্ণলতার কাছে প্রেমভিক্ষা চাইতে আজ রণকের বড্ড ইচ্ছা করছে।কিন্তু এ কি কোনদিন ও সম্ভব হবে?
স্বর্ণলতার আবারো প্রশ্ন-
–”সামান্য প্রশ্নের উত্তর দিতে এতো চিন্তায় পড়ে গেলেন?”

রণক এর কণ্ঠস্বর বারংবার বলতে চাচ্ছে-
‘আমি এক অচেনা কেউ।
আর তুমি আমার অবাধ্য মনের প্রেমের ঢেউ’

না,সে তো এটা বলতে পারবে না।তীরে এসে তরী ডুবাবে!
সে আবেগী।কিন্তু মামা তো বাস্তববাদী!আবেগের বশে বলে ফেললো এই আবেগের ফুল স্বর্ণলতার গায়ে কাটা হয়ে ফুটবে।
তবুও সে তার আসল পরিচয় দিতে মরিয়া।

তাই রণক স্বর্ণলতাকে উদ্দেশ্য করে বললো-
—”প্রশ্ন টা কি যেনো ছিলো তোমার?”

—”আপনি কে?”

—”প্রেমভিক্ষুক!”

ললাটে ভাঁজের রেখা ফেলে স্বর্ণলতার প্রত্যুক্তি
–”প্রেমভিক্ষুক?”

—“হ্যাঁ প্রেম ভিক্ষুক।আমাকে ভালোবাসবে?”দু মুঠো প্রেম ভিক্ষা দিবে?
আমি লোভী না।দু মুঠো ভালোবাসাতেই পুষিয়ে নিবো”।

স্বর্ণলতার কি করা উচিত স্বর্ণলতা বুঝতে পারছে না।তবে সে এতোটুকু বুঝে গেছে যে সে অসময়ে ভুল প্রশ্ন করেছে।এখন রণক কে বুঝতে দেওয়া যাবে না স্বর্ণলতা সন্দেহ করছে।
বরং কিছুদিন অনিচ্ছা সত্বেও প্রেমের/ভালোবাসার অভিনয় করে যেতে হবে।তবে এত শত কবিতায় স্বর্ণলতার মনে বিন্দু মাত্র ঠাঁই পায়নি রণক।কারন তার পুরোটা জুড়ে শুধুই রূপক।
রূপকের কবিতায় সে আকাশ সমান মুগ্ধ হয়েছে।এখন রণকের এসব কবিতা তার ফিকে মনে হচ্ছে।আকাশের বিশালতার মতোই রূপক তার মনে বিশাল জায়গা জুড়ে ঘর বানিয়ে রেখেছে।

রণক বললো-
—”স্বর্ণলতা?কি ঠিক করলে?আমি কতটুকু প্রেম ভিক্ষা পেতে পারি?তোমার দয়ালু মন কি বলে?”

—”আমার মনটা পাথরের মতো শক্ত।এটা বরফ না যে আপনার দু-এক ছন্দের উত্তাপে গলে পানি হয়ে যাবে।”

স্বর্ণলতার এহেন উত্তরে রণকের কিন্ঞ্চিত মন খারাপ হলো।

স্বর্ণলতা যাবার উদ্দেশ্য পা বাড়িয়ে দিলো।হেঁটে ঘরে চলে যাবে।চার কদম এগুনোর পর আবার পেছন ফিরে রণক কে বললো-
—”আজ পূর্ণিমা?”

—”হ্যাঁ আজ পূর্ণিমা।”

—”আপনি পূর্ণিমাতিথির খবর জানেন কিভাবে?”

রণক একটু আমতা আমতা করে বললো-
–”শপথ করেছিলাম।যদি তোমাকে দ্বিতীয় বারের মতোন আবার পাই তাহলে তোমার সাথে পূর্ণিমাতিথি উৎযাপন করবো।”

স্বর্ণলতা কোনরকম না হেঁসেই গম্ভীর কণ্ঠে বললো-
—”আপনার নিমন্ত্রণ আমি গ্রহন করলাম।আজকে তাহলে পূর্ণিমাতিথি উৎযাপন করা যাবে।”
রণকের মুখে হাসির রেখা।
পরক্ষণেই স্বর্ণলতা বলে উঠলো-
—‘হয়তো যাওয়া হবে না।”

—”কেনো কেনো??”

—”আমার বাইরে যাওয়া নিষেধ।মামা যেতে দিবে না।দিনের বেলায় ই কোথাও বের হতে পারিনা।আবার রাতে যাবো?”

—”মামার ব্যবস্থা আমি করবো।তুমি শুধু আমার সাথে জোসনা স্নানের প্রস্তুতি নাও।

_________________
সেদিন দুপুরেই স্বর্ণলতা জাফরের সব পরিকল্পনা স্নেহার থেকে শুনে নিয়েছিলো।এরপর তার পরিকল্পনা গুলো সে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিলো।
সেদিন দুপুরে খুব জরুরি কাজে জাফর এবং রূপকের মা কে ঢাকা যেতে হলো।
রূপক বাংলাদেশে আসতে চায়।এবং তার সমস্ত সম্পত্তি তার মায়ের নামে করে দিতে চায়।
এমন লোভনীয় প্রস্তাবে দ্বিতীয় কোন কথাই থাকেনা।এক প্রকার তাড়াহুড়ো করেই তাদের ঢাকা চলে যেতে হয়।
আর নীরব কে যাওয়ার আগে সাবধান করে যায়।যাতে স্বর্ণলতা আর রণককে চোখে চোখে রাখে।

জাফরের এতো দ্রুত স্থান ত্যাগ করা স্বর্ণলতার কাছে ঘটকা লাগে।সে দ্রুত স্নেহার কাছে যায়।এবং জিজ্ঞেস করে-
—”আপু! মামা এতো দ্রুত কোথায় গেলো?”

—”মামা তো বললো ঢাকা যাবে।”

—”হঠাৎ? ”

—”সে তো সঠিক বলতে পারছি না।”

—”আমাকে এ বাড়িতে একা ফেলে মামা তো এভাবে যাবেনা।কি হয়েছে?”

সৈকত বাইরে ছিলো।বাইরে থেকে স্বর্ণলতার এবং স্নেহার সব কথাই শুনলো।এবং বাইরে থেকে ভেতরে আসতে আসতে বললো।
—”স্নেহা! জানো কি হয়েছে?”

—”কি হয়েছে?”

—”স্বর্ণলতা,তুমি জিজ্ঞেস করছিলে না কেনো মামা এতো দ্রুত সবকিছু ফেলে আম্মাকে নিয়ে চলে গেলো?”

—”জ্বী ভাইয়া।কি হয়েছে?”

—”রূপক নাকি তার সব সম্পত্তি মায়ের নামে লিখে দিবে।এখন কি করবে তোমরা?সম্পত্তি পেয়ে গেলে এরা তো রূপক কেও মেরে ফেলবে!”

স্নেহার একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো-
—”উফ!এই ছেলেটা গাধা নাকি!কি করছে এসব!দাড়াও ওকে আমি এখুনি কল দিচ্ছি।”

—”দাড়াও দাড়াও আপু! কল দিয়ে কি বলবে?ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে?”

—”এখন তাই করতে হবে।”
স্নেহা রূপক কে কল দিলো।রূপক ফোন ধরলো না।
বেশ কিচ্ছুক্ষণ পর রূপক নিজেই কল দিলো।
—”আসসালামুআলাইকুম স্নেহা আপু।কেমন আছো?”
স্নেহার রূপকের কথার উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো-
—”কিরে তুই কোথায়? ”

—”কেনো আমি কানাডায়।”

—”তুই কানাডায়!!তুই ঢাকা আসিস নি?”

—”না তো!কে বলেছে আমি ঢাকা এসেছি?”

—”ওহ্! আচ্ছা শোন।তাহলে আমার এক বান্ধবী দুষ্টুমি করেছে আমার সাথে।আচ্ছা রাখি রে।কাজ আছে।পরে কথা হবে”।

—”আ-আ-আপু!!হ্যালো!!!
ধুর কথা শেষ না করেই কেটে দিলো।”

স্নেহা সৈকত আর স্বর্ণলতার দিকে তাকিয়ে বললো-
রূপক তো কানাডায়।তাহলে সম্পত্তি লিখে দিবে মানে?সৈকত তুমি এ কথা কিভাবে জেনেছো?”

—”মামা আর আম্মার কথোপকথন আমি শুনে ফেলেছি।রূপক নাকি বাংলাদেশে এসেছে।এবং উকিলের অফিসে বসেই ফোন করেছে।”

স্বর্ণলতা একটু চিন্তা করলো।আর বললো-
—”ভাইয়া,রূপক তো কানাডাতে।ফোন দিলে বাংলাদেশী নাম্বার দিয়ে তো ফোন দিবে না।যেহেতু উকিলের অফিসে বলেছে সেহেতু বাংলাদেশী নাম্বার ই হবে।কিন্তু তাহলে রূপক এর হয়ে ফোন টা কে করলো?”

—”রণক ভাইজান করছে”-মেহুল দরজায় দাড়িয়ে উত্তর দিলো।
স্নেহা বিস্মিত হয়ে গেলো-
—”মেহুল! রণক করেছে?”

মেহুল এবার তাদের সামনে এগিয়ে আসলো আর বললো-
—”হ রণক ভাই করছে।আমি পুকুর থিকা কয়েকটা তুলসি পাতা তুইলা আনবার গেছিলাম।সারারাত কাঁশছি।আমি পুকুরের নিচে ছিলাম।হে ছিলো আমগাছের পাশে।হে মামারে ফোন দিয়া অমনে কইছে।”

—”আশ্চর্য! রণক এভাবে মিথ্যা বলে মামাকে কেনো ঢাকা পাঠালো!!!”

স্বর্ণলতা বললো-
—”আপু,আমি বুঝতে পেরেছি সে কেনো এমন করেছে।সর্বনাশ!
মামা যখন জানবে সে মিথ্যা বলে ঢাকা পাঠিয়েছে তাহলে তো বিশাল বিপদ। মামা সরাসরি তো আমাকে সন্দেহ করবে।
এরপর রণক কে তো সরিয়ে দিতে পারে!কি করবো?”

স্নেহা ভরসা দিয়ে স্বর্ণলতা কে বললো-
—”আরেহ্ ভয় পেয়ো না।রণক বুদ্ধিমান ছেলে।মামা কে ও ঠিক ই সামলে নিবে।ও বুঝে শুনেই কাজ টা করেছে।”
মেহুল এর মধ্যেই ফিসফিসিয়ে সবাইকে সাবধান করে দিলো-
—”সবাই চুপ করেন।নীরব ভাই আইতাছে।”
__________________
নীরব এসে সবাই কে এক নজরে দেখে আবার চলে গেলো।
এরপর স্বর্ণলতাও স্বর্ণলতার ঘরে চলে গেলো।সেখানে রণক কে দেখতে পেয়েই বললো-
—”আপনাকে তো কিছুই করতে হলো না আর।মামা তো এমনি ই চলে গেলো।যাক,রিস্কি কাজ থেকে বাঁচলেন।”
কথাটা রণকের গায়ে লাগলো।সে কি রণক কে ভীতু ভাবে!
এদিকে স্বর্ণলতাও ইচ্ছে করে এভাবে কথা বলেছে যাতে রণক তাকে সব বলে।

রণক মধুমিশ্রিত কন্ঠে বললো-
—”এই যে শুভ্রশিউলি!”
স্বর্ণএতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো।”
রণক স্মিত হাসলো
—”তোমার নতুন নাম! ‘শুভ্র শিউলি।মানে সাদা শিউলি ফুল।যাইহোক শোনেন,মামা কে আমি ই ঢাকায় পাঠিয়েছে।

—”কিভাবে?”

—”মিথ্যা কথা বলে।খুব বড় একটা মিথ্যা।”

—”কি মিথ্যা?”

—”সে টা গোপন থাক।আমি যে তোমার জন্য কত বড় ঝুঁকির কাজ করতে পারি তা তো তুমি জানো না।এটা নমুনা মাত্র।”

—”মামা তো রাতেই চলে আসবে।তখন কি করবেন?”

—”না মিস শুভ্রশিউলি।মামা আসলে পূর্ণিমাতিথির পরই আসবে।কারন আজকে সন্ধ্যা থেকে পরিবহন ধর্মঘট।চলবে পাক্কা তিনদিন।কোন গাড়ি চলবে না।”

—”আর নীরব,মা?”

—-”এরা নিশ্চিন্তে ঘুমাবে।এদের সকালের আগে ঘুম ই ভাঙ্গবে না।”

স্বর্ণলতা আর কিছুই বললো না।রণক তার মতো পরিকল্পনা সাজাচ্ছে।আর স্বর্ণলতা তার মতো করে পরিকল্পনা সাজালো।এই সুযোগ!”

চলবে……..
Sharmin Sumi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here