স্বর্ণলতা part 40

0
379

#স্বর্ণলতা
পর্বঃ৪০
___________
রণক কে মামা স্বর্ণলতার সামনে হাজির করলো।সময় তখন সকাল ১০ টা।স্বর্ণলতা নিজ কক্ষে বিশ্রামরত অবস্থায় ছিলো।এ বাড়িতে তার বাইরে যাওয়া বারণ।স্নেহার ঘরেও যেতে পারছে না।জাফর সন্দেহ করলে তার পরিকল্পনা কিছুতেই সফল হবে না।তাই তার বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া আপাতত কোন কাজ নেই।
দরজায় দুইবার নক করেই রণক কে নিয়ে জাফর ঘরে ঢুকে পড়লো।সাথে রূপকের মা ও আছে।

স্বর্ণলতা রণক কে দেখে এক লাফে উঠে বসলো।এক মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো তার সামনে রূপক দাড়িয়ে। অবিকল সেই মুখ।কিন্তু পরক্ষনেই বাস্তবতা মনের কুঠুরি তে কড়া নাড়লো।নাহ্ এতো তার রূপক নয়।এ রণক।
কিন্তু রণক কে তার সামনে এভাবে হাজির করাবে এটা সে আগে বুঝতে পারে নি।

স্বর্ণলতার বিস্মিত চোখ দেখে জাফরের চোখ জলজল করে উঠলো।সে ধরেই নিলো স্বর্ণলতা কে এবার বাগে আনা বেশ সহজ হবে।রণক কে ভরসা করে সবকিছু বলবে।আর তাদের টার্গেট সম্পূর্ণ হতে কোন বাঁধা নেই আর।
স্বর্ণলতা এবার আগের চেয়ে আরও বিস্মিত হওয়ার ভান করলো।এবং বললো-
—”রূ-রূ-রূপক!!!!কিন্তু মামা যে বলেছিলো আপনি মারা গেছেন!!!”

—”মামা ঠিক ই বলেছিলো স্বর্ণলতা।কানাডা তে আমার একটা এক্সিডেন্ট হয়।লেকের পাশে এক্সিডেন্ট হওয়ার কারনে আমার বডি কেউ খুঁজে পায়না।যার ফলে আমাকে মৃত ঘোষণা করে।কিন্তু আমাকে কিছুলোক খুঁজে পেয়ে চিকিৎসা চালায়।এবং আমি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরি।”

স্বর্ণলতার ভেতর টা হাসিতে ফেটে যাচ্ছে।আর চিন্তা করছে রণক বুদ্ধিমান একটা ছেলে।তবে আমার সামনে এতো দূর্বল একটা মিথ্যা পেশ করলো কিভাবে!!লেকের পানিতে কারও বডি খুঁজে পাওয়া যাবেনা! তাও কানাডার মতো উন্নত দেশে!বোধহয় মিথ্যা বলাটা প্রাকটিস করে আসতে পারেনি।তাই এই অবস্থা! স্বর্ণলতা জাফরের সামনে আর কথা বাড়ালো না।সে বিশ্বাস করার অভিনয় করতে লাগলো।

এবার জাফর খানিকটা শান্ত গলায় বললো-
—”ইয়ে,স্বর্ণলতা।হোনো।রূপকের মৃত্যু খবর হুইনা আমরাও বেশ কষ্টে আছিলাম।তয় যহন হুনলাম সে বাইচা আছে তাই তোমার কাছে নিয়া আসলাম।”
এবার রূপকের মা বললো-
—”তোমাকে সেদিন বলে গিয়েছিলাম না আমরা যে পাত্র হাজির করবো তাকেই তোমার গ্রহন করতে হবে?আসলে সেদিন ই আমরা জানতে পারি রূপক বেঁচে আছে।তাই তোমাকে এসব বলি।”

—”আম্মা! আপনারা আমার ওপর খুব দয়া করেছেন।কি দিয়ে আপনাদের ঋণ পরিশোধ করি বলেন তো?আচ্ছা আমার পেটের বাচ্চা লাগবে তো।যান,বাচ্চা না হয় আপনাদের নামেই উৎস্বর্গ করলাম”।

উপস্থিত সবাই একটু কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো।
হঠাৎ করে এ কথা তুলবে তারা কেউ ভাবতে পারে নি।কিছুটা শান্ত স্বরে রণক বললো-
—”স্বর্ণলতা।কি হয়েছে?আমাকে খুলে বলো।আমাদের বাচ্চা কোথায়?”
তার এহেন প্রশ্নে মামার মন চাচ্ছিলো রণক কে পিঠ চাপড়ে বলতে-
“সাব্বাশ বেটা!
যেমন ঘুঘু তেমন ফাঁদ।এই সময় এমন প্রশ্নের দরকার ছিলো।স্বর্ণলতা যাতে পুরোপুরি বিশ্বাস করে রণক কে।এখন সে যদি রণক কে অবিশ্বাস করে তাহলে তাদের পরিকল্পনা মাঠে মারা যাবে।এই ভাবে প্রশ্ন টা করে রণক বুঝিয়ে দিলো সে পূর্বের ঘটনা সম্পর্কে অবগত নয়।”

অন্যদিকে স্বর্ণলতাও মনে মনে স্মিত হাসছে।আর বলছে-
”বাহ্ বেশ বুদ্ধিমান!আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করানোর জন্য এই একটি প্রশ্ন ই যথেষ্ট। এবার তো তাদের নাটক এর সূচনা ঘটবে।”
রণকের আবারো প্রশ্ন করলো-
—”স্বর্ণলতা!বলো?আমাদের বাচ্চা কোথায়?”

–”কেনো আপনি জানেন না বুঝি?”

—”নাহ্ তো!”

—”বাচ্চা তো আপনার পরিবারের সবাই মেরে ফেলেছে।তারা তো কালোজাদু তে আসক্ত।”

মেকি বিস্ময় এর চরম পর্যায়ে রণক।এমন একখানা মুখ বানালো যেনো সবাই কে সে ছিড়ে খাবে।কিন্তু ভেতরে ভেতরে বরফের মতোই শান্ত শীতল।
–”মা! মামা কি শুনছি এসব আমি?আমার বাচ্চাকে তোমরা কি করেছো?”
রূপকের মা বললো-
—“রূপক বাবা।বাইরে আয়। শুধু তো ওর কথা শুনলি।আমাদের কথা তোর শুনতে হবে।”

—”না।যা বলার স্বর্ণলতার সামনেই বলো।”

মামা ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো-
—”সব হুনবার পারবি।তয় বাইরে আইতো হইবো।”

মামার ঝাঁঝালো কন্ঠস্বরে রণক বাইরে চলে গেলো।স্বর্ণলতা কে বিশ্বাস করানোর জন্য এতটুকু অভিনয় তাদের দরকার ছিলো।তারা চলে যাওয়ার পর স্বর্ণলতা ও মৃদু হাসলো।
কিহ! দারুন অভিনয়। তবে তাদের সাথে সাথে সমান তালে স্বর্ণলতাকেও অভিনয় করতে হবে।তা না হলে খেলা জমবে কিভাবে?

প্রায় ২০ মিনিট পর রণক ফিরে আসলো।
এতোক্ষণ বাইরে তেমন কোন কথা হয়নি।কিছুটা প্রশংসা রণক এর ঝুলিতে গেলো।এবং প্রশংসা টা জাফর ই করেছিলো।আর তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিলো এরপরে ঠিক কি কি বলতে হবে।শেখানো বুলি আউরাতেই রণক দ্বিতীয় বারের মতো স্বর্ণলতার ঘরে ঢুকলো।

—”কি হলো?সব শুনলেন তাদের থেকে?”

—”স্বর্ণ”

—”উহু! স্বর্ণলতা।স্বর্ণের চেয়ে স্বর্ণলতা ই আপনার মুখে বেশি মানায়।”

—”রাগ করেছো?”

—”রাগ! সে কি আমার সাথে যায়?রাগ আর আমি বিপরীত মুখী।আমার সমমুখী তো ধৈর্য্য।”

র্নিলিপ্ত কন্ঠে রণক বললো-
—”স্বর্ণলতা বললে খুশি?”

—”সত্যি বলতে অনেক খুশি।”

—”তবে সেটাই হোক।তবুও আমার বউয়ের হাসি মুখ টা সারাজীবন রোক।”

স্বর্ণলতার মুষ্ঠি শক্ত করলো।তার মুখে বউ কথা টা মানাচ্ছে না।সে যে রণক তার এতটুকু প্রমান ই যথেষ্ট। কাক কে পেখম লাগালে কাক তো আর ময়ূর হয়ে যায়না।
স্বর্ণলতা চিন্তা করলো।এই মান অভিমানের ছন্দে রণক একটা পৃষ্ঠা মাত্র।আর রূপক পুরো একটা অধ্যায়।এসব ঝেড়ে ফেলে আসল কথায় কর্নপাত করা যাক।

—”তা মামা,আম্মা কি বললো? ”

—”শুধু মাত্র অমরত্বের লোভে আমার সন্তান কে তারা মেরে ফেলেছে।যারা এমন ভয়ানক কাজ করতে পারে তারা সবকিছু করতে পারে স্বর্ণলতা।তারা আমাদের কাছে আরেকটি বাচ্চা চেয়েছে।আরেক টি বাচ্চা দিতে পারলে তবেই আমরা মুক্ত হবো।অন্যথায় আমি তোমাকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবো।আমার তোমাকে লাগবে স্বর্ণলতা।তুমি থাকলে আমরা বাচ্চার মুখ আবার দেখবো ইন শা আল্লাহ।কিন্তু তোমাকে হারালে আমিও বেঁচে থাকবো না।বাচ্চা পেলে ওরা আমাদের মুক্ত করে দিবে।আমি ওদের শর্তে রাজি হয়েছি।”

—”আপনি আগে থেকে জানতেন তারা কালোজাদু করে?”

—”জানতাম।তবে এসব করবে ভাবিনি”।

—”জানলে আমাকে বলেন নি কেনো?সেদিন যখন আমি জঙ্গলে মামা কে দেখলাম এবং বাসায় ফিরে সবকিছু আপনাকে খুলে বললাম তাহলে সেদিন কেনো বলেছিলেন ‘দেখো মামা আমার ঘরেই শুয়ে আছে।তুমি ভুল দেখেছো?’

কথার মারপ্যাঁচে কিছুটা হতভম্ব হলো রণক।কিন্তু ঠিকি সামলে নিলো-
—”স্বর্ণলতা।তুমি বাসায় একা থাকবে।আমার তো চলে যেতে হবে।তাই তোমাকে কিছু বলিনি।তাছাড়া আমি কখনো ভাবিনি তারা নিজের বংশের প্রদীপ কে এভাবে নিভিয়ে দিবে।আমি জানতাম না তারা বাচ্চা বলি দেয়।আমি ভুল করেছি তোমাকে সবকিছু খুলে না বলে। আমার এ ভুলের জন্য আমাকে কি মাফ করা যায়না?”

—”আপনার এই ভুলের মাফ কোন শব্দ দিয়ে করবো?আমার নিষ্পাপ শিশুকে হারিয়ে সব শব্দ আমি ভুলে গেছি।”

—”আমিও তো কষ্ট পেয়েছি।”

—”তাই!!তবে প্রমান দিন।”

-”কি প্রমান চাও বলো?”

—”আজ থেকে সামনের দুই মাস আপনি আমাকে স্পর্শ করতে পারবেন না।”

—”মানে!”

—”মানে,আপনি আর আমি এক ঘরে থাকলেও আপনি ঘুমাবেন অন্যত্র।হয়তো নিচে না হয় খাটে।মোটকথা আপনি খাটে ঘুমালে আমি নিচে ঘুমাবো।আর আপনি নিচে ঘুমালে আমি খাটে।”

—”বাচ্চার কষ্টের সাথে আলাদা ঘুমানোর কি সম্পর্ক?”

স্বর্ণলতা স্মিত হাসলো।আর উল্টোদিক ঘুরে গেলো।এবার নরম সূরে বললো-
—”বাচ্চার বাবার,বাচ্চা জন্ম দেওয়া ছাড়াও বাচ্চার শোকে পাথর হতে পারে তা আপনাকে দেখে আমি বুঝিনি।সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুকে হারিয়ে যে কারো হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হবে।কিন্তু আপনি আলাদা থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন?হতেও তো পারে এ আমার মানসিক প্রস্তুতি।”

—”কিসের মানসিক প্রস্তুতি?”

—”হতে পারে তাদের হাতে আমার সদ্যজাত আরেকটি প্রাণ তুলে দেওয়ার। অথবা আপনাকে আবার নতুন করে ভালোবাসার।”

এবার রণক কিছুটা ঘাবড়ে গেলো।এবং বেশ খুশিও হলো।
ঘাবড়ে যাওয়ার কারন, বাচ্চা হারানোর শোক একটা বাবার অন্তরে কেমন ভাবে আচর কাটে সে তো তা জানেনা।তাই তার মধ্যে সেই ভাবটি সে ফুটিয়ে তুলতে পারেনি।অন্যদিকে মামা যেগুলো বলে দিয়েছে তাদের বাচ্চা প্রয়োজন।যত দ্রুত বাচ্চা দিতে পারবে তত দ্রুত এখান থেকে তারা বের হতে পারবে।দেরী হলে পাছে স্বর্ণলতার ক্ষতি না করে দেয় তারা।এই ভয়ে ভেতরটা কু ডাক ডাকছে।
অন্যদিকে সে যদি ২ মাস ভালোবাসার পরীক্ষা দিয়ে উর্ত্তীন হতে পারে তাহলে স্বর্ণলতা নিজ থেকেই তাকে ভালোবাসবে।এর চেয়ে বড় আনন্দের দ্বিতীয় টা আর হয়না!

রণক কে চুপ করে থাকতে দেখে স্বর্ণলতা বললো-
—”কি হলো!কি চিন্তা করছেন এতো?”

—“মামা বাচ্চা চেয়েছে।কি করবো?”

—”বাচ্চা কি আমরা তৈরী করবো?আল্লাহ পাক দিলে হবে।মামাকে বলে দিবেন আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।”

—”স্বর্ণলতা কষ্ট পেয়ো না।আমরা একদিন এখান থেকে খুব দূরে চলে যাবো।”
রণকের এই কথার উত্তর দিতে বোধহয় স্বর্ণলতার ইচ্ছে করলো না।
কিছুক্ষন চুপ থেকে সে রণক কে বললো-
—”আলাদা থাকার কথা আমাদের মধ্যেই যাতে থাকে।”

—”জানাজানি হলে মামা তোমার ক্ষতি করবে।আমি অবশ্যই তা হতে দিবো না।নিশ্চিত থাকো আমাদের মধ্যেই থাকবে”।

স্বর্ণলতা কিছুটা স্বস্তি পেলো।দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।রণক এর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।রূপকের মতো দেখতে হলেও এ ছেলের কিছুটা পার্থক্য আছে।রূপকের চোখ শীতল।আর রণক এর চোখ আগ্নেয়গিরির মতো।এই চোখে প্রেমের লাল গোলাপ ফুটলো কি করে!গোলাপের উল্টোপাশে কাটায় পরিপূর্ণ। আর রণক এর উল্টোপাশ কাটার মতোই যন্ত্রণাদায়ক ও বিষাক্ত।
রণক এর ডাকে স্বর্ণলতার ভাবনার সূতা ছিড়লো।
—”স্বর্ণকি দেখছো?”

—”আমার সামনে যে নির্দয় পুরুষটি দাড়িয়ে আছে তাকে দেখছি।”

—”হতে পারে তোমার কাছে আজ আমি নির্দয়।কিন্তু আমার মনের কুঞ্জ তে তোমার জন শতশত নীল পদ্মের আবাস করে তুলেছি।এ মন তো নির্দয় হয়নি।তবে কেনো একটা ভুলের জন্য এমন তকমা!”
—”আপনি একটু বাইরে বসুন।আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছে।”

স্বর্ণলতা এহেন উত্তরে রণক আর কিছুই বললো না।থাক সে একা।জোর করে ভালোবাসা ফুটিয়ে তোলা যায়না।কিছুটা ধৈর্য্য কিছুটা সাধনার প্রয়োজন হয়।
সে তার এক সমুদ্র পরিমান ভালোবাসা স্বর্ণলতার জন্য তোলা রেখেছে।এবার স্বর্ণলতার প্রেম সাগরে দেবার পালা।”

চলবে………….
Sharmin Sumi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here