#স্বর্ণলতা
পর্বঃ৩৯
________________
চারদিকে ঘন আধারে ছেয়ে গেছে।স্বর্ণলতা একা একটি ঘরে। পুরোনো সব স্মৃতি মাথা চারা দিয়ে উঠছে।এমন পরিবার কে সে আপন ভেবেছিলো যে পরিবার তার কাছের মানুষ গুলোকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো।খুব ঘৃনা হচ্ছে সবার ওপর।কত কিছুর লোভ দেখেছে সে।কিন্তু অমর হওয়ার লোভ প্রথম দেখছে।একটা ভন্ড সাধু অন্ধকার নরকের দরজা ঘেষে দাড়িয়ে আছে।আর দরজার ওপাশে নরকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার জন্য কিছু লোক খোদ হামাগুড়ি দিয়ে হাজির হচ্ছে।
একে একে সবাই শেষ হবে।নিশ্চিহ্ন হবে সবার অস্তিত্ব। কত বড় পাপাচারে লিপ্ত তারা।অবৈধ সন্তান,খু**ন,র**ক্ত,মৃতসাধন না জানি আর কতশত ভয়ংকর পাপ করে বসে আছে।
জাফরের ঘরে আলোচনা হচ্ছে।আর স্বর্ণলতা তার ঘরে প্রিয়জনদের স্মৃতিচারণ করছে।কতটা তফাৎ দুইঘরের ভেতর।এক ঘরে সব হারানোর কষ্টে অশ্রুভেজা স্বর্ণলতা।অন্যঘরে নিকষ কালো অন্ধকারে ষড়যন্ত্রের মলাট লাগানো একটা অধ্যায়।
জাফর রণক কে ঢোকানোর সবরকম পরিকল্পনা সবার সাথে আলোচনা করে নিলো।আজ গভীর রাতে রণক কে ডাকা হবে।তাকে নিয়ম মতো সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়া হবে।এ বাড়িতে ডাকা নিয়ে শোভা আপত্তি করে বসলো-
—”শোনেন ভাই,রণক কে এখানে ডাকলে ক্ষতি হতে পারে।স্বর্ণলতা কে আমি চিনি।ইদানিং ও বেশি ভয়নাক হয়ে যাচ্ছে।ও যদি রণক এর আসা টের পায় তখন কিন্তু ফলাফল খুব খারাপ হবে।কাল সকালে রনকের সাথে কথা বলবেন।
—”কথা ডা খারাপ কও নাই।কিন্তু রণক জেদ ধরছে আইজকা ও আশু সর্দারের লগে নাকি দেখা করবো।”
স্নেহা বললো-
—”কেনো!ও কি সব জেনে গিয়েছে নাকি?
—“না ঐসব জানে নাই।ওর খুব ইচ্ছা ও মরণ বান শিখবো।”
শোভা বললো-
—”মরন বান শিখবে মানে?কেনো শিখবে?আর আপনি এগুলো ওকে শিখান নি?”
—”তুমি তো জানোই আমি মরণ বান কাউরে শিখাই না।রণক ক্যান শিখবো জানিনা।তয় শিখলে আর শিখতে গেলে দুই ডাই বিপদ।যদি শিখতে যায় তাইলে আশু সর্দার যদি একবার স্বর্ণলতা রে ওর কাছে চাইয়া বসে ও তো হেরে খু*ন-ই কইরা ফেলবো।আর শিখলে ছ্যাড়া ডা কারে না কারে বান দেয়!!অহন ওই তো বিপদ।”
সবাই চুপ করে বসে রইলো।বিষয় টা আসলেই খুব গুরুতর। কেউ সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না।এর মধ্যেই উদয় হলো রণক এর।দরজা ঠেলে সোজা ভেতরে চলে আসলো।তাকে দেখে সবাই ভূত দেখার মতো চমকে গেলো।জাফর তো এইভাবে আসা নিয়ে ভীষন রেগে গেলো।
—”আক্কেল জ্ঞান কি সব পানির লগে গুলাইয়া খাইছোস?এমনে এই বাড়িত ঢুকলি ক্যান?”
—”তাড়াতাড়ি কন তো কি কইবেন।আমি আশু সর্দারের বাড়িতে যাবো।কাজ আছে।”
—”তোরে ডাকছিলাম স্বর্ণলতারে তোরে একবারে দিয়া দিমু এই জন্যে”।
রণক এতোক্ষণ বেখেয়ালি ছিলো।জাফরের মুখে এ কথা শুনে তার চোখ চকচক করে উঠলো।নিজের কান কে সে বিশ্বাস করতে পারছে না।নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরেকবার জিজ্ঞেস করলো-
—”কিছু বললেন নাকি?”
—”হ,কইলাম তো।ক্যান হুনোস নাই?”
—”না।আবার কন তো।”
—”স্বর্ণলতা রে তুই আইজ থিকা পাবি।কিন্তু কিছু শর্ত মানতে হইবো তোর”।
রণক নড়েচড়ে বসলো।আর নিম্নস্বরে বললো-
—”কি শর্ত বলেন।আমি সব শর্ত মানতে রাজি।”
মামা খ্যাক করে কেঁশে নিলো আর বলতে শুরু করলো-
—“প্রথম শর্ত-
★তুই আশু সর্দারের বাড়ির আশেপাশেও যাবিনা।হের থিকা মরন বান শেখা বাদ দেওন লাগবো।
দ্বিতীয় শর্ত-
★তুই আইজ থিকা রূপক।তোর নিজ অস্তিত্ব ভুইলা গিয়া রূপক সাইজা থাকতে হইবো।
তৃতীয় শর্ত-
★প্রেমে অন্ধ হইয়া কোন কাম করা যাইবো না।বড় কোন পদক্ষেপ লওয়ার আগে আমারে অবশ্যই জানাবি তুই।
যদি আমার দেওয়া শর্ত গুলা মানতে পারোস তাইলে কাইল ই তোরে স্বর্ণলতার সামনে হাজির করমু।
রণক বিনাবাক্যে সব শর্ত গুলো মেনে নিলো।সে রূপক হয়ে হলেও সারাজীবন স্বর্ণলতার পাশে থাকতে চায়।
প্রথম দেখাতেই হৃদয়স্পন্দনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো যে হৃদয়স্পর্শী নারী।তার স্পর্শে এক জনম কাটিয়ে দিতে চায়।
মনে মনে সে চিন্তা করে রেখেছে।জাফরের সব কাজে সে সাহায্য করবে।কিন্তু সে অমরত্ব লাভ করতে চায়না।সে চায়না অমর হতে।কারন সে অমর হলেও স্বর্ণলতা কখনো অমর হবে না।স্বর্ণলতা একদিন মারা যাবে।
প্রানের চেয়েও প্রিয় প্রেয়সির মৃত্যু শোক সে সহ্য করতে পারবে না।আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতো স্বর্ণলতার হাত ধরে সে বৃদ্ধ হতে চায় ।তাই সে রণক নামের অস্তিত্ব কে কবর দিয়ে রূপক হয়ে নতুন এক সূর্যদিপ্তীময় ভোরের প্রহর গুনতে লাগলো।
____________________
ভোর হয়ে গিয়েছে।সূর্যিমামা পূর্ব দিগন্তে আভা ছড়াচ্ছে।শীতের সকাল।স্বর্ণলতা খুব ভোরে ওঠে।সে নামাজ পড়ে।এ বাড়ির কারও ই নামাজে কোন মন নেই।ঘড়ির কাটা যখন ৯ টা সইসই তখন তাদের নিদ্রা কাটে।আজ এ বাড়িতে রণক আছে।স্বর্ণলতা সেটা জানতো না।নামাজ পড়ে একটু বাইরে বের হতে চায়।কিন্তু মেইন দরজায় তালা ঝোলানো থাকে।
তাই বাড়ির আঙ্গিনা ঘুরে দেখে।
সেই কাঠ কাটার জায়গা সেই দীঘি।তার স্মৃতিতে মন্টু আসে।কোনো এক সময় মন্টুর দখলদারিতে পুরো বাড়ি ছিলো।দিঘীর এ পাশে আসা স্বর্ণলতার জন্য নিষিদ্ধ ছিলো।
আজ তো সে এসেছে।কিন্তু বুবুজান বলে চিৎকার করে সাবধান করার সেই মন্টু নেই।
ঘুরতে ঘুরতে চোখ আঁটকে যায় দূরের এক গোলচত্বরে।বাড়িটা বিশাল বড়।আর মাঝখানে বাংলো।আর চারপাশে প্রচুর জায়গা।গোল চত্বরে ঝোপঝাড় দিয়ে ঢাকা।স্বর্ণলতা আগাতে থাকে।আগাতে আগাতে একেবারে গোলচত্বরের সামনে চলে আসে।
সামনে গিয়ে লক্ষ করে গোলচত্বরের সিমানা বেশ বড়।চারপাশ টা ছোট ছোট ঝাউগাছ দিয়ে পরিপূর্ন।কি আছে এখানে!
ঝাউগাছ গুলো দিয়ে জায়গাটা এভাবে বেষ্টিত করে রাখার মানে কি!
স্বর্ণলতা ঝাউগাছ ডেঙ্গিয়ে গোলচত্বরের মাঝখানে ঢুকে যায়।এখানকার মাটি বেশ নরম।আর ঘাসগুলো অতটা সতেজ লাগছেনা।মনে হচ্ছে এখানে মানুষের যাতায়াত আছে। ঘাস গুলো হলদেটে হয়ে নুইয়ে আছে।অন্যঘাস গুলো বেশ সবুজ।কিন্তু এগুলো এমন হলদেটে কেনো!
স্বর্নলতার বেশ সন্দেহ হয়।
মাটি গুলো এমন আলগা আলগা।
শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে নেয়।বসে পড়ে স্বর্ণলতা।এবার মাটিগুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই কিছু মাটি উঠে আসে।
স্বর্ণলতার এবার বেশ সন্দেহ হয়।মন্টু তাকে এদিকে আসতে বারণ করতো।আর এইদিকে এমন গোলচত্বর।তার ওপর মাটি গুলো আলগা।মনে হচ্ছে কেউ মাটিগুলো খুঁড়েছে।আবার চাপা দিয়ে রেখেছে।
স্বর্ণলতা এবার হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাত দিয়ে ক্রমশ মাটিগুলো সরাতে লাগলো।তার বের করতেই হবে এই খানে কি আছে।
হঠাৎ জাফরের হুংকার-
—”এই মাইয়া! তোমার এইহানে কি?বেশি সাহস বাড়ছে?তোমারে কি অহন শিকল বেড়ি পরাইয়া ঘরে বাইন্ধা রাখা লাগবো?”
স্বর্ণলতা হকচকিয়ে যায়।আর বলে-
—”এইখানে কি মামা?এখান কার মাটি এমন আলগা কেনো?
—”এই হানে জাহান্নাম।যাইবা জাহান্নামে?তাইলে একটা কোদাল আনি।আর এইহানেই জিন্দা কবর দিয়া দেই।”
—”আমি মরে গেলে আপনি বাচ্চা পাবেন কোথায়?”
—”সেই চিন্তা আমার।দরকার হইলে অন্যত্র খুঁজমু।তবুও কথা না শোনা বজ্জাত মাইয়া লোক আমি বাঁচাইয়া রাখমু না।”
স্বর্ণলতা গোলচত্বর থেকে বের হয়ে আসলো।মামার সাথে এখন তর্কে যাবে না।কিছুদিন পর উল্টো চাল দিয়ে বাজিমাৎ করবে।আজ না হয় তাকে জিততে দেওয়া যাক।
স্বর্ণলতা কোন কথা না বলে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো।
আর চিন্তা করতে লাগলো-
–”এখন ভোর ৬ টা। মামা এতো ভোরে কখনো ওঠেনা।আজকে কিভাবে এতো ভোরে উঠলো!আর উঠেই আমি যে এদিক এসেছি সেটা সে জানলো কি করে!!নিশ্চয়ই কেউ আমাকে অনুসরণ করেছে।আর আমাকে এখানে আসতে দেখে মামাকে খবর টা দিয়েছে।কিন্তু কে সে?
মেহুল কোনদিনও হবেনা।ও এমন কাজ হয়তো করবে না।তাছাড়া ও নিজেই ঘুম কাতুরে।আর কে হবে!
মা,রূপকের মা,নীরব কেউ তো কোনদিন ও এতো জলদি ওঠে না।
জলদি ওঠে স্নেহা আপু।ভোর ৭ টায় তার ঘুম ভাঙে।তাহলে কি স্নেহা আপু!!
নাহ্ কি সব ভাবছি আমি!স্নেহা আপু তো কালকে আমাকে সব বললো।সে কি বেঈমানী করবে!!
নাহ্ একবার স্নেহা আপুর ঘর টা দেখা দরকার।”
স্বর্ণলতা দ্রুত হেঁটে স্নেহার ঘরের দিক ঢুকলো।নাহ্ স্নেহার দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ।তার মানে তারা কেউ ঘুম থেকে উঠেনি।তাহলে মামা কি কাকতালীয় ভাবে জেগে গেলো।!!
জাফর আবারো স্বর্ণলতাকে দেখে কটকট করে বললো-
—”আবার এইহানে কি তোমার!যাও ঘরে যাও।সাত সকালে এতো ঘোরাঘুরি কিসের?”
স্বর্ণলতা নিশব্দে স্থান ত্যাগ করলো।
________________
পাঠকদের জন্য কিছু কথাঃ-
প্রকৃত কারন টা হচ্ছে রণক স্বর্ণলতার ঘরের আশেপাশে সারারাত ঘুরঘুর করেছে।প্রেমিকের মন আর মানছে না।যেই অশুদ্ধ প্রেমে নিজেকে শুদ্ধ করতে চেয়েছে। সেই প্রেম তার বাহুডোরে ধরা দিচ্ছে।মহা অন্যায়ের প্রলয় ঘটেছিলো সেদিন,যেদিন সে তার বড় ভাইয়ের বউয়ের প্রেম সাগরে ডুব দিয়েছিলো।
পরিবার ছিঃ ছিঃ করেছে।মার খেয়েছে বাজে কথা শুনেছে।তবুও স্বর্ণলতার নিষ্পাপ চাহনি সে ভুলতে পারেনি।হৃদয় দোলানে হাসিতে মরেছে বারংবার।সরল চোখের চাহনি তে দিক ভোলা হয়েছে।স্বর্ণলতার রূপের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে।
পাপের স্বর্গে বাস করে পবিত্র এই প্রেম তার ভিতরে এলো কোথা থেকে!
প্রেম তো পবিত্র।কিন্তু এ যে তার ভাবী!
তার এই পবিত্র প্রেমকে এই একটা শব্দই কলুষিত করেছে।দিয়েছে অপবিত্র প্রেমের তকমা।
ও তোমার ভাবী।করোনা এ প্রেম।
প্রেম তাহার অবুঝ তোতাপাখি।বড্ড ছন্নছাড়া।তাই কারও কথা বাঁধনে না বেঁধে একাই ডানা ঝাপটেছে।আর স্বর্ণলতাকে নিজের করে পাওয়ার আকাঙ্খা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।
অপেক্ষার রজনী আজ শেষ।নতুন ভোরে নতুন করে স্বর্ণলতার মুখ দেখার জন্যই সে চাতক পাখির মতো সূর্যের ওঠার অপেক্ষা করছিলো।চারপাশ পায়চারি করেছে সারারাত।ভোরে দরজা খোলার শব্দে লুকিয়ে গিয়েছিলো।যখন দেখলো স্বর্ণলতা বাইরে যাচ্ছে তখন তাকে অনুসরণ করতে লাগলো।যখন স্বর্ণলতা দিঘীর পাশে যাচ্ছিলো তখনি সে দৌড়ে এসে মামাকে খবর দেয়।কারন সে তো তার সামনে গিয়ে আটকাতে পারবে না।এমতঅবস্থায় যা করার মামাই করতে পারবে।তাই দ্রুত সে মামার ঘরে দৌড়ে যায়।মামা তৎক্ষনাৎ গিয়েই স্বর্ণলতা কে সরিয়ে নিয়ে আসে।
এই খবর স্বর্ণলতা জানেনা।স্বর্ণলতা হয়তো পরে জানতে পারবে। অথবা জানতেই পারবে না।পুরো ব্যাপার টা তার কাছে ধোঁয়াশাই থাকবে।হয়তো বিশ্বাস করবে হঠাৎ করে মামার আগমন পুরোটাই কাকতালীয় বিষয়।
আপাতত স্বর্ণলতার কাছে বিষয় টা ধোঁয়াশা থাক।পাঠকরা এই বিষয় টার পর্দা উন্মোচন করুক।কার ডাকে মামা ওরফে জাফরের ঘুম ভাঙলো।
চলবে……….
Sharmin Sumi.