স্বর্ণলতা part 34

0
351

#স্বর্ণলতা
পর্বঃ৩৪
___________
পথ টা এতো দূর কেনো মনে হচ্ছে!সহস্র মাইল হেঁটে আসার পর শরীরটায় ক্লান্তি রা ঠিক যেমন করে ভর করে,স্বর্ণলতার শরীর ও ঠিক তেমন করে ভারী হয়ে আসছে।পা চলছে না।অতিরিক্ত চিন্তা মনের দেয়াল ভেদ করে চোখে মুখে ফুটে উঠেছে।এতটুকু পথ তার সহ্য হচ্ছেনা।চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে।আর বার বার হোঁচট খাচ্ছে।আর মন্টু ধরে ফেলছে।
—”সাবধান বুবুজান।সাবধানে হাটেন। বাচ্চার কিছু হইবো না”।
স্বর্ণলতাও মনে মনে সুরা পড়ছে।আর দোয়া করছে যাতে তার বাচ্চা টা সুস্থ থাকে।

হাটঁতে হাঁটতে মন্টু বললো-
—”বুবুজান!আপনি কি আমারে কোনদিনও মাফ করতে পারবেন?”

—”এসব কথা এখন বলার সময় মন্টু?”

—”আপনে এই শীতের মধ্যেও প্রচুর ঘামতাছেন।আমরা তো জঙ্গলেই যাইতাছি আপনে চিন্তা কইরেন না বুবুজান”।

—”মন্টু!আমার বাচ্চাটাই আমার শেষ সম্বল।আমার বাচ্চাটাকে আমার বাঁচাতেই হবে।”

—”বুবুজান,আমরা কেউ জানতাম না যে বাচ্চা তারা মাইরা ফেলবো।আমি আর মেহুল ভাবছি বাচ্চা হয়তো কাউরে বিক্রি কইরা দিবো।আমগো এইহানে অনেক মানুষ আছে যারা বাচ্চা কেনে।”

কপালে ভাঁজ পড়লো স্বর্ণলতার।আর উৎসুক দৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে একবার মন্টুকে দেখে নিলো।
—”বাচ্চা কেনে কেনো!!কি করে বাচ্চা দিয়ে?”

—”অনেকের পোলাপান হয়না আবার অনেকে বিদেশ পাচার করে।”

—”তোমার কুসুম বুবুর কি হয়েছিলো?”

—”হে খুব সুন্দর আছিলো।ঠিক আপনার মতো।মায় হেরে বিয়া দেয়।এরপর হের শ্বশুর বাড়ি গিয়া উঠে।ঐ হান থিকা জাফর চাচা একবার বুবুরে দেহে।আমার দুলাভাইয়ের কি যেনো হইতো হে।
বুবুরে দেইহা তার ভালা লাগে।কয়েকবার কু প্রস্তাব দেয়।কিন্তু নাকি বুবু রাজি হয়না।পরে মায়ের লগেও কথা কয়।তহন বুবুর পেটে বাচ্চা ছিলো।বাচ্চা সহ জাফর চাচা নাকি বুবুরে বিয়া করতে চায়।”

স্বর্ণলতা এক দলা থুথু ফেলে ঘৃনা ভরা কন্ঠে বলে উঠলো-
—”ছিঃ এতো জঘন্য মানুষ হয়!!”
মন্টু আবারও বলতে শুরু করলো-
—”পরে যখন কেউ রাজি হয়না। তহন বুবুর চরিত্র নিয়া আজেবাজে কথা কইয়া বুবুরে ঘর ছাড়া করে।তহন বুবু আমগো বাসায় থাকতো।আমি তখন খালি এইটুকু বুঝি যে আমার কুসুম বুবু আগের মতোন আর হাসি খুশি নাই।আমার দুলাভাই ও আর আইতো না।
শেষে নাকি জাফর চাচা মায়েরে সকাল বিকাল হুমকি দিতো।কুসুম বুবুরে হের লাগবো ই।মায়ে বুঝতো না ক্যান হে এমন করে।

একবার কুসুম বুবুরে নাকি একলা ঘরে পাইয়া ইজ্জতের ওপর হামলা দিছিলো। মায়ে আইয়া পড়ায় আর পারেনাই।কুসুম বুবুর তহন ৮ কি ৯ মাসের পোয়াতি।”

—”এতো কিছু তুমি কি আজকে শুনেছো?”

—”হ, আইজ আমার আম্মা আমারে সব খুইলা কইছে।”

—”তারপর তোমার কুসুম বুবুর বাচ্চা কিভাবে নিলো?”

—”সেইদিন জাফর চাচা মায়রে হুমকি দিছে যে এই ঘটনার কথা যদি আম্মা কাউরে জানায় তাইলে নাকি উল্টা আমগো দোষ হইবো।আমার বাপ ছিলো না।হের লিগা মা ভয় পাইতো।আবার আমি ছোডো ছিলাম।আমারে মাইরা ফেলানোর ও ভয় দেহাই তো।

বুবুর যহন বাচ্চা হয় তখন দাই রে দিয়া বাচ্চা হে নিয়া নেয়।আর আম্মা ঠিক-ই বুঝে বাচ্চা কেডা নিছে।অনেক খুঁইজা হেরে বাইর করে।কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হইয়া গেছিলো গা।হে আমার কুসুম বুবুর বাচ্চারে জবাই করে।সেদিন হের সাধু রূপ দেইখা আম্মা খুব ডরায়।আর হে মরন বান দিতে পারে।হে আমার ওপর মরন বান দিবো এগুলা কইয়া আম্মারে চুপ করাইয়া দেয়।হেই থিকা নাকি আমরা হেরে ডরাই।হের কথা মতো চলি।আম্মা খালি একটা কথা কইতো,যে ছোট নিষ্পাপ বাচ্চারে এমনে জবাই করতে পারে হে দুনিয়ার সবকিছু পারে।আমি যাতে তার কথা মতো চলি।”

স্বর্ণলতা অপলক দৃষ্টিতে মন্টুকে দেখছিলো।
—”তোমার মা বোধহয় জানতো যে আমার সাথেও এমন কিছু হবে?”

—”হ,জাফর চাচা কিন্তু জন্ম নক্ষত্র দেইখা মাইয়া বাছে।আপনার নাম আগেই কইছিলো আম্মারে।আপনারে যহন এইহানে আনা হয় তার আগেই আম্মারে কইছিলো।
আমিও হেরে ভয় পাই।কারন হে আমারে খুব মারতো।হে খুব খারাপ বুবুজান।”

মন্টু আর স্বর্ণলতা হাটঁছে আর হাঁটছে।আর মন্টুর মুখে মামার নোংরা অতীত শুনে মামাকে তার মেরে ফেলতে মন চাচ্ছে।

অন্যদিকে স্নেহা আর সৈকত কে দেখে মেহুল হতবাক!এখানে এভাবে তাদের তো আসার কথা না।আবার স্নেহা কান্না করছে।পেটের দিকে তাকিয়ে মেহুল বুঝতে পেরেছে তার বাচ্চা বেঁচে নেই।
—”আপা!আপনার কি বাচ্চা……”

—”আর কিছু বলিস না মেহুল।আমার বাচ্চা আর পৃথিবীতে নেই।আমি অনেক পাপ করেছি। যার শাস্তি এখন পাচ্ছি।”

—”আপা জানেন?স্বর্ণলতা আপামনির বাচ্চারে মামা বিক্রি কইরা দিবো।”

—”কে বলেছে তোকে বিক্রি করবে?”

—”ক্যান?মন্টুভাই কইলো!”.

—”আসার সময় যেই ছেলেটাকে দেখলাম সে কি মন্টু?”

—”হ,হেই মন্টু”।

স্নেহা সৈকতের দিকে তাকালো।আর বললো-
—”আমি কি এতোদিন ভুল জেনেছি?”

—”তুমি ভুল জানোনি।তোমার ঐ শয়তান মামা সবকিছু করেছে।তোমাকে একটা কথা লুকিয়েছি আমি।যেদিন স্বর্ণলতা আমাদের বাড়িতে যায় ও আমার কাছে সবকিছু জানতে চায়।তুমি কেনো ঐ বাড়িতে থাকোনা।তোমার কসমের জন্য মেয়েটাকে কিছু বলিনি।কিন্তু একটা চিরকুট লিখেছিলাম।চিরকুট টা তে বলেছিলাম
‘ওর জঙ্গলে যাওয়ার সঙ্গী থেকে দূরে থাকতে।’
পুরোটা বললে মেয়েটার এমন দিন দেখতে হতোনা।’

—”আমি দায়ী সবকিছুর জন্য।এইজন্য আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিয়েছে।”

—”কেঁদোনা স্নেহা।এখন তো আমরা ওকে সাহায্য করতে এসেছি।ওকে সব বলবো আমরা।”

___________________
মন্টু আর স্বর্ণলতা জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেলো।আর গাছ এবং কুয়াশার ফাঁকে কিছু বাতি দেখতে পেলো।নিশ্চয়ই এখানে তারাই সাধন করছে।এবার পা টিপেটিপে দুজন হাঁটা শুরু করলো।যতকাছে তারা আসছে তত কাছেই আলোকছটা টা স্পষ্ট হতে লাগলো।আর স্বর্ণলতার বুকটা ধুক ধুক করে উঠলো।হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে।
আশেপাশে শত শত ঝি ঝি পোকার ডাক।
একটা ছোট্ট কুটির।ছনের ঘড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে হারিকেন আলো বেড়িয়ে আসছে।কি একটা ভূতুড়ে পরিস্থিতি!
কেউ প্রান নেওয়ার আয়োজনে মগ্ন।অন্যদিকে দিশেহারা এক মায়ের তার নাড়ি ছেড়া ধনের প্রান বাঁচাতে রুগ্ন শরীর নিয়ে ছুঁটে এসেছে।
এদিক ওদিক তাকালো স্বর্ণলতা।দূর দূর শুধু অন্ধকার।জঙ্গলের মাঝটা একদম ঝকঝকে পরিষ্কার। মাঝখানে একটা মশাল জ্বালানো। চারপাশে গোল করে মোমবাতি আর হারিকেন জ্বালানো।মাঝখানে একটা ঝুড়ি।

স্বর্ণলতার ফিসফিস আওয়াজ করে মন্টুকে বললো-
—”এ তো পুরো নিস্তব্ধ এক ভূতপুরী লাগছে।মামা কোথায় আর আমার বাচ্চাকে কোথায় রেখেছে জানো?”

—”আপামনি আমি তো জানিনা।তয় আমি কি গিয়া দেখমু?”

—”তোমাকে না বলেছে তারা ঢাকায়? আর তোমাকে তো জানাতে চায়না তাহলে তুমি কিভাবে যাবে?গিয়ে তো সন্দেহের মধ্যে পড়বে।”

—”আমার আম্মা তো সব জানেই।আমি গিয়া কিছু একটা ব্যবস্থা করবার পারমু।আপনে খালি চুপ কইরা এইহানে দাড়ান।”

দুই কদম এগুতোই পিছনে ফিরে মন্টু বললো-
—”আইজ মনে হয় অমাবস্যা। এতো আলো জ্বালানোর পরেও জায়গা গুলা অন্ধকার লাগতাছে।অস্পষ্ট সব কিছু।আপনে সাবধানে থাকেন।”

এই বলে মন্টু যেইনা গাছপালা ঠেলে ভেতরে ঢুকবে অমনি স্বর্ণলতা ওর হাত ধরে পেছনে টেনে নিয়ে আসলো।আর মুখ চেপে ধরে বললো-
—”শব্দ করোনা।ঐ যে এইমাত্র একজন লোক বের হলো ঘর থেকে।আর এই লোকটাই হলো আমার সৎভাই।পৃথিবীতে দ্বিতীয় জঘন্য ব্যক্তি।ও থাকলে ঠিকি বুঝে যাবে তুমি এখানে কেনো আছো।ওরা যেহেতু বের হয়েছে সেহেতু আমরা আরেকটু অপেক্ষা করি।নিশ্চয়ই বাচ্চার কথা কিছু বলবে।”

দুজনেই একদম নিশ্চুপ হয়ে কান খাড়া করে শুনতে লাগলো।নিরবের সাথে একটা লোক বের হলো।লোকটাকে মন্টু বা স্বর্ণলতা কেউই চিনেনা।দুজনের কথা পুরোপুরি স্পষ্ট ছিলো না।শুধু এতোটুকু বুঝতে পারলো যে গোলচত্বরে রাখা ঝুড়িটার মধ্যেই বাচ্চাটা রাখা।আর তাদের আর কিছুক্ষণ বাকী।এরপরই তারা নাকি তাদের কাঙ্খিত ফলাফল টি পেয়ে যাবে।
স্বর্ণলতা এবং মন্টু দুজনেই বাচ্চার সন্ধান পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো।তারপর নীরব আর ঐ লোক যখন ঘরের ভেতরে গেলো তখন তারা আরও বড় সুযোগ পেলো।স্বর্ণলতা পা টিপে টিপে গোল চত্বর ডেঙ্গিয়ে বাচ্চাটাকে ঝুড়ি থেকে নিয়ে দৌড় দিলো।এদিকে মন্টু দৌড় দিতে গিয়ে পিছলে পড়ে গেলো।আর পুরো মোমবাতি সহ সবকিছু একসাথে পড়ে যাচ্ছিলো।স্বর্ণলতা পেছনে না ফিরে তার বাচ্চাকে নিয়েই দৌড় দিলো।

মিনিট ১০ এক পর সে হাঁপিয়ে গেলো।এই কুয়াশার মধ্যে সে শুধু দৌড়িয়েছে।শা শা করে বাতাস কানে লাগছে।আর সে দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে।আজকে তার পা চললেই আগামীদিন তার বাচ্চার পা ও চলবে।অন্যথায় এখানেই থেমে যাবে সে এবং তার ছোট্ট সন্তান।এক পর্যায়ে হাঁপাতে হাঁপাতে একটা নদীর সামনে আসলো।এইখানে কোন নৌকা নেই।কিভাবে অতিক্রম করবে এই পথ!নানা চিন্তা মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছিলো।আর সে দোয়া পড়ছিলো।এমন সময় তোয়ালে ভেজা কিছু অনুভব করলো।এতো গাঢ় অন্ধকারে সে কিছুই বুঝতে পারছিলো না।বারবার তোয়ালে থেকে হাত দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলো।এমন সময় সে বাচ্চার গলায় হাত দিলো।আর দেখলো বাচ্চার গলা থেকে তরল জাতীয় পদার্থ বের হচ্ছে।

তার আর বুঝতে বাকী রইলো না এটা তার বাচ্চার রক্ত।তার বাচ্চা জান্নাতে চলে গিয়েছে।আল্লাহর কাছে গিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।তাই তো মায়ের বুকে তার আর ঘুম ভাঙছেনা।বাচ্চাকে নাড়ালো স্বর্ণলতা।নাহ! বাচ্চার কোন নড়াচড়া নেই।ধপ করে কাঁদা মাটির মধ্যে বসে পড়লো স্বর্ণলতা।বাচ্চার গলায় বাচ্চার মুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।আর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-
—”এই! কল্প! তোর নাম কল্প।তোর বাবা রেখেছিলো এই নাম টা।নাম টা শোনার আগেই অভিমানে হারিয়ে গেলি?তোর কিসের এতো অভিমান ছিলো মায়ের প্রতি?তোকে গর্ভে নেওয়া আমার পাপ রে সোনা।আমার এই অভিশপ্ত জীবনে তুই ফুল হয়ে এসেছিলি রে!আমি তোকে বিষাক্ত পোকার হাত থেকে রক্ষা করতে পারিনি রে!নির্মম যন্ত্রণা নিয়ে তোকে পৃথিবীর ছাড়তে হলো।সামান্যতম মায়ের আদর ও পেলিনা?”

কপালে চুমু দিয়ে বললো-
—”দেখ সোনা,তোর মা তো তোকে আদর করছে।দেখবি না?উঠ একটু সোনা! একটু কান্না কর।তোর মায়ের বুকটা যে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। বুকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।নিভাবিনা বাবা?একবার ওঠ! দেখ তোর মা তো তোকে আদর করছে! তোর কি অভিমান ভাঙবে না রে বাবা?আমার লক্ষী বাবা।ঘুমা তুই ঘুমা।আমার বুকে ঘুমা।”

কিছু সেকেন্ড পর স্বর্ণলতা পাগলের মতো বাচ্চাকে ঝাকাতে লাগলো-
–”কিরে উঠবি না!এতো নিশ্চিতে ঘুম তোর?তাহলে তোর মা কে নিয়ে যা।আমিও তোর সাথে ঘুমাতে চাই রে সোনা।আমাকে নিয়ে যা! আল্লাহ!!!!!!আমার মৃত্যু দাও।আমাকে আমার বাচ্চার থেকে আলাদা করোনা খোদা।
এমন সময় পেছনে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলো।মনে হলো কেউ শক্ত কোন কিছু দিয়ে মাথায় মেরেছে।
চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেলো।আস্তে আস্তে পানির একপাশে কাঁদামাটিতে লুটিয়ে পড়লো স্বর্ণলতা।

চলবে…………..
®Sharmin Sumi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here