স্বর্ণলতা part 25

0
365

#স্বর্ণলতা
পর্ব-২৫
______________
মেহুল আর স্বর্ণলতা ঘরে চলে গেলো।এই বাসাটায় ৬ টা ঘর আছে।স্বর্ণলতা যে ঘরে ছিলো সেটা পুরোপুরি বদ্ধ।
জানালা নেই।এইজন্য লাইট অফ করে দিলে পুরো পাতাল পুরী হয়ে যায়।
বাড়ির পেছন টা ঝোপঝাড়ে ভরা।মন্টু প্রতি সপ্তাহে একবার করে সেগুলো পরিষ্কার করে।
বাগানে নানারকম ফুল ফুটেছে।ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক।পুরো বাসা একবার ঘুরে দেখলো স্বর্ণলতা।স্বর্ণলতা ভাবছিলো,বাসায় মানুষ মাত্রই তারা তিনজন।এখানে দুই জনই স্বর্ণলতার দেখাশোনার কাজে আছে।স্বর্ণলতা নিশ্চিন্তে বাসাটা ঘুরে দেখতে পারবে।এখানে কেউ তাকে বারণ করবে না।এটা করোনা,ওটা করোনা,ওদিকে যেওনা।যখন তখন সে ছাঁদেও উঠতে পারবে।পুরো বাড়ির ছয়টা ঘর ই খুলে খুলে দেখবে সে।
বেশ নিশ্চিন্তে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দরজা,জানালা,আসবাবপত্র গুলো পর্যবেক্ষন করে নিচ্ছে।এখানে সে শাসন করবে।তাকে শাসন করার মতো কেউ নেই।

স্বর্ণলতার ধারনা ভুল প্রমানিত করে দিয়ে মন্টু গলা খ্যাক করে কেশে বললো-
—”বুবুজান,এ বাড়ির ডানপাশের দুইটা ঘরে যাওয়া নিষেধ।”
হকচকিয়ে মন্টুর দিকে তাকালো স্বর্ণলতা।ছেলেটার গা বেয়ে পানি পড়ছে।বাইরে তো বৃষ্টি নেই।ভিজলো কি করে!
—”বুবুজান ঘরে যান।”

—”তাই,এদিকে যাওয়া নিষেধ?কে নিষেধ করেছে?”

—”বাড়ির মালিক”।

—”বাড়ির মালিক টা কে?”

—”বলা নিষেধ”।

স্বর্ণলতার ক্রোধ উচ্চশিখরে পৌঁছে গেলো।মাথা টগবগিয়ে রক্ত গুলো এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।মনে হচ্ছে এক্ষুনি ফেটে বেড়িয়ে পড়বে।তবে এখন রাগ করা যাবেনা।নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-
—”ভিজলে কি করে?বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছেনা!”

মন্টু নিশ্চুপ…
—”বলছো না কেনো?নাকি এটাও বলা নিষেধ?”

—”পুষ্কুনিতে পইরা গেছিলাম”।

স্বর্ণলতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই মন্টু দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো।

স্বর্ণলতা ব্যাঙ্গ করে তাদের মতো অভিনয় করে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলছে-
—”আজব নাকি এরা! একজনকে জিজ্ঞেস করলে বললে
দোহাই আপা জিগাইয়েন না।আবার আরেকজন এর মুখে এক বুলি,বলা নিষেধ বলা নিষেধ।আবার কথা শেষ না করেই দৌড় লাগায়।নাহ্ মন্টু ছেলেটা কে বাগে আনা কঠিন হবে।তবে ওকেই আনতে হবে।মেহুল অসহায়।ওকে জোর করলে ও হয়তো বলবে তবে ওর ক্ষতি হবে।এর আগের ঘটনা তো আমি নিজ চোখেই দেখলাম।নীরব আমার ওপর হামলা না করলে তো ওকে আমি কখনোই খুঁজে পেতাম না।ওকে আর হারাতে চাইনা”।

—”আপামনি,ও স্বর্ণআপামনি।কি করেন এনে?এলকা এলকা কার লগে কথা কন?”

—”নিজের সাথে কথা বলি।এখানে আমি ছাড়া আর আছে কে?”

—” ক্যান আমরা আছি না!”

—”তোমরা! তোমরা মানুষ নাকি?তোমরা তো ব্যাটারি চালিত পুতুল।যে ভাষা মাথায় সেইভ করে দেওয়া সে বুলি-ই আওরাতে থাকো।”
মাথা নিচু করে থাকে মেহুল।
স্বর্ণলতা গালে হাত দিয়ে বলে-
“চলেন ম্যাডাম আর মন খারাপ করে থাকতে হবে না।ঘরে কি কিছু আছে?ক্ষুধা লেগেছে।”

—”হ আপামনি,আপনার লিগা আমি পরোটা আর ডিমভাজি কইরা রাখছি”।

—”চলো তবে,খেয়ে পেট টা কে শান্তি দেই।”

স্বর্ণলতার মনে হলো অনেকদিন পর সে তৃপ্তি করে খেলো।মেহুল চলে যাবার পর সে অসম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো।আজকে তার পরিপূর্ণ লাগছে।
খাবার শেষে বাইরে বসে আছে।এর মধ্যে মেইন গেইটে ঠকঠক আওয়াজ আসে।মন্টু গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
একটা মধ্য বয়স্ক মহিলা।মাথায় কাঁচাপাকা চুল ভর্তি।এই বয়সেও এতো রূপ তার!গায়ের রং কাচা হলুদের মতোন।হাতের চামড়া কিছুটা ভাঁজ হয়ে গিয়েছে।
এটা যে মন্টুর মা সেটা স্বর্ণলতার চিনতে খুব বেশি অসুবিধা হলো না।মন্টুর চেহারার সাথে তার মায়ের চেহারার মিল আছে।মহিলা ভেতরে ঢুকে মন্টুকে দেখে একটা হাসি দিলো।

স্বর্ণলতাকে আড়চোখে দেখতে পেয়ে মন্টুকে ঠেলে ভেতরে আসলো।স্বর্ণলতার কাছে এসে আপাদমস্তক জহুরীর মতো পরখ করে নিলো।
আর মিনমিনয়ে বললো-
—”আল্লাহ গো আল্লাহ! এতো সুন্দর মাইয়া!জীবনেও তো এতো সুন্দর মাইয়া দেখিনাই আমি।মনে হইতাছে পরী বইসা আছে।”
একটু কোমল সুরে প্রশ্ন করলো-
—” নাম কি তোমার মাইয়া?তুমি দেখতে খুব সুন্দর”।

—”আপনিও খুব সুন্দর। আপনার নাম কি?”

—” হে হে,আমার নাম সাইবুরি।”

—”খুব সুন্দর নাম তো!আমার নাম স্বর্ণলতা।”

স্বর্ণলতা নাম শোনা মাত্রই ফুরফুরে হাসি মাখা উজ্জ্বল মুখটা অমাবস্যার মতো অন্ধকার হয়ে গেলো।মনে হচ্ছে রোদেলা দিনে সূর্যকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আষাঢ়ি কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।খানিকক্ষণ পর নামবে বৃষ্টি।সাথে ভয়ংকর শব্দ করে বজ্রপাত ও।একরাশ বিষন্নতায় নিয়ে
করুন সুরে বললো-
—”তুমি-ই স্বর্ণলতা”!

—”আপনি আমাকে চেনেন?”

—”হায়রে,পোড়া কপাল।আল্লাহ কি খেলা দেখাইলা তুমি”।
জানোস তোর মুখটা আমার মরা মাইয়ার মতোন।আর তুই-ই কিনা স্বর্ণলতা!তোরে দেইখা খুব মায়া লাগতাছে আমার।আমার মাইয়ার নাম আছিলো কুসুম। হে……..

পুরো কথা শেষ করার আগেই মন্টুর ধমকের সুরে কেঁপে উঠলো তার মা।
—”আম্মা,যান এইহান থিকা।আপনারে আইতে নিষেধ করছিলাম না?হুদাই নিজের বিপদ নিজে ডাইকা আনতাছেন। যান কইলাম।অহন যান।”
ছেলের ধমকে সাইবুরি কিছুটা ভীত হলো।
—”হ বাপ যাইতাছি, যাইতাছি।পটলায় মাছ ভাজা আনছিলাম খাইয়া লইস”।(কপালে আদর করতে করতে বললো)।
—”হ খামুনে যান।”

করুন চোখে একবার স্বর্ণলতার দিকে তাকিয়ে সাইবুরি চলে গেলো।স্বর্ণলতার ঐ চোখ দুটো দেখে মনে হলো সে অনেককিছু দেখতে পেলো।কিন্তু তার চোখের ভাষা সে পড়তে পারলো না।কারন সে তো তাদের ভাষা জানেনা।যদি ভাষা জানতো হয়তো পড়তে পারতো।হয়তো অল্প,তবুও তো কিছুটা জানতে পারতো গল্প।

—”মন্টু!!এদিকে এসো।মায়ের সাথে কেউ এমন ব্যবহার করে?আর কোনদিনও যেনো না দেখি।আর সে আমাকে দেখে এতো সুন্দর বললো আর নাম শুনে এমন আফসোস কেনো করলো?সে কি বলতে চেয়েছিলো?”

—”বলা নিষেধ”।
মন্টু যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই স্বর্ণলতা হাত খপ করে ধরে ফেললো।-
—”এই! এক পাও নরবে না।আমার কি কথা শেষ হয়েছে?”

—”কন বুবুজান।”

—”আচ্ছা যাও,কি আর বলবে?একটা কথাই তো শিখেছো-
‘বলা নিষেধ’।

মন্টু চলে গেলো।স্বর্ণলতাও আগ বাড়িয়ে কিছু বললো না।মনে মনে ভেবে নিলো,আজ গভীর রাতেই ডানপাশের ঘর গুলো তে যাবে।কি এমন আছে সেখানে!একদম নিষিদ্ধ যাওয়া।আর মন্টুর মায়ের কথা সে পাত্তা দিলো না।তার এতোটুকু মাথায় এতো রহস্যের জায়গা হচ্ছেনা।
কতশত অজানা প্রশ্ন তার মাথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।একটারও সঠিক উত্তর সে মিলাতে পারেনা।
তাই আর ভাবলো ও না।যা হবার দেখা যাবে।

দুপুড় গড়ালো।দুপুরে হাসের মাংস রান্না করেছিলো মেহুল।
খাবার টেবিলে মন্টু তৃপ্তি করে হাসের মাংস খেলো।
মনে হচ্ছিলো তার হাসের মাংস খুব প্রিয়।
স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করলো-
—”তোমার কি হাসের মাংস খুব প্রিয়?”
মন্টু নিশ্চুপ….
একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো-
—” কি,বলা নিষেধ?”

—” হ প্রিয়,কিন্তু আমার মায়ের হাতের রান্দন।”

—”সে কি যেনো খাবার দিয়েছিলো খেয়েছো?

—”হ”।
ভ্রু কুঁচকে স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করলো-
—”একাই খেলে!!আমাদের একটুও দিলে না?”
মন্টু বোধহয় লজ্বা পেয়েছে।
প্লেটের কিছুটা খাবার অবশিষ্ট রেখেই প্লেট নিয়ে উঠে পড়লো।

স্বর্ণলতা আর মন্টু কে ঘাটালো না।রাতের সব প্ল্যান সে করে রেখেছে।কিভাবে যাবে,গিয়ে কি করবে।তার মাথায় দুনিয়াদারির কিছুই এখন ঘুরছেনা।সে শুধু জানতে চাচ্ছে কেনো মন্টুর এতো কড়া নিষেধ!কি সমস্যা ওখানে গেলো।সে গিয়েই ছাড়বে।সারাদিন খোশমেজাজে থাকলেও,
রাত হওয়ার অপেক্ষা করছিলো স্বর্ণলতা।রাতের খাবার শেষ করে বিছানা এপাশ ওপাশ করছিলো।আর অন্যদিকে মেহুল ও নেই।সে অন্যঘরে ঘুমায়।কত করে বললো তার ঘরে থাকতে,কিন্তু সে থাকবে না মানে থাকবেই না।

ঘড়িতে ১২.০৫ বাজে।গ্রামে অনেক আগেই মানুষ ঘুমে ঢলে পড়ে।নিশ্চয়ই মেহুল আর মন্টু ঘুমিয়ে পড়েছে।
আস্তে আস্তে উঠে বসে সাবধানে দরজা খুললো স্বর্ণলতা।
পা টিপেটিপে আগাতে লাগলো।
যেই না ডানপাশে মোড় নিবে অমনি-ই গম্ভীর কন্ঠে কেউ একজন বিরক্ত নিয়ে বললো-
—”কইছিলাম না আপনারে যাওয়া নিষেধ!”
স্বর্ণলতা স্ট্যাচু হয়ে দাড়িয়ে রইলো।দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো।
আর মনে মনে বলতে লাগলো,
—” ভেবেছিলাম এ বাড়িতে আমার রাজত্ব চলবে।কিন্তু এখন দেখছি এ তো দ্বিতীয় মামা”।

চলবে……………
✍️Sharmin Sumi-শারমিন সুমি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here