#স্বর্ণলতা
পর্বঃ২৪
_____________
একটা অন্ধকার ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করলো স্বর্ণলতা।
এখন ঠিক রাত না দিন কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা।হাত টা ভীষন যন্ত্রণা করছে।চামড়া উঠে গেছে সম্ভবত।
মাথার পেছন সাইডটাও ব্যাথায় টনটন করছে।
পুরো ঘর জুড়ে বোটকা গন্ধ ভেসে আসছে।বমি করে দেবার উপক্রম তার।
এ পাশ ও পাশ ঘুরে খাটের সাইড দিয়ে এক দলা থুথু ফেললো।
বোটকা গন্ধে টিকতে না পেরে শাড়ির আঁচলটা মুখে চেপে ধরলো।
আস্তে আস্তে উঠে বসার চেষ্টা করলো।
নাহ্,উঠার শক্তিটুকুও স্বর্ণলতা পাচ্ছেনা।হাত, পা, কপালে চামড়া ছিলে গেছে।তার শুধু এতোটুকু মনে আছে সে চারপাশে শুধু আগুন দেখছিলো।এরপর তার আর কিছু মনে নেই।
মিনিট দশেক এভাবেই শুয়ে থাকলো স্বর্ণলতা।এখন আর মাথা খাটাতে ইচ্ছে করছে না।বেঁচে আছে এই তো অনেক।পূর্বের পরিস্থতিতে কিছুক্ষণের জন্য মনে হচ্ছিলো সে মারা যাচ্ছে।
আগুন থেকে বের হয়ে আসবে আযরাইল।তার দেহ থেকে আত্মা আলাদা করে ফেলবে।তার শুধু একটা কথা মনে হচ্ছিলো সে মারা গেলে তার বাচ্চাও তার পেটেই মারা যাবে।যে বাচ্চাকে নিয়ে এতো ভয়,এতো শঙ্কা ছিলো সে এখন তার কোলে।তারা মেঘের রাজ্যে ভাসছে।আর স্বর্ণলতা তার আদরের জাদুমনি কে কোলে নিয়ে গান গাইছে।শান্তি আর শান্তি।আর কোন দুশ্চিন্তা নেই।
নাহ্ অনেক হলো,আর জোর করে শুয়ে থাকা যাচ্ছেনা।কোথায় আছে সে!সে কি এখানে একা নাকি আরও কেউ আছে!
শরীর ওপর জোর খাটিয়ে স্বর্ণলতা উঠে বসলো।পিপাসায় গলা বসে গেছে।একটু ডাক দেবার ও শক্তি নেই।
আস্তে আস্তে মেঝেতে পা ফেললো।পা ফেলতেই আকস্মিক ঠান্ডা অনুভব করলো।পা দিয়েই বুঝতে পারলো এটা টাইলসের ঠান্ডা।ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিক।এখন ঠান্ডা পড়ছে।
আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে হাতরাতে লাগলো দরজা খুঁজতে লাগলো।হাতরাতে হাতরাতে দরজার দেখা মিললো।একটানে দরজা খুলে ফেলল।আর এক ঝাঁক সূর্যের আলো তার চোখে মুখে ঝাপিয়ে পড়লো।এক হাতে চোখ বন্ধ করে পিটপিট করে তাকালো।
এবার স্পষ্ট দেখতে পেলো,তার হাতের বেশ কিছু অংশ পুড়ে গিয়েছে।লাল চামড়া বের হয়ে গেছে।শা শা করে বাতাস ঢুকছে ক্ষতস্থানে।
আহ্ দারুন যন্ত্রনা হচ্ছে।
আশেপাশে শুধু গাছ আর গাছ।মনে হচ্ছে এটা বাগান বাড়ি।কিন্তু আশেপাশে কাউকেই দেখা যাচ্ছেনা।এদিক ওদিক তাকিয়ে দরজা থেকে বের হলো।পুরো বাড়ি নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত দেখে নিলো।
ডুপ্লেক্স বাড়ির মতো হলেও পুরোপুরি ডুপ্লেক্স না।চারপাশ উন্মুক্ত। সবুজ ঘাস আর ঘাস ফুলের সমারোহ।মাটিতে পা রাখতেই শীতে সর্বাঙ্গ কেঁপে কেঁপে উঠলো।
অনেকটা শক্তি সন্ঞ্চার করে বললো-
—“কেউ আছেন?এটা কোথায়?”
কোন সাড়াশব্দ পেলো না।আরেকটু দূরে গিয়ে আবার ডাকলো-
—”কেউ আছেন?”
পিছন থেকে কোমল সুরে একটা ডাক ভেসে আসলো-
—”আপামনি!”
এ কার কন্ঠ?চিরচেনা কন্ঠে উদ্বেগ হয়ে স্বর্নলতা পেছনে তাকালো।
পেছনে ঘুরে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো।আর করুন সুরে বললো,
—”মেহুল!”
—” হ আপামনি,আমি মেহুল”।
দৌড়ে গিয়ে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিলো স্বর্ণলতা।
মেহুলকে বুকে জড়িয়ে অজানা এক প্রশান্তি খুঁজে পায় স্বর্ণলতা।তার শরীরের ব্যাথা,তার মনের ব্যাথা সব এক নিমিষেই ভুলে যায়।তার আহত হৃদয়ের মাঝখানে মেহুলকে জড়িয়ে রাখে।মেহুল যেনো তার আহত হৃদয়ের ক্ষত সারিয়ে দেওয়ার এক মহাঔষধ।
কান্না ভেজা কন্ঠে মেহুলের গাল ধরে জিজ্ঞেস করলো-
—”কোথায় ছিলে এতোদিন?”
মেহুলের উত্তরের অপেক্ষা না করে পুনরায় মেহুলকে জড়িয়ে ধরলো।প্রান টা জুড়িয়ে যাচ্ছে।
মেহুল ভাঙা কন্ঠে স্বর্ণলতা কে বললো-
—”কাইন্দেন না আপামনি!আপনে কানলে আমারও ভিতরটা ফাইট্টা চৌচির হইয়া যায়।”
—”কোথায় চলে গিয়েছিলে আমাকে ছেড়ে?কত খুঁজেছি তোমাকে জানো?কত যুদ্ধ করেছি তোমার জন্য।”
—”আপামনি দোহাই আপনার আমারে কিছু জিগাইয়েন না।আমি কইতে পারমু না।আমি অহন আপনার কাছে আছি।আর দূরে যাইবার চাইনা।”
—”মেহুল,তোমার চিন্তায় আমি রাতে ঘুমাতে পারিনি।কত কষ্টে রাত কেটেছে দিন কেটেছে।একটা চিন্তা আমাকে ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছে,তোমার কিছু হয়ে গেলো নাতো!আমি তোমাকে আগলে রাখতে গিয়ে তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি।ভেতর থেকে মরে যাচ্ছিলাম মেহুল।”
—” আমি অহন আছি আপামনি।কাইন্দেন না।”
স্বর্ণলতা আবেগ কন্ট্রোল করে দু চোখ মুছে নিলো।আর গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
—”এটা কোথায় মেহুল?তুমি এখানে এলে কিভাবে?আর আমি ই বা এখানে এলাম কিভাবে?”
—”এইডা একটা গ্রাম।গ্রামের নাম বক্সিগন্জ।এইটা একটা বাগান বাড়ি।এই বাড়ি একদম জমির মাঝখানে।দূর দূর কারও ভিটা মাটি নাই।
আপনারে এইখানে আনছে মামা।আপনারে নীরব ভাই নাকি মারবার গেছিলো।
আগুন ধরাইয়া দিছিলো।আপনারে লুকাইয়া হেরা এইহানে আনছে।ক্যামনে আনছে আমি জানিনা।আর আমি ক্যামনে আইলাম এইডা আমারে জিজ্ঞেস কইরেন না।”
স্বর্ণলতা কপাল ভাজ করে আবার ও জিজ্ঞেস করলো-
—”এ বাড়িতে কে কে আছে?মামা,আম্মা কোথায়? এখানে কি তুমি একা থাকো?
—”তারা শহরে।”
—”শহরে কেনো?”
—”হেইডা জানিনা।খালি জানি আপনারে লুকাইয়া রাখতে হইবো।নীরব যাতে আপনারে না পায় তাই এই ব্যবস্থা।”
—”এই বাড়ি কার?”
—”জানিনা আপামনি এই বাড়ি কার।এইহানে আমরা তিনজন অহন।”
—”আরেকজন কে?”
—”মন্টু।এ বাড়ির দেখাশোনা করে।ওর বুড়া একটা মা আছে।তয় হে এনে থাকেনা।বহুদূরে তাগো বাড়ি।মন্টুরে প্রতিদিন দুপুরে খাওন দিয়া যায়।দুইদিন হইলো আহেনা।”
—”কেনো আসেনা?”
—”আমি অহন রান্দি তাই আহেনা।”
স্বর্ণলতা পুরো বাড়ি ঘুরে দেখতে লাগলো।এতো বড় বাড়ি।চারপাশে এতো বাগান।
স্বর্ণলতা মেইন গেইট দিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য গেইট এ হাত বাড়াতেই পুরুষয়ালি কন্ঠে ভেসে আসলো-
—”গেইট খোলা নিষেধ।আপনি ঘরে গিয়া বসেন বুবুজান।”
স্বর্ণলতা ভ্রু কুঁচকে বললো-
—”তুমি বুঝি মন্টু?”
—”হ আমি ই মন্টু”।
—”বাইরে গেলে কি হবে?”
—”খুন খারাবি হইবো”।
—”মানে?”
—”জাফর চাচা আমারে মাইরা ফেলবো।”
স্বর্নলতা গেইট না খুলে মন্টুর দিকে আসলো।আর তাকে জিজ্ঞেস করলো-
—”কতদিন ধরে কাজ করো এখানে?”
—”ছুডু বেলা থিকা।আমার কাম বাড়ির দেখাশোনা।”
—”বয়স কত তোমার?”
—”জানিনা,মা কইছে ২১ কি ২২ হইবো।আপনে ঘরে যান আমার মেলা কাম আছে।পিছনের ঝোপঝাড় সাফ করতে হইবো।”
স্বর্ণলতার উত্তরের অপেক্ষা না করেই মন্টু দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো।
মেহুল স্বর্ণলতাকে বললো,
—”আপামনি ঘরে আহেন।আপনার হাতে পায়ে মলম লাগাইয়া দেই।বাইরে বাতাস।এনে থাকলে আপনার শরীর খারাপ করবো।”
স্বর্ণলতা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো-
—“চলো”।
চলবে………..
✍️Sharmin Sumi-শারমিন সুমি।