স্বর্ণলতা part 13+14

0
494

#স্বর্ণলতা
পর্বঃ১৩
___________
স্বর্ণলতার হাত ধরে রূপক তার ঘরের দিকে নিয়ে এলো।এবং সে দেখালো মামা অনেকক্ষন যাবৎ তার পাশে শুয়ে আছে।রূপক ঘুমায়নি তাই মামা কেও সে উঠতে দেখেনি।

—“আমাকে সত্যি টা বলো স্বর্ণলতা। এতো রাতে কোথায় গিয়েছিলে?”

—“আমাকে বিশ্বাস করুন।আমি ওদের পিছু নিয়েছিলাম।হঠাৎ করে সব গায়েব।এটা প্রথমবার না আমি এর আগেও ওদের পিছু নিয়েছিলাম।তখন নীরব,আম্মা এবং আমার মা ছিলো।আমি বড় মাঠ পর্যন্ত গিয়েছিলাম।আর ওদের পিছু নেওয়ার জন্যই আমার পায়ে বরই কাটা বেঁধে।আপনাকে কেউ কিছু বলেনি এই বিষয়ে আমি জানি সেটা।”

—“মামা আমাকে বলেছিলো তোমার পায়ে কাটা বিঁধেছে। আর সেটা তোমার এদিক ওদিক যাওয়ার কারনেই।”

—“ওদের পিছু নিতে গিয়ে হয়েছে।আর আমার ফোন টাও চুরি হয়নি।ছাঁদ থেকে পড়ে গিয়েছে।আপনি যেদিন কানাডা চলে গেলেন ঐ দিন-ই আমি মা এর রুম থেকে ধোঁয়া আসতে দেখি।আমি ঘাবড়ে যাই।কিন্তু মামা কিছু হয়নি বলে দরজা লাগিয়ে দেয়।আর সেদিন আমি ছাঁদে যাই।আমি দেখার জন্য যাই বাড়ির আশেপাশের অবস্থান।কারন আমার মনে হচ্ছিলো যে এ বাড়িতে কোন গন্ডগোল আছে।জানেন আমি নিচে ঝোপঝাড়ের ভেতর কিছু একটার আওয়াজ পাই।আমি নিচে ফ্ল্যাশ ধরে দেখতে যাই।আর অমনি মামার ধমকের সূরে ডাকে আমি আতঙ্কিত হয়ে যাই।আর ফোন নিচে পড়ে যায়।মামা আমাকে মিথ্যা বলতে বলে যে ফোন চুরি হয়ে গেছে।

—“স্বর্ণলতা ঘরে গিয়ে ঘুমাও।তুমি খুব হাঁপাচ্ছো।ঘেমে গেছো একদম।বাচ্চার সমস্যা যাতে না হয়”।

—“আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করেছেন না”?

—“স্বর্ণলতা তোমাকে সবসময় বিশ্বাস করি।কিন্তু এখন তুমি খুব ক্লান্ত।অনেক পথ দৌড়ে এসেছো।আবার পাঁচ মাসের প্রেগনেন্ট তুমি।বাচ্চার কথা টা একটু চিন্তা করবে তো!”

স্বর্ণলতার ঘামে ভেজা মুখ আরও ঘাম দিয়ে পরিপূর্ন হয়ে গেলো।চোখ গুলো ক্রমশ ঘোলা হতে লাগলো।সে ঠিক বুঝতে পারছে না,সবচেয়ে বিশস্ত মানুষ টি কি তাকে অবিশ্বাস করছে?নাকি তার ভালোর জন্য সে তাকে চলে যেতে বলছে!সবকিছু আবছা আবছা।
কবে এই আবছা কাটিয়ে রহস্যের জাল সে ভেদ করতে পারবে।
স্বর্নলতা কথা বাড়ালো না।আসলেই তার শরীরটা ভীষন খারাপ লাগছে।এতো দৌড়ঝাপ,টেনশন তার সন্তানের জন্য ক্ষতিকর।
যতটা ক্লান্তি তাকে গ্রাস করেছিলো,ততটা ঘুম থাকে গ্রাস করতে পারলো না।
এপাশ ওপাশ করতে করতে রাত এর অন্ধকার ঠেলে ভোরের সূর্য উঠলো।

ভোর হয়ে গিয়েছে।বাইরে কিচিরমিচির পাখির আওয়াজ।
স্বর্ণলতা আস্তে আস্তে উঠে বসলো।জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরালো।জানালা ভেদ করে রোদের আলো স্বর্ণলতার চোখে মুখে ঝাপিয়ে পড়লো।গায়ে হাত দিয়ে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা অনুভব করলো।জ্বর এসেছে তার।আর আসাটাই স্বাভাবিক। ক্ষত পা নিয়ে কাল অনেক ধকল গিয়েছে।পা টা তে ভীষন যন্ত্রনা হচ্ছে।ডক্টর আজকে আসলে আবার ড্রেসিং করাতে হবে।বিরক্তিকর সবকিছু।
মেহুল এখনো ঘুমাচ্ছে।দরজা খুলে স্বর্ণলতা বাইরে গেলো।বেসিং এ গিয়ে চোখে মুখ পানি ছিটালো।
আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো।এতো ধকল,অসুস্থতাও তার সৌন্দর্য কে বিলীন করতে পারেনি। সৃষ্টিকর্তা এই একটা জিনিস ই তাকে দু হাত ভরে দিয়েছে।তা হলো সৌন্দর্য।

রূপক আড়মোড়া হয়ে ঘর থেকে বের হতেই স্বর্ণলতাকে দেখতে পেলো।
—“স্বর্ণলতা ঘুম কেমন হয়েছে?”

—“ভালো হয়েছে।”

—“কালকের ঘটনা ভুলে যাও।”

—“দাড়ান! কোথায় যাচ্ছেন?কালকের ঘটনা ভুলে যাবো মানে?”

—“আমাকে কোনো প্রশ্ন করোনা”

—“কেনো প্রশ্ন করবো না?কি চলছে এই বাড়িতে?”

—“বাড়ি ঠিক আছে।তোমার কি চলছে?”

—“আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেন না?”

—“নিজের চোখকে অবিশ্বাস করবো কিভাবে?মামা কালকে আমার সাথে ছিলো।আর তুমি বলছো পিছু নিয়েছো?”

—“মিথ্যা বলিনি আমি”।

—“স্বর্ণলতা শোনো।তুমি অনেক বেশি টেনশন নিয়ে ফেলছো।ওভার থিংকিং করে ফেলছো সবকিছু। তাই তোমার এমনটা হচ্ছে।তুমি টেনশন করা কমাও।আর কিছু না হোক বাচ্চার কথা তো ভাবো!”

স্বর্ণলতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে ঘরে চলে গেলো।স্বর্ণলতার দুই চোখ নোনা জলে ভিজে উঠলো।চোখ মুছে শুয়ে পড়লো বিছানাতে।আর উঠবে না।যাতে এখানেই মরে যায়।নিজেই নিজের মৃত্যু কামনা করছে।

সকাল -৯ টা।
স্বর্ণলতা কারও হাতে স্পর্শে সজাগ হলো।কপালে হাত দিয়ে এতো জ্বর দেখে রূপকের কপালে ভাজ পড়লো।
—“এতো জ্বর বাঁধালে কখন?ঔষধ খাওনি?তুমি কি আমাকে একটুও স্বস্তি দিবেনা?”

—“আমি মরে গেলে খুশি হবে সবাই”।

স্বর্নলতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রূপক বললো-
—“তাহলে আমাকেও নিয়ে চলো।আমিও যাবো তোমার সাথে।আমার কোন কথায় কষ্ট পেওনা স্বর্ণ।তোমাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি।তোমার জন্য খুব চিন্তা হয়”।

ভ্রু কুঁচকে স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করলো-
—“কালকে রাতের কোন কথাই বিশ্বাস করেন নি!”

—“বাদ দাও না কালকের কথা।আজকে তোমাকে নতুন করে বুঝতে চাই।আমি এক্ষুনি ডক্টর কে আসতে বলছি।এমনি তো ড্রেসিং করতে আসতোই।”

অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলো স্বর্ণলতাকে।স্বর্ণলতার উত্তাপে তার শরীর ও গরম হয়ে উঠেছে।স্বর্ণলতার ভীষণ জ্বর হয়েছে।তাকে দ্রুত খাবার খাইয়ে ঔষধ খাওয়াতে হবে।

ড্রেসিং শেষ,জ্বরের ঔষধ ও খাওয়ানো শেষ।স্বর্ণলতা শুধু ঘুমাচ্ছে আর ঘুমাচ্ছে।তার পাশে রূপক শুয়ে আছে।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো।স্বর্ণলতার ঘুম ভাঙলো।
পাশে রূপককে দেখে আনন্দিত হলো।রূপক মুচকি হেসে বললো-
—“ঘুরতে যাবে?তোমাকে কিছুদিনের জন্য ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।”

—“আমি যাবো ঘুরতে।তার আগে আমার পা একটু ঠিক হোক।আর মা কে বলুন।উনি কি রাজী হবেন কিনা।”

—“না করবে কেনো?আমার বউকে নিয়ে আমি ঘুরতে যাবো”।

—“সবাই কি বাসায় আছে?”

—“হুম বাসায় আছে।আজকে স্নেহা আপু আসতে পারে রাতে।বাচ্চা পেটে আসার পর এ বাড়ির পথ তো মাড়ায়-ই নি।কিযে হয়েছে কে জানে!”

—“আপনি শুয়ে থাকুন আমি একটু উঠবো।শরীরটা ভালো লাগছে এখন”।

—“আচ্ছা যাও।সাবধানে যাও”।

স্বর্ণলতা বাইরে গেলো।মেহুল রান্না ঘরে সবজি কাটছে।ফ্রিজ থেকে মাল্টা বের করে স্বর্ণলতা কাটতে লাগলো।

—“আপামনি! কি করবেন?খাইবেন?দেন আমি কাইটা দেই।আপনার শরীর ভালা না।”

—“না এমনি তোমার অনেক কাজ।আর আমার শরীর এখন ভালো লাগছে।”

—“না না আপামনি।আপনারে কাজ করতে দেওন যাইবো না।”

এই বলেই মেহুল স্বর্ণলতার হাত থেকে জোর করেই মাল্টা নিয়ে কাটা শুরু করলো-
ড্রয়ই রুমে কারও একটা ফোন বেজে উঠলো।পাশের রুম থেকে স্বর্ণলতার সৎ মা আওয়াজ করে বলল-
—“মেহুল ফোন টা দিয়ে যা তো।হয়তো নীরব কল করেছে।বাইরে গিয়েছে আমার জন্য খেজুর আনতে।পেলো কি না কে জানে!”

মেহুল ফোন আনতে যাবে তার আগে স্বর্ণলতা বললো-
—“তোমাকে কষ্ট করতে হবেনা।আমি গিয়ে দিয়ে আসছি।”

ফোনটা হাতে নিয়ে ফোনের স্কিনে চোখ বুলাতেই নাম্বার ভেসে উঠলো।নাম্বার টা তার খুব পরিচিত।সে কোথায় যেনো দেখেছে নাম্বার টা!
ভ্রু কুঁচকে নাম্বার টার দিকে ভালো করে তাকালো।
ওহ্ এই সেই নাম্বার! যে নাম্বার থেকে রূপকের ফোনে মেসেজ এসেছিলো।নাম্বার টা অর্ধেক সে তুলে রেখেছিলো।এই নাম্বার থেকে তার মায়ের ফোনে কে কল দিবে!
নাম্বার টা রিসিভ করলো স্বর্ণলতা-

—“মা ঐ নাম্বারে টাকা নেই।তাই এটা দিয়ে দিলাম।খুব এমার্জেন্সি ছিলো তাই।
হ্যালো?মা? কথা কি শুনতে পাচ্ছো?”

স্বর্ণলতা বুঝতে পারলো এটা নীরবের কন্ঠস্বর।মনে মনে বলতে লাগলো-
—“নীরব!! এ তো নীরবের কন্ঠ!তাহলে নীরব রূপককে মেসেজ দিতো!।
কেনো দিতো ও মেসেজ!”
স্বর্ণলতার মনে মনে হাজারো প্রশ্নেরা পসরা সাজাতে লাগলো।

চলবে………
?️Sharmin Sumi

#স্বর্ণলতা
পর্বঃ১৪
__________
–“নীরব এতোদিন রূপককে এসব মেসেজ দিতো কিন্তু কেনো?”
স্বর্ণলতার কৌতুহলী মন নিঃশব্দে কথাটি বলে উঠলো।

স্বর্ণলতা খুব ঠান্ডা মেজাজের এবং ভীতু টাইপের মেয়ে। কিন্তু এই কয়েকদিনে তাকে যেভাবে লড়তে হয়েছে এতে সে পরিস্থিতি বুঝে অনেক কিছু করতে শিখে গিয়েছে।আর আজকে তার সহ্যের সব সীমা অতিক্রম হয়ে গিয়েছে।ছোট থেকে বড় হয়েছে অবহেলায়।চরম মানসিক,শারীরিক অত্যাচার সহ্য করেছে সে।সে সুন্দর সেটার জন্য ও তার মা তাকে মারতো।কেনো মানুষ তাকে সুন্দর বলে।আজ সৃষ্টিকর্তা তাকে ভালো বর এবং ঘর দিয়েছিলো।সেখানেও তাদের সহ্য হবেনা!তাকে ঘরছাড়া করতেই হবে!
এবার সহ্য করা যাবেনা আর।পায়ের মাটি শক্ত করতে হলে তাকে প্রতিবাদ করতে হবে।আর তার স্বামীর সাথে মনোমালিন্য সৃষ্টি করে সংসার ভাঙার পরিকল্পনা করার জন্য সে তো কাউকেই ছাড় দিবে না।

সে রূপকের রুমে গেলো।তার টুকে রাখা মেসেজের নাম্বার টি চেক করতে লাগলো।যতটুকু লিখে রেখেছিলো ততটুকু তে পুরোপুরি নম্বর মিলে গেলো।অর্ধেক নাম্বার মিল।এখন রূপক আর নীরবের মেসেজ চেক করাই বাকী।চেক না করে সে কোন কিছু করবে না। নীরবের আবার ফোন বেজে উঠলো।সে দ্রুত মেহুলের হাত দিয়ে তার মা-এর কাছে ফোন পাঠিয়ে দিলো।
তার শুধু নিশ্চিত হওয়া বাকী।সে মাল্টা খেলোনা আর।তার খুব অস্বস্তি লাগছে।
বিছানায় গিয়ে রূপকের পাশে শুয়ে আছে।রূপক ঘুমাচ্ছে।
পাশে থাকা রূপকের ফোনটি হাতে নিলো।সেখান থেকে এই মেসেজ গুলো চেক করবে।নাম্বার পুরোপুরি মিললে আরেকটু নিশ্চিত হবে।যেহেতু অর্ধেক নাম্বার সেহেতু যেকোন কিছু হতে পারে।মানুষের মাত্র ১ টা নম্বর ভুলের জন্য রং নাম্বারে ফোন চলে যায়।আর সেখানে পুরো ৫ টি নাম্বার।গুনে গুনে পা ফেলতে হবে।তা না হলে হোচট খাওয়ার সম্ভবনা বেশি।

মেহুলকে হাজার বার বারণ করা সত্বেও মাল্টা ঠিকি-ই কেটে নিয়ে এসেছে। এই মেয়েটা তার আপন মায়ের অবতার।এতো ভালোবাসে তাকে!
—“মেহুল তোমাকে বলেছিলাম না মাল্টা কেটে না দিতে?”

—“আমি নিজের চোক্ষে দেখলাম আপনে খাওয়ার লিগা কাটতাছেন।অহন কন খাইবেন না!আমার মন তো মানে না আপা।লন খাইয়া লন রাগ কইরেন না।জ্বর শরীরে ভালা লাগবো।”

এই মেহুল আর রূপকের জোর জবরদস্তি স্বর্ণলতা ফেলতে পারেনা।অনিচ্ছাসত্বেও মাল্টাগুলো বিনাবাক্যে খেয়ে নিলো।
মেহুল ঘর থেকে চলে গেলো।ওর অনেক কাজ বাকী।এই সুযোগে স্বর্ণলতা রূপকের ফোন টা হাতে নিলো।টুকে রাখা নাম্বার পাশেই আছে।শুধু মেসেজ বের করে মিলিয়ে দেখবে।ফোনে মেসেজ খুঁজতে লাগলো।৫-৬ মাস আগের মেসেজ এতো সহজে কি পাওয়া যায়!

কিন্তু একি!সারা ফোন তন্নতন্ন করেও কোন প্রকার মেসেজ পেলোনা স্বর্ণলতা।তার অবাক লাগছে।মেসেজগুলো যাবে কোথায়!তখনি তার মনে পড়লো।রূপকতো বরাবরই মেসেজ এর বিষয় গুলো এড়িয়ে চলতো।সে পাত্তা দিতোনা।সে চাইতো স্বর্ণলতা যেনো এসব কোনভাবেই না জানে।তাই হয়তো সে ডিলিট করে দিয়েছে।এখানে খুঁজে তার কোন লাভ হবেনা।একমাত্র নীরবের ফোনেই পুরো ব্যাপারটা খোলাসা হবে।নীরব মেসেজ সেন্ড করে থাকলে তার ফোনে থাকবে।যদি সে মেসেজ গুলো ডিলিট করে দেয়!!!নাহ্ ডিলিট করে দিলে তো আর পাওয়ার সম্ভবনা নেই।
তার মাথা ধরে যাচ্ছে।জ্বরটা ভীষণ বাড়ছে।তার এতো কেনো প্রেসার!এতো কেনো চাপ!প্রেগনেন্সি মেয়েদের জন্য আর্শিবাদ আর তার জন্য হয়েছে যুদ্ধ। টিকে থাকার যুদ্ধ। দিনদিন রূপকের পরিবর্তন তার চোখ এড়িয়ে যায়না।
তার চোখে মুখে অবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট।
তার ঐ চাহনি তার বুকটা ছেদ করে ফেলে।বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠে।কিন্তু দিব্যি হাসি মুখে থাকে।যন্ত্রণা এমন এক বস্তু যেটা প্রকাশ না করতে পারলে যন্ত্রণার পরিমান দ্বিগুন রূপ ধারন করে।

আকাশ সমান চিন্তা নিয়ে দরজায় চোখ যেতেই লক্ষ্য করলো তার শ্বাশুড়ি ঘোরাঘোরি করছে।এটা নতুন না।যবে থেকে রূপক এসেছে তবে থেকেই তাদের একসাথে দেখলেই তিনি চোখে চোখে রাখে।কেনো এমন করে তার উত্তর শুধুমাত্র তিনি-ই ভালো জানেন।

—“আম্মা!কিছু বলবেন?”
স্বর্ণলতার ডাকে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো রূপকের মা।

—”না কিছুনা।রূপক কি ঘুমায়?”

—“জ্বী ঘুমাচ্ছে”।
—“তুমি এখানে কি করো তাহলে?বাইরে যাও।গল্প করো।হাঁটাহাটি করো।সারাদিন ঘরে বসে থাকো কেনো?যাও বাইরে গিয়ে জাফরের সাথে গল্প করো যাও”।

—“আম্মা আমার শরীর টা খুব খারাপ লাগছে তো।জ্বর এসেছে।এইজন্য রেস্ট নিচ্ছি।আপনি বসুন কিচ্ছুক্ষণ আমাদের ঘরে”।

রূপকের মায়ের চোখ চকচক করে উঠলো।এমন কোন প্রস্তাবের জন্য হয়তো তিনি অপেক্ষা করছিলেন।
কথা না বলে সোজাসুজি বেতের চেয়ারে বসে পড়লো।

মেহুল রান্নাঘরে রান্না করছে।ওর মূখ্য দায়িত্ব স্বর্ণলতাকে দেখা হলেও এখন তা বেড়ে হয়ে গিয়েছে পুরো বাড়ি দেখা।কাজের দিক থেকে প্রমোশন হলেও বেতন সেই আগের জায়গাতেই আটকে আছে।স্বর্ণলতা সুস্থ থাকলে মেহুল কে এটা ওটায় সাহায্য করে।বাচ্চা মেয়ে এতো কাজ একা করতে পারে?এ বাড়িতে তার মা ভাই অনেকদিন হলো এসেছে।যাওয়ার নাম গন্ধ নেই।এদিকে রূপকের মায়ের মুখে কোন প্রকার বিরক্তি ভাব নেই।অন্য কোন শ্বশুরবাড়ি হলে হয়তো ছোটখাটো যুদ্ধ বেঁধে যেতো।অথবা রসিয়ে রসিয়ে অপমান।সেদিক দিয়ে তার শ্বাশড়ি হয়তো বেশ ভালো।এসব চিন্তা করতে করতে পুরো দিন পার করে ফেললো স্বর্ণলতা।

রূপকের মা ঠিক ততক্ষণ-ই বসে ছিলো।যতক্ষণ রূপক ঘুমাচ্ছিলো।রূপক উঠা মাত্র তার মা জোর করেই তাকে রুম থেকে নিয়ে গেলো।তার ভাবসাব দেখা মনে হয় স্বর্ণলতাকে স্পর্শ করাও তার জন্য মহাপাপ।কিন্তু তার ছেলে তো লুকিয়ে চুড়িয়ে ছোঁয়ার বাহানা তেই থাকে।
একজন বিবাহিত ছেলেকে তার মা তার বউয়ের স্পর্শ থেকে দূরে রাখছে।বিষয়টা হাস্যকর।

মেহুল আসলো চা নিয়ে ।জ্বর আসাতে বেশ আদর যন্ত পাচ্ছে সে।কিন্তু তার মনে আছে বাড়িতে তার জ্বর আসলে কোন প্রকার ছাড় দেওয়া হতোনা।
একরাতের কথা-……
স্বর্ণলতার ঝাপিয়ে জ্বর এসেছিলো।তার বয়স তখন হবে ১৭ কি ১৮।নীরবের বয়স তখন ১৫।
টগবগে যুবক।তাকে জ্বলপট্টি দেওয়ার বাহানা করে অপ্রীতিকর অবস্থায় ফেলে দেয়।সেদিন স্বর্ণলতার সম্মান রক্ষার্থে কেউ এগিয়ে আসেনি।উল্টো জ্বরের মধ্যে প্রচন্ড মার খেয়েছে।নিজের বড় বোনকে কেউ এভাবে কু-প্রস্তাব দিতে পারে!সৎ বোন কি বোন না?সেদিন তার মা কড়া করে বলেছিলো-
এই রূপ দেখিয়ে আমার ছেলের মাথা ঘুরিয়েছিস।বাজারে নামিস।কিছু টাকা ইনকাম হবে।তোকে পড়াশোনা করাতে তো টাকা খরচ হচ্ছেই!
অঝোরে কেঁদেছিলো স্বর্ণলতা সেদিন।
আকাশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে বিচার দিয়েছিলো এ পাপের শাস্তি যেনো হয়।তার অভিযোগ ও ছিলো সৃষ্টিকর্তার কাছে।কেনো এতো রূপ তার!

আজকে এ নোংরা স্মৃতি গুলো বারবার ভেসে উঠছে।কারন সে নীরব এর ওপর ক্ষিপ্ত।ঘৃনায় তার বমি আসছে।সে অনেক অন্যায় করেছে স্বর্ণলতার সাথে।আর সবচেয়ে বড় অন্যায় বিয়ের পর করেছে।তার করা অন্যায় গুলো প্রমানিত হলে শাস্তি স্বর্ণলতা নিজের হাতে দিবে।

—“আপামনি!আপনে সারাক্ষণ কি চিন্তা করেন?”

মেহুলের ডাকে স্বর্ণলতার ভাবনার অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো।একটু চুপ থেকে বললো-
—“আমার কত শত চিন্তা!তুমি বুঝবেনা মেহুল।”

—“আপনারে বড় বইন এর মতো দেহি।আপনারে খুব ভালোবাসি আমি”।

—“আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি”।

অপর রুম থেকে নীরবের চিৎকার।
—“মেহুল!মেহুল শুনে যা।”
মেহুল শুনেও না শোনার ভান করছে।
—“মেহুল তোমাকে ডাকছে তো! যাও শুনে আসো কি বলে!”

—“আমার ওনার ঘরে যাইতে ভালা লাগেনা”

—“কেনো!”

—“উনি ভালা মানুষ না”

ললাট ভাঁজ করে স্বর্ণলতার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো-
—“কেনো! হঠাৎ এ কথা বললে যে?”

মামা দরজার সামনে দাড়িয়ে কঠিন কন্ঠস্বর এ বললো-

—“তোর কি কানে যায়না কখন থেকে নীরব ডাকতাছে?এনে বইয়া কি করোস?যা জলদি”।

তড়িঘড়ি করে মেহুল উঠে গেলো।মামা স্বর্ণলতাকে দেখে বিদখুটে একটা হাসি দিয়ে বললো-
—“কি স্বর্ণ! শরীর কেমন?”।
মামা উত্তরের অপেক্ষা না করে সাইডে নিয়ে মেহুল কে শাসিয়ে দিলো।কি কি কথা হচ্ছে সেটা শুনতে পেলোনা স্বর্ণলতা।কিন্তু তাকে হয়তো কড়া নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে কিছু গোপন রাখার জন্য তা স্বর্ণলতার চোখ এড়ালো না।

প্রায় ১ ঘন্টা পর।স্বর্ণলতা রুম থেকে বের হলো।সবাই সবার কাজে ব্যস্ত।মামা,রূপক,রূপকের মা,স্বর্ণলতার মা,নীরব সবাই গল্প মজেছে।হয়তো তারা লুডু খেলছে।ওদিকে মেহুল কাজ করেই যাচ্ছে।তাদের নাস্তা,চা কতশত আবদার।রান্নাঘরে গেলো স্বর্ণলতা।
মেহুল কিছু বলতে যাবে এর আগেই স্বর্ণলতা বলে উঠলো
—“একদম চুপ! শরীর ভালো লাগছে তাই এসেছি।একা একা এতো কাজ করেও হাঁপাও না? কেউ সাহায্য করতে আসলেও করতে দাওনা।”

—“কথাটা পুরাপুরি ঠিক না আপামনি।কেউ সাহায্য করতে আইলে আমি কিছু কমুনা।কিন্তু সাহায্য তো খালি আপনে করতে আহেন।আর কেউ আহেনা।আর আমার তো আপনারে কাজ করতে দিতে ভালা লাগেনা।”

—“সবার কাজ করে দিতে ভালো লাগে?”

—“হ”।

—“আর নীরবের?”
নীরবের কথা শুনেই মেহুল তার নিজকর্ম খানিকক্ষন থামিয়ে দৃষ্টি শূণ্যে রাখলো।এরপর কয়েক সেকেন্ড পরই কাজে মনোযোগ দিয়ে স্বর্ণলতাকে জিজ্ঞেস করলো-

—“আপামনি জ্বর মাপছিলেন?”

—“আমার জ্বর চলে যাবে।তোমার জড়তা দূর করো।সেটা কোনদিনও যাবেনা।সেটার মেডিসিন একমাত্র তুমি”।

কথায় কান না দিয়ে আপন মনে কাজ করছে মেহুল।

—“মেহুল নীরব তোমার সাথে যা যা করে আমি দেখেছি”।

মেহুল কাজ করা থামিয়ে দিয়ে টলমলে চোখে স্বর্ণলতার দিকে তাকালো।

—“আপামনি সে আমার বুকে হাত দিছে আপনি সেটা কখন দেখলেন?”

স্বর্নলতা পাশে থাকা গ্লাসটা খামচে ধরলো।তার মন চাচ্ছে এখন নীরবের মাথা ফাটিয়ে দিতে।রাগান্বিত চোখ মুখ।
দাঁত কটমট করে বললো –
—“আর কি করেছে তোমার সাথে?”

—“মাঝে মধ্যে রাইতে আমারে দিয়া আপনারে ঘুমের ঔষধ খাওয়ায়।যাতে আপনে কিছু না বোঝেন।আমারে হে অত্যাচার করে।আমি মুখ দিয়া কইতে পারমু না।আমারে হে অপবিত্র কইরা ফেলছে।নিজের শরীরের প্রতি নিজের এখন ঘৃনা লাগে”।

স্বর্ণলতা রাগে আগুন হয়ে গেলো।যেইনা ঘুরে বের হতে যাবে অমনি মেহুল পা জড়িয়ে ধরলো।
—“আপামনি!আমারে মাইরা ফেইলেন না।মামা যদি জানে আমি আপনারে কইছি তাইলে আমারে জানে মাইরা ফেলবো।আমার আরও অনেক কিছু কওয়ার আছে আপনারে।আপনি কিছু কইয়েন না নীরব রে।আমি আর কোনদিন আপনারে ঔষধ দিমুনা।আমারে আপনি ঐ পিচাশের হাত থিকা বাচাইবেন।
স্বর্ণলতা মেহুল কে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

স্বর্ণলতা অসহায় দৃষ্টিতে মেহুলের দিকে তাকালো আর ভাবলো-
মেয়েরা এতো অসহায়!
এতিম মেয়েরা বোধহয় আরও বেশি অসহায়!
মেহুলের নীরব কান্নায় স্বর্ণলতার শাড়ি ভিজে যাচ্ছিলো।আর তার মনে হচ্ছিলো বুকের ভেতর কেউ হাতুড়ি পিটাচ্ছে।
দু গাল বেয়ে স্বর্নলতার আগুন অশ্রু ঝরে পড়লো।
এ পানির প্রত্যেকটা ফোঁটা যেনো চিৎকার করে বলছে “প্রতিশোধ,প্রতিশোধ,প্রতিশোধ।

চলবে……..
?️Sharmin Sumi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here