#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৪২
শ্রেয়াকে গাড়ি থেকে বের করে একটা বিশাল আকারের গেইট পেরিয়ে ঢুকে পড়লো তূর্য। চমৎকৃত নয়ন ফেলছে শ্রেয়া আশেপাশে। ঢের সুন্দর একটা বাড়ি। প্রাচুর্যে ভর্তি। সাদা রঙটা কেমন ঝিলিমিলি করছে। ছোটোখাটো একটা বাগান পেরিয়ে ওরা সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। কলিংবেল চাপতেই যে দরজা মেলল তাকে দেখেই চক্ষুদ্বয়ের আকার নিমিষেই বড় হয়ে আসে শ্রেয়ার। চকিতে তূর্যর দিকে তাকালো ও। তাকিয়ে রইল অনিমেষ। নেত্র পল্লব ফেলতে পর্যন্ত ভুলে বসলো। তূর্য ওকে বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিয়ে সামনের ভ্রুঁ কুঁচকে, কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে রাখা মেয়েটাকে প্রশ্ন করলো,
‘ কেমন আছেন আপু?আমাদের ঘরে ঢুকাবেন না?’
অহমিকার দরজার হাতল ধরে নিজেকে সামলে নেয়। চোখ জোড়া সংকুচিত হয়ে আসে তার। বিস্মিত কন্ঠস্বর, ‘ আপু?আপু কেন ডাকছো?আর তোমরা এখানে?’
শ্রেয়া নিজেও হতবাক। কথা বলার শক্তি হারিয়ে নির্বাক। তূর্য অধর কার্নিশে বাঁকা হাসি আঁকে। নিরলস হাবভাব তার। কন্ঠে গুরুতর ভাব এনে প্রতি উত্তর করে। বললো, ‘ খালা শাশুড়ির মেয়ে সম্পর্কে আমার বড় হলে আপু ডাকবো না?আর এটা তো ডাবল শশুর বাড়ি৷ মানে নানা ও খালা শাশুড়ির বাড়ি। টানে টানে ছুটে এলাম। ‘
‘কি?’
একই সঙ্গে দুটো ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কন্ঠনালি গলিয়ে অভিন্ন শব্দ বেড়িয়ে আসে। কর্ণে বেজে ওঠে তূর্যর। বিরক্ত মাখা স্বরে বলে উঠলো, ‘ পা ধরে গিয়েছে ভিতরে গিয়ে বসে বসে বলবো। ‘
ফের অহমিকার দিকে তাকিয়ে বলে,’ আপু প্লিজ সাইড। ‘
তাজ্জব হয়ে চেয়ে চেয়ে একপাশে চেপে গেল অহমিকা। তূর্য শ্রেয়ার হাত ধরে ড্রইং রমে এলো। শ্রেয়াকে সোফায় বসিয়ে বললো,’ এটা তোমার নানার বাড়ি ও খালার বাড়ি। দুটোই। বলতে পারো তোমার মা’য়ের বাড়িও। ‘
অহমিকা ও শ্রেয়ার উভয়ের পায়ের নিচ থেকে শক্তপোক্ত মেঝেটা যেন সরে গেল। তূর্য ওদের হতভম্ব দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়ে গাঢ় স্বরে বলে উঠলো,’ আপনার বাবা কোথায় অহমিকা আপু? আর নানু?’
তখনই রাশভারী গলায় কেউ ডেকে উঠলেন অহমিকা বলে। শ্রেয়া তাকিয়ে দেখে একজন বয়স্ক লোক। ওনাকে প্রিয়ু ও আয়ুশের বিয়েতে দেখেছিল সে। সম্পর্কে অহমিকার বাবা। ইনিই তাহলে ওর খালু?খালা কোথায়?তূর্য যে নানুর কথা বললো তার মানে নানুও আছেন। অহমিকার বাবা হাতের খবরের কাগজ টি টেবিলের উপর রেখে খানিক ঈষৎ ক্রোধমিশ্রিত গলায় তূর্যকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ তোমরা এখানে কি করছো?আমার মেয়েকে সবার সামনে অপমান করে শান্তি হয় নি তোমার?এখন বউ নিয়ে বাড়ি অবধি চলে আসলে?সেদিন কিছু বলি নি কারণ তুমি আগে থেকে বিবাহিত ছিলে। নাহলে আমার মেয়েকে তোমার পরিবার বিয়ের আশ্বাস দিয়ে অপমান করে এর একটা বিহিত আমি করেই ছাড়তাম। মেয়েটা দিন রাত এক করে সুস্থ করেছে তোমায়। তোমার মা তো তোমাকে এক রুমেই বন্দী বানিয়ে রেখেছিল। আমার মেয়ে মিনতি করে মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করায়। তোমার সব অত্যাচার সহ্য করেছে। সাইকোসিস ডিসঅর্ডারে ওকে কল্পনা করেই মানুষকে আ’ঘাত করতে,তাহলে সামনে পেয়ে কি করতে মনে নেই? কতবার আহত হয়ে বাড়ি ফিরেছে মেয়েটা। তবুও তোমার ট্রিটমেন্টে পিছুপা হয় নি সে। তোমার পাগলামি সইয়ে গিয়েই পাশে থেকেছে শুধুমাত্র নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে। সামান্য কৃতজ্ঞতাবোধ নেই তোমার।’
তূর্যর নাসারন্ধ্র দিয়ে সূক্ষ্ণ, তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। ঠোঁটে ফিচেল হাসি৷ অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে আওড়ালো,
‘ বসুন খালু। আপনার মেয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ বলেই কিছু বলি নি। আপনার মেয়ের অন্যায় টা ছোট ছিল না৷ কাউকে ভিতর থেকে দুমড়েমুচড়ে দেওয়া অনেক বড় অপ’রাধ। চিকিৎসার জন্য আমার মা যথেষ্ট পেমেন্ট করেছে। তাছাড়া আপনার মেয়ে আমার জীবনের সবথেকে বেশি প্রিয় একটা মানুষ দিয়েছে। ও ছেড়ে না গেলে কখনও আমার শ্রেয়সীকে পেতাম না আমি। সেটার জন্য সহস্র বার ধন্যবাদ বলতেও দ্বিধা নেই আমার। ‘
শ্রেয়া বিমুগ্ধ। অহমিকার মাথা নত হয়ে গেল। সে লন্ডনে থাকতেই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। আসলে কাউকে ঠকিয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত তার যন্ত্রণা পরখ করা যায় না যতক্ষণ না স্বয়ং ঠকে। আজ বুঝে ও জীবনে কি হারিয়েছে এবং তা নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই। মেহরিমার কথায় তূর্যকে পাওয়ার স্বার্থ টা জাগ্রত হলেও নিজের অপরাধবোধে তা এখন দমে গিয়েছে। সাইদ সাহেব ধমকে উঠলেন,
‘ তো এখন কেন এসেছো?’
‘ নানা,খালা শাশুড়ির বাড়িতে আসতে মানা আছে?’– পাল্টা প্রশ্ন তূর্যর।
সাইদ সাহেবের কপালে বলিরেখার ভাঁজ পড়লো। ভাঁজের সংখ্যা কতশত হবে গুণে নি শ্রেয়া। কন্ঠে প্রবল অস্থিরতা মেখে প্রশ্ন করলেন,’ মানে?’
‘ আপনার একজন শালী সাহেবা ছিল, ভুলে গেলেন?’
‘ না। বাবার জেদের জন্য মা ও অহমিকার আম্মু কখনও ওকে এ বাসায় ফিরিয়ে না কিংবা যোগাযোগ করতে পারে নি। কিন্তু ওনার মৃ’ত্যুর পর শিমুলকে অনেক খুঁজেছি আমরা। একবার শিমুল যোগাযোগ করে আমাদের সাথে সাহায্যের জন্য। বাবা কেমন করে সেটা জেনে যায়। অসহায় ছিলাম আমরা। কারণ বাবা কথা নিয়েছিলেন আড়ালেও যেন আমরা কেউ ওর সাহায্য না করি। পরে একটা সময় জানতে পারি স্বামীর হাতে ও খু’ন হয়েছে। স্বামীও বেঁচে নেই। আশেপাশে জিজ্ঞেস করে জানি ওর একটা মেয়েও আছে। আমি অনেক খুঁজি কিন্তু মেয়েটাকে পাই নি। তার জন্য ধরে নিই মেয়েটাও বেঁচে নেই। ‘
শেষোক্ত কথাটা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে ওনার। শ্রেয়ার চোখ ছলছল করে ওঠে। তূর্য ওর হাতের উপর হাত রেখে বললো,
‘ আমার বউই শাশুড়ি মা’র মেয়ে। আশেপাশের এতিম খানায় খোঁজ নিলেই পেয়ে যেতেন। এতকাল কষ্ট বড় হতে হতো না ওর। আপনাদের খোঁজায় গাফিলতি রয়ে গিয়েছিল। ‘
সাইদ সাহেবের কন্ঠ কেঁপে কেঁপে উঠলো। বললেন,’ ও শিমুলের মেয়ে?’
গম্ভীরভাবে প্রতুত্তর তূর্যর,’ হ্যাঁ। ‘
‘ তুমি কিভাবে জানলে?’
‘ খুব একটা বেগ পোহাতে হয় নি, শাশুড়ি মা’র বাবার নামটা কালেক্ট করতে। সেই নামের সূত্রপাত ধরেই জানলাম অহমিকা ও শ্রেয়সী একে অপরের খালাতো বোন। আমি চাইছিলাম শ্রেয়সীর নানুর বাড়ির খোঁজ নিতে। তারা মানুক আর না মানুক নিজ চোখে একবার নিজের আত্মীয় স্বজন দেখুক ও,চিনুক তাদের। নানু কোথায়?’
‘ বছর খানেক আগে স্ট্রোক করে অহমিকার মা মা’রা যাবার পর থেকেই তিনি অসুস্থ। পরিবারে তো আর কেউ নেই। আমিও একা মানুষ। তাই অহমিকা কে নিয়ে এখানেই থাকা। ওনি রুমে আছেন। পায়ের হাড্ডি ক্ষয়ে গিয়েছে তাই চলাফেরা করতে পারেন না। ‘
__________
ত্রিহা নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল। অজান্তেই দৃষ্টি মেহরিমার রুমের সামনে যেতেই দেখলো তোহাশ দরজায় আলগোছে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ নক করছে না,ডাকছে না। হয়ত দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে সে। মৃদু হাসলো ও। সবই সময়ের খেল। প্রকৃতি কাউকে ছাড় দেয় না। যেটা মানুষ অবজ্ঞা করে নিয়তি যেন টেনে হিঁচড়ে সেখানেই সুখের খোঁজে দাড় করিয়ে দেয়। কয়েক পল চেয়ে নিরবে প্রস্থান করলো। টের পেতে দিল না তোহাশকে। পাছে যদি সে লজ্জায় চলে যায়।
রহিমা পানের বাটা টা নিয়ে ফাতেমা চৌধুরীর সামনে রাখলো। গড়গড় করে বললো,’ আজকের পান টা অনেক ভালো কইরা বানামু আম্মা। ‘
ভ্রুঁ কুঁচকে দুই অধর ফাঁক করে চাপা গর্জন করে ফাতেমা,
‘ তুই কি বাকিদিন আমারে খারাপ বানাইয়া খাওয়াইতি?’
‘ আরে আম্মা। তা না। আজ তো খুশির দিন। বাঘিনী জালে ফাঁসছে। কত ভাব দেখাইয়া,মিছা প্যাঁচ লাগাইয়া তোহাশ বাবারে একলা কইরা কাইড়া নিছিল মনে নাই আপনার?’
ফাতেমা ভেংচি কাটলেন। থমথমে মুখে বললেন,
‘ তোহাশ কিতা বাচ্চা লো?হেতে ফিডার খায়?বললেই চইল্লা যাইব?বদ একটা। মায়ার মতো নিষ্পাপ মাইয়ার ঘরে কেমনে এই বদ হইল আমি বুঝি না। বউয়ের কথায় নাচে খালি। ভালা হইছে নুরু কথা শুনায় দিছে। আমার আত্মা ডা শান্তি পাইলো। আমি নুরুর মা। ও কোনোদিন আমারে কষ্ট না দিলেও আমি বুঝি সন্তান কষ্ট দিলে কেমন লাগে। দুনিয়াতে যদি কারো সাথে সবথেকে উত্তম ব্যবহার করা লাগে তা মায়ের লগে,তারপর বাপ। কষ্ট ছাড়া সৎ মায়ের আদর পাইয়া বড় হইছে এ কারণে কদর কিতা তা জানে না। এখন বুঝবো হারে হারে। তোহাশের চেহারায় আমি কষ্ট দেখছি। ‘
‘ আমিও দেখছি আম্মা। ‘– বিবশ কন্ঠে বললো রহিমা।
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)